অবসরকালীন রায়: বিতর্কেই সমাধান by আসিফ নজরুল
প্রধান
বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার দায়িত্ব গ্রহণের বছর পূর্তি হলো ১৭
জানুয়ারি। এ উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাণীতে তিনি বলেন,
‘বিচারপতিদের অবসরের পর রায় লেখা সংবিধান পরিপন্থী।’
প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক উঠেছে। এই বিতর্ক অবশ্য কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। যেমন বিএনপি বলেছে, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের যে রায় ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় দেওয়া হয়েছিল (চূড়ান্ত রায়টি সংশ্লিষ্ট বিচারপতির অবসরের পর লেখা), তা অবৈধ হয়ে গেছে। এ রায়ের পর ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দেওয়া হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যের পর পঞ্চদশ সংশোধনীও ‘বাতিলযোগ্য হয়ে গেছে’।
প্রথমেই বলে রাখি, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় রায়ের সঙ্গে পঞ্চদশ সংশোধনী বৈধতার আসলে কোনো সরাসরি সাংবিধানিক সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সংবিধান সংশোধনী আনা যায়। সে কারণেই (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে অনেক যুক্তি থাকলেও) এটি বাতিল করা-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী অন্তত আইনগতভাবে বৈধ। এই সংশোধনীর পক্ষে আওয়ামী লীগ যেসব যুক্তি দিয়েছিল, তার অন্যতম ছিল ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার রায় পালনের বাধ্যবাধকতা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এ রায় যদি না-ও থাকত, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগের পঞ্চদশ সংশোধনী আনার সাংবিধানিক সুযোগ ছিল। ‘পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ’—এ ধরনের কোনো রায় উচ্চ আদালতে না আসা পর্যন্ত এটি তাই বৈধ।
প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে তাই আওয়ামী লীগের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, বিএনপিরও বেশি উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধান বিচারপতিকে এ জন্য সংযত হয়ে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি প্রধান বিচারপতিকে যে ভাষায় আরও কিছু কথা বলেছেন, তা কতটা শোভনীয়, এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে তিনি যে প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, তা নিয়ে বরং আরও বেশি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
এই প্রয়োজন অবসরকালীন রায়ের ফলে সৃষ্ট নানা সমস্যার মধ্যে নিহিত। বাংলাদেশে অনেক বিচারপতি রায় লিখতে বহু সময় নেন, হাইকোর্টে এতে কখনো কখনো তিন-চার বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়, এটি আইনমন্ত্রীও বলেছেন। এতে বিচারপ্রার্থী নানা ধরনের ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন। কিন্তু অবসরকালে যদি বিচারপতিরা রায় লেখার জন্য বহু মাস সময় নেন, তখন এটি নৈতিকতারও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। অবসর-পরবর্তী সময়ে বিচারকেরা তাই আদৌ রায় লিখতে পারেন কি না, পারলে কত দিন পর্যন্ত বিলম্ব গ্রহণযোগ্য হতে পারে, বিলম্বের কারণে কী ধরনের আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হয়, এমন পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে তাই সৎ উদ্দেশ্যমূলক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে অতীত নজিরের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেরও।
২.
