সচিবালয়ের আন্দোলন ও ১৯৯৬ সালের জনতার মঞ্চ by এমাজউদ্দীন আহমদ
প্রশাসনের
প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় পর্যন্ত আন্দোলনের উত্তপ্ত ক্ষেত্রে রূপান্তরিত
হয়েছে। বেতনবৈষম্যকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সচিবালয়ের ভেতরে ও
বাইরে। বিসিএসের ২৮টি ক্যাডারের মধ্যে শুধু প্রশাসন ও পররাষ্ট্র ছাড়া
অন্যরা বেতনবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আন্দোলন শুরু করেছেন। এর
সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তারাও। প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য
ক্যাডারের কর্মকর্তারা সচিবালয়ের অভ্যন্তরে কাজ করছেন কালো ব্যাজ ধারণ
করে। এই অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হলে সরকারের কর্মকাণ্ডে বিরূপ প্রভাব
সৃষ্টি হবে। দেশে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারভুক্ত মিলিয়ে রয়েছেন প্রায় চার লাখ
১০ হাজার কর্মকর্তা। এর মধ্যে প্রশাসন ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে রয়েছেন প্রায়
ছয় হাজারের মতো এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তা রয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ। বেতন
স্কেলে সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল পুনর্বহাল এবং ক্যাডার ও নন-ক্যাডার
বৈষম্য নিরসনসহ কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলছেন প্রকৌশলী, কৃষিবিদ,
চিকিৎসক ও অন্য ২৬টি ক্যাডারের বিসিএস কর্মকর্তারা। অন্য কথায়, বাংলাদেশের
বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে গড়ে তুলছেন তীব্র এক আন্দোলন।
সরকার এই আন্দোলন দমনের লক্ষ্যে শক্তিশালী উদ্যোগ এখনো নেয়নি। কিন্তু দমন
করার কোনো বিকল্প আছে কি? এর কোনো বিকল্প নেই, তবে এর একটি অতীত আছে। এ
জন্য এই আন্দোলনের যেমন রয়েছে তীব্র এক গতি, তেমনি এই আন্দোলন দমনের গরজও
বড্ড বেশি। অতীতটা অনেকটা সেই কল্পকাহিনী, যা নররূপী দানব ফ্রাঙ্কেস্টাইনের
মতোই। বাংলাদেশে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সেই ‘জনতার মঞ্চে’
ফেসলেস আমলাদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যককে আহ্বান করে রাজনীতির সাথে সরকারি
কর্মকর্তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলনে একাত্ম করার ‘অশুভ’ পদক্ষেপের কাহিনী।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনিক নেতৃত্বের মধ্যে যে পার্থক্য সে সম্পর্কে প্রত্যেক সচেতন নাগরিক সজ্ঞাত। নীতিনির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তা বাস্তবায়ন করেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। রাজনৈতিক ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থানকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিকনির্দেশ করেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কর্মচঞ্চল থেকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। সুষ্ঠু নীতির জন্য যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা তা সংগ্রহ করেন, সমন্বয় করেন, সংরক্ষণ করেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি একান্তভাবে অনুগত থেকে সহযোগিতা করেন। রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে মানবদেহের সাথে তুলনা করলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেকটা মস্তিষ্কের মতো এবং প্রশাসন হাত, পা, নাক, কান, চোখের মতো। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রদীপের সাথে তুলনা করলে প্রশাসন অনেকটা পিলসুজের মতো। অপরিহার্য বটে, কিন্তু মুখ্য নয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ বটে; কিন্তু মৌল নিয়ামক নয়। গণতন্ত্রে প্রশাসন রাজনৈতিক নেতৃত্বের আজ্ঞাবহ মাত্র। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে প্রতিনিয়ত অধোবদন।
গণতন্ত্র এক অর্থে দলীয় শাসন। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, শাসন পরিচালনার দায়িত্ব সে দলের ওপর ন্যস্ত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে সে দল শাসন পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করে। এ দিক থেকে বলা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনশীল। প্রশাসন কিন্তু স্থায়িত্বের প্রতীক। স্থায়ীভাবে নিয়োজিত এবং প্রশিক্ষিত প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়েও ঝড়ের মুখে স্থায়িত্বের খুঁটি হিসেবে টিকে থাকেন। মোট কথা, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও অবস্থান ভিন্নমুখী। একটি দৃশ্যমান, অন্যটি কিন্তু নিয়মপদ্ধতির আড়ালে ঢাকা। একটি গতিশীল অন্যটি কিন্তু রুটিনের ছকে বাঁধা। একটি জাতীয়, অন্যটি কিন্তু দাফতরিক অথবা বিভাগীয়। একটি নির্দেশ দেয়, অন্যটির দায়িত্ব হলো নির্দেশ পালন করা। একটি সৃজনশীলতায় সচকিত, অন্যটি পেশাদারিত্ব অর্জনের গৌরবে তৃপ্ত। কোনো বিচ্যুতি ঘটলে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জবাবদিহি করার জন্য তৈরি থাকতে হয়। প্রশাসন কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের আড়ালে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকা দিতে পারে।
ভিন্ন প্রকৃতির হয়েও গণতন্ত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসন এক ঘনিষ্ঠ সূত্রে আবদ্ধ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে অক্ষুণœ রেখে অথচ দু’টিকে স্বতন্ত্র অবস্থানে স্থাপন করতে হয়। দুয়ের সুষম সম্পর্ক বিনষ্ট হলে দেশের শাসন-প্রশাসনে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক নর্ম বিধ্বস্ত হয়। শাসন-প্রশাসনে ষড়যন্ত্র বাসা বাঁধে। দলীয় চেতনা মুখ্য হয়ে ওঠে। কর্মকর্তাদের মধ্যে বিদ্যমান স্বাতন্ত্র্য অবলুপ্ত হয়ে সরকার এক ফ্যাসিস্ট চরিত্র ধারন করে। দেশে গণতন্ত্রের কাঠামো বিদ্যমান থাকলেও ওই কাঠামোয় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ফ্যাসিবাদী স্লোগান- এক দেশ, এক জাতি, এক দল, এক নেতা। চূড়ান্ত পর্যায়ে গণতন্ত্র ওই সমাজ থেকে নির্বাসিত হয়।
এত কথা বলা হলো এ কারণে যে, আজ বাংলাদেশের সচিবালয়ে যে আন্দোলন গতিশীল রয়েছে এবং এই আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য সরকারের নির্মম ষড়যন্ত্র যেভাবে প্রসারিত, তার মূল নিহিত রয়েছে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণের সামনে আজকের ক্ষমতাশ্রয়ী ক্ষমতাসীনদের ‘জনতার মঞ্চে’। ক্ষমতালাভের উদগ্র কামনায় তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণার জন্য নির্মিত এই মঞ্চে আহ্বান করে ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবহারবিদ-প্রকৌশলী, কৃষিবিদ-চিকিৎসক, শ্রমজীবী, সংস্কৃতিসেবী, বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক, এমনকি সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিরোধী দলের অবিবেচনাপ্রসূত ডাকে সাড়া দিয়ে জনতার মঞ্চে এসে উপস্থিত হন বেশ কিছুসংখ্যক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ‘ব্যুরোক্র্যাটিক’ নর্মকে দুমড়ে মুচড়ে, এতদিনের গড়া প্রশাসন ব্যবস্থার সব নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে, একেক জন খুদে রাজনীতিকের অবয়বে, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে।
এ ক্ষেত্রে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পরে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারপ্রধানের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রশাসন ছেড়ে রাজনৈতিক নেতায় রূপান্তরিত হয়েছেন এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক- উভয় ক্ষেত্রের সুবিধা উপভোগ করে এবং (যেহেতু তিনি উভয় ক্ষেত্রের দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত) দুই দিকেই ছড়ি ঘুরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়কে দেশের প্রধান শক্তিকেন্দ্রে পরিণত করেছেন। এই শক্তিকেন্দ্রই আজ বাংলাদেশের একধরনের ভাগ্যনিয়ন্তা। দুই ক্ষেত্র থেকে যা কিছু লাভ করা সম্ভব, তা তিনি এবং ‘জনতার মঞ্চে’ আরোহণকারীরা তার সহযোগিতায় লাভ করেছেন। শক্তিমত্তার দাপটে প্রশাসনের সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত রেখেছেন।
আজকের বাংলাদেশে যেসব সমস্যা আজ বিষধর সাপের মতো ফণা উদ্যত করে রয়েছে, তাদের বেশির ভাগের মূল তাই চিহ্নিত করা যায় ওই ‘জনতার মঞ্চ’ নির্মাণের অর্বাচীনতায়। বিভক্ত হয়েছে সমাজ এবং সমাজের প্রায় সব শ্রেণীর পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা। বিভক্ত আজ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। কোনো উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এমনটি হতে কখনো দেখা যায়নি। যে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জাতীয় দুর্যোগের দিনেও স্থায়িত্বের প্রতীক হিসেবে, সমাজে নিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে, ঝড়ের মুখেও জাতীয় স্বার্থ এবং জনস্বার্থের জাহাজটি নিরাপদে নোঙর করেছেন অতীতে, তারাও আজ বিভ্রান্তির মধ্যে। এই অবস্থা শুধু অনাকাক্সিক্ষত নয়, জাতীয় স্বার্থের পুরোপুরি পরিপন্থী।
‘জনতার মঞ্চে’র কর্মকর্তাদেরই একাংশ সচিবালয়ের সাধারণ আন্দোলনকে, তাদের রুটি-রুজির এই দাবিকে রাজনৈতিক আন্দোরন রূপে চিহ্নিত করে, স্বল্প বেতনের কর্মচারীদের জীবনে টেনে এনেছেন এক অভিশাপ। কারণ তারাও রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে কোনো দ্বিধা করেননি। অফিসের টাইমিং তাদেরই পরামর্শে পরিবর্তন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভাবখানা, উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপের মতো উন্নত বাংলাদেশ সমাজে পাঁচ দিনের বেশি কাজ করবেন কেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা? কেন তাদের প্রয়োজন হবে অত বেশি অর্থের? প্রধানমন্ত্রী এসব স্বার্থান্বেষীর হাতে প্রায় বন্দী। নিজের এবং নিজের আত্মীয়-স্বজনের স্মৃতি রক্ষার্থে হাজার কোটি ব্যয় করলেও এসব ‘নিম্নস্তরের’ কর্মচারীদের জন্য কোনো ভাবনা তিনি ভাবতে পারেন না, যা তাদের প্রাপ্য। অর্থাৎ ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর দন্তনখর তারা আঁচ করুক। দেখুক, আন্দোলনে যাওয়ার মজাটা।
ক’দিন আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক দুঃখ করে বলেছিলেন, মাত্র দু-একজনের জন্য বাংলাদেশ ব্যুরোক্র্যাসির মূল যেভাবে শিথিল হয়েছে, ব্যুরোক্র্যাসির মর্মবাণী যেভাবে অপমানিত হয়েছে তার তুলনা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান এ সম্পর্কে একবার উক্তি করেছিলেন বটে; কিন্তু এই নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে তিনি কিছুই করেননি। কোনো কোনো সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ‘সুয়োমটো’ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও এমন স্বার্থপরদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। অথচ ‘জনতার মঞ্চে’র ওই পদক্ষেপ দেশের রাজনীতিকে করেছে নীতিহীন এবং দরিদ্র, এবং প্রশাসনকে করেছে দায়িত্বহীন ও পক্ষপাতপূর্ণ। আইনের শাসনের কথা বলা হয়; কিন্তু আইনের শাসনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে এখনো কেউ তেমন সোচ্চার হয়ে ওঠেননি।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনিক নেতৃত্বের মধ্যে যে পার্থক্য সে সম্পর্কে প্রত্যেক সচেতন নাগরিক সজ্ঞাত। নীতিনির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তা বাস্তবায়ন করেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। রাজনৈতিক ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থানকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিকনির্দেশ করেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কর্মচঞ্চল থেকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। সুষ্ঠু নীতির জন্য যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা তা সংগ্রহ করেন, সমন্বয় করেন, সংরক্ষণ করেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি একান্তভাবে অনুগত থেকে সহযোগিতা করেন। রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে মানবদেহের সাথে তুলনা করলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেকটা মস্তিষ্কের মতো এবং প্রশাসন হাত, পা, নাক, কান, চোখের মতো। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রদীপের সাথে তুলনা করলে প্রশাসন অনেকটা পিলসুজের মতো। অপরিহার্য বটে, কিন্তু মুখ্য নয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ বটে; কিন্তু মৌল নিয়ামক নয়। গণতন্ত্রে প্রশাসন রাজনৈতিক নেতৃত্বের আজ্ঞাবহ মাত্র। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে প্রতিনিয়ত অধোবদন।
গণতন্ত্র এক অর্থে দলীয় শাসন। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, শাসন পরিচালনার দায়িত্ব সে দলের ওপর ন্যস্ত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে সে দল শাসন পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করে। এ দিক থেকে বলা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনশীল। প্রশাসন কিন্তু স্থায়িত্বের প্রতীক। স্থায়ীভাবে নিয়োজিত এবং প্রশিক্ষিত প্রশাসনিক কর্মকর্তারা রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়েও ঝড়ের মুখে স্থায়িত্বের খুঁটি হিসেবে টিকে থাকেন। মোট কথা, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও অবস্থান ভিন্নমুখী। একটি দৃশ্যমান, অন্যটি কিন্তু নিয়মপদ্ধতির আড়ালে ঢাকা। একটি গতিশীল অন্যটি কিন্তু রুটিনের ছকে বাঁধা। একটি জাতীয়, অন্যটি কিন্তু দাফতরিক অথবা বিভাগীয়। একটি নির্দেশ দেয়, অন্যটির দায়িত্ব হলো নির্দেশ পালন করা। একটি সৃজনশীলতায় সচকিত, অন্যটি পেশাদারিত্ব অর্জনের গৌরবে তৃপ্ত। কোনো বিচ্যুতি ঘটলে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জবাবদিহি করার জন্য তৈরি থাকতে হয়। প্রশাসন কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের আড়ালে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকা দিতে পারে।
ভিন্ন প্রকৃতির হয়েও গণতন্ত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসন এক ঘনিষ্ঠ সূত্রে আবদ্ধ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে অক্ষুণœ রেখে অথচ দু’টিকে স্বতন্ত্র অবস্থানে স্থাপন করতে হয়। দুয়ের সুষম সম্পর্ক বিনষ্ট হলে দেশের শাসন-প্রশাসনে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। গণতান্ত্রিক নর্ম বিধ্বস্ত হয়। শাসন-প্রশাসনে ষড়যন্ত্র বাসা বাঁধে। দলীয় চেতনা মুখ্য হয়ে ওঠে। কর্মকর্তাদের মধ্যে বিদ্যমান স্বাতন্ত্র্য অবলুপ্ত হয়ে সরকার এক ফ্যাসিস্ট চরিত্র ধারন করে। দেশে গণতন্ত্রের কাঠামো বিদ্যমান থাকলেও ওই কাঠামোয় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ফ্যাসিবাদী স্লোগান- এক দেশ, এক জাতি, এক দল, এক নেতা। চূড়ান্ত পর্যায়ে গণতন্ত্র ওই সমাজ থেকে নির্বাসিত হয়।
এত কথা বলা হলো এ কারণে যে, আজ বাংলাদেশের সচিবালয়ে যে আন্দোলন গতিশীল রয়েছে এবং এই আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য সরকারের নির্মম ষড়যন্ত্র যেভাবে প্রসারিত, তার মূল নিহিত রয়েছে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণের সামনে আজকের ক্ষমতাশ্রয়ী ক্ষমতাসীনদের ‘জনতার মঞ্চে’। ক্ষমতালাভের উদগ্র কামনায় তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক প্রচারণার জন্য নির্মিত এই মঞ্চে আহ্বান করে ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবহারবিদ-প্রকৌশলী, কৃষিবিদ-চিকিৎসক, শ্রমজীবী, সংস্কৃতিসেবী, বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক, এমনকি সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিরোধী দলের অবিবেচনাপ্রসূত ডাকে সাড়া দিয়ে জনতার মঞ্চে এসে উপস্থিত হন বেশ কিছুসংখ্যক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ‘ব্যুরোক্র্যাটিক’ নর্মকে দুমড়ে মুচড়ে, এতদিনের গড়া প্রশাসন ব্যবস্থার সব নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে, একেক জন খুদে রাজনীতিকের অবয়বে, লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে।
এ ক্ষেত্রে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পরে অতি অল্প সময়ের মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারপ্রধানের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রশাসন ছেড়ে রাজনৈতিক নেতায় রূপান্তরিত হয়েছেন এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক- উভয় ক্ষেত্রের সুবিধা উপভোগ করে এবং (যেহেতু তিনি উভয় ক্ষেত্রের দুর্বলতা সম্পর্কে অবহিত) দুই দিকেই ছড়ি ঘুরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়কে দেশের প্রধান শক্তিকেন্দ্রে পরিণত করেছেন। এই শক্তিকেন্দ্রই আজ বাংলাদেশের একধরনের ভাগ্যনিয়ন্তা। দুই ক্ষেত্র থেকে যা কিছু লাভ করা সম্ভব, তা তিনি এবং ‘জনতার মঞ্চে’ আরোহণকারীরা তার সহযোগিতায় লাভ করেছেন। শক্তিমত্তার দাপটে প্রশাসনের সবাইকে ভীতসন্ত্রস্ত রেখেছেন।
আজকের বাংলাদেশে যেসব সমস্যা আজ বিষধর সাপের মতো ফণা উদ্যত করে রয়েছে, তাদের বেশির ভাগের মূল তাই চিহ্নিত করা যায় ওই ‘জনতার মঞ্চ’ নির্মাণের অর্বাচীনতায়। বিভক্ত হয়েছে সমাজ এবং সমাজের প্রায় সব শ্রেণীর পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা। বিভক্ত আজ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। কোনো উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এমনটি হতে কখনো দেখা যায়নি। যে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জাতীয় দুর্যোগের দিনেও স্থায়িত্বের প্রতীক হিসেবে, সমাজে নিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে, ঝড়ের মুখেও জাতীয় স্বার্থ এবং জনস্বার্থের জাহাজটি নিরাপদে নোঙর করেছেন অতীতে, তারাও আজ বিভ্রান্তির মধ্যে। এই অবস্থা শুধু অনাকাক্সিক্ষত নয়, জাতীয় স্বার্থের পুরোপুরি পরিপন্থী।
‘জনতার মঞ্চে’র কর্মকর্তাদেরই একাংশ সচিবালয়ের সাধারণ আন্দোলনকে, তাদের রুটি-রুজির এই দাবিকে রাজনৈতিক আন্দোরন রূপে চিহ্নিত করে, স্বল্প বেতনের কর্মচারীদের জীবনে টেনে এনেছেন এক অভিশাপ। কারণ তারাও রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে কোনো দ্বিধা করেননি। অফিসের টাইমিং তাদেরই পরামর্শে পরিবর্তন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভাবখানা, উত্তর আমেরিকা বা ইউরোপের মতো উন্নত বাংলাদেশ সমাজে পাঁচ দিনের বেশি কাজ করবেন কেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা? কেন তাদের প্রয়োজন হবে অত বেশি অর্থের? প্রধানমন্ত্রী এসব স্বার্থান্বেষীর হাতে প্রায় বন্দী। নিজের এবং নিজের আত্মীয়-স্বজনের স্মৃতি রক্ষার্থে হাজার কোটি ব্যয় করলেও এসব ‘নিম্নস্তরের’ কর্মচারীদের জন্য কোনো ভাবনা তিনি ভাবতে পারেন না, যা তাদের প্রাপ্য। অর্থাৎ ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর দন্তনখর তারা আঁচ করুক। দেখুক, আন্দোলনে যাওয়ার মজাটা।
ক’দিন আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক দুঃখ করে বলেছিলেন, মাত্র দু-একজনের জন্য বাংলাদেশ ব্যুরোক্র্যাসির মূল যেভাবে শিথিল হয়েছে, ব্যুরোক্র্যাসির মর্মবাণী যেভাবে অপমানিত হয়েছে তার তুলনা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান এ সম্পর্কে একবার উক্তি করেছিলেন বটে; কিন্তু এই নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে তিনি কিছুই করেননি। কোনো কোনো সময়ে সুপ্রিম কোর্ট ‘সুয়োমটো’ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও এমন স্বার্থপরদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গৃহীত হয়নি। অথচ ‘জনতার মঞ্চে’র ওই পদক্ষেপ দেশের রাজনীতিকে করেছে নীতিহীন এবং দরিদ্র, এবং প্রশাসনকে করেছে দায়িত্বহীন ও পক্ষপাতপূর্ণ। আইনের শাসনের কথা বলা হয়; কিন্তু আইনের শাসনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের সম্পর্কে এখনো কেউ তেমন সোচ্চার হয়ে ওঠেননি।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments