মধ্যম আয়ের দেশ বনাম উন্নত জাতি by সৈয়দ আবুল মকসুদ
কোন
রেস্তোরাঁর রান্না সুস্বাদু, তা তার ভোজনকারীরাই ভালো জানেন, তার মালিক বা
ম্যানেজার নন। কোন ভাষার সাহিত্যের অবস্থা কী, তা সেই ভাষার লেখকদের চেয়ে
পাঠকেরা ভালো বলতে পারেন। কোন হাসপাতালের চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা কেমন, তা
তার ডাক্তার-নার্সদের চেয়ে রোগী ও তাদের দেখাশোনায় নিয়োজিত সঙ্গীরাই ভালো
জানেন। কোন ট্রেনে যাতায়াতে কী সুবিধা-অসুবিধা, তা ওই ট্রেনের চালক ও
গার্ডের চেয়ে যাত্রীরাই সঠিক বলতে পারেন। কোন দেশের কী অবস্থা, তা সে
দেশের সরকারের চেয়ে সাধারণ মানুষ হাজার গুণ বেশি জানে। এবং তাদের মতামতই
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—অন্য কারও সার্টিফিকেট নয়।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৪৫ বছরে পা দিয়ে বাংলাদেশ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে—এমন প্রশ্ন যদি কেউ করেন, এক কথায় জবাব দেওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ বলতে পারেন, একটি নিম্ন মাঝারি পর্বতের ওপর দাঁড়িয়ে। কেউ বলবেন তিনি দাঁড়িয়ে নেই, নিম্ন মধ্যম গতিতে ছুটে চলেছেন। কেউ বলবেন, তিনি একটি মাঝারি পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন বটে, কিন্তু তার পাশেই গভীর এক খাদ, নড়াচড়ায় অসাবধান হলেই সর্বনাশ!
মোটামুটি আশাবাদী, তবে খুব সাবধানি কোনো সাধারণ নাগরিক বলবেন, বাংলাদেশের একদিকে সম্ভাবনা, আরেক দিকে অনিশ্চয়তা। একদিকে অশেষ আশার আলো, আরেক দিকে অপার হতাশার অন্ধকার। একদিকে সূর্যালোক, অন্যদিকে ঘন কুয়াশা। খুব ভালো নেতৃত্বই পারে অনিশ্চয়তা, অন্ধকার ও কুয়াশার অমঙ্গল থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে।
সব বাঙালিই, তা তিনি বাংলাদেশিই হোন বা অন্য কোনো দেশের হোন, মেটাফোর বা রূপক-অলংকার দিয়ে ভাব প্রকাশ করা পছন্দ করেন। একশ্রেণির বাঙালি সমস্বরে বলছেন, বাংলাদেশ নাকি এশিয়ার বাঘ হতে যাচ্ছে। বাঘ—তা মানুষের চেয়ে যত বেশি শক্তিমানই হোক, সে পশু। পশুর ভেতরে পাশবিকতাই প্রাধান্য পাবে, মানবিক গুণাবলি নয়। ৪৫ বছর আগে যখন আমাদের মধ্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার স্পৃহা জাগ্রত হয়, সেদিন আমরা একটি মধ্যমানের মহৎ জাতি হতে চেয়েছিলাম। বাঘ-ভাল্লুক নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিন্দুকে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুত আছে, তা দিয়ে কোনো জাতির যোগ্যতা ও মহত্তের পরিমাপ হয় না।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ঢাকার রাস্তায় মোটরগাড়ির দীর্ঘ সারি বা যানজট দেখে সন্তুষ্ট ও তাজ্জব হয়েছেন। কারণ, এত চকচকে দামি গাড়ি দুই দশক আগে তিনি দেখেননি। রাস্তায় দামি মোটরগাড়ির বহর টেকসই অর্থনীতির পরিচয় কি না, তা আমার মতো অজ্ঞ লোকের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমরা সাধারণ মানুষ শুধু এটুকুই বলতে পারি, এই গাড়িবহর দেখে আমরাও খুশি হতে পারতাম, যদি গাড়িগুলো মালয়েশিয়ার মতো আমরাই তৈরি করতাম। প্রমোশন পেলাম প্রায় মধ্যম আয়ের দেশে, বানাতে পারি না একখানা মোটরগাড়ি। অথচ স্বাধীনতার আগেই প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ চট্টগ্রামে মোটরগাড়ি বানাতে শুরু করেছিল।
স্বাধীনতার পরে দেশে বহু নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। পাটকল, চিনিকল প্রভৃতি বহু পুরোনো শিল্প ধ্বংস হয়েছে দুর্নীতির কারণে। গড়ে উঠেছে তৈরি পোশাক, সিমেন্ট প্রভৃতি শিল্প। কর্মসংস্থানও হয়েছে বহু মানুষের। জিডিপিতে শিল্প খাত থেকে অর্জন ৩০ শতাংশের বেশি। অথচ এই খাতের ৯০ শতাংশ শ্রমিকের সামাজিক ও আইনগত সুরক্ষা নেই। অনানুষ্ঠানিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীদের নিরাপত্তা নেই। এমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট থেকে তাঁরা বঞ্চিত।
আমরা অবশ্যই মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। তবে যেটা বেশি চাই তা হলো উন্নত জাতির দেশ। যেখানে অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয় গুরুত্ব পাবে, কিন্তু প্রাধান্য পাবে জ্ঞানচর্চা ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড লুণ্ঠনের অর্থনীতি আর উন্নয়নের অর্থনীতি দুই জিনিস। রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি ছোট্ট শ্রেণি যখন ফুলেফেঁপে ওঠে, তখন তা অনুৎপাদনশীল অর্থনীতি। দুর্নীতির অর্থনীতি ও দুর্নীতির সংস্কৃতি যখন একাকার হয়ে যায়, তা দেশকে টেকসই অর্থনীতি উপহার দেয় না। দায়িত্ববান গণমুখী রাজনীতি ছাড়া উৎপাদনশীল অর্থনীতির প্রাধান্য সৃষ্টি হবে না।
সাবেক বাঙালি মধ্যশ্রেণি একটি অনতিক্রান্ত বৃত্তের মধ্যে আটকে আছে। সমাজে উচ্চবিত্ত শ্রেণির আকার বাড়ছে। উন্নয়নের সুফল তারাই ভোগ করছে। বারো আনা মানুষ উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত। সামগ্রিক উন্নয়ন আর শ্রেণিবিশেষের আংশিক উন্নয়ন দুই জিনিস।
বাঙালির সভ্যতা হচ্ছে গ্রামীণ কৃষি সভ্যতা। সেই কৃষি ও গ্রামই উপেক্ষিত। উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের, পেশাজীবীদের সম্পর্ক শূন্য। গ্রামে এখন যে ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে, তাতে উপকৃত হচ্ছে সরকারি দলগুলোর ক্যাডার ও টাউট-ধড়িবাজ ধরনের মানুষ—সব শ্রেণির পেশাজীবী সাধারণ মানুষ নয়।
জাতি গঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। বিশাল যুবসমাজের মেধা ও শক্তি অব্যবহৃত থাকছে। তার ফলে রাষ্ট্র থাকছে বঞ্চিত তাদের সেবা থেকে। অন্যদিকে তরুণদের মধ্যে হতাশা দেখা দিচ্ছে। তাদের কেউ কেউ উগ্রপন্থায় ঝুঁকে পড়লে সমাজের ও জাতির সর্বনাশ ঘটবে। বিশেষ করে বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা যদি হতাশায় ভোগে, তারা ধরবে মাদক, ঝুঁকবে যৌনাচারের দিকে। গরিবের সন্তানদের ক্ষোভ থেকে যে হতাশা, তার ফলে তারা হিংসার পথ ধরবে। হিংসার পথ হলো উগ্র রাজনীতির পথ। বিশ্বব্যাপী এই পথটি বর্তমানে খুবই বাণিজ্যসফল। সমাজে অনুৎপাদনশীল অর্থনীতি যত বিস্তৃত হবে, উগ্র রাজনীতির কর্মীদের অর্থায়নের সুযোগও তত বাড়বে।
জ্ঞানচর্চা ও সৃষ্টিশীল কাজের চেয়ে আমরা অর্থহীন হট্টগোলে বেশি অভ্যস্ত। সরল মানুষের মন ভোলানোর কায়দা রপ্ত করেছি ভালো। মানসম্মত বই পড়ে মেধার বিকাশ ঘটানো এক কথা আর নতুন বই নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা-মন্ত্রীসহ লাফালাফি করা আরেক জিনিস। মানবজাতির ইতিহাসে কোনোকালে কোনো দেশে বই উৎসব নামে কিছু হয়েছে, ইন্টারনেট ঘেঁটে তা পাওয়া যাবে না। যে দেশে বই উৎসব উদ্ভাবিত হয়, সেখানে বিদেশি অনুদানে অর্থনৈতিক অবস্থা আর একটু ভালো হলে ব্যাগ উৎসব, খাতা উৎসব, পেনসিল উৎসব হবে না তার নিশ্চয়তা কী? তা ছাড়া বই দিয়েছে রাষ্ট্র বিনা মূল্যে, অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তা প্রকাশ্যে করছেন বিক্রি। এই আমাদের নৈতিকতা!