সংবিধানের ৯৫ ও ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের দায়িত্ব গ্রহণের আগে সংবিধানসম্মতভাবে একটি শপথ নিতে হয়। এই শপথে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কাজ করার, আইন ও সংবিধানের রক্ষণের এবং অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে আচরণ করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা হয়। প্রধান বিচারপতির বক্তব্য হচ্ছে অবসরের পর একজন বিচারপতি সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বলে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের সময় গৃহীত শপথ বহাল থাকে না। এ কারণে অবসরের পর আদালতের নথি সংরক্ষণ, পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করা এবং তাতে সই করার অধিকার হারান বিচারপতিরা।
প্রধান বিচারপতির এটি একটি পর্যবেক্ষণ। কিন্তু এটি কোনো বায়বীয় বা মনগড়া পর্যবেক্ষণ নয়। এর সপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের জোরালো ও সুস্পষ্ট পূর্বনজির রয়েছে। ১৯৬৪ সালে কাজী মেহারদিন বনাম মুরাদ বেগম মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াসের নেতৃত্বে পাঁচজন বিচারক হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের রায়ের বৈধতার বিষয়টি নিষ্পত্তি করেন। বিষয়টি–সম্পর্কিত সব পূর্বসিদ্ধান্ত পরীক্ষা করে সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দেন যে অবসর-পরবর্তী সময়ে একজন বিচারপতির লিখিত ও স্বাক্ষরকৃত রায় কোনো রায় নয়।
অবসরের পর বিচারপতি রায় লিখতে পারবেন—এর সপক্ষেও অবশ্য পুরোনো কিছু বিচারিক বিশ্লেষণ রয়েছে। তবে তা সুপ্রিম কোর্টের নয়, হাইকোর্ট বা নিম্ন আদালতের এবং আমার জানামতে, ১৯৬৪ সালের সুপ্রিম কোর্টের পূর্বে উল্লেখিত রায়ের পর এর পরিপন্থী কোনো রায় একই আদালত থেকে কখনো দেওয়া হয়নি।
অবসরের পর শপথ থাকে না বলে বিচারকদের রায় লেখার অধিকার থাকে না—সরল পাঠেও তা-ই মনে হতে পারে। তবে কিছু বিষয় পর্যালোচনা করে কেউ কেউ এমন অভিমত দিতে পারেন যে কোনো যৌক্তিক কারণে (কর্মকালে কাজের অতিরিক্ত চাপ, অসুস্থতা বা অন্য কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে) হয়তো রায় লেখার জন্য অবসরের পর কিছুটা সময় নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কখনো কখনো তা নানা অনভিপ্রেত ও গুরুতর বিতর্কেরও সৃষ্টি করতে পারে। যেমন বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল-সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়।
৩.
বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর অবসরে যাওয়ার কিছুদিন আগে ২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়ে যান। সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে আগামী দুটো সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে বলে অভিমত দেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে নির্বাচনের সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার বিধান ছিল। অথচ সুদীর্ঘ ১৬ মাস পরে প্রকাশিত রায়ের চূড়ান্ত আদেশে তিনি কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে বলে নির্দেশনা দিয়েছেন। নিজের দেওয়া আদেশ থেকে কোনো রকম অতিরিক্ত শুনানি ছাড়া এ ধরনের বিচ্যুতি নজিরবিহীন এবং বিচারদর্শনের গুরুতর লঙ্ঘন বলে অভিযোগ রয়েছে। আপিল বিভাগের ভিন্নমতপোষণকারী তিনজন বিচারপতিও এই বিচ্যুতিকে চিহ্নিত করেছিলেন।
আপিল বিভাগের বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া ও নাজমুন আরা সুলতানার অভিমত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হলে তা জাতীয় সংসদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করতে হবে—এই শর্ত সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিচারপতি ইমান আলী লিখেছিলেন, এই শর্ত সংক্ষিপ্ত আদেশে ছিল না। এই তিনজন বিচারক আরও কিছু বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন, যা সংক্ষিপ্ত আদেশে ছিল না।
বিচারপতি খায়রুল হকের রায়টি ছিল সুদীর্ঘ ৩৪২ পৃষ্ঠার। এতে ছিল অন্তত এক ডজন কাহিনির বিবরণ, বিভিন্ন আইনবিদ ও লেখকের অর্ধশতাধিক কোটেশন, সমাজের বিভিন্ন মহলের প্রতি সমালোচনা ও উপদেশ এবং এমনকি নানান দেশের আইনের ইতিহাস। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা, সংক্ষিপ্ত আদেশ চূড়ান্ত রায়ে বদলে দেওয়ার কোনো সাংবিধানিক ক্ষমতা একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের আছে কি না, এ ধরনের কোনো নজির বিচারিক ইতিহাসে রয়েছে কি না বা তাঁরই দেওয়া সংক্ষিপ্ত আদেশটির এখন প্রাসঙ্গিকতা কী, এ সম্পর্কে কোনো রকম বিশ্লেষণই এতে নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে অবসরকালে কেউ যদি চূড়ান্ত রায়ে এমন কিছু লেখেন, যা বিচারপতির শপথে থাকা অবস্থায় তাঁরই দেওয়া আদেশের পরিপন্থী বা বহির্ভূত, তাহলে কোনটি বৈধ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত? বিচারকের আদেশ, নাকি ব্যক্তির রায়? এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা আমরা কোথায় পাব অবসরকালের রায়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা না হলে? এসব প্রশ্নের সুরাহা না করলে অবসরকালে রায় লেখার নামে স্বেচ্ছাচার হলে তা ঠেকানো যাবে কীভাবে?
