ব্যাংক আমানতের পাহারাদার ফার্নান্দেজের গল্প
ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ, সুইজারল্যান্ডের উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি ব্যবসায়ী। তাঁর নামটি বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষের কাছেই অজানা। প্রায় অচেনা এই লোকটি অনেকটা নিভৃতে বিশ্বের লাখ লাখ ব্যাংক হিসাবের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত অ্যাভালক ব্যাংকিং সফটওয়্যার বর্তমানে ৪ লাখ কোটি বা ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যাংক আমানত নিরাপদ রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজের সাফল্যের গল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে বলা হয়েছে, ফার্নান্দেজের তৈরি অ্যাভালক ব্যাংকিং সফটওয়্যার এখন বিশ্বজুড়ে ৪৫০টি ব্যাংক ব্যবহার করছে।
এই তালিকায় রয়েছে বার্কলেজ, এইচএসবিসি, রয়েল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড, ডয়েচ ব্যাংক, সোসাইটি জেনারেল, ইউবিএস, নমুরার মতো বড় বড় বহুজাতিক ব্যাংক। সাইবার হামলা করে যাতে ব্যাংক হিসাব থেকে কেউ অর্থ সরিয়ে নিতে না পারে, সেটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিশ্চিত করে অ্যাভালক। এ জন্য বেশ অদ্ভুত উপায়ে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। সফটওয়্যারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অ্যাভালকের চুক্তি আছে ইসরায়েলের কয়েকটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। অর্থের বিনিময়ে ওই সব প্রতিষ্ঠান অ্যাভালকের তৈরি সফটওয়্যারে সাইবার হামলা করে। ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ এ বিষয়ে বিবিসিকে বলেন, ‘সাইবার হামলা ও হ্যাকিংয়ে ইসরায়েলিরা খুবই দক্ষ। যেসব সফটওয়্যার আমরা তৈরি করি, সেগুলোতে হামলা চালাতে ইসরায়েলিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর তাদের সহায়তায় সফটওয়্যারগুলোকে বুলেটপ্রুফ করা হয়।’ ১৯৯১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিজেড ব্যাংকের কম্পিউটার বিভাগ কিনে নিয়ে অ্যাভালক প্রতিষ্ঠা করেন ফার্নান্দেজ। ব্যাংকের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে কিনে নিতে তাঁর খরচ হয়েছিল মাত্র ২ লাখ ডলার। তখন প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত ছিলেন মাত্র ৫ জন। সেই অবস্থা থেকে বর্তমানে অ্যাভালকের বার্ষিক আয় ৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অ্যাভালকের সাফল্যের কারণ সম্পর্কে ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ বলেন, বেশির ভাগ ব্যাংক আগে যে ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করত, সেগুলো ছিল বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল। ব্যাংকিং সফটওয়্যারকে সহজ ও সর্বজনীন করতে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে অ্যাভালক। আর এ ধরনের একটি সফটওয়্যার তৈরি করতে পাঁচ বছর সময় লেগেছে।
নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে শুরুর দিনগুলোতে কঠিন সময় পার করার অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন ফার্নান্দেজ। তিনি বলেন, নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোনো ব্যাংকই আমাদের সফটওয়্যার কিনতে রাজি ছিল না। এ সময় এক পরিচিত ব্যক্তির সহায়তায় সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক অ্যাভালকের সফটওয়্যার কিনে নেয়। এর ছয় মাসের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের পাঁচটি বাণিজ্যিক ও বিভিন্ন বহুজাতিক ব্যাংক আমাদের সফটওয়্যারে আগ্রহী হয়। অ্যাভালক এখন দুই ধরনের ব্যাংকিং সফটওয়্যার-সেবা দেয়। আগ্রহী ব্যাংকের প্রয়োজন অনুসারে সফটওয়্যার তৈরি করে বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানটি। আবার সফটওয়্যার তৈরির পাশাপাশি একটি ব্যাংকের কম্পিউটার ও সফটওয়্যার নেটওয়ার্ক পরিচালনার দায়িত্বও নিয়ে থাকে অ্যাভালক। অ্যাভালকের সাফল্যের একটি অন্যতম কারণ হলো প্রতিষ্ঠানটির গঠনকাঠামো। বেতন-ভাতার পাশাপাশি এখানে কর্মরত আড়াই হাজার কর্মীরই অ্যাভালকে মালিকানা রয়েছে। বার্ষিক আয়ের লক্ষ্য পূরণ হলে বোনাসের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানটির সব কর্মীই কোম্পানির মালিক হিসেবে লভ্যাংশ পান। এটি কর্মীদের কাজের ক্ষেত্রে বাড়তি প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজের পূর্বপুরুষেরা সাবেক স্বৈরশাসক ফ্রাঙ্কোর আমলে স্পেন ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে চলে আসেন। পারিবারিক এই ইতিহাস উদ্যোক্তা হিসেবে ঝুঁকি নিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন ফার্নান্দেজ। তিনি বলেন, ‘স্বস্তির জায়গা থেকে বের হয়ে এসে ঝুঁকি নিতে পারার বিষয়টি আমার ডিএনএতে আছে। সেই সাহস থেকেই অ্যাভালকের যাত্রা শুরু হয়েছিল।’
No comments