নির্বাহী ক্ষমতার বিরুদ্ধে আদালতের চ্যালেঞ্জ
যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফেডারেল আপিল আদালত সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আগমন এবং সব ধরনের শরণার্থীর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন, তা স্থগিত রাখার পক্ষে দেওয়া নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের করা আপিলের শুনানি শেষে তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ যে রায় দিয়েছেন, তা ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য একটি রাজনৈতিক পরাজয়।
ট্রাম্প বলে আসছিলেন যে এই মামলায় তাঁর সরকার জয়ী হবে। কেননা জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং এ নিষেধাজ্ঞা আরোপের আইনগত অধিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর রয়েছে। ট্রাম্প গত ২৭ জানুয়ারি দেওয়া নির্বাহী আদেশে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, সুদান, ইরান ও সোমালিয়া থেকে যেকোনো ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর ৯০ দিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন এবং শরণার্থীদের গ্রহণের কর্মসূচি ১২০ দিনের জন্য স্থগিত করেন। কিন্তু ৩ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটলের মার্কিন ডিস্ট্রিক্ট আদালতের বিচারক জেমস রবার্ট এই নির্বাহী আদেশ স্থগিত করে দিলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসন আপিল করে। ওয়াশিংটন ও মিনেসোটা এই দুটি অঙ্গরাজ্য এই আদেশের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল। বোস্টনের একজন ফেডারেল বিচারক অবশ্য প্রশাসনের পক্ষে ২১ পৃষ্ঠার একটি আদেশ দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন সিয়াটলের আদালতের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চাইলে আপিল আদালত তা নাকচ করে উভয় পক্ষের যুক্তি শোনার সিদ্ধান্ত নেন। সেই প্রেক্ষাপটে উভয় পক্ষের যুক্তি শোনার পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই রায় দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্টের দেওয়া আদেশের পর এর বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে বিক্ষোভ এবং এই আদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনার অভাবে দেশের বিমানবন্দরগুলোতে তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হেনস্তার শিকার হয় বহু মানুষ। এই পদক্ষেপের আইনি ও নৈতিক দিক নিয়ে সারা দেশেই প্রশ্ন ওঠে; সমালোচনা, প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভের মুখে তা ৩ ফেব্রুয়ারির পর সাময়িকভাবে হলেও স্থগিত হয়।
গত ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্প প্রশাসন যেসব বাধার মুখে পড়েছে, আদালতের এই রায় হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের। আদালতের এই রায়কে বলা হচ্ছে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা ব্যবহারে প্রেসিডেন্টের ওপর বিচার বিভাগের সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। এটা ঠিক যে এই রায় প্রেসিডেন্টের দেওয়া আদেশ বাতিল করে দেয়নি, কিন্তু তার কার্যকারিতা স্থগিতের পাশাপাশি আদালত ২৯ পৃষ্ঠার যে রায় দিয়েছেন, তাতে এমন সব বিষয় উঠে এসেছে, যা অনেক বিবেচনায়ই তাৎপর্যপূর্ণ। রায়ের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ‘আদালতে দেখা হবে।’