আমেথির ভোট যুদ্ধে মুখোমুখি দুই রানি
সঞ্জয় লীলা বনসালি চাইলে টান টান একটা সিনেমা তৈরি করতে পারেন। আমেথির রাজপ্রাসাদে হিট সিনেমার উপাদান এতটাই। বাজি ধরে বলতে পারি, গোটা দেশের মানুষ চোখের পলক না ফেলে সেই সিনেমা গিলবে, যেমন গিলেছিল সঞ্জয়ের তৈরি দেবদাস, বাজিরাও মাস্তানি কিংবা হাম দিল দে চুকে সনম। আমেথি ও রাহুল গান্ধী প্রায় সমার্থক হয়ে গেলেও কংগ্রেসের সহসভাপতি সরাসরি এই সিনেমার কাহিনির সঙ্গে জড়িত নন। আবার তাঁকে যে একেবারেই চরিত্র লিপির বাইরে রাখা যাবে, তা-ও নয়। কারণ, আমেথির রাজা সঞ্জয় সিংয়ের বর্তমান স্ত্রী অমিতাকে ওই বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিট দিয়েছেন তিনিই। আবার রাজ্যে সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোট বাঁধার পেছনেও রয়েছে তাঁর হাত। সিনেমা তৈরির জন্য আমেথির রাজপ্রাসাদের অলিন্দে পরতে পরতে যে উপাদানগুলো রয়েছে, সঞ্জয় লীলা বনসালিকে তা বরং জানানো যাক। লক্ষ্ণৌর প্রায় দেড় শ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে আমেথি। রাহুল গান্ধীর লোকসভা কেন্দ্র আমেথির মধ্যেই রয়েছে আমেথি বিধানসভা, যেখানকার শেষ রাজা রনঞ্জয় সিং দত্তক নিয়েছিলেন আজকের ‘রাজা’ সঞ্জয় সিংকে। স্বাধীন ভারতে রাজাদের রাজত্ব যাওয়ার পরই সঞ্জয়ের জন্ম। তবু অামেথির আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে সঞ্জয় অাজও ‘মহারাজ’। এখনো আমেথির রাস্তায় তাঁর গাড়ি বেরোলে অন্য সব গাড়ি থেমে যায়। কাহিনির শুরু আশির দশকের মাঝামাঝি। ব্যাডমিন্টনে তখন দেশ কাঁপাচ্ছেন সৈয়দ মোদি। আটবারের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন। মেয়েদের মধ্যে সেরা অমিতা সিং। দুজনের বাধাহীন প্রেম তখন ‘টক অব দ্য টাউন’।
রক্ষণশীল লক্ষ্ণৌয়ে হিন্দু-মুসলমানের সেই প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়াল। তারপর শুরু হলো জটিলতা। আসরে হাজির সঞ্জয় সিং। অমিতার মধ্যে সঞ্জয় কী দেখেছিলেন তিনিই জানেন। শুরু হয়ে গেল আর এক উদ্দাম প্রেমকাহিনি। লক্ষ্ণৌর রাস্তায় আচমকাই মারা যান সৈয়দ মোদি। ১৯৮৮ সালে। কানাকানি শুরু হয়ে গেল, সৈয়দকে খুন করা হয়েছে। খুনের ষড়যন্ত্র করেছেন সঞ্জয় ও অমিতা! রসাল গল্পের শাখা-প্রশাখা অতঃপর পল্লবিত হতে থাকল। সিবিআইয়ের চার্জশিটে সঞ্জয় ও অমিতার নাম উঠে গেল। শেষমেশ অবশ্য প্রমাণের অভাবে দুজনেই খালাস, যা এ দেশের ধনী ও প্রভাবশালীরা যে সুবিধা অাজন্ম উপভোগ করে অাসছেন। অমিতার সঙ্গে প্রেমপর্ব শুরুর অনেক অাগেই সঞ্জয়ের বিয়ে হয়েছিল। স্ত্রী গরিমা সিং, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৮৯ সালে পুত্র অনন্ত বিক্রম ও দুই কন্যা মহিমা এবং শৈব্যাকে নিয়ে গরিমা আমেথির প্রাসাদ ত্যাগ করে লক্ষ্ণৌবাসী হন। ১৯৯৫ সালে সঞ্জয় বিয়ে করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলেন অমিতাকে। বহু বছর পর রাজপ্রাসাদ পেল দ্বিতীয় রানিকে। গরিমাও দ্বারস্থ হলেন আদালতের। অভিযোগ, সঞ্জয় তাঁকে বিবাহবিচ্ছেদ না করেই অমিতাকে বিয়ে করেছেন। বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আদালতে গরিমা সিং বলে যাঁকে হাজির করা হয়েছিল, সেই নারী নাকি তিনি নন। সঞ্জয় সেই অভিযোগ উড়িয়ে বললেন, আইনত বিচ্ছেদ ঘটিয়েই তাঁর এই দ্বিতীয় দারপরিগ্রহণ। গরিমা আদালতকে জানালেন, সঞ্জয়ের দাখিল করা তথ্য-প্রমাণও জাল। তিনি এখনো স্ত্রী। সঞ্জয় এখনো তাঁর বৈধ বিবাহিত স্বামী। মামলার নিষ্পত্তি আজও হয়নি। কিন্তু ঘটনার জাল ছড়িয়েছে বিস্তর। নরেন্দ্র মোদি যে বছর ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রী হলেন, সেই ২০১৪ সালেই একদিন আচমকা পুত্র অনন্ত বিক্রম, পুত্রবধূ সম্ভাবীর সঙ্গে দুই কন্যাকে নিয়ে গরিমা রাজপ্রাসাদের একটা অংশে এসে উঠলেন। রানিমাকে তাঁর ন্যায্য পাওনা পাইয়ে দিতে সেদিন হাজির ছিলেন আমেথির কয়েক হাজার প্রজা। জনতা সেদিনই ঘোষণা করে, বড় রানিমা গরিমাই আমেথির প্রকৃত রানি। তাঁর ন্যায়বিচারের সঙ্গী তাঁরাও। অনেক চেষ্টা করেও সঞ্জয় সিং গরিমাকে প্রাসাদ থেকে সরাতে পারলেন না। একই প্রাসাদের দুই কোনায় দুই রানির সংসার। অন্য একটা ঘটনাও ঘটে গেল। আমেথির পরমহংস অাশ্রমের পূজনীয় স্বামী দিনেশানন্দজি মহারাজ গরিমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। রাজ্যবাসীকে জানালেন, গরিমার সংগ্রামে তাঁর আশীর্বাদ রয়েছে। তিনি রয়েছেন গরিমার পক্ষে। রাহুলকে ভোটে হারাতে স্মৃতি ইরানি তখন আমেথি চষে বেড়াচ্ছেন। বিজেপি নেতাদের বোধোদয় তখনই। গরিমার মধ্যে তাঁরা এক ‘ফাইটার’-এর সন্ধান পেয়ে যান। গরিমার রাজনীতিকরণের সেই শুরু। বিজেপি ঠিক করে নেয়, আমেথি বিধানসভায় গরিমাই হবেন তাদের তুরুপের তাস। গরিমার মধ্যে অনেক ‘কিন্তু কিন্তু’ ছিল। ডামি প্রার্থী হিসেবে বিজেপি সে জন্য দাঁড় করিয়ে দেয় রাজপুত্র অনন্ত বিক্রমকে, যাতে মা রাজি না হলে ছেলেকে সমর্থন দিতে পারে। শেষ বেলায় গরিমা রাজি হন, অথচ অনন্ত বিক্রমও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেন না। খাতা-কলমে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী। কাহিনিটা তা হলে দাঁড়াচ্ছে এ রকম, ছোট রানি কংগ্রেসের অমিতা সিংয়ের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী বড় রানি গরিমা। স্বতন্ত্র প্রার্থী বড় রানির একমাত্র পুত্র অনন্ত বিক্রম। দুই প্রার্থীর স্বামী এক ও অদ্বিতীয় রাজা সঞ্জয় সিং, যিনি আসাম থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য হিসেবে এবং বেশ কিছু বছর যিনি বিজেপির ঘরও করেছেন। এই মূল কাহিনির পাশে একটা পার্শ্ব প্লটও আছে। সেটা যাঁকে কেন্দ্র করে, তিনি আমেথির বর্তমান বিধায়ক গায়ত্রী প্রসাদ প্রজাপতি। গত ভোটে কংগ্রেসের অমিতা সিংকে হারিয়ে তিনি মুলায়ম মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছিলেন। পরে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির ভূরি ভূরি অভিযোগের পাশাপাশি এসে যায় ধর্ষণের এক মারাত্মক অভিযোগও।
জোটে কংগ্রেসকে আসনটি ছাড়া হলেও মুলায়ম সিং ঘনিষ্ঠ গায়ত্রী প্রসাদ আমেথিতে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থী। গায়ত্রী প্রসাদ নাছোড়বান্দা। ভোটের লড়াই তিনি লড়বেনই। অখিলেশ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই পরিস্থিতিতে অখিলেশের হাত শক্ত করে দেন খোদ সুপ্রিম কোর্ট। সর্বোচ্চ অাদালতের নির্দেশ, অবিলম্বে গায়ত্রী প্রসাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা শুরু করতে হবে। সোমবারের ছবিটা একটু বলি। অখিলেশ প্রচারে এসেছেন আমেথিতে। সমাজবাদী-কংগ্রেসের যৌথ মঞ্চ। জনসভায় আসার আগেই তাঁর নির্দেশে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে হলো গায়ত্রী প্রসাদ প্রজাপতিকে। অখিলেশ একটিবারের জন্যও গায়ত্রী প্রসাদকে ভোট দিতে বললেন না। মঞ্চের নিচে কাঁদতেই থাকলেন সমাজবাদী পার্টির আমেথির সরকারি প্রার্থী! আমেথি লোকসভা কেন্দ্রের পাঁচটি আসনই এবার কংগ্রেস-সমাজবাদী জোট ছেঁকে নেবে কি না, সেই আগ্রহ ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে দুই রানির লড়াই। বড় রানি মাথায় ঘোমটা টেনে দুই হাতে আঁচল ছড়িয়ে প্রজাদের ভোটভিক্ষা করছেন, ‘আমার সম্মানটুকু শুধু ফেরত দিন। আমার ন্যায্য লড়াইয়ে সঙ্গ দিন।’ একই কথা গরিমার দুই কন্যার মুখেও। ‘২৪ বছর ধরে বাবাকে বাবা ডাকতে পারি না। অথচ শৈশব-কৈশোরে বাবাই ছিলেন আমাদের ধ্যান-জ্ঞান!’ বসে নেই অমিতা সিংও। এই আমেথি থেকে ২০০২ সালে বিজেপির হয়ে ও ২০০৭ সালে কংগ্রেসের টিকিটে জিতেছিলেন। ২০১২ সালে গায়ত্রী প্রসাদ প্রজাপতির কাছে হার। এবার ফের জিততে চান। তিনি প্রচার করছেন, ‘বিজেপির চক্রান্তে রাজপরিবারের সম্মান আজ ধুলোয় মিশেছে। আমেথির মানুষ এর জবাব দিক।’ কী জবাব দেবেন ‘প্রজারা’? রাজপ্রাসাদের ঠিক বাইরে সারি সারি ঘোড়ানিমের তলায় প্রজাদের জটলা। সুরেন্দ্রনাথ উপাধ্যায়, হাবিব ঠিকাদার, ঘনশ্যাম তিওয়ারি, পালানিরাম, মনোজ শর্মা, পালঙ্ক গুপ্তা, গোপীনাথ সিংরা বিভ্রান্ত। কী করবেন তাঁরা? বড় রানিমার কান্না ঘোচাতে পদ্মফুলে ছাপ দেবেন, নাকি বংশানুক্রমে রাজ অনুগ্রহ পেয়ে আসার দরুন মহারাজ সঞ্জয় সিংয়ের ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে হাতে মোহর লাগাবেন? সঞ্জয় লীলা বনসালিকে চুপি চুপি বলি, দীর্ঘ আলোচনা শেষে আমেথির প্রজারা একমত হয়ে বললেন, ‘আমাদের কাছে এ এক গভীর ধর্মসংকট’।
No comments