ভয়ঙ্কর নেশায় পথশিশুরা by আফরিন আপ্পি
পড়ন্ত
বিকাল। কয়েকটি পথশিশু গোল হয়ে বসে আছে হাইকোর্টের সামনে রাস্তার একপাশে।
সে জটলা থেকে ভেসে আসছে একটি গানের কলি। সুরেলা কণ্ঠে তারা গাইছে ‘নেশা
আমার পেশারে ভাই নেশা আমার পেশা’। কাছে যেতেই দেখা গেল, শুধু গান নয়- মাদক
নিচ্ছে এসব পথশিশু।
সেখানে দাঁড়িয়ে কয়েকটি পথশিশুর সঙ্গে কথা হয়। গোলগাল চেহারার একটি শিশু। ১১ বছর বয়সের শিশুটির নাম জনি। কীভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়লো সে। জানতে চাইলেই একগাল হেসে জানায়, তার নেশার হাতেখড়ি দুই বছর আগে। বাবা একজন রিকশাচালক। একদিন বাবার ফেলে দেয়া সিগারেটে কয়েকটি টান দিয়েছিল জনি। তারপর বাবার ফেলে দেয়া সিগারেটের শেষাংশে টানতে টানতেই নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সে। প্রথম প্রথম বাবার প্যাকেট থেকে সিগারেট এবং টাকা চুরি করেই চলতো তার নেশা। কিছুদিনের মধ্যেই সমবয়সী কয়েকজন নেশাগ্রস্তের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় তার। নেশা করতে তো টাকা লাগে, কীভাবে জোগাড় হয় সে টাকা? জনি হাসে। যখন যেভাবে পারি, জোগাড় করি। কখনও ল্যাংড়া ফকিরের গাড়ি ঠেলি, কখনও লেগুনায় হেলপারি করি, কখনও বা কমলাপুর-সদরঘাটে যাত্রীদের মাল টানি।
জটলায় যে ছেলেটি গান করছিল তার নাম নাজমুল। বয়স ১০ বছর। বাবার বাড়ি নরসিংদী হলেও কমলাপুর রেলস্টেশনেই তার বসবাস। কুলির কাজ করে পকেটে কিছু টাকা জমলেই নেশা তাকে টানতে থাকে। নেশা করতেই চলে এসেছে হাইকোর্টের সামনে। কেন সে নেশা করে জানতে চাইলে নাজমুল বলে, নেশা করতে ভালো লাগে। নেশা করলে শইলডা হালকা হালকা লাগে।
কমলাপুর রেলস্টেশনের প্লাটফরমে একটি থামের গোড়ায় মুখোমুখি বসেছিল কয়েকটি পথশিশু। পাশেই দাঁড়ানো লোকাল ট্রেন। সেখানে দিয়ে গিয়ে দেখা গেল এক ভয়াবহ দৃশ্য। ব্লেড দিয়ে হাত কাটছে একটি শিশু। সে কাটা অংশ দিয়ে বেরিয়ে আসছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। দুয়েক ফোঁটা ঝরেও পড়ছে হাত বেয়ে। গাট্টাগোট্টা ধরনের সে ছেলেটির নাম হাসান। বয়স ১৫ বছর। ব্লেড দিয়ে হাত কাটতে ব্যথা লাগে না? বলে, এটাও নেশার একটা অংশ। নেশা করার সময় ব্লেড দিয়ে হাত-পা কাটতে খুব মজা লাগে। হাসান ও তার পাশে বসা অন্য দুই পথশিশুর শরীরে ভয়ে গা শিউরে ওঠার মতো অসংখ্য দাগ। হাত-পা, পিঠ, ঘাড় কোথাও বাদ নেই। হাসানের পাশেই বসেছিল হাসিব। হাসানের ব্যবহৃত ব্লেডের অপেক্ষায়। হাসানের মতো সেও শরীরে দাগ কাটবে ব্লেড দিয়ে। হাসিবের বয়স ১২ বছর। কথা বলতে বলতেই হাসিব জানালো, তার শখের কথা। এ বয়সেই সেসব ধরনের মাদক নিয়েছে শরীরে।
শিশুস্বাস্থ্যের
ওপর মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ
বিশেষজ্ঞ ডা. মো. রশিদুল হক বলেন, মাদকের প্রভাবে শিশুরা ভয়াবহ মানসিক ও
শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। গাঁজার প্রভাবে লিভার ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমে কোনো মাদক গ্রহণ করলে নিডল (সুঁই)
শেয়ারিংয়ের কারণে সহজেই হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস, এইচআইভি ভাইরাস ছড়ায়। তিনি
বলেন, মাদক সেবনের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে মস্তিষ্কে এক ধরনের উদ্দীপনা সৃষ্টি
হয়। ভালো লাগা কাজ করে। যার ফলে শিশুরা খুব দ্রুত নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে।
তিনি জানান, ড্যান্ডির মূল উপাদান টলুইন। মাদকের তালিকায় থাকা এ টলুইন
