স্বৈরাচারের ছায়া: গণ-অভ্যুত্থানের ২৫ বছর by কামাল আহমেদ
একটি
নির্বাচনের মাত্র ১৩ সপ্তাহের মাথায় একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত
করা যায়, এমন নজির দুনিয়ায় বিরল। কিন্তু বাংলাদেশে সেই দুষ্কর্মের নজির
স্থাপিত হয় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এবং তার হোতা ছিলেন ক্ষমতালোভী জেনারেল হু
মু এরশাদ। ক্ষমতা গ্রহণের আগেই, মূলত তাঁর পূর্বসূরি আরেক সেনাশাসক জেনারেল
জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই তিনি হুংকার দিতে শুরু করেন যে ‘দেশ শাসনে
সেনাবাহিনীর অংশীদারত্ব থাকতে হবে’। বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বলতম রাষ্ট্রপতি
বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে তাই নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ১৩ সপ্তাহের মাথায়
তিনি পদত্যাগ করিয়ে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হন। ’৭৫ থেকে ’৭৮ পর্যন্ত
রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে যে রক্তপাতময় অস্থিরতা চলেছিল, তার
পটভূমিতে ’৮১ সালের মে মাসে জিয়ার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ক্ষীণ আশাবাদ তৈরি হয়েছিল যে দেশের রাজনীতি
গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরতে পারবে।
সম্ভবত সে কারণেই জেনারেল এরশাদের সেনা অভ্যুত্থানের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লেগে যায় ‘সামরিক শাসন মানি না, সামরিক আইন তুলে নাও’। ২৫ মার্চ রাতে এসব পোস্টার লাগানোর সময় গ্রেপ্তার হন বামপন্থী ছাত্রসংগঠন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর তিন নেতা শিবলী কাইয়ুম, আবদুল আলী ও হাবিবুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ওঠা সেই স্লোগান আর থামেনি। ’৮৩-র ১১ জানুয়ারি, ’৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারি, ’৮৪-র ২৮ ফেব্রুয়ারি, তারপর ’৮৬, ’৮৭, ’৮৮ এবং ’৯০-এর অনেকগুলো দিন আন্দোলনকারীরা সামরিক স্বৈরশাসন অবসানের দাবিতে রক্ত ঝরান। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের অনেকের নাম স্বজনেরা ছাড়া আর কেউ মনে রাখেন না। রক্তঝরা সেই তারিখগুলোও এখন আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে।
কিন্তু এসব মৃত্যু, এসব আত্মত্যাগের বিনিময়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমরা কত দূর এগোলাম? নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বরকে প্রথম দিকে আমরা স্বৈরাচার পতনের দিন কিংবা গণতন্ত্রের বিজয় দিবস হিসেবে উদ্যাপন করতাম। এখন আর তা বলতে পারি না। এখন অনেক কষ্ট নিয়ে শুধু গণ-অভু্যত্থান দিবস বলি। কেননা, না হয়েছে গণতন্ত্রের বিজয়, না হয়েছে ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসনের অবসান। এরশাদ যে সামরিক শাসনের পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ প্রথম সোচ্চার হলেও রাজনৈতিক দলগুলো ছিল অনেকটাই নিস্তেজ। বিএনপি ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিত ও বিপর্যস্ত। আর আওয়ামী লীগ বিএনপির নাকাল দশায় আত্মতৃপ্ত। ’৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র আন্দোলন দমনে নির্বিচার শক্তি প্রয়োগে অনেকের প্রাণহানির পর আওয়ামী লীগ, সিপিবি, ন্যাপ, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারা ড. কামাল হোসেনের বাসায় বৈঠকে বসলে সেনাবাহিনী তাঁদের অনেককেই চোখ বেঁধে উঠিয়ে নিয়ে যায়। সামরিক জান্তার সেই ধরপাকড়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে রাজনীতিকদের সময় লাগে বছর খানেক।
তবে জেনারেল এরশাদ বেশি দিন স্বস্তিতে থাকতে পারেননি। ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিকেরাও তাঁদের দাবি–দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণকে ঘিরে গড়ে ওঠে আইনজীবীদের আন্দোলন। সামরিক ফরমানে সংবাদপত্র বন্ধ হওয়ায় সাংবাদিকেরাও রাস্তায় নামেন। ছাত্র-শ্রমিক ও পেশাজীবীদের আন্দোলনের পাশাপাশি উপজেলা গঠন ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের উদ্যোগ রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রাণসঞ্চার করে। আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের জোট ১৫ দল এবং বিএনপি ও কয়েকটি ডানপন্থী দলের জোট ৭ দল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অভূতপূর্ব সমঝোতায় পৌঁছায়। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া বৈঠক করে অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন পরিচালনার পথে অগ্রসর হন। জামায়াতে ইসলামীর কোনো জোটে জায়গা না হলেও উভয় জোটের সঙ্গেই তাদের একধরনের অলিখিত সমঝোতার রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং সব আন্দোলনে তাদেরও অংশ নিতে দেখা যায়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দুই নেত্রী ’৮৬-র সংসদ নির্বাচনে দেড় শটি করে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিলে ভরাডুবি নিশ্চিত জেনে সংবিধান সংশোধন করে কোনো ব্যক্তির একসঙ্গে পাঁচটির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে সেই সমঝোতা টেকেনি এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেয় আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট তা বর্জন করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে ভেঙে যায় ১৫ দল এবং বামপন্থী ৫টি দল জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে নির্বাচন বর্জনে শামিল হয়। কিছুটা সময়ের জন্য এরশাদ থিতু হয়ে বসলেও ’৮৭-তে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে এবং সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়।
’৯০-এ এরশাদবিরোধী আন্দোলন যে গণ-অভু্যত্থানে রূপ নেয়, তা আরও আগে সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। কেননা, ছাত্র-তরুণেরা আট বছরে বারবার রাজপথে নেমে মার খেয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, জেল খেটেছেন। অথচ রাজনীতির অঙ্গনে সামরিক শাসন অবসানে সুদৃঢ় সমঝোতা ’৯০-র আগ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অনেকের মতে, ওই দীর্ঘসূত্রতার কারণ দুটো বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই প্রধানের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। এরশাদের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে ১৫, ৭ ও ৫-দলীয় জোট ওই বছরের ২১ নভেম্বর একটি যুক্ত ঘোষণা ও রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আচরণবিধিতে সম্মত হয় ও তা প্রকাশ করে। ওই যুক্ত ঘোষণায় ‘দেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা ও জীবনপদ্ধতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা’র কথা ছিল। ওই যুক্ত ঘোষণায় ‘সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার’ করে ‘তিন জোটের নিকট গ্রহণযোগ্য একজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তির নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা’ এবং ‘একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদের জন্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা’ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল।
ওই ঘোষণায় (অনুচ্ছেদ ৪ক) তিনটি জোট অঙ্গীকার করেছিল, দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যেকোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা প্রতিরোধ করা হবে। নির্বাচন ব্যতীত অসাংবিধানিক বা সংবিধান-বহির্ভূত কোনো পন্থায়, কোনো অজুহাতেই নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা হবে (অনুচ্ছেদ ৪খ)। মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সব আইন বাতিল করা হবে (অনুচ্ছেদ ৪গ)।
ওই যুক্ত ঘোষণায় ‘প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ছলে-বলে-কৌশলে’ এরশাদ সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টার বিবরণে ‘ভোট চুরি, ভোট জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, নির্লজ্জ ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলে আসছে’ বলে বলা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই আন্দোলনের ফসল ’৯১-তে যে সংসদ গঠিত হয়েছিল, সেই সংসদেরই উপনির্বাচনগুলোতে কেন্দ্র দখল ও ভোট জালিয়াতির দৌরাত্ম্য ফিরে এল। ফলে ওই সংসদেই নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি উঠল এবং সেই দাবি পূরণের আগে অনুষ্ঠিত হলো একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন। তারপর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো নির্বাচনই এসব দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত ছিল না। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে যে নির্বাচনই হয়েছে তা সে স্থানীয় সরকার সংস্থারই হোক—সব ক্ষেত্রেই প্রহসনের পুনর্মঞ্চায়ন দেখা গেছে। আর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার মোড়কে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে ১৫৪ জনের ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকার কীভাবে সুরক্ষা পেয়েছে, সে প্রশ্ন এখন অনেকটা তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয়। তাতে দৈনন্দিন বাস্তবতায় হেরফের ঘটার কারণ নেই।
মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী আইনগুলো বাতিলের অঙ্গীকার সব রাজনৈতিক দলই ভুলে গেছে। কেননা, ক্ষমতায় থাকার এবং ক্ষমতার স্বাদ শান্তিতে ভোগ করার জন্য বিরোধীদের নিপীড়নের হাতিয়ারগুলো সবারই প্রয়োজন হয়। ক্ষমতায় থাকলে তাই তাঁরা ৫৪ ধারার যথেচ্ছ প্রয়োগ করেন। কোন আইনে গ্রেপ্তার বা জেলে পাঠানো হবে সেটা তখন বড় প্রশ্ন নয়, বড় কথা হলো, আগে ধরো এবং তারপর সুবিধামতো আইনে মামলা দাও। ৫ ডিসেম্বরের সংবাদপত্রগুলোতে ১৯টি পরিবারের আকুতি ফলাও করে ছাপা হয়েছে, যাতে তারা তাদের দুই বছর ধরে নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধান চেয়েছে। বাংলাদেশে যে গুমের কথা সামরিক শাসনের সময়েও শোনা যায়নি সেই অপচর্চা কোন ধরনের আইনের শাসন, সে কথা আজ আর রাজনীতিকেরা কেউই তোলেন না। সব ধরনের কালাকানুন বাতিলের যে অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছিল, তাতে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিক দলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত ছাপাখানা ও প্রকাশনা আইন (ঘোষণা ও নিবন্ধন) ১৯৭৩ এর একটি ধারা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করলেও নতুন রূপে একের পর এক আইন ও বিধিমালা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বহাল আছে। এসেছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা, তৈরি হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইন। সর্বোপরি আছে কথিত মানহানির অভিযোগে ফৌজদারি মামলার অপপ্রয়োগ।
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই তিন জোটের রূপরেখায় সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু সেই আদালত শুরু থেকেই রাজনীতিকরণের শিকার হয়েছে এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের টানাপোড়েনের অবসান ঘটেনি।
যুক্ত ঘোষণার সঙ্গে তিনটি জোটের নেতারা যে আচরণবিধিতে সম্মত হয়েছিলেন, সেটিকেও ধীরে ধীরে তাঁরা বিসর্জন দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করতে স্বৈরাচারের দোসরদের চক্রান্ত অব্যাহত থাকার কথা জানিয়ে তাঁরা বলেছিলেন যে ‘এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের সহযোগীদের আমাদের কোনো দলে স্থান না দেওয়ার অঙ্গীকার করছি।’ ’৯১-এর সংসদে সব দলের দাবির মুখে পতিত স্বৈরাচার এরশাদকে কারাগারে পাঠানো হলেও পরের সংসদেই তাঁর সমর্থন পেতে শুরু হয়ে যায় দুই দলের প্রতিযোগিতা। আর বামপন্থীদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ ক্ষমতা দখলের মামলাও করেছিলেন, তাঁরা এখন তাঁকেই ‘গণতন্ত্রের সুহৃদ’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
পারস্পরিক মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতার সাধারণ গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুসরণের পাশাপাশি তাঁরা ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকার আশ্বাসবাণী দিয়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদেরও তা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অথচ, কুৎসা প্রচারে এখন কর্মী-সমর্থকদের চেয়ে নেতা-নেত্রীরাই সবচেয়ে এগিয়ে আছেন।
’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের ২৫ বছর পর আমাদের রাজনীতিকেরা কি একটু আয়নায় নিজেদের চেহারাটা দেখে নেবেন? তাঁদের চেহারায় এবং রাজনীতি ও আদর্শে স্বৈরাচারের ছায়া কতটা বড় হয়ে তাঁদের আড়াল করে ফেলেছে, সেটা বুঝতে যতই দেরি হবে ততই আমাদের গণতান্ত্রিক বোধ লোপ পাবে।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
সম্ভবত সে কারণেই জেনারেল এরশাদের সেনা অভ্যুত্থানের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লেগে যায় ‘সামরিক শাসন মানি না, সামরিক আইন তুলে নাও’। ২৫ মার্চ রাতে এসব পোস্টার লাগানোর সময় গ্রেপ্তার হন বামপন্থী ছাত্রসংগঠন, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর তিন নেতা শিবলী কাইয়ুম, আবদুল আলী ও হাবিবুর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ওঠা সেই স্লোগান আর থামেনি। ’৮৩-র ১১ জানুয়ারি, ’৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারি, ’৮৪-র ২৮ ফেব্রুয়ারি, তারপর ’৮৬, ’৮৭, ’৮৮ এবং ’৯০-এর অনেকগুলো দিন আন্দোলনকারীরা সামরিক স্বৈরশাসন অবসানের দাবিতে রক্ত ঝরান। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের অনেকের নাম স্বজনেরা ছাড়া আর কেউ মনে রাখেন না। রক্তঝরা সেই তারিখগুলোও এখন আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে।
কিন্তু এসব মৃত্যু, এসব আত্মত্যাগের বিনিময়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমরা কত দূর এগোলাম? নব্বইয়ের ৬ ডিসেম্বরকে প্রথম দিকে আমরা স্বৈরাচার পতনের দিন কিংবা গণতন্ত্রের বিজয় দিবস হিসেবে উদ্যাপন করতাম। এখন আর তা বলতে পারি না। এখন অনেক কষ্ট নিয়ে শুধু গণ-অভু্যত্থান দিবস বলি। কেননা, না হয়েছে গণতন্ত্রের বিজয়, না হয়েছে ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসনের অবসান। এরশাদ যে সামরিক শাসনের পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ প্রথম সোচ্চার হলেও রাজনৈতিক দলগুলো ছিল অনেকটাই নিস্তেজ। বিএনপি ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিত ও বিপর্যস্ত। আর আওয়ামী লীগ বিএনপির নাকাল দশায় আত্মতৃপ্ত। ’৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র আন্দোলন দমনে নির্বিচার শক্তি প্রয়োগে অনেকের প্রাণহানির পর আওয়ামী লীগ, সিপিবি, ন্যাপ, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারা ড. কামাল হোসেনের বাসায় বৈঠকে বসলে সেনাবাহিনী তাঁদের অনেককেই চোখ বেঁধে উঠিয়ে নিয়ে যায়। সামরিক জান্তার সেই ধরপাকড়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে রাজনীতিকদের সময় লাগে বছর খানেক।
তবে জেনারেল এরশাদ বেশি দিন স্বস্তিতে থাকতে পারেননি। ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি শ্রমিকেরাও তাঁদের দাবি–দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণকে ঘিরে গড়ে ওঠে আইনজীবীদের আন্দোলন। সামরিক ফরমানে সংবাদপত্র বন্ধ হওয়ায় সাংবাদিকেরাও রাস্তায় নামেন। ছাত্র-শ্রমিক ও পেশাজীবীদের আন্দোলনের পাশাপাশি উপজেলা গঠন ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের উদ্যোগ রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রাণসঞ্চার করে। আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের জোট ১৫ দল এবং বিএনপি ও কয়েকটি ডানপন্থী দলের জোট ৭ দল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে অভূতপূর্ব সমঝোতায় পৌঁছায়। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া বৈঠক করে অভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন পরিচালনার পথে অগ্রসর হন। জামায়াতে ইসলামীর কোনো জোটে জায়গা না হলেও উভয় জোটের সঙ্গেই তাদের একধরনের অলিখিত সমঝোতার রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং সব আন্দোলনে তাদেরও অংশ নিতে দেখা যায়। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দুই নেত্রী ’৮৬-র সংসদ নির্বাচনে দেড় শটি করে আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিলে ভরাডুবি নিশ্চিত জেনে সংবিধান সংশোধন করে কোনো ব্যক্তির একসঙ্গে পাঁচটির বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে সেই সমঝোতা টেকেনি এবং আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেয় আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট তা বর্জন করে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে ভেঙে যায় ১৫ দল এবং বামপন্থী ৫টি দল জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে নির্বাচন বর্জনে শামিল হয়। কিছুটা সময়ের জন্য এরশাদ থিতু হয়ে বসলেও ’৮৭-তে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে এবং সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়।
’৯০-এ এরশাদবিরোধী আন্দোলন যে গণ-অভু্যত্থানে রূপ নেয়, তা আরও আগে সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। কেননা, ছাত্র-তরুণেরা আট বছরে বারবার রাজপথে নেমে মার খেয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, জেল খেটেছেন। অথচ রাজনীতির অঙ্গনে সামরিক শাসন অবসানে সুদৃঢ় সমঝোতা ’৯০-র আগ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। অনেকের মতে, ওই দীর্ঘসূত্রতার কারণ দুটো বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই প্রধানের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। এরশাদের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে ১৫, ৭ ও ৫-দলীয় জোট ওই বছরের ২১ নভেম্বর একটি যুক্ত ঘোষণা ও রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আচরণবিধিতে সম্মত হয় ও তা প্রকাশ করে। ওই যুক্ত ঘোষণায় ‘দেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা ও জীবনপদ্ধতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা’র কথা ছিল। ওই যুক্ত ঘোষণায় ‘সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার’ করে ‘তিন জোটের নিকট গ্রহণযোগ্য একজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তির নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা’ এবং ‘একটি সার্বভৌম জাতীয় সংসদের জন্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা’ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল।
ওই ঘোষণায় (অনুচ্ছেদ ৪ক) তিনটি জোট অঙ্গীকার করেছিল, দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যেকোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা প্রতিরোধ করা হবে। নির্বাচন ব্যতীত অসাংবিধানিক বা সংবিধান-বহির্ভূত কোনো পন্থায়, কোনো অজুহাতেই নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা হবে (অনুচ্ছেদ ৪খ)। মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সব আইন বাতিল করা হবে (অনুচ্ছেদ ৪গ)।
ওই যুক্ত ঘোষণায় ‘প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ছলে-বলে-কৌশলে’ এরশাদ সরকারের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টার বিবরণে ‘ভোট চুরি, ভোট জালিয়াতি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, নির্লজ্জ ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলে আসছে’ বলে বলা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওই আন্দোলনের ফসল ’৯১-তে যে সংসদ গঠিত হয়েছিল, সেই সংসদেরই উপনির্বাচনগুলোতে কেন্দ্র দখল ও ভোট জালিয়াতির দৌরাত্ম্য ফিরে এল। ফলে ওই সংসদেই নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার দাবি উঠল এবং সেই দাবি পূরণের আগে অনুষ্ঠিত হলো একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন। তারপর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো নির্বাচনই এসব দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত ছিল না। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে যে নির্বাচনই হয়েছে তা সে স্থানীয় সরকার সংস্থারই হোক—সব ক্ষেত্রেই প্রহসনের পুনর্মঞ্চায়ন দেখা গেছে। আর সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার মোড়কে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে ১৫৪ জনের ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে জনগণের মৌলিক অধিকার কীভাবে সুরক্ষা পেয়েছে, সে প্রশ্ন এখন অনেকটা তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয়। তাতে দৈনন্দিন বাস্তবতায় হেরফের ঘটার কারণ নেই।
মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী আইনগুলো বাতিলের অঙ্গীকার সব রাজনৈতিক দলই ভুলে গেছে। কেননা, ক্ষমতায় থাকার এবং ক্ষমতার স্বাদ শান্তিতে ভোগ করার জন্য বিরোধীদের নিপীড়নের হাতিয়ারগুলো সবারই প্রয়োজন হয়। ক্ষমতায় থাকলে তাই তাঁরা ৫৪ ধারার যথেচ্ছ প্রয়োগ করেন। কোন আইনে গ্রেপ্তার বা জেলে পাঠানো হবে সেটা তখন বড় প্রশ্ন নয়, বড় কথা হলো, আগে ধরো এবং তারপর সুবিধামতো আইনে মামলা দাও। ৫ ডিসেম্বরের সংবাদপত্রগুলোতে ১৯টি পরিবারের আকুতি ফলাও করে ছাপা হয়েছে, যাতে তারা তাদের দুই বছর ধরে নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধান চেয়েছে। বাংলাদেশে যে গুমের কথা সামরিক শাসনের সময়েও শোনা যায়নি সেই অপচর্চা কোন ধরনের আইনের শাসন, সে কথা আজ আর রাজনীতিকেরা কেউই তোলেন না। সব ধরনের কালাকানুন বাতিলের যে অঙ্গীকার উচ্চারিত হয়েছিল, তাতে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিক দলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত ছাপাখানা ও প্রকাশনা আইন (ঘোষণা ও নিবন্ধন) ১৯৭৩ এর একটি ধারা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করলেও নতুন রূপে একের পর এক আইন ও বিধিমালা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বহাল আছে। এসেছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা, তৈরি হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তা আইন। সর্বোপরি আছে কথিত মানহানির অভিযোগে ফৌজদারি মামলার অপপ্রয়োগ।
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই তিন জোটের রূপরেখায় সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু সেই আদালত শুরু থেকেই রাজনীতিকরণের শিকার হয়েছে এবং নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের টানাপোড়েনের অবসান ঘটেনি।
যুক্ত ঘোষণার সঙ্গে তিনটি জোটের নেতারা যে আচরণবিধিতে সম্মত হয়েছিলেন, সেটিকেও ধীরে ধীরে তাঁরা বিসর্জন দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করতে স্বৈরাচারের দোসরদের চক্রান্ত অব্যাহত থাকার কথা জানিয়ে তাঁরা বলেছিলেন যে ‘এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের সহযোগীদের আমাদের কোনো দলে স্থান না দেওয়ার অঙ্গীকার করছি।’ ’৯১-এর সংসদে সব দলের দাবির মুখে পতিত স্বৈরাচার এরশাদকে কারাগারে পাঠানো হলেও পরের সংসদেই তাঁর সমর্থন পেতে শুরু হয়ে যায় দুই দলের প্রতিযোগিতা। আর বামপন্থীদের মধ্যে যাঁরা সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন, এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ ক্ষমতা দখলের মামলাও করেছিলেন, তাঁরা এখন তাঁকেই ‘গণতন্ত্রের সুহৃদ’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
পারস্পরিক মতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতার সাধারণ গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুসরণের পাশাপাশি তাঁরা ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশপ্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকার আশ্বাসবাণী দিয়ে দলীয় কর্মী-সমর্থকদেরও তা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছিলেন। অথচ, কুৎসা প্রচারে এখন কর্মী-সমর্থকদের চেয়ে নেতা-নেত্রীরাই সবচেয়ে এগিয়ে আছেন।
’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের ২৫ বছর পর আমাদের রাজনীতিকেরা কি একটু আয়নায় নিজেদের চেহারাটা দেখে নেবেন? তাঁদের চেহারায় এবং রাজনীতি ও আদর্শে স্বৈরাচারের ছায়া কতটা বড় হয়ে তাঁদের আড়াল করে ফেলেছে, সেটা বুঝতে যতই দেরি হবে ততই আমাদের গণতান্ত্রিক বোধ লোপ পাবে।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments