বিএনপির আশাবাদ by আবদুল লতিফ মন্ডল
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে
শাসক দল আওয়ামী লীগের বেপরোয়া প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের সন্ত্রাসী
কর্মকাণ্ড যথা- বোমা বিস্ফোরণ, ভোটকেন্দ্র দখল, বিএনপি প্রার্থীর
এজেন্টদের ভোট কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেয়া বা কেন্দ্র থেকে জোর করে বের করে
দেয়া, জাল ভোট প্রদান ছাড়াও আইনশৃংখলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা ও সর্বোপরি
নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতার কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সরকারবিরোধী
জাতীয় সংসদের বাইরের দল দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনের
ফল প্রত্যাখ্যান এবং সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করলেও দলটি
নির্বাচনে তাদের রাজনৈতিক বিজয় হয়েছে বলে দাবি করেছে। এর চেয়ে বড় কথা,
২৩৪টি মেয়র পদে নির্বাচনে কম-বেশি ১০ শতাংশ পদে জয়ী হলেও দলটির চেয়ারপারসন
খালেদা জিয়া সম্প্র্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ
নির্বাচনের মাধ্যমে খুব শিগগিরই সরকারের পরিবর্তন হবে। যেখানে ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগ তাদের বর্তমান মেয়াদ পূর্ণ করার আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালের আগে
জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সম্ভাবনা নেই বলে একাধিকবার
সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সেখানে বিএনপির চেয়ারপারসনের ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও
নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে খুব শিগগিরই সরকারের পরিবর্তন হবে’- এরূপ
জোরালো আশাবাদের ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক মহল ও দেশবাসীর মনে স্বাভাবিকভাবেই
প্রশ্ন উঠতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনায় যাওয়ার আগে দেখা যাক, বিএনপির এই দুই শীর্ষ নেতা কি বলেছেন। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, এ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির বড় বিজয় হয়েছে। কারণ দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা দিয়ে সরকার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, সে অবস্থা থেকে তারা বেরিয়ে এসে জনগণের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছেন। তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পেরেছিলেন। সেটা একটা বড় বিজয়। আরেকটি বিজয় হচ্ছে- সরকার যে জনবিচ্ছিন্ন সেটা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের ফ্যাসিবাদী চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। পরদিন ১ জানুয়ারি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে খালেদা জিয়া বলেছেন, খুব শিগগিরই দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের বিদায় হবে।
বিএনপি ছাড়াও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করেছে। জাতীয় পার্টির নেতারা আরও বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয়, পৌরসভা নির্বাচনে এ সত্যটি আরও এক দফা প্রমাণিত হল।
এটা সত্য যে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর বিকাশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই- সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। কারণ কেবল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন, সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই হোক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের নজির বেশি নেই। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বপ্ন স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে। আশ্রয় নেয় ষড়যন্ত্র ও ভয়ভীতির। কোনো কোনো আসনে বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ফলে ১১টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। নির্বাচন কমিশন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। সংসদের মোট ৩০০ আসনের ২৯৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কমিশন কর্তৃক বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পরবর্তী ১৫ বছর অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকরা প্রথমে তাদের ক্ষমতা দখলকে তথাকথিত বৈধতা দেয়ার জন্য ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে নির্বাচন কমিশন ও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রজাতন্ত্রের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় রায় নিজেদের পক্ষে নেন। এরপর তারা বেসামরিক লেবাস পরে যেসব সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন, সেগুলোর ফলাফল ছিল পূর্বনির্ধারিত। নির্বাচনের ফলাফল আগে থেকেই ছকে বাঁধা থাকায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তা কোনোরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি। আর এ ধরনের পূর্বনির্ধারিত প্রহসনের নির্বাচনগুলোর ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়।
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের গণদাবির মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয় এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। তার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়, যা বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে জোরদার করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালের ফেব্র“য়ারিতে একদলীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সপ্তম, ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের অষ্টম এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম সংসদ নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতার জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়। এসব নির্বাচন পরিচালনায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। তবে ২০০৪ সালে বিএনপির শাসনকালে ঢাকা-১০ আসনে উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয় এবং বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক আলী ফালু নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচিত ঘোষিত হন।