দুই দিন আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা জগন্নাথ হলে বলেছেন, শিক্ষার মান আগে কী ছিল আর এখন কী হয়েছে। নিম্নমানের শিক্ষা যারা পাচ্ছে, তাদের কেউই উঁচু মাপের কিছু হতে পারবে না। বড় লেখক হতে পারবে না, গবেষক হতে পারবে না, বিজ্ঞানী হতে পারবে না। দেশে জীবন রক্ষাকারী নতুন ওষুধ বা নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হবে না। এ-জাতীয় বিদ্যায় তেজারতি করে বা নানা অবৈধ উপায়ে টাকা রোজগার করতে পারবে। তার ফলে দেশ মধ্যম আয়ে প্রমোশন পাবে। আমাদের ওই মধ্যম আয়ের দেশে উপকৃত হবেন বিদেশি এয়ারলাইনস, ব্যাংকক ও বালি দ্বীপের পর্যটনকেন্দ্রগুলো, বামরুনগ্রাদ ও মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মালিকেরা।
আমাদের পরম হিতার্থী বিশ্বব্যাংক চায় আমরা দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ হই। সরকারি দলেই থাকুন আর বিরোধী দলেই থাকুন, আমাদের শাসকশ্রেণির পরিকল্পনাবিদেরা চান বাংলাদেশের গায়ে মধ্যম আয়ের তকমা আঁটতে। বাংলাদেশের মতো একটি জাতিরাষ্ট্রের, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অপরিমেয় রক্তের বিনিময়ে, প্রধানতম ও একমাত্র অন্বেষা হওয়া উচিত উন্নত জাতি গঠন।
আমাদের মাথা ছোট, বিদ্যা-বুদ্ধি কম, তবে এটুকু বুঝি যে নিম্নমানের শিক্ষা দিয়ে নানা কায়দায় টাকা কামাই করা যায়, যোগ্য ও উন্নত মানুষ হওয়া যায় না। বহু পাইকারি বাজারে ভুঁড়িঅলা আড়তদারের অনেক টাকা; একজন বিজ্ঞানী, শিল্পী বা দার্শনিকের তাঁর তুলনায় অর্থবিত্ত অতি কম, জগতে কার দাম বেশি বা মানবজাতির জন্য কার প্রয়োজন বেশি?
দারিদ্র্য দূর করে, বৈষম্য কমিয়ে আমরা অবশ্যই মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। তবে তা হই বা না হই, যেটা বেশি চাই তা হলো উন্নত জাতির দেশ। যেখানে অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয় গুরুত্ব পাবে, কিন্তু প্রাধান্য পাবে জ্ঞানচর্চা ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৪৫ বছরে পা দিয়ে বাংলাদেশ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে—এমন প্রশ্ন যদি কেউ করেন, এক কথায় জবাব দেওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ বলতে পারেন, একটি নিম্ন মাঝারি পর্বতের ওপর দাঁড়িয়ে। কেউ বলবেন তিনি দাঁড়িয়ে নেই, নিম্ন মধ্যম গতিতে ছুটে চলেছেন। কেউ বলবেন, তিনি একটি মাঝারি পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন বটে, কিন্তু তার পাশেই গভীর এক খাদ, নড়াচড়ায় অসাবধান হলেই সর্বনাশ!
মোটামুটি আশাবাদী, তবে খুব সাবধানি কোনো সাধারণ নাগরিক বলবেন, বাংলাদেশের একদিকে সম্ভাবনা, আরেক দিকে অনিশ্চয়তা। একদিকে অশেষ আশার আলো, আরেক দিকে অপার হতাশার অন্ধকার। একদিকে সূর্যালোক, অন্যদিকে ঘন কুয়াশা। খুব ভালো নেতৃত্বই পারে অনিশ্চয়তা, অন্ধকার ও কুয়াশার অমঙ্গল থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে।
সব বাঙালিই, তা তিনি বাংলাদেশিই হোন বা অন্য কোনো দেশের হোন, মেটাফোর বা রূপক-অলংকার দিয়ে ভাব প্রকাশ করা পছন্দ করেন। একশ্রেণির বাঙালি সমস্বরে বলছেন, বাংলাদেশ নাকি এশিয়ার বাঘ হতে যাচ্ছে। বাঘ—তা মানুষের চেয়ে যত বেশি শক্তিমানই হোক, সে পশু। পশুর ভেতরে পাশবিকতাই প্রাধান্য পাবে, মানবিক গুণাবলি নয়। ৪৫ বছর আগে যখন আমাদের মধ্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার স্পৃহা জাগ্রত হয়, সেদিন আমরা একটি মধ্যমানের মহৎ জাতি হতে চেয়েছিলাম। বাঘ-ভাল্লুক নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিন্দুকে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুত আছে, তা দিয়ে কোনো জাতির যোগ্যতা ও মহত্তের পরিমাপ হয় না।
বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ঢাকার রাস্তায় মোটরগাড়ির দীর্ঘ সারি বা যানজট দেখে সন্তুষ্ট ও তাজ্জব হয়েছেন। কারণ, এত চকচকে দামি গাড়ি দুই দশক আগে তিনি দেখেননি। রাস্তায় দামি মোটরগাড়ির বহর টেকসই অর্থনীতির পরিচয় কি না, তা আমার মতো অজ্ঞ লোকের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আমরা সাধারণ মানুষ শুধু এটুকুই বলতে পারি, এই গাড়িবহর দেখে আমরাও খুশি হতে পারতাম, যদি গাড়িগুলো মালয়েশিয়ার মতো আমরাই তৈরি করতাম। প্রমোশন পেলাম প্রায় মধ্যম আয়ের দেশে, বানাতে পারি না একখানা মোটরগাড়ি। অথচ স্বাধীনতার আগেই প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ চট্টগ্রামে মোটরগাড়ি বানাতে শুরু করেছিল।
স্বাধীনতার পরে দেশে বহু নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। পাটকল, চিনিকল প্রভৃতি বহু পুরোনো শিল্প ধ্বংস হয়েছে দুর্নীতির কারণে। গড়ে উঠেছে তৈরি পোশাক, সিমেন্ট প্রভৃতি শিল্প। কর্মসংস্থানও হয়েছে বহু মানুষের। জিডিপিতে শিল্প খাত থেকে অর্জন ৩০ শতাংশের বেশি। অথচ এই খাতের ৯০ শতাংশ শ্রমিকের সামাজিক ও আইনগত সুরক্ষা নেই। অনানুষ্ঠানিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীদের নিরাপত্তা নেই। এমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট থেকে তাঁরা বঞ্চিত।
আমরা অবশ্যই মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। তবে যেটা বেশি চাই তা হলো উন্নত জাতির দেশ। যেখানে অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয় গুরুত্ব পাবে, কিন্তু প্রাধান্য পাবে জ্ঞানচর্চা ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড লুণ্ঠনের অর্থনীতি আর উন্নয়নের অর্থনীতি দুই জিনিস। রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার করে একটি ছোট্ট শ্রেণি যখন ফুলেফেঁপে ওঠে, তখন তা অনুৎপাদনশীল অর্থনীতি। দুর্নীতির অর্থনীতি ও দুর্নীতির সংস্কৃতি যখন একাকার হয়ে যায়, তা দেশকে টেকসই অর্থনীতি উপহার দেয় না। দায়িত্ববান গণমুখী রাজনীতি ছাড়া উৎপাদনশীল অর্থনীতির প্রাধান্য সৃষ্টি হবে না।
সাবেক বাঙালি মধ্যশ্রেণি একটি অনতিক্রান্ত বৃত্তের মধ্যে আটকে আছে। সমাজে উচ্চবিত্ত শ্রেণির আকার বাড়ছে। উন্নয়নের সুফল তারাই ভোগ করছে। বারো আনা মানুষ উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত। সামগ্রিক উন্নয়ন আর শ্রেণিবিশেষের আংশিক উন্নয়ন দুই জিনিস।
