রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন ও অং সান সু চি by নিকোলাস ক্রিস্টিন
বিশ্ব
শিগগির একটি লক্ষণীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবে। একজন অতিপ্রিয় নোবেল পুরস্কার
বিজয়ী একবিংশ শতাব্দীর কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা নির্যাতন শিবিরে সভাপতিত্ব
করবেন।
বিশ্বের অন্যতম একজন সত্যিকারের বীর অং সান সু চি তার দেশে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে জয়লাভ করেছেন। নভেম্বরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তার দল ব্যাপক বিজয় অর্জন করেছে। বিজয়ী হিসেবে, অং সান সু চি উত্তরাধিকার সূত্রে নিকৃষ্ট জাতিগোষ্ঠীগত নির্মূল অভিযানের ও অংশীদার। রোহিঙ্গা নামক মুসলিম সংখ্যালঘুদের নির্মূল করার জন্য মিয়ানমার যে কঠোর নির্যাতন চালিয়েছে, যে ধরনের নির্মম নিষ্ঠুরতার কথা কেউ কখনো শোনেনি।
সাম্প্রতিক একটি ইয়ালি সমীক্ষায় ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার ওপর চালানো নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা যায় বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের কাছে পাঠানো জাতিসঙ্ঘের একটি কনফিডেনশিয়াল রিপোর্টে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনের আওতায় জাতিসঙ্ঘ ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বিষয়ে একটি আদালত গঠন করতে পারে। এখন পর্যন্ত মনে হয়, অং সান সু চি মিয়ানমারের জাতিবিদ্বেষ অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা করছেন। সু চি এখন একজন রাজনীতিবিদ, রোহিঙ্গাদের মতো সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করাটা অধিকাংশ বৌদ্ধ ভোটারের কাছে একটি পপুলার বিষয়।
অপর একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। মিয়ানমারের ওপর তার বিস্ময়কর প্রভাব আছে। তিনি ২০১২ সালে দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দু’বার মিয়ানমার সফর করেন। কিন্তু তিনিও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন উভয়ে মিয়ানমারকে গণতন্ত্র এবং পশ্চিমা কক্ষপথে পরিভ্রমণে প্রলুব্ধ করতে সহায়তা করে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছেন। তবে এ ব্যাপারে খুব বেশি হইচই করলে হয়তো তাদের প্রয়াস ক্ষতি হতে পারে। হইচই বা হাড়াহুড়ো করলে হয়তো প্রায় ৬৭টি নির্যাতন শিবিরে বন্দী বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
নির্যাতন শিবিরগুলোর একটিতে আটক ১৪ বছরের কিশোর মুহাম্মদ করীম নিষ্ঠুর নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছে। মুহাম্মদ একটি বিশাল নির্যাতন ক্যাম্পে হাজার হাজার রোহিঙ্গার সাথে বসবাস করত। সরকার কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং রাষ্ট্রসত্তা কেড়ে নিয়েছে। তাদের মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা থেকেও বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। মুহাম্মদ মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর জন্য চুপিসারে মানবপাচারকারীদের টাকা দিয়ে নৌকায় করে বেপরোয়াভাবে দেশ ছাড়তে চেয়েছিল। মুহাম্মদের মা সারা খাতুন বলেন, ‘আমরা তাকে যেতে দিইনি। কারণ নৌকা করে মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক।’ এরপর একসময় তার পায়ের গোড়ালিতে আঁচড় লাগে। তার পায়ে কিভাবে যে আঘাত পেল কেউ তা জানে না। কিন্তু তার চোয়ালেও দ্রুত সমস্যা দেখা দিলো। চোয়াল খুলতে তার বেশ সমস্যা হচ্ছিল। পরে সে টিটা নামে আক্রান্ত হয়। নির্যাতন শিবিরের বেশির ভাগ শিশুর মতোই তাকেও কোনো টিকা দেয়া হয়নি। এমনকি পায়ে আঘাত তথা পা কাটা যাওয়ার পরও তাকে কোনো টিটেনাস দেয়া হয়নি। সে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর স্থানীয় মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টরা এবং অন অ্যান্ড অফ ক্লিনিক তাকে কোনো চিকিৎসাসেবা দেয়নি। পরিশেষে তার মা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর লক্ষ্যে শিবির ত্যাগ করার জন্য বিশেষ অনুমতি পায়। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। তার মা জানায়, ‘এর দুই দিন পর সে লাশ হয়ে ফিরে আসে।’ তাদের কুঁড়েঘর থেকে একশত ফুট দূরে অপর একটি পরিবারেও চলছে শোকের মাতম। ২০ বছর বয়সী বিলদার বেগম হেপাটাইটিস এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তার প্রতিবেশীরা এ কথা জানান। সাধারণত হেপাটাইটিস ‘এ’ জীবনহানি করে না। কিন্তু সে প্রয়োজনীয় কোনো চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার কারণে গত বছরের শেষের দিকে মারা যায়। মৃত্যুর সময় সে দুই বছর বয়সী মিরল নামে একটি শিশুসন্তান রেখে যায়।
তার সম্প্রদায়ের নেতা ইউনুস বলেন, ‘সে রোহিঙ্গা না হলে হয়তো এখনো বেঁচে থাকত। আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে এ কথা বলতে পারি।’ এখন হিরল ফুৎ পীড়িত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। ২৮ মাস বয়সে তার ওজন মাত্র ১৯ পাউন্ড। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বয়সভিত্তিক ওজনশিট অনুযায়ী তার ওজন ও উচ্চতা অনেক কম।
নির্যাতন শিবিরে অবস্থানরত কয়েকটি পরিবারের ব্যাংকে অনেক টাকা জমা আছে। ব্যাংকগুলো শিবির থেকে কয়েক মাইল দূরে সিতুইয়ে অবস্থিত। ২০১২ সাল থেকে এসব পরিবার শিবিরে আটকা পড়ে থাকার কারণে তাদের পরিবারের খাওয়া পরার জন্য ব্যাংকে গিয়ে লেনদেন করতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুঃখজনকভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অংশত, এর কারণ হচ্ছে মিয়ানমার বিভিন্ন সাহায্যদাতা সংস্থা এবং সাংবাদিকদের রোহিঙ্গাদের সাথে কার্যত যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না। এ কারণে সেখানে রোহিঙ্গাদের তেমন একটা দেখা যায় না।
মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘ কার্যক্রমকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের অপর একটি অভ্যন্তরীণ দলিল থেকে আমি জানতে পারি মিয়ানমারে দায়িত্ব পালনরত জাতিসঙ্ঘের স্টাফ সদস্যরা একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত রয়েছে। দলিলে তাদের হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় এবং মানবতার বিরুদ্ধে কার্যকর অপরাধের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের সম্ভাব্য জটিলতার ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ফর্টিফাই রাইটস এবং ইউনাইটেড টু অ্যান্ড জেনোসাইডের মতো অ্যাডভোকেসি গ্রুপকে সাবাস দিই। এই সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বর্বরতা ও নৃশংসতা চালানোর বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। মানবাধিকার গ্রুপগুলোর প্রতি সম্মান জানাই। সেখানে তাদের যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তারা সেখানে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপনকারী এসব অসহায় আদম সন্তানের দুঃখদুর্দশা কিছুটা হলেও দূর করার চেষ্টা করেছেন। একটি বড় দ্বীপে আমি নৌকা দিয়ে গিয়ে দেখলাম ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস এবং সেভ দ্য সিলড্রেন অবহেলিত লোকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। কিন্তু অনেক জায়গায় সহায়তা গ্রুপকে যেতে দিচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের যেভাবে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে, সেটা হলো একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম অত্যন্ত অবহেলিত মানবাধিকার বিপর্যয়।
মিয়ানমার সরকার কেবল ব্যক্তিগতভাবে একেকজনের ওপরই নির্যাতন চালাচ্ছে না, তারা রোহিঙ্গাদের একটি জাতিগোষ্ঠীগত গ্রুপ হিসেবে উচ্ছেদ করতে চায়। সরকারের দাবি, মিয়ানমারে তাদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করে না। তাদের দাবি, এরা বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হিসেবে এসেছে। অথচ রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারের নাগরিক তার ঐতিহাসিক দলিল আছে। গত নভেম্বরে সরকার পাঁচ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। তাদের অপরাধ তারা রোহিঙ্গাদের একটি এথনিক বা গোষ্ঠীগত গ্রুপ উল্লেখ করে ২০১৬ সালের একটি ক্যালেন্ডার ছাপাচ্ছিল।
অং সান সু চিও রোহিঙ্গা বলাটা এড়িয়ে গেছেন। মিয়ানমারের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তাদের সরকারি বিবৃতিতে সে দেশের প্রতি নত শিকার করে বক্তব্য দিয়েছে।
মানবাধিকার গ্রুপ ফর্টিফাই রাইটসের ম্যাথি স্মিথ মিয়ানমারের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ওবামা প্রশাসন অবশ্যই আরো অনেক কিছু করতে পারে।’ তার মতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত অনুষ্ঠানের প্রতি সমর্থন দান এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রকাশ্যে ও গোপনে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ এবং রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে সেখানে সাহায্য দাতাসংস্থাকে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে ওবামা প্রশাসন পদক্ষেপ নিতে পারে। অন্য রাজনীতিবিদেরা এ ব্যাপারে নীরব। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারে অনেক সঠিক কাজও হয়েছে। বিশেষভাবে গণতন্ত্রের উত্থানের বিষয়টি বলতে হয়। কিন্তু একইভাবে গণতান্ত্রিক উত্থানের সাথে সাথে বর্ণবাদীরা ক্ষমতার অধিকারী এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ঘৃণাবিদ্বেষের জন্ম হয়েছে। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির দল একজন মুসলিম প্রার্থীকেও মনোনয়ন দিতে অস্বীকার করেছে। বার্মার অনেক মানুষ অং সান সু চিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে বিবেচনা করে থাকে। কারণ তিনি প্রত্যেকবার রোহিঙ্গাদের নিন্দা করার পরিবর্তে তাদের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু আমরা যারা তাকে বছরের পর বছর গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে আসছি নীতির জন্য তার আত্মত্যাগের ইচ্ছা এখন রাজনৈতিক কৌশলে যেন প্রচণ্ডভাবে মোচড় দিতে দেখছি।
মিয়ানমার এবং অং সান সু চির রক্ষক তথা সমর্থকেরা উল্লেখ করেন, দেশের অনেক সমস্যা আছে। তারা রোহিঙ্গাদের একটি দুর্ভাগা জাতি বলে মনে করেন। তাদের ব্যাপারে যে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয় তারা দেখছেন, সেটা হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্র এবং দেশের অনেক স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা। তাদের মতে, জাতি যখন অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, সেখানে একটি এথনিক বা গোষ্ঠীগত সমস্যাকে তারা ক্ষীণদৃষ্টিতে দেখে। তারা এটাকে ফোকাস করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।
তবুও একটি সরকার যখন একটি এথনিক বা জাতিগত গোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে, ওই জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের নির্যাতন শিবিরে আটকে রাখে এবং তাদের প্রয়োজনীয় খাবার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দিতে অস্বীকৃতি জানায়- তখন আমার কাছে ওটাকে ভয়ঙ্কর ও আতঙ্কজনক বিষয় বলে মনে হয়। গোষ্ঠীগত কারণে ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুদের নির্যাতন শিবিরে আটকে রেখে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এটা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের যে সমস্যা সে ধরনের কোনো সমস্যা নয়। এটা হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এই নৃশংসতা ও বর্বরতার অবসান ঘটানোর দায়িত্ব গোটা মানবজাতির।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে
বিশ্বের অন্যতম একজন সত্যিকারের বীর অং সান সু চি তার দেশে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে জয়লাভ করেছেন। নভেম্বরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে তার দল ব্যাপক বিজয় অর্জন করেছে। বিজয়ী হিসেবে, অং সান সু চি উত্তরাধিকার সূত্রে নিকৃষ্ট জাতিগোষ্ঠীগত নির্মূল অভিযানের ও অংশীদার। রোহিঙ্গা নামক মুসলিম সংখ্যালঘুদের নির্মূল করার জন্য মিয়ানমার যে কঠোর নির্যাতন চালিয়েছে, যে ধরনের নির্মম নিষ্ঠুরতার কথা কেউ কখনো শোনেনি।
সাম্প্রতিক একটি ইয়ালি সমীক্ষায় ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার ওপর চালানো নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা যায় বলে অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের কাছে পাঠানো জাতিসঙ্ঘের একটি কনফিডেনশিয়াল রিপোর্টে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনের আওতায় জাতিসঙ্ঘ ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ বিষয়ে একটি আদালত গঠন করতে পারে। এখন পর্যন্ত মনে হয়, অং সান সু চি মিয়ানমারের জাতিবিদ্বেষ অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা করছেন। সু চি এখন একজন রাজনীতিবিদ, রোহিঙ্গাদের মতো সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করাটা অধিকাংশ বৌদ্ধ ভোটারের কাছে একটি পপুলার বিষয়।
অপর একজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হলেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। মিয়ানমারের ওপর তার বিস্ময়কর প্রভাব আছে। তিনি ২০১২ সালে দ্বিতীয়বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দু’বার মিয়ানমার সফর করেন। কিন্তু তিনিও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ওবামা ও হিলারি ক্লিনটন উভয়ে মিয়ানমারকে গণতন্ত্র এবং পশ্চিমা কক্ষপথে পরিভ্রমণে প্রলুব্ধ করতে সহায়তা করে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছেন। তবে এ ব্যাপারে খুব বেশি হইচই করলে হয়তো তাদের প্রয়াস ক্ষতি হতে পারে। হইচই বা হাড়াহুড়ো করলে হয়তো প্রায় ৬৭টি নির্যাতন শিবিরে বন্দী বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
নির্যাতন শিবিরগুলোর একটিতে আটক ১৪ বছরের কিশোর মুহাম্মদ করীম নিষ্ঠুর নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছে। মুহাম্মদ একটি বিশাল নির্যাতন ক্যাম্পে হাজার হাজার রোহিঙ্গার সাথে বসবাস করত। সরকার কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং রাষ্ট্রসত্তা কেড়ে নিয়েছে। তাদের মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা থেকেও বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। মুহাম্মদ মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর জন্য চুপিসারে মানবপাচারকারীদের টাকা দিয়ে নৌকায় করে বেপরোয়াভাবে দেশ ছাড়তে চেয়েছিল। মুহাম্মদের মা সারা খাতুন বলেন, ‘আমরা তাকে যেতে দিইনি। কারণ নৌকা করে মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে যাওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক।’ এরপর একসময় তার পায়ের গোড়ালিতে আঁচড় লাগে। তার পায়ে কিভাবে যে আঘাত পেল কেউ তা জানে না। কিন্তু তার চোয়ালেও দ্রুত সমস্যা দেখা দিলো। চোয়াল খুলতে তার বেশ সমস্যা হচ্ছিল। পরে সে টিটা নামে আক্রান্ত হয়। নির্যাতন শিবিরের বেশির ভাগ শিশুর মতোই তাকেও কোনো টিকা দেয়া হয়নি। এমনকি পায়ে আঘাত তথা পা কাটা যাওয়ার পরও তাকে কোনো টিটেনাস দেয়া হয়নি। সে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর স্থানীয় মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টরা এবং অন অ্যান্ড অফ ক্লিনিক তাকে কোনো চিকিৎসাসেবা দেয়নি। পরিশেষে তার মা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর লক্ষ্যে শিবির ত্যাগ করার জন্য বিশেষ অনুমতি পায়। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। তার মা জানায়, ‘এর দুই দিন পর সে লাশ হয়ে ফিরে আসে।’ তাদের কুঁড়েঘর থেকে একশত ফুট দূরে অপর একটি পরিবারেও চলছে শোকের মাতম। ২০ বছর বয়সী বিলদার বেগম হেপাটাইটিস এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তার প্রতিবেশীরা এ কথা জানান। সাধারণত হেপাটাইটিস ‘এ’ জীবনহানি করে না। কিন্তু সে প্রয়োজনীয় কোনো চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার কারণে গত বছরের শেষের দিকে মারা যায়। মৃত্যুর সময় সে দুই বছর বয়সী মিরল নামে একটি শিশুসন্তান রেখে যায়।
তার সম্প্রদায়ের নেতা ইউনুস বলেন, ‘সে রোহিঙ্গা না হলে হয়তো এখনো বেঁচে থাকত। আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে এ কথা বলতে পারি।’ এখন হিরল ফুৎ পীড়িত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। ২৮ মাস বয়সে তার ওজন মাত্র ১৯ পাউন্ড। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বয়সভিত্তিক ওজনশিট অনুযায়ী তার ওজন ও উচ্চতা অনেক কম।
নির্যাতন শিবিরে অবস্থানরত কয়েকটি পরিবারের ব্যাংকে অনেক টাকা জমা আছে। ব্যাংকগুলো শিবির থেকে কয়েক মাইল দূরে সিতুইয়ে অবস্থিত। ২০১২ সাল থেকে এসব পরিবার শিবিরে আটকা পড়ে থাকার কারণে তাদের পরিবারের খাওয়া পরার জন্য ব্যাংকে গিয়ে লেনদেন করতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুঃখজনকভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। অংশত, এর কারণ হচ্ছে মিয়ানমার বিভিন্ন সাহায্যদাতা সংস্থা এবং সাংবাদিকদের রোহিঙ্গাদের সাথে কার্যত যোগাযোগ করতে দিচ্ছে না। এ কারণে সেখানে রোহিঙ্গাদের তেমন একটা দেখা যায় না।
মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘ কার্যক্রমকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের অপর একটি অভ্যন্তরীণ দলিল থেকে আমি জানতে পারি মিয়ানমারে দায়িত্ব পালনরত জাতিসঙ্ঘের স্টাফ সদস্যরা একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত রয়েছে। দলিলে তাদের হুঁশিয়ার করে দেয়া হয় এবং মানবতার বিরুদ্ধে কার্যকর অপরাধের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের সম্ভাব্য জটিলতার ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ফর্টিফাই রাইটস এবং ইউনাইটেড টু অ্যান্ড জেনোসাইডের মতো অ্যাডভোকেসি গ্রুপকে সাবাস দিই। এই সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে বর্বরতা ও নৃশংসতা চালানোর বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে। মানবাধিকার গ্রুপগুলোর প্রতি সম্মান জানাই। সেখানে তাদের যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তারা সেখানে গিয়ে মানবেতর জীবনযাপনকারী এসব অসহায় আদম সন্তানের দুঃখদুর্দশা কিছুটা হলেও দূর করার চেষ্টা করেছেন। একটি বড় দ্বীপে আমি নৌকা দিয়ে গিয়ে দেখলাম ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস এবং সেভ দ্য সিলড্রেন অবহেলিত লোকদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। কিন্তু অনেক জায়গায় সহায়তা গ্রুপকে যেতে দিচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের যেভাবে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে, সেটা হলো একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম অত্যন্ত অবহেলিত মানবাধিকার বিপর্যয়।
মিয়ানমার সরকার কেবল ব্যক্তিগতভাবে একেকজনের ওপরই নির্যাতন চালাচ্ছে না, তারা রোহিঙ্গাদের একটি জাতিগোষ্ঠীগত গ্রুপ হিসেবে উচ্ছেদ করতে চায়। সরকারের দাবি, মিয়ানমারে তাদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করে না। তাদের দাবি, এরা বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হিসেবে এসেছে। অথচ রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারের নাগরিক তার ঐতিহাসিক দলিল আছে। গত নভেম্বরে সরকার পাঁচ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। তাদের অপরাধ তারা রোহিঙ্গাদের একটি এথনিক বা গোষ্ঠীগত গ্রুপ উল্লেখ করে ২০১৬ সালের একটি ক্যালেন্ডার ছাপাচ্ছিল।
অং সান সু চিও রোহিঙ্গা বলাটা এড়িয়ে গেছেন। মিয়ানমারের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তাদের সরকারি বিবৃতিতে সে দেশের প্রতি নত শিকার করে বক্তব্য দিয়েছে।
মানবাধিকার গ্রুপ ফর্টিফাই রাইটসের ম্যাথি স্মিথ মিয়ানমারের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন, ‘ওবামা প্রশাসন অবশ্যই আরো অনেক কিছু করতে পারে।’ তার মতে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত অনুষ্ঠানের প্রতি সমর্থন দান এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রকাশ্যে ও গোপনে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ এবং রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে সেখানে সাহায্য দাতাসংস্থাকে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে ওবামা প্রশাসন পদক্ষেপ নিতে পারে। অন্য রাজনীতিবিদেরা এ ব্যাপারে নীরব। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারে অনেক সঠিক কাজও হয়েছে। বিশেষভাবে গণতন্ত্রের উত্থানের বিষয়টি বলতে হয়। কিন্তু একইভাবে গণতান্ত্রিক উত্থানের সাথে সাথে বর্ণবাদীরা ক্ষমতার অধিকারী এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ঘৃণাবিদ্বেষের জন্ম হয়েছে। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির দল একজন মুসলিম প্রার্থীকেও মনোনয়ন দিতে অস্বীকার করেছে। বার্মার অনেক মানুষ অং সান সু চিকে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে বিবেচনা করে থাকে। কারণ তিনি প্রত্যেকবার রোহিঙ্গাদের নিন্দা করার পরিবর্তে তাদের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। কিন্তু আমরা যারা তাকে বছরের পর বছর গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে আসছি নীতির জন্য তার আত্মত্যাগের ইচ্ছা এখন রাজনৈতিক কৌশলে যেন প্রচণ্ডভাবে মোচড় দিতে দেখছি।
মিয়ানমার এবং অং সান সু চির রক্ষক তথা সমর্থকেরা উল্লেখ করেন, দেশের অনেক সমস্যা আছে। তারা রোহিঙ্গাদের একটি দুর্ভাগা জাতি বলে মনে করেন। তাদের ব্যাপারে যে অগ্রাধিকার দেয়ার বিষয় তারা দেখছেন, সেটা হলো অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্র এবং দেশের অনেক স্থানীয় সমস্যার সমাধান করা। তাদের মতে, জাতি যখন অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, সেখানে একটি এথনিক বা গোষ্ঠীগত সমস্যাকে তারা ক্ষীণদৃষ্টিতে দেখে। তারা এটাকে ফোকাস করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।
তবুও একটি সরকার যখন একটি এথনিক বা জাতিগত গোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে, ওই জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের নির্যাতন শিবিরে আটকে রাখে এবং তাদের প্রয়োজনীয় খাবার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দিতে অস্বীকৃতি জানায়- তখন আমার কাছে ওটাকে ভয়ঙ্কর ও আতঙ্কজনক বিষয় বলে মনে হয়। গোষ্ঠীগত কারণে ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুদের নির্যাতন শিবিরে আটকে রেখে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এটা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের যে সমস্যা সে ধরনের কোনো সমস্যা নয়। এটা হচ্ছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এই নৃশংসতা ও বর্বরতার অবসান ঘটানোর দায়িত্ব গোটা মানবজাতির।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে
No comments