সাংবাদিকদের সাচ্চা বন্ধু by শাহজাহান মিয়া
মহান সাংবাদিকতা পেশায় হাতে গোনা যে কজন সাংবাদিক নেতা সর্বস্তরের গণমাধ্যমকর্মীর বন্ধু হতে পেরেছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন আলতাফ মাহমুদ। অনুজদের কাছে তিনি ছিলেন ‘প্রিয় আলতাফ ভাই।’ সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনে বারবার তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হতেন। তাঁকে বলা হতো ‘সাধারণ সাংবাদিকদের নেতা’। সাংবাদিকদের ন্যায়সংগত দাবিদাওয়া আদায়ে আলতাফ মাহমুদ বরাবর ছিলেন নির্ভীক ও আপসহীন।
সেই আলতাফ মাহমুদ ২৪ জানুয়ারি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সার্ভিক্যাল কম্প্রেসিভ মাইলো রেডিকিউপ্যাথিতে আক্রান্ত হলে ২১ জানুয়ারি তাঁর স্পাইনাল কর্ডে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকেরা আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু ২৩ জানুয়ারি রাতে হঠাৎ আলতাফ মাহমুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। পরদিন সকালে তাঁর লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলা হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
অস্ত্রোপচারের আগের দিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে তাঁকে দেখতে যাওয়া সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সাংবাদিক বন্ধুরা ভালো থাকুক, এটাই আমার প্রত্যাশা।’ জীবনভর সাংবাদিকদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকা আলতাফ মাহমুদের এভাবে চলে যাওয়ার বিষয়টি কেউ সহজভাবে মানতে পারেননি। তাঁর আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীদের ধারণা, বিদেশে চিকিৎসা হলে হয়তো তাঁকে বাঁচানো যেত। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখেছি, আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী তাহমিনা মাহমুদও অস্ত্রোপচারের আগের দিন বলেছিলেন, ‘আমার কেন যেন মন টানছে, ব্যাংকক কিংবা সিঙ্গাপুরে নিয়ে অস্ত্রোপচার করালে ভালো হতো।’
উল্লেখ্য, আলতাফ মাহমুদের উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছিল।
মৃত্যুর দুই মাস আগে গত বছরের ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) নির্বাচনে আলতাফ মাহমুদ সভাপতি নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি এই সংগঠনের মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন একাধিকবার।
দৈনিক ডেসটিনির নির্বাহী সম্পাদক আলতাফ মাহমুদ সাংবাদিকতায় আসেন গত শতকের সত্তরের দশকের প্রথম দিকে। দৈনিক স্বদেশ দিয়ে তাঁর সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু। এরপর সাপ্তাহিক খবর, দৈনিক খবর, সাপ্তাহিক চিত্রবাংলা, দৈনিক কিষানসহ বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি। সাংবাদিকদের রুটিরুজির আন্দোলনে সব সময় সম্মুখভাগে থাকা আলতাফ মাহমুদ কোনো পত্রিকায় বেতন প্রদান বন্ধ কিংবা কোথাও সাংবাদিক ছাঁটাই হয়েছে শুনলে সবার আগে দৌড়ে গিয়ে খোঁজখবর নিতেন। তাঁদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণের ওপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়; তখন যে গুটি কয়েক পত্রিকা শাসকগোষ্ঠীর ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি তুলে ধরে, সেগুলোর মধ্যে সাপ্তাহিক খবর ছিল উল্লেখযোগ্য। আলতাফ মাহমুদ ছিলেন এই পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক। পরবর্তীকালে পত্রিকাটি দৈনিকে রূপান্তরিত হলেও তিনি একই দায়িত্ব পালন করেছেন। একটি দৈনিক পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদকের দায়িত্ব পালন করে সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দেওয়া খুবই কঠিন কাজ। আলতাফ মাহমুদ সেই কঠিন কাজটি করেছেন সুচারুভাবে।
আশির দশকের প্রথম দিকে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে আলতাফ মাহমুদের সাংবাদিক ইউনিয়নের কর্মকাণ্ড শুরু। তিনি ১৯৮৭ সালে জনকল্যাণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। পরে সাংগঠনিক সম্পাদকও হয়েছিলেন। বর্তমানে ইংরেজি দৈনিক দ্য অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) তিনবার সভাপতি হওয়ার পর আমিও ১৯৮৯ সালে তৃতীয়বারের মতো সভাপতি হয়ে ইউনিয়ন থেকে একরকম সরে গিয়েছিলাম।
কিন্তু ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ইকবাল সাহেব ও অন্যান্য ফোরাম নেতার অনুরোধে ১৯৯২ সালে আমাকে আবার সভাপতি পদে দাঁড়াতে হয়। সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আলতাফ মাহমুদ। আমরা দুজনই প্রতিপক্ষ ফেরামের প্রার্থীদের পরাজিত করে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হই। সেটাই ছিল অবিভক্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের শেষ নির্বাচিত কমিটি। ইউনিয়নে প্রিয় সহকর্মী হিসেবে আলতাফ মাহমুদের মধ্যে যে নিষ্ঠা, সততা, কর্মস্পৃহা ও সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষায় যে আন্তরিক মমত্ববোধ লক্ষ করেছি, তা বিরল। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে প্রেসক্লাবের ভেতরে পুলিশ ঢুকে বেধড়ক লাঠিপেটা করলে বহু সাংবাদিক আহত হন। পুলিশের হামলায় গুরুতর আহত ৩০ জনের বেশি সহকর্মীকে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। সেবারও আহত সাংবাদিকদের পাশে থেকে আলতাফ মাহমুদ সবার খোঁজখবর নিয়েছেন। চিকিৎসায় সহায়তা করেছেন। বেশ কয়েকবার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর আলতাফ মাহমুদ মোট পাঁচবার ডিইউজের সভাপতি হন, সম্ভবত এটি ইউনিয়নের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। তিনি ছিলেন সাংবাদিক সমাজের সাচ্চা বন্ধু।
সাংবাদিক ইউনিয়ন করার কারণে অনেক সময় আমরা একসঙ্গে ইউনিয়নের বিভিন্ন ইউনিটে গিয়েছি। সহকর্মীদের উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। মালিকদের সঙ্গে দেনদরবার করেছি। আলতাফ মাহমুদকে কখনো ক্লান্ত বা হতাশ হতে দেখিনি। এমনকি যখন নিজের চাকরি ছিল না, তখনো তিনি সহকর্মীদের সহায়তা করেছেন। তাঁর একসময়ের সহকর্মী ও বন্ধু স্বপন দাশগুপ্তকে প্রেসক্লাবে এখনো বলতে শোনা যায়, ‘আমার দোস্ত আলতাফ ঢাকায় এসেছিল নায়ক হবে বলে। ফাঁসি নামক একটি ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিল। নানা কারণে ছবিটি মুক্তি পায়নি।’ তাঁর অভিনীত ছবিটি মুক্তি না পেলেও সিনেমার নায়ক হতে ঢাকায় আসা আলতাফ মাহমুদ ব্যক্তিজীবনে সাংবাদিকদের দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলনের অগ্রভাগে থেকে সংবাদপত্র জগতের নায়ক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যু সাংবাদিক সমাজের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
শাহজাহান মিয়া: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
No comments