প্রবাসীদের এসওএস বার্তা শুনুন by ফারুক ওয়াসিফ
‘আমাদের
রক্ষা করো নতুবা গুলি করে মারো’! এত মরিয়া কারা হতে পারেন? না, তাঁরা
সিরীয় শরণার্থী নন, নন রোহিঙ্গা দেশহীন। তাঁরা বাংলাদেশি। গ্রিস সীমান্তে
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর শরণার্থীদের সঙ্গে এক সারিতে তাঁরাও
দাঁড়িয়ে। তাঁরাও বলছেন, আমাদের বাঁচান। মেসিডোনিয়া যেমন সিরীয় শরণার্থীদের
সামনে নিষেধের কাঁটাতার তুলেছে, সেই কাঁটাতারে আমাদের দেশি ভাইয়েরাও আটকা।
তাঁরাও ইউরোপের সমৃদ্ধ কোনো কোনো দেশে যেতে চান। প্রথম আলোর ২৪ নভেম্বরের
সংবাদ বলছে, মেসিডোনিয়া সীমান্তে তাঁদের আটকে রেখেছে পুলিশ। এএফপির ছবি
দেখে তাঁদের যুদ্ধের তাড়া খাওয়া মানুষ থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না। এঁদের
হয়তো ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’ বলা যায়। এই অভিবাসীরা গত সোমবার থেকে
গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্তে আন্দোলন শুরু করেছেন।
ঘটনাটা তিল পরিমাণ, কিন্তু তালের আকার পাওয়ার সব সম্ভাবনা এর মধ্যে রয়েছে। দুঃখজনক, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে এখনো মুখ খোলেনি। কিন্তু ঘটনা কীভাবে পাকিয়ে উঠছে, প্রথম আলোরই বিগত কিছু খবর খেয়াল করলেই তা বোঝা সম্ভব দেখা যাবে। ২০১১ সালে গ্রিস উপকূলে ১০ বাংলাদেশি সমুদ্রে ডুবে মারা যান। ২০১৩ সালে খামারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর গুলিতে ৩২ জন আহত হন। ২০১৪ সালে খামারের মালিককে সে দেশের আদালত বেকসুর খালাস দিয়ে দেন। গত আগস্টে গ্রিসের কুস দ্বীপে ২০০ বাংলাদেশি অভিবাসীর আটকে পড়ার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে।
এর পটভূমিতে ছিল বাংলাদেশের সাহসী উদ্যোক্তা ও শ্রমিকদের এক সাফল্য-কাহিনি। গ্রিসে বাংলাদেশিদের মালিকানায় ছোট-বড় প্রায় ২৫০টি পোশাক কারখানা রয়েছে। কারখানাগুলোয় কাজ করেন পাঁচ হাজার বাংলাদেশি। বাংলাদেশ থেকে পাওয়া ক্রয়াদেশের ওপরই মূলত এসব কারখানা চলে। কিন্তু ২০১৪ সালে গ্রিস দেউলিয়া হয়ে গেলে অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকেও তাদের ক্রয়াদেশ কমে আসায় শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়। এসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে শত শত নয়, হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক ইউরোপে পাড়ি জমাতে মরিয়া হবেন। গ্রিসে সরকারি হিসাবে ২০ হাজার বাংলাদেশি থাকার কথা। বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, মালে, ইরাক প্রভৃতি যুধ্যমান দেশের অবশিষ্ট বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী যুক্তরাজ্যসহ ধনী দেশগুলোকে বাংলাদেশের দুর্গতদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তা শুনবে কেন?