অত্যন্ত ভয়াবহ। যা মানুষের যকৃত ও মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে।
জনি, নাজমুল ও কালুর মতো হাজার হাজার পথশিশুর দেখা মেলে রাজধানী ঢাকায়। যাদের বেশিরভাগই গাঁজা, ইয়াবা, ড্যান্ডি, ফেনসিডিল, পেথিড্রিনসহ নানা নেশাদ্রব্যে আসক্ত। দিন দিন বাড়ছে তাদের সংখ্যা। সরেজমিনে দেখা যায়, কমলাপুর রেলস্টেশন, হাইকোর্ট মাজার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, পলাশী মোড়, দোয়েল চত্বর, চানখারপুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল চত্বর এলাকায় সবচেয়ে বেশি তৎপর মাদকাসক্ত এসব পথশিশু। ভাগ্য বিড়ম্বিত পথশিশুদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে নানা কার্যক্রম। কিন্তু পথশিশুদের নেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, রাজধানী ঢাকায় পথশিশু রয়েছে প্রায় ২ লাখ। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পথশিশুদের পুনর্বাসনের জন্য চাইল্ড সেনসেটিভ সোশাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালে ৬টি ড্রপ ইন সেন্টারের মাধ্যমে নেশায় আসক্ত শিশুদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪ বছরে এসব ড্রপ ইন সেন্টারের মাধ্যমে ১৪ হাজার ৮৮৪ জন পথশিশুকে সামাজিক সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ৭৫৮ জন পথশিশুকে পরিবারে একত্রীকরণ করা হয়েছে। তবে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বরে।
পথশিশুদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মাদক পরিবহন ও সরবরাহকারী। রাজধানীতে কোমলমতি পথশিশুদের ব্যবহার করে মাদকব্যবসা পরিচালনা করে কিছু সিন্ডিকেট। লুঙ্গির আড়ালে, শার্ট-প্যান্টের পকেটে, কখনো বা বাদাম বিক্রি করার ছলে তারা মাদক বিক্রি করে। মাদক পরিবহনের কাজ করতে গিয়েও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে অনেক পথশিশু। কমলাপুরে রবিন নামে কুলির কাজ করা একটি পথশিশুকে মাদকবিক্রি করতে দেখা গেছে। পথশিশুদের পাশাপাশি মাদক সরবরাহে বড় একটি ভূমিকা পালন করে নারীরাও। এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মো. মারুফ হোসেন জানান, কোমলমতি শিশুদের বিপথে পরিচালনার মাধ্যমে কিছু লোক মাদক ব্যবসার মধ্যে ঘৃণ্য অপরাধ করছে। সেসব মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।
সেখানে দাঁড়িয়ে কয়েকটি পথশিশুর সঙ্গে কথা হয়। গোলগাল চেহারার একটি শিশু। ১১ বছর বয়সের শিশুটির নাম জনি। কীভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়লো সে। জানতে চাইলেই একগাল হেসে জানায়, তার নেশার হাতেখড়ি দুই বছর আগে। বাবা একজন রিকশাচালক। একদিন বাবার ফেলে দেয়া সিগারেটে কয়েকটি টান দিয়েছিল জনি। তারপর বাবার ফেলে দেয়া সিগারেটের শেষাংশে টানতে টানতেই নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সে। প্রথম প্রথম বাবার প্যাকেট থেকে সিগারেট এবং টাকা চুরি করেই চলতো তার নেশা। কিছুদিনের মধ্যেই সমবয়সী কয়েকজন নেশাগ্রস্তের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় তার। নেশা করতে তো টাকা লাগে, কীভাবে জোগাড় হয় সে টাকা? জনি হাসে। যখন যেভাবে পারি, জোগাড় করি। কখনও ল্যাংড়া ফকিরের গাড়ি ঠেলি, কখনও লেগুনায় হেলপারি করি, কখনও বা কমলাপুর-সদরঘাটে যাত্রীদের মাল টানি।
জটলায় যে ছেলেটি গান করছিল তার নাম নাজমুল। বয়স ১০ বছর। বাবার বাড়ি নরসিংদী হলেও কমলাপুর রেলস্টেশনেই তার বসবাস। কুলির কাজ করে পকেটে কিছু টাকা জমলেই নেশা তাকে টানতে থাকে। নেশা করতেই চলে এসেছে হাইকোর্টের সামনে। কেন সে নেশা করে জানতে চাইলে নাজমুল বলে, নেশা করতে ভালো লাগে। নেশা করলে শইলডা হালকা হালকা লাগে।
কমলাপুর রেলস্টেশনের প্লাটফরমে একটি থামের গোড়ায় মুখোমুখি বসেছিল কয়েকটি পথশিশু। পাশেই দাঁড়ানো লোকাল ট্রেন। সেখানে দিয়ে গিয়ে দেখা গেল এক ভয়াবহ দৃশ্য। ব্লেড দিয়ে হাত কাটছে একটি শিশু। সে কাটা অংশ দিয়ে বেরিয়ে আসছে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। দুয়েক ফোঁটা ঝরেও পড়ছে হাত বেয়ে। গাট্টাগোট্টা ধরনের সে ছেলেটির নাম হাসান। বয়স ১৫ বছর। ব্লেড দিয়ে হাত কাটতে ব্যথা লাগে না? বলে, এটাও নেশার একটা অংশ। নেশা করার সময় ব্লেড দিয়ে হাত-পা কাটতে খুব মজা লাগে। হাসান ও তার পাশে বসা অন্য দুই পথশিশুর শরীরে ভয়ে গা শিউরে ওঠার মতো অসংখ্য দাগ। হাত-পা, পিঠ, ঘাড় কোথাও বাদ নেই। হাসানের পাশেই বসেছিল হাসিব। হাসানের ব্যবহৃত ব্লেডের অপেক্ষায়। হাসানের মতো সেও শরীরে দাগ কাটবে ব্লেড দিয়ে। হাসিবের বয়স ১২ বছর। কথা বলতে বলতেই হাসিব জানালো, তার শখের কথা। এ বয়সেই সেসব ধরনের মাদক নিয়েছে শরীরে।
মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা |
জনি, নাজমুল ও কালুর মতো হাজার হাজার পথশিশুর দেখা মেলে রাজধানী ঢাকায়। যাদের বেশিরভাগই গাঁজা, ইয়াবা, ড্যান্ডি, ফেনসিডিল, পেথিড্রিনসহ নানা নেশাদ্রব্যে আসক্ত। দিন দিন বাড়ছে তাদের সংখ্যা। সরেজমিনে দেখা যায়, কমলাপুর রেলস্টেশন, হাইকোর্ট মাজার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, পলাশী মোড়, দোয়েল চত্বর, চানখারপুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শহীদ মিনার, ঢাকা মেডিকেল চত্বর এলাকায় সবচেয়ে বেশি তৎপর মাদকাসক্ত এসব পথশিশু। ভাগ্য বিড়ম্বিত পথশিশুদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে নানা কার্যক্রম। কিন্তু পথশিশুদের নেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, রাজধানী ঢাকায় পথশিশু রয়েছে প্রায় ২ লাখ। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পথশিশুদের পুনর্বাসনের জন্য চাইল্ড সেনসেটিভ সোশাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালে ৬টি ড্রপ ইন সেন্টারের মাধ্যমে নেশায় আসক্ত শিশুদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪ বছরে এসব ড্রপ ইন সেন্টারের মাধ্যমে ১৪ হাজার ৮৮৪ জন পথশিশুকে সামাজিক সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ৭৫৮ জন পথশিশুকে পরিবারে একত্রীকরণ করা হয়েছে। তবে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি শেষ হচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বরে।
পথশিশুদের মধ্যে কেউ কেউ আবার মাদক পরিবহন ও সরবরাহকারী। রাজধানীতে কোমলমতি পথশিশুদের ব্যবহার করে মাদকব্যবসা পরিচালনা করে কিছু সিন্ডিকেট। লুঙ্গির আড়ালে, শার্ট-প্যান্টের পকেটে, কখনো বা বাদাম বিক্রি করার ছলে তারা মাদক বিক্রি করে। মাদক পরিবহনের কাজ করতে গিয়েও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে অনেক পথশিশু। কমলাপুরে রবিন নামে কুলির কাজ করা একটি পথশিশুকে মাদকবিক্রি করতে দেখা গেছে। পথশিশুদের পাশাপাশি মাদক সরবরাহে বড় একটি ভূমিকা পালন করে নারীরাও। এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মো. মারুফ হোসেন জানান, কোমলমতি শিশুদের বিপথে পরিচালনার মাধ্যমে কিছু লোক মাদক ব্যবসার মধ্যে ঘৃণ্য অপরাধ করছে। সেসব মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।
No comments