৪.
চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে অবসরকালীন রায়ে কিংবা বহু বিলম্বে প্রদান করা আরও কিছু রায়ে এ রকম বিচ্যুতি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলায় এ ধরনের বিচ্যুতি মানুষের মনে বিচার বিভাগ সম্পর্কে আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে। অবসরকালে, এমনকি কর্মরত থাকা অবস্থায় বিলম্বে রায় অনেক ধরনের জটিলতা বা ভোগান্তিও সৃষ্টি করতে পারে। যেমন সংক্ষিপ্ত আদেশে কেউ জমির পজেশন পেলেও চূড়ান্ত রায়ের কপি না পাওয়া পর্যন্ত তাঁকে দখল ফিরে পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। আদালতে ঘোষিত রায়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে এবং এর বিরুদ্ধে আপিল বা রিভিউ করতে চাইলে লিখিত রায়ের কপি না পাওয়া পর্যন্ত তাঁর কিছু করার উপায় থাকে না।
আবার অবসরে যাওয়া বিচারকের চূড়ান্ত রায়ে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আপত্তিযোগ্য মন্তব্য থাকলে তিনি কার কাছে তখন পিটিশন করবেন, তা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কোনো বিচারক অবসর নিয়েই রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান শুরু করলে বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিলে তাঁর রায় লেখার মতো দৃশ্যমান নিরপেক্ষতা আদৌ আর আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।
অধিকাংশ বিবেচনায় তাই অবসরের আগে এবং চাকরিকালে যত দ্রুত সম্ভব চূড়ান্ত রায় প্রদান করাই উত্তম। উচ্চ আদালতে বিচারকদের অনেকের কাজের চাপ বেশি, অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত লজিস্টিক সুবিধাও নেই। কিন্তু বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে তারপরও দ্রুত রায় লেখার পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। যেমন: সপ্তাহে এক কার্যদিবস রায় লেখার জন্য নির্ধারণ করা, অবসরে যাওয়ার আগে অন্তত ছয় মাস বিচারকদের বিচারকার্য থেকে দূরে রেখে শুধু রায় লেখার সুযোগ দেওয়া, ক্ষেত্রবিশেষে যথোপযুক্ত কারণ থাকলে প্রধান বিচারপতির অনুমতিক্রমে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অবসরকালে রায় লেখার সুযোগ দেওয়া। কাজের চাপ কমানোর জন্য এমনকি সুপ্রিম কোর্টে অবকাশের মেয়াদ কমানো যেতে পারে। সবার সঙ্গে পরামর্শ করে আরও বহু কিছু করা সম্ভব হতে পারে।
আমাদের প্রত্যাশা, প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে রাজনীতি বা জল ঘোলা করার প্রচেষ্টার অবসান ঘটুক। সূচনা হোক বিচার শেষ হওয়ার পর যৌক্তিক সময়ের মধ্যে দ্রুত রায় লেখার সংস্কৃতির। বিচার বিভাগ, বিচারপ্রার্থী, বিচারক—সবার জন্যই এটি মঙ্গলজনক হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক উঠেছে। এই বিতর্ক অবশ্য কতটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। যেমন বিএনপি বলেছে, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের যে রায় ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় দেওয়া হয়েছিল (চূড়ান্ত রায়টি সংশ্লিষ্ট বিচারপতির অবসরের পর লেখা), তা অবৈধ হয়ে গেছে। এ রায়ের পর ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাদ দেওয়া হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যের পর পঞ্চদশ সংশোধনীও ‘বাতিলযোগ্য হয়ে গেছে’।
প্রথমেই বলে রাখি, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় রায়ের সঙ্গে পঞ্চদশ সংশোধনী বৈধতার আসলে কোনো সরাসরি সাংবিধানিক সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সংবিধান সংশোধনী আনা যায়। সে কারণেই (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে অনেক যুক্তি থাকলেও) এটি বাতিল করা-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী অন্তত আইনগতভাবে বৈধ। এই সংশোধনীর পক্ষে আওয়ামী লীগ যেসব যুক্তি দিয়েছিল, তার অন্যতম ছিল ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার রায় পালনের বাধ্যবাধকতা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এ রায় যদি না-ও থাকত, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগের পঞ্চদশ সংশোধনী আনার সাংবিধানিক সুযোগ ছিল। ‘পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ’—এ ধরনের কোনো রায় উচ্চ আদালতে না আসা পর্যন্ত এটি তাই বৈধ।
প্রধান বিচারপতির বক্তব্য নিয়ে তাই আওয়ামী লীগের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, বিএনপিরও বেশি উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধান বিচারপতিকে এ জন্য সংযত হয়ে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি প্রধান বিচারপতিকে যে ভাষায় আরও কিছু কথা বলেছেন, তা কতটা শোভনীয়, এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে তিনি যে প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতিকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, তা নিয়ে বরং আরও বেশি আলোচনা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
এই প্রয়োজন অবসরকালীন রায়ের ফলে সৃষ্ট নানা সমস্যার মধ্যে নিহিত। বাংলাদেশে অনেক বিচারপতি রায় লিখতে বহু সময় নেন, হাইকোর্টে এতে কখনো কখনো তিন-চার বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়, এটি আইনমন্ত্রীও বলেছেন। এতে বিচারপ্রার্থী নানা ধরনের ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন। কিন্তু অবসরকালে যদি বিচারপতিরা রায় লেখার জন্য বহু মাস সময় নেন, তখন এটি নৈতিকতারও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। অবসর-পরবর্তী সময়ে বিচারকেরা তাই আদৌ রায় লিখতে পারেন কি না, পারলে কত দিন পর্যন্ত বিলম্ব গ্রহণযোগ্য হতে পারে, বিলম্বের কারণে কী ধরনের আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হয়, এমন পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে তাই সৎ উদ্দেশ্যমূলক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে অতীত নজিরের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণেরও।
২.
সংবিধানের ৯৫ ও ১৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের দায়িত্ব গ্রহণের আগে সংবিধানসম্মতভাবে একটি শপথ নিতে হয়। এই শপথে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কাজ করার, আইন ও সংবিধানের রক্ষণের এবং অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে আচরণ করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা হয়। প্রধান বিচারপতির বক্তব্য হচ্ছে অবসরের পর একজন বিচারপতি সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বলে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের সময় গৃহীত শপথ বহাল থাকে না। এ কারণে অবসরের পর আদালতের নথি সংরক্ষণ, পর্যালোচনা বা রায় প্রস্তুত করা এবং তাতে সই করার অধিকার হারান বিচারপতিরা।
প্রধান বিচারপতির এটি একটি পর্যবেক্ষণ। কিন্তু এটি কোনো বায়বীয় বা মনগড়া পর্যবেক্ষণ নয়। এর সপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের জোরালো ও সুস্পষ্ট পূর্বনজির রয়েছে। ১৯৬৪ সালে কাজী মেহারদিন বনাম মুরাদ বেগম মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াসের নেতৃত্বে পাঁচজন বিচারক হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের রায়ের বৈধতার বিষয়টি নিষ্পত্তি করেন। বিষয়টি–সম্পর্কিত সব পূর্বসিদ্ধান্ত পরীক্ষা করে সুপ্রিম কোর্ট এই রায় দেন যে অবসর-পরবর্তী সময়ে একজন বিচারপতির লিখিত ও স্বাক্ষরকৃত রায় কোনো রায় নয়।
অবসরের পর বিচারপতি রায় লিখতে পারবেন—এর সপক্ষেও অবশ্য পুরোনো কিছু বিচারিক বিশ্লেষণ রয়েছে। তবে তা সুপ্রিম কোর্টের নয়, হাইকোর্ট বা নিম্ন আদালতের এবং আমার জানামতে, ১৯৬৪ সালের সুপ্রিম কোর্টের পূর্বে উল্লেখিত রায়ের পর এর পরিপন্থী কোনো রায় একই আদালত থেকে কখনো দেওয়া হয়নি।
অবসরের পর শপথ থাকে না বলে বিচারকদের রায় লেখার অধিকার থাকে না—সরল পাঠেও তা-ই মনে হতে পারে। তবে কিছু বিষয় পর্যালোচনা করে কেউ কেউ এমন অভিমত দিতে পারেন যে কোনো যৌক্তিক কারণে (কর্মকালে কাজের অতিরিক্ত চাপ, অসুস্থতা বা অন্য কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে) হয়তো রায় লেখার জন্য অবসরের পর কিছুটা সময় নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কখনো কখনো তা নানা অনভিপ্রেত ও গুরুতর বিতর্কেরও সৃষ্টি করতে পারে। যেমন বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল-সংক্রান্ত ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়।
৩.
বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর অবসরে যাওয়ার কিছুদিন আগে ২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার সংক্ষিপ্ত আদেশ দিয়ে যান। সেখানে তিনি সুস্পষ্টভাবে ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে আগামী দুটো সংসদ নির্বাচন করা যেতে পারে বলে অভিমত দেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে নির্বাচনের সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করার বিধান ছিল। অথচ সুদীর্ঘ ১৬ মাস পরে প্রকাশিত রায়ের চূড়ান্ত আদেশে তিনি কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যেতে পারে বলে নির্দেশনা দিয়েছেন। নিজের দেওয়া আদেশ থেকে কোনো রকম অতিরিক্ত শুনানি ছাড়া এ ধরনের বিচ্যুতি নজিরবিহীন এবং বিচারদর্শনের গুরুতর লঙ্ঘন বলে অভিযোগ রয়েছে। আপিল বিভাগের ভিন্নমতপোষণকারী তিনজন বিচারপতিও এই বিচ্যুতিকে চিহ্নিত করেছিলেন।
আপিল বিভাগের বিচারপতি ওয়াহাব মিয়া ও নাজমুন আরা সুলতানার অভিমত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হলে তা জাতীয় সংসদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠন করতে হবে—এই শর্ত সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বিচারপতি ইমান আলী লিখেছিলেন, এই শর্ত সংক্ষিপ্ত আদেশে ছিল না। এই তিনজন বিচারক আরও কিছু বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন, যা সংক্ষিপ্ত আদেশে ছিল না।
বিচারপতি খায়রুল হকের রায়টি ছিল সুদীর্ঘ ৩৪২ পৃষ্ঠার। এতে ছিল অন্তত এক ডজন কাহিনির বিবরণ, বিভিন্ন আইনবিদ ও লেখকের অর্ধশতাধিক কোটেশন, সমাজের বিভিন্ন মহলের প্রতি সমালোচনা ও উপদেশ এবং এমনকি নানান দেশের আইনের ইতিহাস। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা, সংক্ষিপ্ত আদেশ চূড়ান্ত রায়ে বদলে দেওয়ার কোনো সাংবিধানিক ক্ষমতা একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের আছে কি না, এ ধরনের কোনো নজির বিচারিক ইতিহাসে রয়েছে কি না বা তাঁরই দেওয়া সংক্ষিপ্ত আদেশটির এখন প্রাসঙ্গিকতা কী, এ সম্পর্কে কোনো রকম বিশ্লেষণই এতে নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে অবসরকালে কেউ যদি চূড়ান্ত রায়ে এমন কিছু লেখেন, যা বিচারপতির শপথে থাকা অবস্থায় তাঁরই দেওয়া আদেশের পরিপন্থী বা বহির্ভূত, তাহলে কোনটি বৈধ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত? বিচারকের আদেশ, নাকি ব্যক্তির রায়? এসব প্রশ্নের ব্যাখ্যা আমরা কোথায় পাব অবসরকালের রায়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা না হলে? এসব প্রশ্নের সুরাহা না করলে অবসরকালে রায় লেখার নামে স্বেচ্ছাচার হলে তা ঠেকানো যাবে কীভাবে?
