বেতন বন্ধ হওয়ায় দিশেহারা পাটকল শ্রমিকেরা by শেখ আল-এহসান
পাটকলশ্রমিকদের রাজপথ ও রেলপথ অবরোধের কারণে গতকাল দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। |
দেশের
সবচেয়ে বড় পাটকল খুলনার ক্রিসেন্ট জুটমিলের শ্রমিক মো. খালেকুজ্জামান
খোকন (৫৫)। সপ্তাহে তিনি মজুরি পান ১ হাজার ৮০০ টাকা। তা দিয়ে চার সদস্যের
সংসার সামলিয়ে আর টেনেটুনে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন
খোকন। কিন্তু নয় সপ্তাহ বেতন বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন তিনি। ঘরে নেই
চাল। দোকানদারেরাও আর বাকি দিতে চাইছেন না। অসহায় খোকনের কণ্ঠে অভিমানের
সুর, ‘মিলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন, উৎসব ভাতা পাচ্ছেন। আর
আমরা শ্রম দিয়েও টাকা পাচ্ছি না।’ খোকনের মতোই অবস্থা খুলনা অঞ্চলের
রাষ্ট্রায়ত্ত সাতটি পাটকলের প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিকের। প্রতিটিতেই শ্রমিকদের
মজুরি চার থেকে ১৬ সপ্তাহ বকেয়া। বাধ্য হয়ে বকেয়া মজুরি ও ভাতা পরিশোধ
এবং পাট খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড়সহ পাঁচ দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের
ধর্মঘটে নেমেছেন পাটকলের শ্রমিকেরা। গত সোমবার সকাল ছয়টা থেকে লাগাতার এ
ধর্মঘট শুরু করেন শ্রমিকেরা। পাশাপাশি গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে বেলা
দুইটা পর্যন্ত খুলনার দুটি পয়েন্টে রাজপথ ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালিত
হয়। শ্রমিকনেতারা বলেছেন, আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এসব কর্মসূচি চলবে।
এর মধ্যে দাবি আদায় না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। আন্দোলনে
নেতৃত্ব দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত জুট মিল সিবিএ-নন সিবিএ ঐক্য পরিষদ। পরিষদের
সদস্যসচিব জাকির হোসেন বলেন, প্রায় দেড় বছর ধরে শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে
সরকারের সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করা হয়েছে। কিছুতেই
কোনো কাজ হয়নি। দাবি আদায়ে সর্বশেষ ৩ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ আসেনি। তাই পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ৪
এপ্রিল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য লাগাতার কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হয়েছেন
তাঁরা। খুলনার স্টার জুটমিলের শ্রমিক মো. মোস্তফা জানান, তাঁর মিলের
শ্রমিকদের আট সপ্তাহের মজুরি বকেয়া রয়েছে। ছেলে স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন।
কিন্তু তাঁর কোনো খরচ দিতে পারছেন না তিনি। ফলে আজ (মঙ্গলবার) সকালে তিনি
কলেজে যেতে পারেননি। মোস্তফা ডায়াবেটিসের রোগী। টাকার অভাবে তাঁর
চিকিৎসাও বন্ধ। বেতন বকেয়ার কারণ জানতে চাইলে ক্রিসেন্ট জুট মিলের
উপমহাব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকায়
মৌসুমের শুরুতে চাহিদামতো পাট কেনা যায়নি। তা ছাড়া রপ্তানি বন্ধ থাকায়
রপ্তানি আদেশ থেকে অগ্রিম টাকাও পাওয়া যায়নি। এসব কারণে শ্রমিকদের মজুরি
বকেয়া পড়েছে। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) খুলনা অঞ্চলের
সমন্বয়কারী মহব্বত আলী মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, চাল, গম, ভুট্টাসহ ছয়টি
পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহারে ‘ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যাক্ট’ বাস্তবায়নের
জন্য পণ্য তৈরি করতে গিয়ে মিলগুলো বাইরে পণ্য রপ্তানি করতে পারেনি।
পাশাপাশি পণ্য ছাড় না হওয়ায় টাকাও আটকে ছিল। তবে এখন পণ্য বাইরে রপ্তানির
আদেশ হয়েছে, আশা করা যায়, কয়েক দিনের মধ্যে সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে। আন্দোলনে
বিএনপির সমর্থন: পাটকলশ্রমিকদের চলমান আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে খুলনা
মহানগর বিএনপি। গত সোমবার রাতে মহানগর বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক
শামসুজ্জামান চঞ্চল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।
যশোরে রাজপথ অবরোধ: অভয়নগর (যশোর) প্রতিনিধি জানান, পাঁচ দফা দাবিতে
যশোরে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি পাটকল যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ (জেজেআই) ও
কার্পেটিং জুট মিলসের শ্রমিক-কর্মচারীরা গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো
অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করেন। এর অংশ হিসেবে তাঁরা উৎপাদন বন্ধ রেখে
ভোর ছয়টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত যশোর-খুলনা মহাসড়কের রাজঘাট এলাকায়
অবস্থান নেন। এ সময় মহাসড়কে কোনো যানবাহন চলেনি। কোনো ট্রেনও চলাচল
করতে দেখা যায়নি। কর্মসূচি চলাকালে শ্রমিকেরা মহাসড়কের ওপর সমাবেশ করেন।
এতে ঐক্য পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও জেজেআইয়ের সিবিএ সভাপতি আহসান উল্লাহর
সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও জেজেআই সিবিএ সম্পাদক
হারুন-অর-রশিদ মল্লিক, কার্পেটিং জুট মিলসের সিবিএ সভাপতি জাহিদুল হোসেন
ওরফে লাল প্রমুখ। বক্তারা অবিলম্বে সরকার পাঁচ দফা দাবি না মানলে আরও কঠোর
আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন।
No comments