এঁদের পেছনে যাওয়ারও উপায় নেই, সামনের দিকেও কাঁটাতার ও সীমান্ত বাহিনী। আর সমুদ্র তো মরণের ফাঁদ। বাধ্য হয়ে তাঁরা সেখানকার একটি রেলপথ অবরোধ করে বলেছেন, ‘আমাদের গুলি করে মেরে ফেলো, আমরা কখনোই ফিরে যাব না।’
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়ার ভয় আছে। অন্যদিকে, প্যারিসে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের হামলার পর রাশিয়া বাদে পশ্চিমা দুনিয়াতেই মুসলিমভীতি বাড়ছে। ইউরোপের ডানপন্থী দল এবং কিছু কিছু মিডিয়া তীব্র মুসলিমবিদ্বেষ ছড়াতে কোমর কষে নেমেছে। এতে তাদের ফায়দা রয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের শ্রমিকেরা নিজেদের ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’ বললেও তাঁদের দেখা হবে ধর্মপরিচয় খোঁজার হিংসুক চশমা দিয়ে। যদিও বাস্তবে আইএসকে মুসলিম বলা যায় কি না, কিংবা কোনো বিচ্ছিন্ন মুসলিম ঘাতকদের দায় সমগ্র ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীর ওপর চাপানো যায় না। তারপরও যুক্তির কথা কে শুনবে? বাস্তবে ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মোট সন্ত্রাসী ঘটনার মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশে মুসলমান কেউ জড়িত ছিলেন। ইহুদিরা জড়িত ৭ শতাংশ ক্ষেত্রে। তথ্যটা এফবিআইয়ের দেওয়া। তাহলেও ঘৃণা ও আতঙ্ক সত্য ও ন্যায়কে পরাস্ত করছে।
এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, ইউরোপে কর্মরত মুসলমান অভিবাসী ও শ্রমিকদের নিয়ে বাংলাদেশকে দূরদর্শী ও মানবিক কর্মসূচি নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা তো কিছু জানতাম না, এ কথা বলে পার পাওয়া যাবে না। যখন বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে শত শত বাংলাদেশির গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছিল, তখনো সরকার কিছু না জানার ভান করেছিল। না জানা দোষ নয়, কিন্তু জানতে না চাওয়া অপরাধ; বিশেষত যেখানে দেশের নাগরিকদের জীবনের প্রশ্ন জড়িত। যাঁরা আবার সোনার ডিম পাড়া হাঁস, যাঁদের রেমিট্যান্স ছাড়া বাংলাদেশ এখনো চলতে সক্ষম নয়। এটা প্রতিদান বা দয়া নয়, এটা সরকারের জরুরি দায়িত্ব।
জাতিসংঘ শরণার্থী আইন সেকেলে। আমাদের জলবায়ু শরণার্থী, যুদ্ধতাড়িত শরণার্থী, অর্থনৈতিক অভিবাসীদের সেই সংজ্ঞায় সঠিকভাবে ধারণ করা হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনই বলি, যুদ্ধ-সন্ত্রাসই বলি, আর বলি অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা, এসবের কোনোটির দায় একসময়কার ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্য এবং বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণকারী দেশগুলো এড়াতে পারে না। বুকার বিজয়ী লেখক মহসিন হামিদ আমাদের চিন্তাকে থমকে দেন এই বলে যে, ‘একদিন পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষ আমাদের যুগের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখবে এবং চিন্তা করবে, এরা স্বাধীনতার পূজারি হয়েও কীভাবে অভিবাসীদের বন্দী করা ও ফেরত পাঠানোকে আইন করে বৈধতা দেয়! সেই আগামীর মানুষ ঠিক সেই চোখেই আমাদের দেখবে, যেভাবে আমরা দেখি দাসপ্রথাকে আইনসম্মত করা সমাজকে।’
একদিকে বিশ্বের ধনী ও তাদের পুঁজি, পণ্য, অস্ত্র অসম্ভব গতিশীল, কোনো সীমান্তই তাদের আটকে রাখতে পারে না। অন্যদিকে দরিদ্র ও আশ্রয়প্রার্থীরা হয় অঞ্চলবন্দী ও স্থানীয়তার অনন্ত বাঁধনে আটক। যুদ্ধ, মন্বন্তর, জলবায়ু পীড়িত করলেও সীমান্তের কাঁটাতার পেরোনো তাদের জন্য নিষিদ্ধ। ক্রমেই শরণার্থী পরিচয় ভারাক্রান্ত হচ্ছে অপরাধী, সন্ত্রাসী, বিশৃঙ্খলাকারী ঊনমানব হিসেবে। ধনী দেশগুলোর নীতিনির্ধারকেরা ‘দুর্গ মানসিকতা’র পরিচয় দিচ্ছেন। আর কাঁটাতারের বেড়ার এপারে অপেক্ষমাণ যাঁরা, যাঁরা শরণার্থীশিবিরের অমানবিক-অসামাজিক ঘেরাটোপে আবদ্ধ, তাঁরা স্থায়ীভাবে ‘অস্থায়ী দশা’য় ঝুলে থাকছেন। এঁদের বলা যায় নৈরাষ্ট্রের নৈনাগরিক। এঁরা নেতিবাচক বিশ্বায়নের শিকার। এঁরা নিজ সমাজ হারিয়েছেন, কিন্তু নতুন সমাজেও তাঁদের অবস্থান মানববর্জ্য হিসেবে। কিন্তু এই দুর্ভাগ্যের জন্য তাঁরা কোনোভাবেই দায়ী নন। প্রশ্নটাও আর মানবিকতার নয়, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। একদিকে শরণার্থীদের বলা হচ্ছে সম্ভাব্য শরণার্থী, সভ্যতার সুযোগের অযোগ্য, অন্যদিকে বহিরাগত আতঙ্ক সৃষ্টি করে শক্তিশালী হচ্ছে ডানপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদ: ভারত থেকে ফ্রান্স অবধি।
এমন নয় যে ইউরোপের বাংলাদেশি শ্রমিক দরকার নেই। প্রচণ্ড দরকার আছে। বিশেষত, জার্মানির মতো বিরাট অর্থনীতির দেশের। আমাদের দরকার অসুবিধাকে সুবিধায় পরিণত করার পথে হাঁটা। জাতীয়ভাবেই এ বিষয়ে এখনই তৎপর না হলে আচানক বিরাট বিপদে পড়তে পারেন লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি। অথচ পরিহাসের কথা, আশ্রয়ণ, প্রত্যাবাসন ও স্থানান্তর তো দূরের কথা, ১১ লাখ প্রবাসীর পাসপোর্ট অচল হতে বসেছে। কারণ, তাঁদের হাতে সেই পুরোনো পাসপোর্ট! আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (আইসিএও) ১৬ বছর আগে বাংলাদেশকে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট, এমআরপি) চালুর নির্দেশনা দিলেও কাজটা হয়নি। দুনিয়া চলে রকেটগতিতে, আমরা চলি গদাইলস্করি চালে।
এ মুহূর্তে তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এটাই বলার আছে, ভাই, এভাবে হয় না, হবে না, হওয়ার নয়। প্রবাসীদের এসওএস বার্তা শুনুন।
ঘটনাটা তিল পরিমাণ, কিন্তু তালের আকার পাওয়ার সব সম্ভাবনা এর মধ্যে রয়েছে। দুঃখজনক, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অথবা প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে এখনো মুখ খোলেনি। কিন্তু ঘটনা কীভাবে পাকিয়ে উঠছে, প্রথম আলোরই বিগত কিছু খবর খেয়াল করলেই তা বোঝা সম্ভব দেখা যাবে। ২০১১ সালে গ্রিস উপকূলে ১০ বাংলাদেশি সমুদ্রে ডুবে মারা যান। ২০১৩ সালে খামারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ওপর গুলিতে ৩২ জন আহত হন। ২০১৪ সালে খামারের মালিককে সে দেশের আদালত বেকসুর খালাস দিয়ে দেন। গত আগস্টে গ্রিসের কুস দ্বীপে ২০০ বাংলাদেশি অভিবাসীর আটকে পড়ার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আসে।
এর পটভূমিতে ছিল বাংলাদেশের সাহসী উদ্যোক্তা ও শ্রমিকদের এক সাফল্য-কাহিনি। গ্রিসে বাংলাদেশিদের মালিকানায় ছোট-বড় প্রায় ২৫০টি পোশাক কারখানা রয়েছে। কারখানাগুলোয় কাজ করেন পাঁচ হাজার বাংলাদেশি। বাংলাদেশ থেকে পাওয়া ক্রয়াদেশের ওপরই মূলত এসব কারখানা চলে। কিন্তু ২০১৪ সালে গ্রিস দেউলিয়া হয়ে গেলে অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকেও তাদের ক্রয়াদেশ কমে আসায় শ্রমিকদের চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হয়। এসব কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে শত শত নয়, হাজার হাজার বাংলাদেশি শ্রমিক ইউরোপে পাড়ি জমাতে মরিয়া হবেন। গ্রিসে সরকারি হিসাবে ২০ হাজার বাংলাদেশি থাকার কথা। বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি। তাঁদের সঙ্গে যোগ হয়েছেন লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, মালে, ইরাক প্রভৃতি যুধ্যমান দেশের অবশিষ্ট বাংলাদেশি শ্রমিকেরা। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী যুক্তরাজ্যসহ ধনী দেশগুলোকে বাংলাদেশের দুর্গতদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তা শুনবে কেন?