নবম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে (২০০৯-১৩) ২০১২ সালের প্রথমদিকে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান নির্বাচন কমিশন ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, মার্চ-এপ্রিলে উপজেলা নির্বাচন, চলতি বছর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং সদ্য অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়েছে।
এখন নিবন্ধের মূল বিষয় অর্থাৎ ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে খুব শিগগিরই সরকারের পরিবর্তন হবে’- বিএনপির চেয়ারপারসনের এমন আশাবাদ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের-আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসযোগ্য আশা প্রতিফলন না ঘটায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহসহ প্রায় সারা গণতান্ত্রিক বিশ্ব হতাশা প্রকাশ করে এবং বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি ভারত ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন সমর্থন করলেও তারা একই সঙ্গে দেশে রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শেখ হাসিনার সরকারকে পরামর্শ দেয়। এতে সরকার এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এ নাজুক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ জানুয়ারি গণভবনে নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে একাদশ সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। দুঃখের বিষয় কয়েক মাস যেতে না যেতেই তিনি তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন এবং তার সরকারের মেয়াদ শেষে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এ অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগ সরে আসছে কিনা এমন খবর জানা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ এবং জাতিসংঘ বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকুক ভারতের বর্তমান সরকারও চায়। এসব কারণেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশম সংসদ নির্বাচনের পরপরই দেয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে আগাম নির্বাচনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। তাছাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও পৌরসভা নির্বাচনে দলের সাফল্য আওয়ামী লীগকে আগাম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে উৎসাহিত করে তুলতে পারে। পদ্মা সেতু নির্মাণসহ সারা দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে গৃহীত কার্যক্রম এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে অভাবিত সাফল্য বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা বহু পরিমাণে বাড়িয়েছে। আগাম নির্বাচন দিয়ে এ জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে উদ্যোগী হতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, জনগণ চায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত হোক একটি জাতীয় সরকার। জাতীয় ও স্থানীয় সব পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হোক নির্ভেজাল গণতন্ত্র। ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র পচে গেছে’ মর্মে বিদেশী মিডিয়ায় যে খবর প্রকাশিত হয় তার অবসান হোক। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনায় যাওয়ার আগে দেখা যাক, বিএনপির এই দুই শীর্ষ নেতা কি বলেছেন। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, এ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির বড় বিজয় হয়েছে। কারণ দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও মিথ্যা মামলা দিয়ে সরকার যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, সে অবস্থা থেকে তারা বেরিয়ে এসে জনগণের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছেন। তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে পেরেছিলেন। সেটা একটা বড় বিজয়। আরেকটি বিজয় হচ্ছে- সরকার যে জনবিচ্ছিন্ন সেটা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের ফ্যাসিবাদী চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। পরদিন ১ জানুয়ারি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে খালেদা জিয়া বলেছেন, খুব শিগগিরই দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের বিদায় হবে।
বিএনপি ছাড়াও নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করেছে। জাতীয় পার্টির নেতারা আরও বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যে সম্ভব নয়, পৌরসভা নির্বাচনে এ সত্যটি আরও এক দফা প্রমাণিত হল।
এটা সত্য যে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও এর বিকাশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই- সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই অনুষ্ঠিত হোক। কারণ কেবল অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন, সে নির্বাচন জাতীয় বা স্থানীয় যে পর্যায়েই হোক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের নজির বেশি নেই। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের স্বপ্ন স্বাধীনতার ঊষালগ্নেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও প্রশাসনযন্ত্রকে ব্যবহার করে। আশ্রয় নেয় ষড়যন্ত্র ও ভয়ভীতির। কোনো কোনো আসনে বিরোধী প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ফলে ১১টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। নির্বাচন কমিশন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়। সংসদের মোট ৩০০ আসনের ২৯৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের কমিশন কর্তৃক বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পরবর্তী ১৫ বছর অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী সামরিক শাসকরা প্রথমে তাদের ক্ষমতা দখলকে তথাকথিত বৈধতা দেয়ার জন্য ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে নির্বাচন কমিশন ও এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত প্রজাতন্ত্রের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় রায় নিজেদের পক্ষে নেন। এরপর তারা বেসামরিক লেবাস পরে যেসব সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন, সেগুলোর ফলাফল ছিল পূর্বনির্ধারিত। নির্বাচনের ফলাফল আগে থেকেই ছকে বাঁধা থাকায় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তা কোনোরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি। আর এ ধরনের পূর্বনির্ধারিত প্রহসনের নির্বাচনগুলোর ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়।
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের গণদাবির মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয় এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। তার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপির শাসনামলে ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়, যা বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে জোরদার করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যোগ দেয় জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালের ফেব্র“য়ারিতে একদলীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সপ্তম, ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের অষ্টম এবং ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম সংসদ নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতার জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়। এসব নির্বাচন পরিচালনায় সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। তবে ২০০৪ সালে বিএনপির শাসনকালে ঢাকা-১০ আসনে উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয় এবং বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক আলী ফালু নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচিত ঘোষিত হন।
নবম সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে (২০০৯-১৩) ২০১২ সালের প্রথমদিকে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান নির্বাচন কমিশন ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, মার্চ-এপ্রিলে উপজেলা নির্বাচন, চলতি বছর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং সদ্য অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়েছে।
এখন নিবন্ধের মূল বিষয় অর্থাৎ ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে খুব শিগগিরই সরকারের পরিবর্তন হবে’- বিএনপির চেয়ারপারসনের এমন আশাবাদ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। দশম সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় এবং এতে জনগণের-আকাঙ্ক্ষার বিশ্বাসযোগ্য আশা প্রতিফলন না ঘটায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহসহ প্রায় সারা গণতান্ত্রিক বিশ্ব হতাশা প্রকাশ করে এবং বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি ভারত ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন সমর্থন করলেও তারা একই সঙ্গে দেশে রাজনৈতিক ঐকমত্যের মাধ্যমে আরেকটি সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে শেখ হাসিনার সরকারকে পরামর্শ দেয়। এতে সরকার এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এ নাজুক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬ জানুয়ারি গণভবনে নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে একাদশ সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। দুঃখের বিষয় কয়েক মাস যেতে না যেতেই তিনি তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন এবং তার সরকারের মেয়াদ শেষে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এ অবস্থান থেকে আওয়ামী লীগ সরে আসছে কিনা এমন খবর জানা নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ এবং জাতিসংঘ বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি সরকার বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকুক ভারতের বর্তমান সরকারও চায়। এসব কারণেই হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশম সংসদ নির্বাচনের পরপরই দেয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে আগাম নির্বাচনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। তাছাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও পৌরসভা নির্বাচনে দলের সাফল্য আওয়ামী লীগকে আগাম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে উৎসাহিত করে তুলতে পারে। পদ্মা সেতু নির্মাণসহ সারা দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে গৃহীত কার্যক্রম এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে অভাবিত সাফল্য বর্তমান সরকারের জনপ্রিয়তা বহু পরিমাণে বাড়িয়েছে। আগাম নির্বাচন দিয়ে এ জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে উদ্যোগী হতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সবশেষে যা বলা দরকার তা হল, জনগণ চায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত হোক একটি জাতীয় সরকার। জাতীয় ও স্থানীয় সব পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হোক নির্ভেজাল গণতন্ত্র। ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র পচে গেছে’ মর্মে বিদেশী মিডিয়ায় যে খবর প্রকাশিত হয় তার অবসান হোক। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
No comments