তাঁর স্বপ্ন ও ভাষা বেঁচে থাক by মাতিয়া বানু
বাংলার
একটি প্রবাদ এ রকম, ‘আজ মরলে কাল বাদে হবে তিন দিন, মানে শোকের তীব্রতা
যাবে কমে, তুমি হারিয়ে যাবে বিস্মৃতির অতলে।’ আমার বাবাকে এতবার বলতে
শুনেছি এই কথা যে এখনো তাঁর কণ্ঠই কানে বাজে। সত্যিই কীভাবে দিন চলে যায়,
পেরিয়ে গেল একটা বছর।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন চলে গেছেন এক বছর হয়ে গেল। আজ বাদে কাল তিন দিন হলে শোক কমে যায় ঠিকই, কিন্তু বছর চলে গেলেও আমার মনে হচ্ছে তিন দিন। এই না সেদিন শহীদ মিনারে কত লোক জড়ো হয়ে ভাষা-মতিনকে শ্রদ্ধা জানাল! কবে হলো যেন, পরশু, নাকি তার আগের দিন, নাকি গত সপ্তাহে! ভুলোমনা মেয়েরা হয়তো বাবার প্রস্থানের দিনের হিসাব রাখতে পারে না। যে চলে যায়, তার কাছের লোকদের মন এত সহজে প্রস্থান মেনে নিতে পারে না! সময় লাগে। আর আমার মন না মানলেও এটাই সত্য, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় সবকিছু। নতুনকে জায়গা করে দিতে পুরোনোর সরে যাওয়াটাই প্রকৃতির রীতি।
না, ভয়ের কিছু নেই, কে কতটা মনে রেখেছে বা ভুলে গিয়েছে, তার হিসাব করতে বসিনি আমি। কারও দিকে আঙুল তুলে বলবও না, তুমি যে আমার বাবার অনেক কাছের লোক ছিলে, আজ কেন তোমার ছায়াটাও দেখা যায় না!
কারও কাছে কৈফিয়ত চেয়ে বলব না, ‘ভাষা-মতিনের স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকা তাঁর স্ত্রী-পরিবারের সঙ্গে সামান্য সৌজন্য সম্পর্কটুকু আজ কারও নেই, কিসের ভয়ে! তাদের বিপন্নতার দায় ঘাড়ে এসে পড়ার কিংবা দান-অনুদানের ভয়!’ আবারও বলছি, ভয়ের কিছু নেই। ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের পরিবারে কখনোই কোনো প্রাচুর্য ছিল না, তাই অভাবের প্রশ্ন আসে না। কিন্তু অভাব তো হয়েছে। কোলাহলমুখর, চিন্তাসচেতন একজন প্রাণবন্ত মানুষের অভাব সেখানে ঘটেছে। তাঁকে ঘিরে যে জনসমাগম ঘটত, সেটা এখন আর হয় না, সেই অভাব সৃষ্টি হয়েছে।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের নীতি-আদর্শে সচল কর্মজীবনে ছায়াসঙ্গী হয়ে ছিলেন যিনি, তিনি আজও ছায়া হয়ে আছেন, কায়া নেই। স্ত্রী গুলবদন নেছা নীরবে ভাষা-মতিনের সব সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে হঠাৎ যেন বেকার হয়ে পড়েছেন। একেই বলে নারী জীবন। কোনো প্রাপ্তি বা স্বীকৃতি তো নেই-ই, তাঁর কর্মোদ্যমী সচল জীবনটাকে কর্মমুখর করে তোলার জন্যও কেউ সহায়তার হাত বাড়ায়নি। অথচ আজীবন সংগ্রামী ভাষাসৈনিকের জীবনের অনেক না-বলা কথা, অপ্রকাশিত ইতিহাস আর অনেক স্বপ্নের সাক্ষী তিনি।
স্বাধীন রাষ্ট্রের কামনা, রাষ্ট্রভাষার দাবি থেকে শুরু করেগণমুক্তির রাজনীতি, অন্যায়ের প্রতিবাদ, মোট কথা দেশের যেকোনো সংকটের সময়ে বুক পেতে তিনি দাঁড়িয়েছেন, বাঙালি জনগোষ্ঠীর খুব কাছের এবং জনপ্রিয় ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন। ভাষাশহীদ, ভাষাসৈনিক এবং মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে দেশ গঠনে তঁার অবদান কোনো অংশে কম ছিল না।