এঁদের পেছনে যাওয়ারও উপায় নেই, সামনের দিকেও কাঁটাতার ও সীমান্ত বাহিনী। আর সমুদ্র তো মরণের ফাঁদ। বাধ্য হয়ে তাঁরা সেখানকার একটি রেলপথ অবরোধ করে বলেছেন, ‘আমাদের গুলি করে মেরে ফেলো, আমরা কখনোই ফিরে যাব না।’
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়ার ভয় আছে। অন্যদিকে, প্যারিসে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের হামলার পর রাশিয়া বাদে পশ্চিমা দুনিয়াতেই মুসলিমভীতি বাড়ছে। ইউরোপের ডানপন্থী দল এবং কিছু কিছু মিডিয়া তীব্র মুসলিমবিদ্বেষ ছড়াতে কোমর কষে নেমেছে। এতে তাদের ফায়দা রয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের শ্রমিকেরা নিজেদের ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’ বললেও তাঁদের দেখা হবে ধর্মপরিচয় খোঁজার হিংসুক চশমা দিয়ে। যদিও বাস্তবে আইএসকে মুসলিম বলা যায় কি না, কিংবা কোনো বিচ্ছিন্ন মুসলিম ঘাতকদের দায় সমগ্র ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীর ওপর চাপানো যায় না। তারপরও যুক্তির কথা কে শুনবে? বাস্তবে ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মোট সন্ত্রাসী ঘটনার মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশে মুসলমান কেউ জড়িত ছিলেন। ইহুদিরা জড়িত ৭ শতাংশ ক্ষেত্রে। তথ্যটা এফবিআইয়ের দেওয়া। তাহলেও ঘৃণা ও আতঙ্ক সত্য ও ন্যায়কে পরাস্ত করছে।
এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, ইউরোপে কর্মরত মুসলমান অভিবাসী ও শ্রমিকদের নিয়ে বাংলাদেশকে দূরদর্শী ও মানবিক কর্মসূচি নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা তো কিছু জানতাম না, এ কথা বলে পার পাওয়া যাবে না। যখন বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে শত শত বাংলাদেশির গণকবর আবিষ্কৃত হয়েছিল, তখনো সরকার কিছু না জানার ভান করেছিল। না জানা দোষ নয়, কিন্তু জানতে না চাওয়া অপরাধ; বিশেষত যেখানে দেশের নাগরিকদের জীবনের প্রশ্ন জড়িত। যাঁরা আবার সোনার ডিম পাড়া হাঁস, যাঁদের রেমিট্যান্স ছাড়া বাংলাদেশ এখনো চলতে সক্ষম নয়। এটা প্রতিদান বা দয়া নয়, এটা সরকারের জরুরি দায়িত্ব।
জাতিসংঘ শরণার্থী আইন সেকেলে। আমাদের জলবায়ু শরণার্থী, যুদ্ধতাড়িত শরণার্থী, অর্থনৈতিক অভিবাসীদের সেই সংজ্ঞায় সঠিকভাবে ধারণ করা হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনই বলি, যুদ্ধ-সন্ত্রাসই বলি, আর বলি অর্থনৈতিক বঞ্চনার কথা, এসবের কোনোটির দায় একসময়কার ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্য এবং বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণকারী দেশগুলো এড়াতে পারে না। বুকার বিজয়ী লেখক মহসিন হামিদ আমাদের চিন্তাকে থমকে দেন এই বলে যে, ‘একদিন পৃথিবী নামক গ্রহের মানুষ আমাদের যুগের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখবে এবং চিন্তা করবে, এরা স্বাধীনতার পূজারি হয়েও কীভাবে অভিবাসীদের বন্দী করা ও ফেরত পাঠানোকে আইন করে বৈধতা দেয়! সেই আগামীর মানুষ ঠিক সেই চোখেই আমাদের দেখবে, যেভাবে আমরা দেখি দাসপ্রথাকে আইনসম্মত করা সমাজকে।’
একদিকে বিশ্বের ধনী ও তাদের পুঁজি, পণ্য, অস্ত্র অসম্ভব গতিশীল, কোনো সীমান্তই তাদের আটকে রাখতে পারে না। অন্যদিকে দরিদ্র ও আশ্রয়প্রার্থীরা হয় অঞ্চলবন্দী ও স্থানীয়তার অনন্ত বাঁধনে আটক। যুদ্ধ, মন্বন্তর, জলবায়ু পীড়িত করলেও সীমান্তের কাঁটাতার পেরোনো তাদের জন্য নিষিদ্ধ। ক্রমেই শরণার্থী পরিচয় ভারাক্রান্ত হচ্ছে অপরাধী, সন্ত্রাসী, বিশৃঙ্খলাকারী ঊনমানব হিসেবে। ধনী দেশগুলোর নীতিনির্ধারকেরা ‘দুর্গ মানসিকতা’র পরিচয় দিচ্ছেন। আর কাঁটাতারের বেড়ার এপারে অপেক্ষমাণ যাঁরা, যাঁরা শরণার্থীশিবিরের অমানবিক-অসামাজিক ঘেরাটোপে আবদ্ধ, তাঁরা স্থায়ীভাবে ‘অস্থায়ী দশা’য় ঝুলে থাকছেন। এঁদের বলা যায় নৈরাষ্ট্রের নৈনাগরিক। এঁরা নেতিবাচক বিশ্বায়নের শিকার। এঁরা নিজ সমাজ হারিয়েছেন, কিন্তু নতুন সমাজেও তাঁদের অবস্থান মানববর্জ্য হিসেবে। কিন্তু এই দুর্ভাগ্যের জন্য তাঁরা কোনোভাবেই দায়ী নন। প্রশ্নটাও আর মানবিকতার নয়, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। একদিকে শরণার্থীদের বলা হচ্ছে সম্ভাব্য শরণার্থী, সভ্যতার সুযোগের অযোগ্য, অন্যদিকে বহিরাগত আতঙ্ক সৃষ্টি করে শক্তিশালী হচ্ছে ডানপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদ: ভারত থেকে ফ্রান্স অবধি।
এমন নয় যে ইউরোপের বাংলাদেশি শ্রমিক দরকার নেই। প্রচণ্ড দরকার আছে। বিশেষত, জার্মানির মতো বিরাট অর্থনীতির দেশের। আমাদের দরকার অসুবিধাকে সুবিধায় পরিণত করার পথে হাঁটা। জাতীয়ভাবেই এ বিষয়ে এখনই তৎপর না হলে আচানক বিরাট বিপদে পড়তে পারেন লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি। অথচ পরিহাসের কথা, আশ্রয়ণ, প্রত্যাবাসন ও স্থানান্তর তো দূরের কথা, ১১ লাখ প্রবাসীর পাসপোর্ট অচল হতে বসেছে। কারণ, তাঁদের হাতে সেই পুরোনো পাসপোর্ট! আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (আইসিএও) ১৬ বছর আগে বাংলাদেশকে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট, এমআরপি) চালুর নির্দেশনা দিলেও কাজটা হয়নি। দুনিয়া চলে রকেটগতিতে, আমরা চলি গদাইলস্করি চালে।
এ মুহূর্তে তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এটাই বলার আছে, ভাই, এভাবে হয় না, হবে না, হওয়ার নয়। প্রবাসীদের এসওএস বার্তা শুনুন।
গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্তে আটকা পড়া শরণার্থীরা গতকালও সহায়তার জন্য আকুতি জানান। এই শরণার্থীদের মধ্যে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান ছাড়াও বাংলাদেশের নাগরিক আছেন। ছবি: এএফপি |
No comments