বাঙালির সভ্যতা হচ্ছে গ্রামীণ কৃষি সভ্যতা। সেই কৃষি ও গ্রামই উপেক্ষিত। উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের, পেশাজীবীদের সম্পর্ক শূন্য। গ্রামে এখন যে ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে, তাতে উপকৃত হচ্ছে সরকারি দলগুলোর ক্যাডার ও টাউট-ধড়িবাজ ধরনের মানুষ—সব শ্রেণির পেশাজীবী সাধারণ মানুষ নয়।
জাতি গঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। বিশাল যুবসমাজের মেধা ও শক্তি অব্যবহৃত থাকছে। তার ফলে রাষ্ট্র থাকছে বঞ্চিত তাদের সেবা থেকে। অন্যদিকে তরুণদের মধ্যে হতাশা দেখা দিচ্ছে। তাদের কেউ কেউ উগ্রপন্থায় ঝুঁকে পড়লে সমাজের ও জাতির সর্বনাশ ঘটবে। বিশেষ করে বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা যদি হতাশায় ভোগে, তারা ধরবে মাদক, ঝুঁকবে যৌনাচারের দিকে। গরিবের সন্তানদের ক্ষোভ থেকে যে হতাশা, তার ফলে তারা হিংসার পথ ধরবে। হিংসার পথ হলো উগ্র রাজনীতির পথ। বিশ্বব্যাপী এই পথটি বর্তমানে খুবই বাণিজ্যসফল। সমাজে অনুৎপাদনশীল অর্থনীতি যত বিস্তৃত হবে, উগ্র রাজনীতির কর্মীদের অর্থায়নের সুযোগও তত বাড়বে।
জ্ঞানচর্চা ও সৃষ্টিশীল কাজের চেয়ে আমরা অর্থহীন হট্টগোলে বেশি অভ্যস্ত। সরল মানুষের মন ভোলানোর কায়দা রপ্ত করেছি ভালো। মানসম্মত বই পড়ে মেধার বিকাশ ঘটানো এক কথা আর নতুন বই নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা-মন্ত্রীসহ লাফালাফি করা আরেক জিনিস। মানবজাতির ইতিহাসে কোনোকালে কোনো দেশে বই উৎসব নামে কিছু হয়েছে, ইন্টারনেট ঘেঁটে তা পাওয়া যাবে না। যে দেশে বই উৎসব উদ্ভাবিত হয়, সেখানে বিদেশি অনুদানে অর্থনৈতিক অবস্থা আর একটু ভালো হলে ব্যাগ উৎসব, খাতা উৎসব, পেনসিল উৎসব হবে না তার নিশ্চয়তা কী? তা ছাড়া বই দিয়েছে রাষ্ট্র বিনা মূল্যে, অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তা প্রকাশ্যে করছেন বিক্রি। এই আমাদের নৈতিকতা!
দুই দিন আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা জগন্নাথ হলে বলেছেন, শিক্ষার মান আগে কী ছিল আর এখন কী হয়েছে। নিম্নমানের শিক্ষা যারা পাচ্ছে, তাদের কেউই উঁচু মাপের কিছু হতে পারবে না। বড় লেখক হতে পারবে না, গবেষক হতে পারবে না, বিজ্ঞানী হতে পারবে না। দেশে জীবন রক্ষাকারী নতুন ওষুধ বা নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হবে না। এ-জাতীয় বিদ্যায় তেজারতি করে বা নানা অবৈধ উপায়ে টাকা রোজগার করতে পারবে। তার ফলে দেশ মধ্যম আয়ে প্রমোশন পাবে। আমাদের ওই মধ্যম আয়ের দেশে উপকৃত হবেন বিদেশি এয়ারলাইনস, ব্যাংকক ও বালি দ্বীপের পর্যটনকেন্দ্রগুলো, বামরুনগ্রাদ ও মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মালিকেরা।
আমাদের পরম হিতার্থী বিশ্বব্যাংক চায় আমরা দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ হই। সরকারি দলেই থাকুন আর বিরোধী দলেই থাকুন, আমাদের শাসকশ্রেণির পরিকল্পনাবিদেরা চান বাংলাদেশের গায়ে মধ্যম আয়ের তকমা আঁটতে। বাংলাদেশের মতো একটি জাতিরাষ্ট্রের, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অপরিমেয় রক্তের বিনিময়ে, প্রধানতম ও একমাত্র অন্বেষা হওয়া উচিত উন্নত জাতি গঠন।
আমাদের মাথা ছোট, বিদ্যা-বুদ্ধি কম, তবে এটুকু বুঝি যে নিম্নমানের শিক্ষা দিয়ে নানা কায়দায় টাকা কামাই করা যায়, যোগ্য ও উন্নত মানুষ হওয়া যায় না। বহু পাইকারি বাজারে ভুঁড়িঅলা আড়তদারের অনেক টাকা; একজন বিজ্ঞানী, শিল্পী বা দার্শনিকের তাঁর তুলনায় অর্থবিত্ত অতি কম, জগতে কার দাম বেশি বা মানবজাতির জন্য কার প্রয়োজন বেশি?
দারিদ্র্য দূর করে, বৈষম্য কমিয়ে আমরা অবশ্যই মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। তবে তা হই বা না হই, যেটা বেশি চাই তা হলো উন্নত জাতির দেশ। যেখানে অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয় গুরুত্ব পাবে, কিন্তু প্রাধান্য পাবে জ্ঞানচর্চা ও সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments