ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন
নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স ও জার্মানিতে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তর্কযোগ্যভাবে বলা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের পর সবচেয়ে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তা অনুষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে যে উদার গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল, সেটা এখন সব জায়গায় হুমকির মুখে রয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপের ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য, যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নানা চ্যালেঞ্জের মুখে আছে, যার মধ্যে আছে ক্রমশ আগ্রাসী অবস্থানে যাওয়া রাশিয়া, সন্ত্রাসবাদের সার্বক্ষণিক হুমকি, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও অসম অর্থনৈতিক বিকাশ। যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট গণভোট আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার পর ইউরোপ এক সাদাসিধা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে: লোকরঞ্জনবাদী ও জাতীয়তাবাদীরা কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল দেশগুলোতেও একই প্রভাব বিস্তার করতে পারবে? নেদারল্যান্ডসে দেখা যাচ্ছে, গার্ট ওয়াইল্ডার্সের অতি ডানপন্থী ফ্রিডম পার্টি আগামী মাসের নির্বাচনের আগে জরিপে ভালো করছে।
ট্রাম্প যে সাতটি দেশের মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন, ওয়াইল্ডার্স তা অনুমোদন করেছেন। ট্রাম্পের প্রধান কৌশলবিদ স্টিফেন ব্যাননের মতো ওয়াইল্ডার্স পৃথিবীকে বর্ণবাদী কাচের ভেতর দিয়ে দেখে থাকেন। তিনি বিশ্বাস করেন, পশ্চিমা বিশ্বকে ইসলামের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি এক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। তবে নেদারল্যান্ডসের আর কোনো সংসদীয় দল তেমন মত পোষণ করে না, ফলে ওয়াইল্ডার্সের দলই যে ক্ষমতায় আসবে, তার নিশ্চয়তা তেমন একটা নেই। ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রাট এখনো নিজের জায়গা ধরে রেখেছেন, ফলে শেষমেশ ক্ষমতা হয়তো তাঁর হাতে আসবে না। ওদিকে ফ্রান্সের নির্বাচন-পূর্ব জরিপে অতি ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা মেরিন লা পেন এগিয়ে আছেন। নির্বাচন হবে এপ্রিল ও মে মাস, অর্থাৎ দুই পর্বে। ইউরোজোনে ফ্রান্স থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে লা পেন গণভোট করার অঙ্গীকার করেছেন। যদিও ব্যাংক অব ফ্রান্স সতর্ক করে দিয়েছে, এই ইউনিয়ন ছেড়ে গেলে ফ্রান্সের জাতীয় ঋণ বার্ষিক ৩২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার হারে বেড়ে যাবে। লা পেন এমন আকাঙ্ক্ষাও পোষণ করেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৌলিক উপাদান, যেমন ইউরোপীয় নাগরিকদের অবাধ চলাচল বন্ধ করে দিতে চান। যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দেখা গেছে, বড় বড় শহরের ভোটাররা যথাক্রমে ইউনিয়নে থেকে যাওয়া ও হিলারি ক্লিনটনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ফ্রান্সের নির্বাচনেও আমরা হয়তো সে রকম একটা ধরন দেখব। কিন্তু যেখানে বয়স্ক ভোটাররা ব্রিটিশ ও মার্কিন জাতীয়তাবাদ উসকে দিয়েছেন, সেখানে লা পেনের বেশির ভাগ সমর্থকই তরুণ।
কথা হচ্ছে, লা পেন যদি ফ্রান্সে জিতে যান, তাহলে ইউরোপ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। ইউরোপের অতীতকালের বিপজ্জনক জাতীয়তাবাদী দানবেরা যখন বোতল ভেঙে বেরিয়ে আসবে, আমরা জানি তখন ইউরোপ সহজেই ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু যাঁরা উদার গণতন্ত্র ও আইনের শাসনে বিশ্বাস করেন, তাঁদের কাছে ইউরোপীয় একতা ধরে রাখার বিকল্প প্রার্থী আছেন, যিনি অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করবেন এবং ইউরোপে ফ্রান্সের সক্রিয় ভূমিকা ধরে রাখবেন। জার্মানির নির্বাচন হবে বছরের শেষ নাগাদ। তবে সেই নির্বাচনে অতি ডানপন্থী দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানি চ্যান্সেলর পদের জন্য প্রতিযোগিতায় আসতে পারবে বলে মনে হয় না, যদিও তারা রাশিয়ার কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছে। কিন্তু ম্যার্কেল পুনর্নির্বাচিত হোন বা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলের মারটিন শুলজ নির্বাচিত হোন না কেন, তাঁকে সেই দেশগুলোর জোটের নেতৃত্ব দিতে হবে, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের ব্যবস্থার যে কিয়দংশ টিকে আছে, তা টিকিয়ে রাখতে চায়। এই প্রচেষ্টায় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়ার পশ্চিমা মিত্ররাও থাকতে পারে, কিন্তু এই জোটের প্রথম কাজ হবে ইউরোপের ঘর ঠিক করা। সম্প্রতি ইউরোপীয়রা মাসট্রিখট চুক্তির ২৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে, যেটা ছিল ইউরোপের একতাবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মধ্যবর্তী বছরগুলোতে আমরা শিখেছি, ইউরোপের সামনে আজ যেসব চ্যালেঞ্জ আছে, তা মোকাবিলায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তি যথেষ্ট নয়। এই পরিস্থিতি শোধরাতে জার্মানির আরও আত্মবিশ্বাসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ইউরোপ গঠনের প্রস্তাব দেওয়া উচিত; যে ইউরোপ অভ্যন্তরীণ বিভাজন কাটিয়ে নিজের নিরাপত্তা ও অভিবাসনব্যবস্থা টেকসইভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারে। জাতীয়তাবাদ ও লোকরঞ্জনবাদ ঠেকানোর জন্য যদি পাল্টা শক্তি দাঁড়ায়, তাহলে এটা খুব দূরবর্তী ব্যাপার হবে না। অন্যদিকে ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির সাবেক নেতা নাইজেল ফারাজ, ওয়াইল্ডার্স, লা পেন ও তাঁদের সমকক্ষরা ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে এমন সাহসী অবস্থান নিতে থাকলে এই আত্মগর্ব গ্রহণযোগ্যতা হারাতে থাকবে, মূলত তাঁদের নিজেদের সফলতার জন্য।
আর ইউকে ইনডিপেনডেন্স পার্টির ক্ষেত্রে তা হবে আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্য। তবে অতি ডানপন্থীরা ইউরোপের বড় কয়েকটি দেশে ক্ষমতায় এলেও তারা শিগগিরই আবিষ্কার করবে, প্রতিশ্রুতি দেওয়ার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। ট্রাম্প যেমন এখন টের পাচ্ছেন। ট্রাম্প, ব্রেক্সিটবাদী তাঁদের সমকক্ষদের এখনো এটা প্রমাণ করতে হবে যে তাঁরা সিংহভাগ মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করতে পারেন। বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁরা যোগ্যতা ও সফলতার সঙ্গে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতে পারবেন, সেই প্রমাণও তাঁদের দিতে হবে। এটা পরিষ্কার হয়ে যাওয়া উচিত, আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীতে যেখানে একক জাতিরাষ্ট্রগুলো নখ–দন্তহীন হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এই লোকরঞ্জনবাদী জাতীয়তাবাদীরা মানুষের কাঙ্ক্ষিত দাবি পূরণ করতে পারবে। সৌভাগ্যবশত, উদার গণতন্ত্র এখনো প্রগতিশীল বিকল্পের সন্ধান দেয়। ফলে জার্মানিতে ম্যার্কেল বা শুলজের বিদায় বা ফ্রান্সে লা পেনের পরাজয় হলে বৈশ্বিক পর্যায়ে এক পাল্টা আঘাতের সূচনা হতে পারে। অন্যদিকে নতুন ঘরানার এক ইউরোপবাদী মধ্যপন্থী আন্দোলন ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে। এই দলগুলো মিথ্যার বেসাতি করে না। তারা রুশ স্টাইলে প্রচারণার ওপরও নির্ভর করে না। হ্যাঁ, কয়েক জায়গায় লোকরঞ্জনবাদীরা ক্ষমতায় এসেছে। উদারপন্থীদের কাজ হচ্ছে এদের জবাবদিহি চাওয়া এবং বিকল্প পেশ করা। যাঁরা ট্রাম্প ও ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা কাজের কথা নয়। পৃথিবীর এই নতুন বক্তৃতাবাগীশদের কাজ দিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। সত্য, যুক্তি ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা দিয়ে তাঁদের পরাজিত করতে হবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
গাই ভারহোফস্টাড: বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
গাই ভারহোফস্টাড: বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
No comments