৪.
চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে অবসরকালীন রায়ে কিংবা বহু বিলম্বে প্রদান করা আরও কিছু রায়ে এ রকম বিচ্যুতি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর মামলায় এ ধরনের বিচ্যুতি মানুষের মনে বিচার বিভাগ সম্পর্কে আস্থার সংকট তৈরি করতে পারে। অবসরকালে, এমনকি কর্মরত থাকা অবস্থায় বিলম্বে রায় অনেক ধরনের জটিলতা বা ভোগান্তিও সৃষ্টি করতে পারে। যেমন সংক্ষিপ্ত আদেশে কেউ জমির পজেশন পেলেও চূড়ান্ত রায়ের কপি না পাওয়া পর্যন্ত তাঁকে দখল ফিরে পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। আদালতে ঘোষিত রায়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে এবং এর বিরুদ্ধে আপিল বা রিভিউ করতে চাইলে লিখিত রায়ের কপি না পাওয়া পর্যন্ত তাঁর কিছু করার উপায় থাকে না।
আবার অবসরে যাওয়া বিচারকের চূড়ান্ত রায়ে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আপত্তিযোগ্য মন্তব্য থাকলে তিনি কার কাছে তখন পিটিশন করবেন, তা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কোনো বিচারক অবসর নিয়েই রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান শুরু করলে বা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিলে তাঁর রায় লেখার মতো দৃশ্যমান নিরপেক্ষতা আদৌ আর আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।
অধিকাংশ বিবেচনায় তাই অবসরের আগে এবং চাকরিকালে যত দ্রুত সম্ভব চূড়ান্ত রায় প্রদান করাই উত্তম। উচ্চ আদালতে বিচারকদের অনেকের কাজের চাপ বেশি, অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত লজিস্টিক সুবিধাও নেই। কিন্তু বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করে তারপরও দ্রুত রায় লেখার পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। যেমন: সপ্তাহে এক কার্যদিবস রায় লেখার জন্য নির্ধারণ করা, অবসরে যাওয়ার আগে অন্তত ছয় মাস বিচারকদের বিচারকার্য থেকে দূরে রেখে শুধু রায় লেখার সুযোগ দেওয়া, ক্ষেত্রবিশেষে যথোপযুক্ত কারণ থাকলে প্রধান বিচারপতির অনুমতিক্রমে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অবসরকালে রায় লেখার সুযোগ দেওয়া। কাজের চাপ কমানোর জন্য এমনকি সুপ্রিম কোর্টে অবকাশের মেয়াদ কমানো যেতে পারে। সবার সঙ্গে পরামর্শ করে আরও বহু কিছু করা সম্ভব হতে পারে।
আমাদের প্রত্যাশা, প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ নিয়ে রাজনীতি বা জল ঘোলা করার প্রচেষ্টার অবসান ঘটুক। সূচনা হোক বিচার শেষ হওয়ার পর যৌক্তিক সময়ের মধ্যে দ্রুত রায় লেখার সংস্কৃতির। বিচার বিভাগ, বিচারপ্রার্থী, বিচারক—সবার জন্যই এটি মঙ্গলজনক হবে।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments