নষ্ট হচ্ছে মাছের আধার
আবাসিক, শিল্প ও ট্যানারির বর্জ্যে প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদী। নদীর উজানে ফটিকছড়ির ভূজপুর এলাকায় দুটি রাবার ড্যামের (বাঁধ) কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে হালদা নদীর একটি অংশ। নদী থেকে নির্বিচারে বালু তোলায় এর মাটির গঠন নষ্ট হচ্ছে। তীরে একের পর এক গড়ে ওঠা ইটভাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে নদীর মাটি ও পানি। নদীর ১১টি স্থানের বাঁক সমান করে ফেলায় মাছের বিচরণ ও প্রজনন কমে গেছে। হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য ও মাছের প্রজনন নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে একটি গবেষণা হয়েছে। হালদা নদীর জন্য ক্ষতিকর অন্তত ১০টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে এই গবেষণায়। এর সব কটি মানবসৃষ্ট কারণ। এর মধ্যে আরও রয়েছে ফটিকছড়ির চা-বাগানগুলোর জন্য নদীর পানি ব্যবহার, নদী থেকে প্রতিদিন চট্টগ্রাম ওয়াসার পানি উত্তোলন, মা মাছ নিধন, খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে নদীর তীরে তামাক চাষ ও যন্ত্রচালিত নৌযান থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ে দূষিত হচ্ছে হালদা নদী।
হালদা নদীর এই গবেষণার কাজে যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আটজন গবেষক। গবেষণার প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের করা গবেষণাটির নাম ‘ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট অন আপস্ট্রিম ওয়াটার উইথড্রয়াল টু কনসার্ভ ন্যাচারাল ব্রিডিং হ্যাবিটেট অব মেজর কার্পস ইন দ্য রিভার হালদা’। (উজানের পানি প্রত্যাহারে হালদা নদীতে রুই-জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণের প্রভাব মূল্যায়ন)। ২০১৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গবেষণাটি চলে। গত বছরের ডিসেম্বরে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার হালদাছড়া (পাহাড়ি ঝরনা) থেকে হালদা নদীর উৎপত্তি। ৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে এসে মিশেছে। ২০১০ সাল থেকে নদীর নাজিরহাট অংশ থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে সরকার। এরপরও প্রতিবছর মাছের ডিম ও রেণুর সংখ্যা কমছে। হালদা নদী নিয়ে গবেষণা করা দলটির প্রধান ও বুয়েটের পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক উম্মে কুলসুম নভেরা প্রথম আলোকে বলেন, ২০১২ সালে হালদা নদীতে বাঁধ দেওয়ার পর থেকেই মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ কমে গেছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ কমে যাওয়ায় তা কী পরিমাণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে মাছের প্রজননের ক্ষেত্রে সেটাও গবেষণায় উঠে এসেছে। চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কার্যালয়ের হিসাবে দেখা যায়,
২০১২ সালে হালদা নদী থেকে উৎপাদিত মাছের রেণুর পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৬৯ কেজি, ২০১৩ সালে সেটি অর্ধেকে নেমে আসে। ওই বছর সংগ্রহ করা যায় ৬১২ কেজি রেণু, ২০১৪ সালে ৫০৮ কেজি, ২০১৫ সালে ১০৬ কেজি ও ২০১৬ সালে ১৬৭ কেজি রেণু সংগ্রহ করা হয়। অবশ্য রেণু সংগ্রহ করা নিয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে একমত নন গবেষকেরা। তাঁদের হিসাবে, গত পাঁচ বছরে সংগৃহীত রেণুর পরিমাণ আরও অনেক কম। গবেষকেরা বলছেন, ২০১২ সালে হালদা থেকে সংগৃহীত রেণুর পরিমাণ ছিল ৩৫৪ কেজি, ২০১৩ সালে ৭০ কেজি, ২০১৪ সালে ২৭৫ কেজি, ২০১৫ সালে ৪৭ কেজি ও ২০১৬ সালে ১২ কেজি। হালদা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া। তিনি বলেন, নদী থেকে মাছের ডিম সংগ্রহের সময় জেলে ও ডিম সংগ্রহকারীদের সঙ্গে কথা বলে প্রকৃত চিত্র (গবেষকদের তথ্য) বের করা হয়েছে। মৎস্য কার্যালয় কীভাবে এত রেণু সংগ্রহের হিসাব বের করেছে তা জানা নেই তাঁর। হালদার পানির প্রবাহ কমার কারণেই মাছের রেণুর পরিমাণ কমছে—এ বিষয়ে একমত চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কার্যালয়ের মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপপরিচালক প্রভাতী দেব। তিনি বলেন, কৃষি বিভাগ ও এলজিইডি যখন বাঁধটি দেয়, তখন মৎস্য বিভাগের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেনি।
হালদা নদীপারের শিল্পকারখানাগুলোর বেশির ভাগেরই ইটিপি (তরল বর্জ্য শোধনাগার) নেই। আবার যেসব কারখানার ইটিপি রয়েছে, সেগুলোও সব সময় চালু করা হয় না। তাই কারখানা ও ট্যানারির দূষিত বর্জ্য সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে।হাটহাজারীর খন্দকিয়া, কাটাখালী, বাথুয়া, কৃষ্ণখালী, শাহ মাদারী ও চট্টগ্রাম নগরের বামনশাহী খাল বেয়ে বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য সরাসরি পড়ছে হালদা নদীতে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চলমান অনন্যা আবাসিক এলাকার মাস্টার ড্রেনটি বামনশাহী খালের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে বামনশাহী ও হাটহাজারীর কুয়াইশ খালের মাধ্যমে নগর ও হাটহাজারীর বিশাল এলাকার বর্জ্য হালদায় গিয়ে মিশছে। গত জুলাই মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনেও এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার খন্দকিয়া খালের মদুনাঘাট (হাটহাজারী উপজেলায়) এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, খালের পানি কালো। তরল বর্জ্যের পাশাপাশি পানিতে ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনসহ গৃহস্থালির বর্জ্য। হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা এলাকায় শাহ মাদারি খাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায় পানির সঙ্গে ভাসমান বর্জ্য পড়ছে হালদায়। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও হালদা নদীর উত্তর মাদার্শা ও গড়দুয়ারা এলাকায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলতে দেখা যায়। বুয়েটের গবেষক দল হালদার দূষণের মাত্রা পরিমাপের জন্য ২০১৫ সালে শিল্পকারখানা রয়েছে এমন ১৩টি স্থানের পানির মান তিন দফা পরীক্ষা করে। প্রতিটি স্থানেই পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) ও বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) সর্বনিম্ন পর্যায়ে পাওয়া গেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নগরের ফতেয়াবাদ এলাকার এশিয়া প্যাসিফিক পেপার মিলস লিমিটেড ও জননী পেপার মিলস কারখানার সব বর্জ্য পাশের একটি খালের মাধ্যমে হালদা নদীতে গিয়ে পড়ছে। ওই খালে প্রতি লিটার পানিতে ডিও পাওয়া গেছে দশমিক ১৭ মিলিগ্রাম।
একইভাবে মাদারি খালে দ্রবীভূত অক্সিজেন ১ দশমিক ৪ ও খন্দকিয়া খালে দশমিক ১১ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়। অন্যদিকে বিওডি প্রতি লিটারে সর্বনিম্ন পাওয়া গেছে ৪ মিলিগ্রাম। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, দ্রবীভূত অক্সিজেন ৪ দশমিক ৫-এর নিচে নামলে তাতে জলজ প্রাণী বাঁচে না। অন্যদিকে বিওডি ৬-এর কম থাকা জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। পরিবেশ অধিদপ্তরও গত জুলাই মাসে হালদাসংলগ্ন বিভিন্ন খালের পানি পরীক্ষা করে দূষণের প্রমাণ পেয়েছে। গত জুলাই মাসে ঘোর বর্ষাকালে খন্দকিয়া খালের পানিতে ডিও পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে ২ দশমিক ২৯ মিলিগ্রাম। দূষণের দায়ে মদিনা ট্যানারি, এশিয়ান পেপার মিল, রীফ লেদার লিমিটেডসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশে মদিনা ট্যানারি ও রীফ লেদার বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। মদিনা ট্যানারির স্বত্বাধিকারী আবু মোহাম্মদ বলেন, এখন কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কীভাবে নদীদূষণ না করে কারখানা চালু করা যায়, সে বিষয়ে তাঁরা ভাবছেন। হালদা নদীর দুই পাড়ে গড়ে ওঠা ২২টি ইটভাটাকেও হালদার জন্য হুমকি বলে মনে করছেন গবেষকেরা। ইটভাটাগুলো ইট তৈরির জন্য নদীর পাড় ও তলদেশের মাটি ব্যবহার করছে। পানিও ব্যবহার করছে হালদা থেকে। গবেষণা দলের সদস্য ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ভাটাগুলোকেও নদীর কাছ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। তারা যাতে কোনোভাবেই নদীর পাড় থেকে মাটি ব্যবহার করতে না পারে, সেদিকে নজরদারি বাড়ানো দরকার। দূষণ কমানোর জন্য ভারী শিল্প-কারখানাগুলোকে ইটিপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। নির্বিচারে হালদা নদী থেকে বালু উত্তোলনকেও হালদার জীববৈচিত্র্যর জন্য হুমকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, হাটহাজারীর রামদাস মুনশির হাট,
মদুনাঘাটের নাইস টাওয়ার থেকে পলুয়ার পুল পর্যন্ত এবং মদুনা ঘাটের পূর্ব পাশে (রাউজান) ও কালুরঘাট—এই চার জায়গা থেকে প্রতিদিন ১ লাখ ২৯ হাজার বর্গফুট বালু তোলা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, এভাবে বালু তোলার কারণে নদীর তলদেশের মাটির গঠন নষ্ট হচ্ছে। মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর খাদ্যও উঠে আসছে বালুর সঙ্গে। পানি ঘোলা হয়ে যাচ্ছে, শব্দের উৎপাত বেড়েছে, সূর্যের আলো ঠিকভাবে পানির নিচে পৌঁছাচ্ছে না। এতে করে নদীর জীববৈচিত্র্যর ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১০০ বছরে হালদা নদীর অন্তত ১১টি বড় আকারের বাঁক কেটে সোজা করে ফেলা হয়েছে। এই বাঁকগুলো কেটে ফেলার কারণে নদীর দৈর্ঘ্য ১২৩ কিলোমিটার থেকে ৮৮ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। নদীর বাঁক কার্প-জাতীয় মাছের প্রধান বসতি হিসেবে চিহ্নিত। বাঁক সোজা করে ফেলায় মাছের বিচরণক্ষেত্র কমে গেছে। হালদা রক্ষায় গবেষণা প্রতিবেদনে ১০টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খালের মাধ্যমে হালদা নদীতে শিল্প ও আবাসিক বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা, ভারী শিল্প-কারখানায় ইটিপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা, মা মাছ ধরা বন্ধে নদীতে পাহারা জোরদার করা, রাবার ড্যাম প্রত্যাহার, তামাক চাষ বন্ধ করা প্রভৃতি।
No comments