থেমে গেছে ‘সওগাত প্রেস’
১৯৩৩ সালে নাসিরউদ্দীন কলকাতায় ‘সওগাত কালার প্রিন্টিং প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে এই প্রেস থেকেই সুফিয়া কামালের সম্পাদনায় মহিলাদের প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক বেগম ছাপা হয়। পরে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মেয়ে নূরজাহান বেগম এর সম্পাদনার দায়িত্ব পান মুশফেকা ইসলাম বুকসমান উঁচু তাকের খোঁপে খোঁপে রাখা সিসার টাইপে কয়েক বছরের ধুলা। মূল প্রেস ঘরের মেঝেতেও ধুলার স্তর। হেলে পড়েছে এক পাশের দেয়াল। টিনের ছাদও ভাঙাচোরা। ছাপা, বাঁধাই আর কাটিংয়ের যন্ত্রগুলো অলস পড়ে আছে। সাহিত্য পত্রিকা সওগাত এবং প্রথম মহিলা সাপ্তাহিক বেগম-এর ছাপাখানা ‘সওগাত প্রেস’ এখন ধুলায় মলিন, জীর্ণ।
বছরখানেক ধরে এখানে ছাপার কাজও বন্ধ আছে। ১৯১৮ সালে সাংবাদিক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের হাত ধরে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল সওগাত। প্রগতিশীল এই সাহিত্য পত্রিকার প্রধান লেখকদের মধ্যে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরও এতে লিখেছেন। ১৯৩৩ সালে নাসিরউদ্দীন কলকাতায় ‘সওগাত কালার প্রিন্টিং প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে এই প্রেস থেকেই সুফিয়া কামালের সম্পাদনায় মহিলাদের প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক বেগম ছাপা হয়। পরে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মেয়ে নূরজাহান বেগম এর সম্পাদনার দায়িত্ব পান। দেশভাগের পর নাসিরউদ্দীন সপরিবারে ঢাকায় স্থায়ী হন। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে পাটুয়াটুলীতে নতুন ঠিকানায় আবার চালু হয় সওগাত প্রেস। এখান থেকেই ছাপা হতে থাকে সওগাত আর বেগম। ৬৬ নম্বর পাটুয়াটুলীর ঠিকানায় তালাবদ্ধ প্রেসের বাইরে গতকাল কথা হয় মো. হেলালের সঙ্গে। ষাটোর্ধ্ব হেলাল ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রেসের দেখভালের কাজ করছেন। তালা খুলে তিনিই ঘুরিয়ে দেখান সব। ‘এইটা ছিল চায়ের ঘর। সাহেবের কাছে অনবরত লোক আসতেন। সারা দিনই চায়ের কেতলি ফুটত।’ এখন সেখানে ধুলায় ঢাকা পুরোনো হাঁড়ি-পাতিল, হিটার। তাঁর কাছেই জানা যায়, জরাজীর্ণ প্রেস ঘরটির আকার আরও বড় ছিল। পাশের জমিটি বিক্রি হয়ে গেলে প্রেস ঘর ছোট হয়ে আসে। প্রেস ঘরের পাশের ঘরটি পুরোই ধ্বংসস্তূপ।
ছাদ নেই। দরজা-জানালার কপাট ভেঙে গেছে। পুরোনো টিন, ভাঙা আসবাব আর আগাছার রাজত্ব সেখানে। জানা গেল, এটা ছিল ‘বেগম ক্লাব’। বেগমের লেখক, পাঠক, কর্মীদের কাজ আর আড্ডার জায়গা। এখন শুধু কয়েকটি দেয়াল টিকে আছে। হেলাল বলেন, ‘এই প্রেস অনেক জমজমাট ছিল। সত্তর-আশি-নব্বই জন লোক ডেইলি কাজ করত। কত মানুষ আসত। এখন কেউ খবরও নেয় না।’ সত্তরের দশকের শুরুতে সওগাত বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বেগম ছিল সবটা জুড়ে। কিন্তু গত বছর নূরজাহান বেগম মারা যাওয়ার কিছুদিন পর সওগাত প্রেসের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এখন সাপ্তাহিকের বদলে মাসিক ভিত্তিতে বাইরের ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বেগম। নূরজাহান বেগমের বড় মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন এখন বেগম প্রকাশের দায়িত্বে আছেন। তিনি বলেন, মূলত ব্যয় সংকোচনের জন্যই সওগাত প্রেস এখন বন্ধ আছে। বেগমকে আর একটু গুছিয়ে এনে আবার আগের ঠিকানায় ফেরত যেতে চান তাঁরা। ফ্লোরা বলেন, ‘আমরা কোনো কিছু ধ্বংস হতে দিতে চাই না। সব আবার শুরু হবে।’
No comments