বিশাল স্মৃতিসৌধ, নামী পদক, স্মরণ সমাবেশ, নামকরণ—এমন কোনো কিছুর চাহিদা ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের ছিল না। তাঁর মেয়ে হিসেবে এই দেশ ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে আমারও বিশেষ কোনো দাবি নেই। তবে একটা আকাঙ্ক্ষা আছে, প্রত্যাশা আছে। ভাষাসৈনিকদের দাবি, আর ভাষাশহীদদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই বাংলা ভাষাকে যেন পূর্ণ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা হয়। ভুল বা বিভ্রান্তি নয়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভাষার অর্জন আর তার ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সঠিক ইতিহাস যেন লিপিবদ্ধ হয়।
ভাষা আমাদের পরিচয়। বর্ণ, ধর্মের ভেদাভেদ থাকলেও ভাষার কোনো বিভেদ নেই। বাংলায় কথা বলা প্রতিটি মানুষের একটাই জাত, বাঙালি। প্রত্যেক স্বতন্ত্র মানুষের নিজেকে প্রকাশ করার একটাই অবলম্বন, ভাষা। অর্থাৎ ভাষা প্রাণের সমতুল্য। ভাষা আমার অধিকার, অথচ সেই ভাষাকে রক্তের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছিল আমাদের। স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস প্রতিটি রাষ্ট্রের থাকে, ভাষা অর্জনের ইতিহাস বিরল। যত দিন এই ভাষা টিকে থাকবে, তত দিন আমাদের জাতিগত পরিচয় টিকে থাকবে। গাছের যেমন করে তার শিকড় চিনতে হয়, তেমনিভাবে প্রজন্মের জাতিসত্তার ইতিহাস জানার আকাঙ্ক্ষা থাকা স্বাভাবিক। আর অগ্রজদের দায়িত্ব হলো সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা। পিঁপড়ার দলনেতা যদি তার দলকে ভুল পথে এগিয়ে দেয়, তাহলে ঘটতে পারে যেকোনো কিছু।
আমি সাধারণ মানুষ। রাজনীতি, দলনেতা—এসব বুঝি না। ভূতের রাজার কাছে আমি এমন এক ভাষার বর চাইব, যে ভাষায় আমি প্রাণ খুলে গাইতে পারি—
‘সুরেরই ভাষা, প্রাণেরই ভাষা, গানেরই ভাষা, আনন্দেরই ভাষা
ভাষা এমন কথা বলে, বোঝে রে সকলে, উঁচা-নিচা, ছোট-বড় সমান
মোরা সেই ভাষাতেই করি গান।’
মাতিয়া বানু শুকু: প্রয়াত ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের মেয়ে, নাট্যনির্মাতা।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন চলে গেছেন এক বছর হয়ে গেল। আজ বাদে কাল তিন দিন হলে শোক কমে যায় ঠিকই, কিন্তু বছর চলে গেলেও আমার মনে হচ্ছে তিন দিন। এই না সেদিন শহীদ মিনারে কত লোক জড়ো হয়ে ভাষা-মতিনকে শ্রদ্ধা জানাল! কবে হলো যেন, পরশু, নাকি তার আগের দিন, নাকি গত সপ্তাহে! ভুলোমনা মেয়েরা হয়তো বাবার প্রস্থানের দিনের হিসাব রাখতে পারে না। যে চলে যায়, তার কাছের লোকদের মন এত সহজে প্রস্থান মেনে নিতে পারে না! সময় লাগে। আর আমার মন না মানলেও এটাই সত্য, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় সবকিছু। নতুনকে জায়গা করে দিতে পুরোনোর সরে যাওয়াটাই প্রকৃতির রীতি।
না, ভয়ের কিছু নেই, কে কতটা মনে রেখেছে বা ভুলে গিয়েছে, তার হিসাব করতে বসিনি আমি। কারও দিকে আঙুল তুলে বলবও না, তুমি যে আমার বাবার অনেক কাছের লোক ছিলে, আজ কেন তোমার ছায়াটাও দেখা যায় না!
কারও কাছে কৈফিয়ত চেয়ে বলব না, ‘ভাষা-মতিনের স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকা তাঁর স্ত্রী-পরিবারের সঙ্গে সামান্য সৌজন্য সম্পর্কটুকু আজ কারও নেই, কিসের ভয়ে! তাদের বিপন্নতার দায় ঘাড়ে এসে পড়ার কিংবা দান-অনুদানের ভয়!’ আবারও বলছি, ভয়ের কিছু নেই। ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের পরিবারে কখনোই কোনো প্রাচুর্য ছিল না, তাই অভাবের প্রশ্ন আসে না। কিন্তু অভাব তো হয়েছে। কোলাহলমুখর, চিন্তাসচেতন একজন প্রাণবন্ত মানুষের অভাব সেখানে ঘটেছে। তাঁকে ঘিরে যে জনসমাগম ঘটত, সেটা এখন আর হয় না, সেই অভাব সৃষ্টি হয়েছে।
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের নীতি-আদর্শে সচল কর্মজীবনে ছায়াসঙ্গী হয়ে ছিলেন যিনি, তিনি আজও ছায়া হয়ে আছেন, কায়া নেই। স্ত্রী গুলবদন নেছা নীরবে ভাষা-মতিনের সব সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে হঠাৎ যেন বেকার হয়ে পড়েছেন। একেই বলে নারী জীবন। কোনো প্রাপ্তি বা স্বীকৃতি তো নেই-ই, তাঁর কর্মোদ্যমী সচল জীবনটাকে কর্মমুখর করে তোলার জন্যও কেউ সহায়তার হাত বাড়ায়নি। অথচ আজীবন সংগ্রামী ভাষাসৈনিকের জীবনের অনেক না-বলা কথা, অপ্রকাশিত ইতিহাস আর অনেক স্বপ্নের সাক্ষী তিনি।
স্বাধীন রাষ্ট্রের কামনা, রাষ্ট্রভাষার দাবি থেকে শুরু করেগণমুক্তির রাজনীতি, অন্যায়ের প্রতিবাদ, মোট কথা দেশের যেকোনো সংকটের সময়ে বুক পেতে তিনি দাঁড়িয়েছেন, বাঙালি জনগোষ্ঠীর খুব কাছের এবং জনপ্রিয় ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন। ভাষাশহীদ, ভাষাসৈনিক এবং মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে দেশ গঠনে তঁার অবদান কোনো অংশে কম ছিল না।
বিশাল স্মৃতিসৌধ, নামী পদক, স্মরণ সমাবেশ, নামকরণ—এমন কোনো কিছুর চাহিদা ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের ছিল না। তাঁর মেয়ে হিসেবে এই দেশ ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর কাছে আমারও বিশেষ কোনো দাবি নেই। তবে একটা আকাঙ্ক্ষা আছে, প্রত্যাশা আছে। ভাষাসৈনিকদের দাবি, আর ভাষাশহীদদের রক্তের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই বাংলা ভাষাকে যেন পূর্ণ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা হয়। ভুল বা বিভ্রান্তি নয়, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভাষার অর্জন আর তার ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সঠিক ইতিহাস যেন লিপিবদ্ধ হয়।
ভাষা আমাদের পরিচয়। বর্ণ, ধর্মের ভেদাভেদ থাকলেও ভাষার কোনো বিভেদ নেই। বাংলায় কথা বলা প্রতিটি মানুষের একটাই জাত, বাঙালি। প্রত্যেক স্বতন্ত্র মানুষের নিজেকে প্রকাশ করার একটাই অবলম্বন, ভাষা। অর্থাৎ ভাষা প্রাণের সমতুল্য। ভাষা আমার অধিকার, অথচ সেই ভাষাকে রক্তের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছিল আমাদের। স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস প্রতিটি রাষ্ট্রের থাকে, ভাষা অর্জনের ইতিহাস বিরল। যত দিন এই ভাষা টিকে থাকবে, তত দিন আমাদের জাতিগত পরিচয় টিকে থাকবে। গাছের যেমন করে তার শিকড় চিনতে হয়, তেমনিভাবে প্রজন্মের জাতিসত্তার ইতিহাস জানার আকাঙ্ক্ষা থাকা স্বাভাবিক। আর অগ্রজদের দায়িত্ব হলো সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ করা। পিঁপড়ার দলনেতা যদি তার দলকে ভুল পথে এগিয়ে দেয়, তাহলে ঘটতে পারে যেকোনো কিছু।
আমি সাধারণ মানুষ। রাজনীতি, দলনেতা—এসব বুঝি না। ভূতের রাজার কাছে আমি এমন এক ভাষার বর চাইব, যে ভাষায় আমি প্রাণ খুলে গাইতে পারি—
‘সুরেরই ভাষা, প্রাণেরই ভাষা, গানেরই ভাষা, আনন্দেরই ভাষা
ভাষা এমন কথা বলে, বোঝে রে সকলে, উঁচা-নিচা, ছোট-বড় সমান
মোরা সেই ভাষাতেই করি গান।’
মাতিয়া বানু শুকু: প্রয়াত ভাষাসৈনিক আবদুল মতিনের মেয়ে, নাট্যনির্মাতা।
No comments