বিদেশি নাগরিক হত্যার নির্মোহ তদন্ত জরুরি by এম সাখাওয়াত হোসেন
হঠাৎ
করেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে
বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এর কারণ রহস্যজনকভাবে এক
সপ্তাহেরও কম সময়ে দেশের দুই প্রান্তে দুজন বিদেশি নাগরিকের দৃশ্যত সংগঠিত
কোনো গোষ্ঠী দ্বারা একই কায়দায় খুন হওয়া। ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক
নেদারল্যান্ডসভিত্তিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) কর্মকর্তা সিজার
তাবেলা এমন সময় খুন হলেন, যখন বাংলাদেশে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের
নিরাপত্তার শঙ্কা দূর করতে দেশের সরকার ও ক্রিকেট বোর্ড সব ধরনের নিশ্চয়তা
দিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশে সফর পূর্বনির্ধারিত হলেও হঠাৎ করে অস্ট্রেলীয় সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আশঙ্কার বিষয়টি তুলে ধরে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে অস্ট্রেলীয় সরকার একধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছিল এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা দল অনেকটা মুখ রক্ষার জন্য বাংলাদেশে এসেছিল। ওই দলের ফিরে যাওয়ার ক্ষণেই দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা বলে পরিচিত গুলশান কূটনৈতিকপাড়ায় মি. তাবেলা খুন হলেন। ওই জায়গার আশপাশে ছয়টি দূতাবাস ও ভারতীয় হাইকমিশনারের বাসস্থান রয়েছে।
এ ঘটনার পর অস্ট্রেলিয়া সরকারের মত পরিবর্তনের আশা করাও অস্বাভাবিক বিষয়। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে অস্ট্রেলিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্যান্য কিছু দেশ তাদের নাগরিকদের ওপর সতর্কবার্তা জারি করে। এর জের না কাটতেই প্রায় একই কায়দায় রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুন হন আরেক বিদেশি। তিনি জাপানি নাগরিক।
এ দুটি ঘটনা বাংলাদেশে অবস্থিত দূতাবাস এবং বিদেশি নাগরিকদের ভীষণভাবে শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কারণ, দুটি হত্যাই ছিল সুপরিকল্পিত এবং বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোষ্ঠী দ্বারা সংঘটিত। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাঁদের ওপরে এই তদন্তের ভার রয়েছে, তাঁরাও একমত প্রকাশ করেছেন। এমন সংগঠিত কাজ কারা করতে পারে, তা নিয়ে এখনো পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা।
ইতিমধ্যে শুধু কথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস নামক উগ্রপন্থী সংগঠন, যারা এখন ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধরত, তাদের তরফ থেকে এই হত্যার দায় স্বীকার করার খবর দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমে এসেছে। দেশের অভ্যন্তরের কোনো তথাকথিত উগ্র সন্ত্রাসী সংগঠন দায় স্বীকার করে বক্তব্য দেয়নি; যেমনটা দিয়েছিল কয়েকজন ব্লগার বলে কথিত ব্যক্তিকে হত্যার পর। এখানেই তদন্তকারীদের বিড়ম্বনা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সাতটি সন্ত্রাসী সংগঠন নিষিদ্ধের তালিকায় রয়েছে, তাদের কেউই মুখ খোলেনি। তাহলে কারা এ হত্যার জন্য দায়ী? এখন পর্যন্ত এর কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি তদন্ত সংস্থাগুলো।
এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত রয়েছে, তা নির্ণয় করতে হবে নির্মোহ এবং সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে। এ ঘটনা নিয়ে কোনো পক্ষেরই রাজনীতি করা সমীচীন হবে না বাংলাদেশে এই প্রথম এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যদিও ইতিপূর্বে বিভিন্ন কারণে দু-একজন বিদেশি খুন হয়েছেন। এ ঘটনা কারা ঘটাতে পারে, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে এ দুটি হত্যার দৃশ্যত অভিন্ন কৌশলের উল্লেখ করা অপাঙ্ক্তেয় হবে না। দুটি ঘটনায়ই ন্যূনতম পক্ষে তিনজনের উপস্থিতি ছিল; ব্যবহৃত হয়েছে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া মোটরসাইকেল। অন্তত রংপুরের ঘটনার সঙ্গে জড়িত মোটরসাইকেলের বিবরণ থেকে তেমনই তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল তেমনই হতে পারে অথবা ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহৃত হয়েছে। তিন ভাগে এই অপারেশন চালানো হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। প্রথমত, বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই গতিবিধি নজরদারিতে ছিল; দ্বিতীয় পর্ব খুনের সময় নির্ধারণ এবং তৃতীয় পর্ব ছিল নিরাপদে ঘটনাস্থল দ্রুত ত্যাগ করা। রংপুরের ঘটনা যেহেতু সকালে ঘটেছে, তাই আততায়ীদের মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। একই কায়দায় পিস্তলের ব্যবহারে অতি নিকট থেকে গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করা।
এই হত্যা দুটিকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে চিরাচরিত দোষারোপের পালা যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি আলোচনা হচ্ছে দেশে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা জঙ্গি আছে কি নেই। গত কয়েক বছর দেশের জঙ্গি দমনের চিত্র প্রায়ই দেখা যেত। বাংলাদেশে জঙ্গি দমন ও প্রতিপালন নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য আমরা শুনেছি। সরকারি মহল থেকে জঙ্গি তৎপরতা, তার বিপদ ও এই সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব হিসেবে জঙ্গি দমনের চিত্র দেশে ও দেশের বাইরে তুলে ধরার ঘটনাও আমরা দেখে আসছি। অতীতেও জোট সরকারের সময় জঙ্গি নেই এবং আছে নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। এতে যে হিতে বিপরীত হয়েছে, তা এখন সবাই উপলব্ধি করছেন আশা করি। ইতালীয় নাগরিক হত্যার পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশে আইএস বলে কিছু নেই। এ কথায় পশ্চিমা দূতাবাস, সরকার এবং যে দুই দেশের নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে, সেই দুই দেশ বিশেষ করে জাপান, আশ্বস্ত হতে পেরেছে কি না, তা এখনো অস্পষ্ট।
সবচেয়ে বড় শঙ্কার কারণ হলো দেশের অভ্যন্তরের যেসব ছোট ছোট গোষ্ঠী ইতিপূর্বের ঘটনাগুলোর দায়িত্ব নিয়েছিল, তারা এ দুই হত্যার দায় নেয়নি। তা ছাড়া ইতিপূর্বে যেসব বাংলাদেশি ব্লগার ও ভিন্নমতাবলম্বীরা খুন হয়েছেন, তাঁদের হত্যার ধরন ও ব্যবহৃত অস্ত্র বর্তমান ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ থেকে কয়েকজন ব্লগার হত্যার ধরন ও ব্যবহৃত অস্ত্র ছিল একই রকম—চাপাতি। এই প্রথম হালকা অস্ত্রের ব্যবহার দৃশ্যমান।
যাহোক, আইএস বলে কথিত যেসব বার্তা প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের গবেষক বলে পরিচিত সাইট (এসআইটিই) এবং এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রিটা কার্টজের কর্মকাণ্ড নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও প্রশ্ন রয়েছে। রিটা কার্টজের পরিবারের অতীত এবং ধর্ম ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে অনেকেই মনে করেন, এই সংগঠনটি নিরপেক্ষ নয়। এমনই একটি সংগঠনের এবং পরবর্তী সময়ে ‘রয়টার্স’-এর মাধ্যমে আইএসের সম্পৃক্ততার তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সরকার অনেকটা আত্মরক্ষামূলক বক্তব্যে আইএসের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করেছে। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগে আইএস সদস্য বা রিক্রুটকারী সন্দেহে কয়েকজন যুবককে গ্রেপ্তার করার তথ্য ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। কয়েক দিন আগেও ময়মনসিংহে একজন তরুণকে আইএসের পক্ষে লিফলেট লাগানোর অভিযোগে আটক করার খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এসব তথ্য থেকে দেশের ভেতরে ও বাইরে একধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়ছিল যে বাংলাদেশ থেকেও আইএসে যোগ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। অপরদিকে আল-কায়েদা এই অঞ্চলে, ভারতসহ তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য আঞ্চলিক সংগঠন গঠনের ঘোষণাও দিয়েছিল। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যে এখানে আল-কায়েদা এবং আইএসের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা হতে পারে। আইএস বিশ্বে এখন সবচেয়ে আলোচিত একটি গোষ্ঠীর নাম; যারা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের দখলে থাকা ভূমি বিস্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং পশ্চিমা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। অত্যন্ত নিষ্ঠুর সন্ত্রাসের কারণে পশ্চিমা বিশ্বে আইএস এক আতঙ্কের নাম। বাংলাদেশে এদের অস্তিত্ব আছে কি নেই, সেই সংশয় আছে। তবে সরকারের সাম্প্রতিক বক্তব্যে মনে হয় যে তারা আগের অবস্থান থেকে সরে আসছে।
যে দুটি হত্যা নিয়ে দেশে এবং বিদেশে তোলপাড় হচ্ছে তার সঙ্গে আইএস জড়িত কি না, তা অবশ্যই তদন্তের বিষয়। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ঘোষণা দিয়েছেন যে দুই বিদেশি হত্যায় আইএসের দাবির সত্যতা তাঁরা যাচাই করবেন। অবশ্যই করবেন, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন আল-কায়েদা নয়, আইএসই মূল শত্রু। অপরদিকে জাপান তাদের নাগরিকের হত্যা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যা জাপান সরকারের মুখপাত্রের বরাতে জানা গেল।
বাংলাদেশের এ ঘটনার সঙ্গে আইএস জড়িত কি না, তা নির্ণয় করতে হলে প্রয়োজনে অন্য দেশের সহায়তা নেওয়া উচিত। কারণ, আইএস আছে কি নেই, তা এই তদন্তের অন্যতম বিষয় হবে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের কৌশল এবং ধরনের যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে আইএস যে পদ্ধতিতে হত্যাযজ্ঞ এবং তার যে প্রচারণার উপাদান তৈরি করে, সেই কৌশলের সঙ্গে মিল নেই। আইএস সাধারণত তাদের যেকোনো কর্মকাণ্ডকে ব্যাপক প্রচারণার কাজে লাগায়, তেমন প্রয়াস এখনো দেখা যাচ্ছে না। কাজেই এখানেও সন্দেহ থাকার কথা। তবে কিছুই নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন সময়ে বা দেশে তারা ভিন্ন কৌশলও নিয়ে থাকতে পারে। এসবই তদন্তের বিষয়। আইএসের হয়ে নতুন কোনো সংগঠন বাংলাদেশে কাজ শুরু করেছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ তদন্তের বিষয় হতে পারে।
যাহোক, হঠাৎ করেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বড় ধরনের অশান্তির সংকেত দেখা দিয়েছে। এর দায়দায়িত্ব কার, সেটাও নির্ণয় করা প্রয়োজন। ইতিপূর্বে যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার অনেকগুলোই তদন্তে কোনো অগ্রগতি তো হয়নি; বরং নানা ধরনের বক্তব্যের মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে। যাদের সঠিক তদন্ত করার কথা, তারা হয়তো নানাবিধ কারণে অগ্রগতি করতে পারেনি। এ দুই ঘটনার তদন্ত যেমন সহজ হবে না, তেমনি পাশ কাটানোরও সুযোগ নেই। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে বিদেশিদের বক্তব্যদানের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কাজেই এই তদন্ত তাদের কাছেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ জাপান সরকার ও রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট।
এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত রয়েছে, তা নির্ণয় করতে হবে নির্মোহ এবং সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে। এ ঘটনা নিয়ে কোনো পক্ষেরই রাজনীতি করা সমীচীন হবে না। সঠিক তদন্তের সঙ্গে প্রয়োজনে অভিজ্ঞ দেশগুলোর সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। কারণ, এই তদন্তের বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ থাকবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের। সঠিক ও নির্মোহ তদন্ত না হলে এবং হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে না পারলে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশে সফর পূর্বনির্ধারিত হলেও হঠাৎ করে অস্ট্রেলীয় সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আশঙ্কার বিষয়টি তুলে ধরে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে অস্ট্রেলীয় সরকার একধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছিল এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা দল অনেকটা মুখ রক্ষার জন্য বাংলাদেশে এসেছিল। ওই দলের ফিরে যাওয়ার ক্ষণেই দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা বলে পরিচিত গুলশান কূটনৈতিকপাড়ায় মি. তাবেলা খুন হলেন। ওই জায়গার আশপাশে ছয়টি দূতাবাস ও ভারতীয় হাইকমিশনারের বাসস্থান রয়েছে।
এ ঘটনার পর অস্ট্রেলিয়া সরকারের মত পরিবর্তনের আশা করাও অস্বাভাবিক বিষয়। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে অস্ট্রেলিয়াসহ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্যান্য কিছু দেশ তাদের নাগরিকদের ওপর সতর্কবার্তা জারি করে। এর জের না কাটতেই প্রায় একই কায়দায় রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুন হন আরেক বিদেশি। তিনি জাপানি নাগরিক।
এ দুটি ঘটনা বাংলাদেশে অবস্থিত দূতাবাস এবং বিদেশি নাগরিকদের ভীষণভাবে শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কারণ, দুটি হত্যাই ছিল সুপরিকল্পিত এবং বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোষ্ঠী দ্বারা সংঘটিত। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাঁদের ওপরে এই তদন্তের ভার রয়েছে, তাঁরাও একমত প্রকাশ করেছেন। এমন সংগঠিত কাজ কারা করতে পারে, তা নিয়ে এখনো পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা।
ইতিমধ্যে শুধু কথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস নামক উগ্রপন্থী সংগঠন, যারা এখন ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধরত, তাদের তরফ থেকে এই হত্যার দায় স্বীকার করার খবর দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমে এসেছে। দেশের অভ্যন্তরের কোনো তথাকথিত উগ্র সন্ত্রাসী সংগঠন দায় স্বীকার করে বক্তব্য দেয়নি; যেমনটা দিয়েছিল কয়েকজন ব্লগার বলে কথিত ব্যক্তিকে হত্যার পর। এখানেই তদন্তকারীদের বিড়ম্বনা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সাতটি সন্ত্রাসী সংগঠন নিষিদ্ধের তালিকায় রয়েছে, তাদের কেউই মুখ খোলেনি। তাহলে কারা এ হত্যার জন্য দায়ী? এখন পর্যন্ত এর কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি তদন্ত সংস্থাগুলো।
এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত রয়েছে, তা নির্ণয় করতে হবে নির্মোহ এবং সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে। এ ঘটনা নিয়ে কোনো পক্ষেরই রাজনীতি করা সমীচীন হবে না বাংলাদেশে এই প্রথম এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, যদিও ইতিপূর্বে বিভিন্ন কারণে দু-একজন বিদেশি খুন হয়েছেন। এ ঘটনা কারা ঘটাতে পারে, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে এ দুটি হত্যার দৃশ্যত অভিন্ন কৌশলের উল্লেখ করা অপাঙ্ক্তেয় হবে না। দুটি ঘটনায়ই ন্যূনতম পক্ষে তিনজনের উপস্থিতি ছিল; ব্যবহৃত হয়েছে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া মোটরসাইকেল। অন্তত রংপুরের ঘটনার সঙ্গে জড়িত মোটরসাইকেলের বিবরণ থেকে তেমনই তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল তেমনই হতে পারে অথবা ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহৃত হয়েছে। তিন ভাগে এই অপারেশন চালানো হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। প্রথমত, বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই গতিবিধি নজরদারিতে ছিল; দ্বিতীয় পর্ব খুনের সময় নির্ধারণ এবং তৃতীয় পর্ব ছিল নিরাপদে ঘটনাস্থল দ্রুত ত্যাগ করা। রংপুরের ঘটনা যেহেতু সকালে ঘটেছে, তাই আততায়ীদের মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। একই কায়দায় পিস্তলের ব্যবহারে অতি নিকট থেকে গুলি করে হত্যা নিশ্চিত করা।
এই হত্যা দুটিকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে চিরাচরিত দোষারোপের পালা যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি আলোচনা হচ্ছে দেশে উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা জঙ্গি আছে কি নেই। গত কয়েক বছর দেশের জঙ্গি দমনের চিত্র প্রায়ই দেখা যেত। বাংলাদেশে জঙ্গি দমন ও প্রতিপালন নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য আমরা শুনেছি। সরকারি মহল থেকে জঙ্গি তৎপরতা, তার বিপদ ও এই সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব হিসেবে জঙ্গি দমনের চিত্র দেশে ও দেশের বাইরে তুলে ধরার ঘটনাও আমরা দেখে আসছি। অতীতেও জোট সরকারের সময় জঙ্গি নেই এবং আছে নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। এতে যে হিতে বিপরীত হয়েছে, তা এখন সবাই উপলব্ধি করছেন আশা করি। ইতালীয় নাগরিক হত্যার পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, দেশে আইএস বলে কিছু নেই। এ কথায় পশ্চিমা দূতাবাস, সরকার এবং যে দুই দেশের নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে, সেই দুই দেশ বিশেষ করে জাপান, আশ্বস্ত হতে পেরেছে কি না, তা এখনো অস্পষ্ট।
সবচেয়ে বড় শঙ্কার কারণ হলো দেশের অভ্যন্তরের যেসব ছোট ছোট গোষ্ঠী ইতিপূর্বের ঘটনাগুলোর দায়িত্ব নিয়েছিল, তারা এ দুই হত্যার দায় নেয়নি। তা ছাড়া ইতিপূর্বে যেসব বাংলাদেশি ব্লগার ও ভিন্নমতাবলম্বীরা খুন হয়েছেন, তাঁদের হত্যার ধরন ও ব্যবহৃত অস্ত্র বর্তমান ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ থেকে কয়েকজন ব্লগার হত্যার ধরন ও ব্যবহৃত অস্ত্র ছিল একই রকম—চাপাতি। এই প্রথম হালকা অস্ত্রের ব্যবহার দৃশ্যমান।
যাহোক, আইএস বলে কথিত যেসব বার্তা প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের গবেষক বলে পরিচিত সাইট (এসআইটিই) এবং এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রিটা কার্টজের কর্মকাণ্ড নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও প্রশ্ন রয়েছে। রিটা কার্টজের পরিবারের অতীত এবং ধর্ম ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে অনেকেই মনে করেন, এই সংগঠনটি নিরপেক্ষ নয়। এমনই একটি সংগঠনের এবং পরবর্তী সময়ে ‘রয়টার্স’-এর মাধ্যমে আইএসের সম্পৃক্ততার তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সরকার অনেকটা আত্মরক্ষামূলক বক্তব্যে আইএসের অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করেছে। অথচ মাত্র কয়েক মাস আগে আইএস সদস্য বা রিক্রুটকারী সন্দেহে কয়েকজন যুবককে গ্রেপ্তার করার তথ্য ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। কয়েক দিন আগেও ময়মনসিংহে একজন তরুণকে আইএসের পক্ষে লিফলেট লাগানোর অভিযোগে আটক করার খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এসব তথ্য থেকে দেশের ভেতরে ও বাইরে একধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়ছিল যে বাংলাদেশ থেকেও আইএসে যোগ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। অপরদিকে আল-কায়েদা এই অঞ্চলে, ভারতসহ তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য আঞ্চলিক সংগঠন গঠনের ঘোষণাও দিয়েছিল। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যে এখানে আল-কায়েদা এবং আইএসের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা হতে পারে। আইএস বিশ্বে এখন সবচেয়ে আলোচিত একটি গোষ্ঠীর নাম; যারা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের দখলে থাকা ভূমি বিস্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং পশ্চিমা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। অত্যন্ত নিষ্ঠুর সন্ত্রাসের কারণে পশ্চিমা বিশ্বে আইএস এক আতঙ্কের নাম। বাংলাদেশে এদের অস্তিত্ব আছে কি নেই, সেই সংশয় আছে। তবে সরকারের সাম্প্রতিক বক্তব্যে মনে হয় যে তারা আগের অবস্থান থেকে সরে আসছে।
যে দুটি হত্যা নিয়ে দেশে এবং বিদেশে তোলপাড় হচ্ছে তার সঙ্গে আইএস জড়িত কি না, তা অবশ্যই তদন্তের বিষয়। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ঘোষণা দিয়েছেন যে দুই বিদেশি হত্যায় আইএসের দাবির সত্যতা তাঁরা যাচাই করবেন। অবশ্যই করবেন, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন আল-কায়েদা নয়, আইএসই মূল শত্রু। অপরদিকে জাপান তাদের নাগরিকের হত্যা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যা জাপান সরকারের মুখপাত্রের বরাতে জানা গেল।
বাংলাদেশের এ ঘটনার সঙ্গে আইএস জড়িত কি না, তা নির্ণয় করতে হলে প্রয়োজনে অন্য দেশের সহায়তা নেওয়া উচিত। কারণ, আইএস আছে কি নেই, তা এই তদন্তের অন্যতম বিষয় হবে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের কৌশল এবং ধরনের যে চিত্র পাওয়া যায়, তাতে আইএস যে পদ্ধতিতে হত্যাযজ্ঞ এবং তার যে প্রচারণার উপাদান তৈরি করে, সেই কৌশলের সঙ্গে মিল নেই। আইএস সাধারণত তাদের যেকোনো কর্মকাণ্ডকে ব্যাপক প্রচারণার কাজে লাগায়, তেমন প্রয়াস এখনো দেখা যাচ্ছে না। কাজেই এখানেও সন্দেহ থাকার কথা। তবে কিছুই নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন সময়ে বা দেশে তারা ভিন্ন কৌশলও নিয়ে থাকতে পারে। এসবই তদন্তের বিষয়। আইএসের হয়ে নতুন কোনো সংগঠন বাংলাদেশে কাজ শুরু করেছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ তদন্তের বিষয় হতে পারে।
যাহোক, হঠাৎ করেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বড় ধরনের অশান্তির সংকেত দেখা দিয়েছে। এর দায়দায়িত্ব কার, সেটাও নির্ণয় করা প্রয়োজন। ইতিপূর্বে যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার অনেকগুলোই তদন্তে কোনো অগ্রগতি তো হয়নি; বরং নানা ধরনের বক্তব্যের মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছে। যাদের সঠিক তদন্ত করার কথা, তারা হয়তো নানাবিধ কারণে অগ্রগতি করতে পারেনি। এ দুই ঘটনার তদন্ত যেমন সহজ হবে না, তেমনি পাশ কাটানোরও সুযোগ নেই। দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে বিদেশিদের বক্তব্যদানের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কাজেই এই তদন্ত তাদের কাছেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ জাপান সরকার ও রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট।
এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত রয়েছে, তা নির্ণয় করতে হবে নির্মোহ এবং সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে। এ ঘটনা নিয়ে কোনো পক্ষেরই রাজনীতি করা সমীচীন হবে না। সঠিক তদন্তের সঙ্গে প্রয়োজনে অভিজ্ঞ দেশগুলোর সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে। কারণ, এই তদন্তের বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ থাকবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের। সঠিক ও নির্মোহ তদন্ত না হলে এবং হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে না পারলে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments