জিয়ার নির্দেশে লালমাটিয়ায় প্লট দেয়া হয় তাহেরের পরিবারকে
তাহেরের
ফাঁসি ছিল একটা ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’। তবে এটা জিয়ার একক সিদ্ধান্ত ছিল
না। এর পেছনে সামরিক বাহিনীর সব কর্মকর্তারই সায় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের একজন
সেক্টর কমান্ডার তো দাবিই করেছিলেন, ফাঁসি না দিলে তিনি কোমরের বেল্ট খুলে
ফেলবেন, অর্থাৎ সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দেবেন। ওই সময় সেনাবাহিনীর কোন
কর্মকর্তা তাহেরের পক্ষ নিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন
আহমদ তার সদ্য প্রকাশিত ‘বিএনপি সময়-অসময়’ শীর্ষক বইতে এসব কথা লিখেছেন।
মহিউদ্দিন আহমদ আরও লিখেছেন, তাহেরের ফাঁসি নিয়ে জিয়ার মধ্যে অপরাধবোধ বা
মর্মবেদনা থাকতে পারে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তার আদেশে তাহেরের পরিবারের
জন্য ঢাকার লালমাটিয়ায় একটা আবাসিক প্লট বরাদ্দ করা হয়। তাহেরের স্ত্রী এবং
তাহেরের বড় ভাইয়ের স্ত্রীকে জিয়ার আদেশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে চাকরি
দেয়া হয়েছিল। তারা সেটি গ্রহণও করেছিলেন। তাহেরের বড় ভাই সার্জেন্ট (অব.)
আবু ইউসুফ সামরিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। চার বছর না
পেরোতেই আবু ইউসুফ ছাড়া পান। জাসদের সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবের ১০
বছরের সাজা হয়েছিল। তাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে চিকিৎসার
জন্য যেতে দেয়া হয়।
সরকারি খরচেই জার্মানিতে রবের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থায় রব খুশি ছিলেন না। বন থেকে ২৫শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৯) তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছে একটি চিঠি পাঠান। প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) এএসএম মোস্তাফিজুর রহমানকেও তিনি চিঠির অনুলিপি দেন। রব দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলাকালে ১৯শে ফেব্রুয়ারি (১৯৮০) এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রবের চিকিৎসার জন্য সরকারের পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
তাহেরের অনুজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং জাসদ-গণবাহিনীর ঢাকা নগরের কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের ১০ বছরের সাজা হয়েছিল। তিনিও সাজার মেয়াদ অর্ধেক ভোগ করে ছাড়া পান। জিয়ার সঙ্গে জাসদের একটা সমঝোতার ফলেই সবাইকে এক এক করে ছেড়ে দেয়া হয়। অস্ত্র আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল, তাদের অনেকেই সাধারণ ক্ষমা পেয়ে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন এবং জয়ী হন। আনোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ফিরে পান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে আওয়ামীবিরোধী ‘গোলাপি’ দলে যোগ দেন। পরে জিয়াপন্থিরা ‘গোলাপি’ দল ভেঙে ‘সাদা’ দল বানালে আনোয়ার সাদা দলে যোগ দেন এবং ওই দলের সমর্থনে সিন্ডিকেট নির্বাচনে অংশ নেন। ১৯৯৬ সালে হাওয়া ঘুরে গেলে তিনি আওয়ামীপন্থি নীল দলে নিজেকে সমর্পণ করেন। আনোয়ার যখন সাদা দলের সংগঠক হন, তাকে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক নেহাল করিম জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘যারা আপনার ভাইকে ফাঁসি দিল, আপনি তাদের সঙ্গে যান কিভাবে? আনোয়ার জবাব দিলেন, ‘অনেক কথা আছে, পরে বলব।’
জিয়াউর রহমানের যুদ্ধদিনের সাথী ছিলেন মেজর (পরে লে. জেনারেল, অবসরপ্রাপ্ত) মীর শওকত আলী। জিয়ার মৃত্যুর পর তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তার মতে, জিয়া ছিলেন স্বাধীনচেতা ও প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তার আশপাশে মৌমাছির মতো অনেক চাটুকারের সমাবেশ ঘটেছিল। কিন্তু জিয়া চাটুকারিতা একদম পছন্দ করতেন না। এ প্রসঙ্গে মীর শওকত আলীর একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে:
আমাদের জাতিগত স্বাধীনতা এখনো হয়নি। আমরা এখনো নিজেদের চেয়ে সাদা চামড়াদের বিশেষ খাতির করি। একজন ইউরোপিয়ান প্রেসিডেন্টকে দেখেন। তিনি নিজের ব্রিফকেস নিজে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠছেন। আমাদের এখানে দরজা খোলার জন্য চামচারা রীতিমতো কম্পিটিশন করে। আমাদের নেতা যাবেন, তার বক্তৃতার কপি আরেকজনের বগলে। তার সানগ্লাস আরেকজনের হাতে। স্কুলের বাচ্চারা সকাল থেকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লিডার বক্তৃতা দিতে যখন আসলেন, ততক্ষণে বাচ্চাগুলো রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। তাদের হাতের ফুল শুকিয়ে গেছে। নেতা দুর্নীতিবাজ হলেও তার লোকের অভাব হয় না। স্লোগান হয় ‘অমুক ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’। এই নেতা যখন স্টেজে দাঁড়ায়, সে নিজেও জানে না সে কী বলবে। তাকে আরেকজনে ফাইল খুলে দিতে হয়। বড়ই বিচিত্র যে, আমাদের নিতম্বের অবস্থানের ওপর আমাদের মানসম্মান নির্ধারিত হয়। চেয়ার নেওয়ার জন্য মারামারি দেখে এটাই মনে হয়। ইসরায়েলের কেবিনেটে দেখেন প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে মিনিস্টার প্রাইম মিনিস্টারের সামনের টেবিলে বসে পড়ছেন। আর আমাদের এখানে নেতার সামনে জড়সড় হয়ে থাকতে হয়। আমাদের এখানে এক ধরনের হীনমন্যতা আছে এবং স্বাধীন জাতির স্বাধীনতার অহংকারের জাগরণ এখনো হয়নি। দিস ইজ প্যাথেটিক অ্যান্ড ট্র্যাজিক। জিয়াউর রহমান আমাকে একদিন বলেছিলেন, মীর, যতদিন আমাদের দেশের দশ হাজার টাউট ও চামচা নিশ্চিহ্ন না হবে, ততদিন আমাদের কষ্ট থাকবে।
সরকারি খরচেই জার্মানিতে রবের চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থায় রব খুশি ছিলেন না। বন থেকে ২৫শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৯) তিনি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছে একটি চিঠি পাঠান। প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) এএসএম মোস্তাফিজুর রহমানকেও তিনি চিঠির অনুলিপি দেন। রব দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন। ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলাকালে ১৯শে ফেব্রুয়ারি (১৯৮০) এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রবের চিকিৎসার জন্য সরকারের পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
তাহেরের অনুজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং জাসদ-গণবাহিনীর ঢাকা নগরের কমান্ডার আনোয়ার হোসেনের ১০ বছরের সাজা হয়েছিল। তিনিও সাজার মেয়াদ অর্ধেক ভোগ করে ছাড়া পান। জিয়ার সঙ্গে জাসদের একটা সমঝোতার ফলেই সবাইকে এক এক করে ছেড়ে দেয়া হয়। অস্ত্র আইনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল, তাদের অনেকেই সাধারণ ক্ষমা পেয়ে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন এবং জয়ী হন। আনোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ফিরে পান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে আওয়ামীবিরোধী ‘গোলাপি’ দলে যোগ দেন। পরে জিয়াপন্থিরা ‘গোলাপি’ দল ভেঙে ‘সাদা’ দল বানালে আনোয়ার সাদা দলে যোগ দেন এবং ওই দলের সমর্থনে সিন্ডিকেট নির্বাচনে অংশ নেন। ১৯৯৬ সালে হাওয়া ঘুরে গেলে তিনি আওয়ামীপন্থি নীল দলে নিজেকে সমর্পণ করেন। আনোয়ার যখন সাদা দলের সংগঠক হন, তাকে সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক নেহাল করিম জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘যারা আপনার ভাইকে ফাঁসি দিল, আপনি তাদের সঙ্গে যান কিভাবে? আনোয়ার জবাব দিলেন, ‘অনেক কথা আছে, পরে বলব।’
জিয়াউর রহমানের যুদ্ধদিনের সাথী ছিলেন মেজর (পরে লে. জেনারেল, অবসরপ্রাপ্ত) মীর শওকত আলী। জিয়ার মৃত্যুর পর তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তার মতে, জিয়া ছিলেন স্বাধীনচেতা ও প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। তার আশপাশে মৌমাছির মতো অনেক চাটুকারের সমাবেশ ঘটেছিল। কিন্তু জিয়া চাটুকারিতা একদম পছন্দ করতেন না। এ প্রসঙ্গে মীর শওকত আলীর একটি লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে:
আমাদের জাতিগত স্বাধীনতা এখনো হয়নি। আমরা এখনো নিজেদের চেয়ে সাদা চামড়াদের বিশেষ খাতির করি। একজন ইউরোপিয়ান প্রেসিডেন্টকে দেখেন। তিনি নিজের ব্রিফকেস নিজে নিয়ে গাড়ির দরজা খুলে গাড়িতে উঠছেন। আমাদের এখানে দরজা খোলার জন্য চামচারা রীতিমতো কম্পিটিশন করে। আমাদের নেতা যাবেন, তার বক্তৃতার কপি আরেকজনের বগলে। তার সানগ্লাস আরেকজনের হাতে। স্কুলের বাচ্চারা সকাল থেকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লিডার বক্তৃতা দিতে যখন আসলেন, ততক্ষণে বাচ্চাগুলো রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেছে। তাদের হাতের ফুল শুকিয়ে গেছে। নেতা দুর্নীতিবাজ হলেও তার লোকের অভাব হয় না। স্লোগান হয় ‘অমুক ভাই এগিয়ে চলো, আমরা আছি তোমার সাথে’। এই নেতা যখন স্টেজে দাঁড়ায়, সে নিজেও জানে না সে কী বলবে। তাকে আরেকজনে ফাইল খুলে দিতে হয়। বড়ই বিচিত্র যে, আমাদের নিতম্বের অবস্থানের ওপর আমাদের মানসম্মান নির্ধারিত হয়। চেয়ার নেওয়ার জন্য মারামারি দেখে এটাই মনে হয়। ইসরায়েলের কেবিনেটে দেখেন প্রাইম মিনিস্টারের সঙ্গে আলোচনা করতে করতে মিনিস্টার প্রাইম মিনিস্টারের সামনের টেবিলে বসে পড়ছেন। আর আমাদের এখানে নেতার সামনে জড়সড় হয়ে থাকতে হয়। আমাদের এখানে এক ধরনের হীনমন্যতা আছে এবং স্বাধীন জাতির স্বাধীনতার অহংকারের জাগরণ এখনো হয়নি। দিস ইজ প্যাথেটিক অ্যান্ড ট্র্যাজিক। জিয়াউর রহমান আমাকে একদিন বলেছিলেন, মীর, যতদিন আমাদের দেশের দশ হাজার টাউট ও চামচা নিশ্চিহ্ন না হবে, ততদিন আমাদের কষ্ট থাকবে।
No comments