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে ইতিমধ্যে এ নিয়ে দুবার আদালতে ট্রাম্প প্রশাসন পরাজিত হয়েছে। এই রায়ের পর বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে দুটি। প্রথমত, রায়ে যা বলা হয়েছে, তার আইনি ও সাংবিধানিক তাৎপর্য কী এবং দ্বিতীয়ত, প্রশাসন এখন কী কী ব্যবস্থা নিতে পারে। রায়ের পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একে ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ বলে বর্ণনা করলেও এর সবচেয়ে বড় গুরুত্ব হচ্ছে এই যে, ক্ষমতার তিনটি কেন্দ্রের একটি কেন্দ্র বিচার বিভাগ যে নির্বাহী বিভাগকে বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেবে না, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। এত দিন ‘ফোর্থ এস্টেট’ বা গণমাধ্যমের সঙ্গে ট্রাম্পের যে সংঘাত, যাকে তিনি ‘যুদ্ধ’ বলেই বর্ণনা করেছেন, তাকেই মনে হচ্ছিল ট্রাম্পের একনায়কী ধরনের আচরণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী পদক্ষেপ। নির্বাচনের পর থেকেই দেশের সিভিল সোসাইটি তাঁর আচরণের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। তার সঙ্গে এখন সম্ভবত আরেকটি সংঘাত তৈরি হলো। আদালতের দেওয়া রুলিংয়ে এটা স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যে এই তিন বিচারক মনে করেন,
অভিবাসন ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রশ্ন করার এবং তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার আদালতের আছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে ধারণা দেওয়া হয়েছে যে, তারা এ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবে না, তা অগণতান্ত্রিক। আদালত আরও বলেছেন, তাঁরা মনে করেন না যে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এই আদেশ তাড়াতাড়ি করে পুনস্থাপনের কোনো দরকার আছে। আদালত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে জনগণের অধিকার রক্ষায় বিচার বিভাগের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। আদালত যদিও বলেছেন, তাঁরা নিশ্চিত নন যে এই আদেশ মুসলিমদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করে কি না, কিন্তু তাঁরা মনে করেন, মিনেসোটা ও ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের আনা এই সব অভিযোগ ‘সিরিয়াস’ এবং এগুলোর সঙ্গে ‘গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত’। ভবিষ্যতে আদালতের এই পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে গুরুত্ব পাবে। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, এর পরে কী হবে? প্রশাসন আর কী কী ব্যবস্থা নিতে পারে? আইনি বিবেচনায় ট্রাম্প প্রশাসনের হাতে অন্তত তিনটি পথ খোলা আছে। প্রথমত, এখন এ বিষয়ে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের শরণাপন্ন হওয়া। কিন্তু তা প্রশাসনের জন্য খুব আশাব্যঞ্জক বিষয় নয় এই কারণে যে আদালতের আটজন বিচারক রয়েছেন এবং আদর্শিকভাবে তাঁরা ঠিক দুভাগে বিভক্ত। ফলে চার-চার ভোটে এ বিষয়ে রায় আটকে যেতে পারে। তা ছাড়া গত বছর অভিবাসন বিষয়ে টেক্সাসের এক আদালতের দেওয়া রায়ের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রক্ষণশীল বিচারকেরা যে অবস্থান নিয়েছিলেন,
সেটি ছিল প্রেসিডেন্ট ওবামার নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে। এখন তাঁরা যদি সেই একই অবস্থান নেন, তাহলে তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধেই যাবে। দ্বিতীয় হচ্ছে, ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের যে আদালত প্রথম আদেশ দিয়েছিলেন, তাঁরা সেখানেই ফিরে গিয়ে এখন পূর্ণাঙ্গভাবে মামলাটি শুনানি করতে পারেন। সেই শুনানিতে তাঁদের জেতার সম্ভাবনা একেবারে নেই, তা বলা যাবে না। তৃতীয় পথ হচ্ছে, এখন এই আদেশ বাতিল করে দিয়ে একটি নতুন আদেশ দেওয়া। আদালতের দেওয়া রুলিংয়ে এই রকম ইঙ্গিত আছে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের গত কয়েক দিনের আচরণে স্পষ্ট, তারা আপসের পক্ষে নয়। ফলে তারা যে আদালতেই এটার নিষ্পত্তি করবে, সেটাই অনুমেয়। ফলে বৃহস্পতিবারের এই রুলিং থেকে এ কথা মনে করার কারণ নেই যে অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ে গত কয়েক সপ্তাহের বিতর্ক এবং ঘটনাপ্রবাহের ইতি ঘটবে। তা সত্ত্বেও এটা এখন আশার বিষয় যে নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ এবং ক্ষমতার রাশ টেনে ধরার জন্য এখন পর্যন্ত আদালতের ওপর ভরসা করা যেতে পারে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments