বাংলাদেশের এক নির্মল মর্যাদা অর্জনের গল্প by ফারুক ওয়াসিফ

সবচেয়ে বড় আবিষ্কার মানুষের ভেতরের মানুষ আবিষ্কার। কিন্তু এ কেমন আত্ম-আবিষ্কার যে কেউ বলছে, ‘একে অন্যের গু খেয়ে আর এক দিনও থাকা যায় না!’
শুনে ধন্দ লাগে। কথাটা কে বলছেন? এক দরিদ্র গ্রামবাসী—পাটখেত বা সুপারি বনে যাঁদের দারা-পুত্র-কন্যাদের টাট্টি সারতে হয়। রিয়েলিটি শোর কায়দায় জনসমক্ষে টাট্টিকরায় জামাই রাজি না থাকায় এক মেয়ের তো বিয়েই ভেস্তে গেল। বেচারার হবু শ্বশুরবাড়িতে টাট্টিখানা নেই। মান্ধাতানামে যদি কেউ থেকে থাকেন, তাঁর আমল থেকে এ-ই চলছিল। লজ্জা ছিল না, রোগবালাইয়ের চিন্তা ছিল না, অসম্মানের হেতুও ছিল না। যা হয়ে আসছে, তা-ই তারা করে যাচ্ছিল। আর ডায়রিয়া হয়ে ছিল জাতীয় রোগ।
একদিন তাঁদের বলা হলো, আপনারা বাল-বাচ্চা-বৃদ্ধ-বনিতা যেসব স্থানে ইয়ে করেন, সেসব জায়গায় ছাই দিয়ে রাখুন তো! রাখা
হলে তাদের আক্কেলখানা গুড়ুম করে চুপসে গেল। দেখা গেল, গ্রামটাই ছাইময় তথা মলময় হয়ে আছে। তার মধ্যেই ঘর-সংসার, বাচ্চাদের বেড়ে ওঠা। সেই জিনিস হাতে-পায়ে লাগছে, খাওয়া-গোসলের যে পুকুর, তাতে ভাসছে। তার স্পর্শে বারবার অজু ভেঙে যাচ্ছে নামাজিদের।
১৯৯৯ সাল। রাজশাহীর বাগমারা থানার মসমইল গ্রামের মনসুরের সহ্য হলো না। চোখ খুলে দেওয়া মানুষটি কথা দিলেন, ‘দুই মাসের মধ্যে এসব বন্ধ করব।’ ৫৫ দিনের মাথায় খবর এল, গ্রামটি এখন সম্পূর্ণ নির্মল। এভাবে একের পর এক গ্রাম। তখন বাংলাদেশ বিশ্বের দরিদ্রতম দেশের সারিতে। সেই থেকে মাত্র ১৬ বছর! সারা বাংলাদেশের গ্রামীণ মাঠঘাট ৯৯ শতাংশ নির্মল হয়ে গেছে। এদিকে আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ নিম্ন–মধ্যমে উঠেছে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করেছে। এতে মনসুরের মতো মানুষের উঠে দাঁড়ানোর অবদানও কম না। যা তাদের চালিত করেছিল, তা শুধু স্বাস্থ্যের চিন্তা না, মর্যাদাবোধও। মর্যাদাবান মানুষ অধিকারের জায়গায় আপস করে না।
উন্নতির সোপানে ওঠার নামে আমরা তৈলাক্ত লাঠি বাওয়ার কসরত করছি, আবার অতি উৎসাহে সেটা ভাঙতেও কসুর করছি না। ক্ষমতা ও অন্যায়ের বিষ্ঠায় মাখামাখি হচ্ছি প্রতিদিনই। কবে আমরা মসমইলের মনসুরের মতো করে বলে উঠতে পারব, ‘একে অন্যের গু খেয়ে আর এক দিনও থাকা যায় না!’
না, এই নির্মল বাসভূমি প্রচলিত সরকারি (জিও) বা বেসরকারি (এনজিও) পথে হয়নি পুরোটা। এটা হয়েছে সমাজের সম্মিলিত শক্তিতে। ছোট্ট একটা জাদুর কাঠির ঘষায় পরিবর্তনের জং ধরা চেরাগ জ্বলে উঠেছিল। যিনি এই আশ্চর্যের জাদুকর, তাঁর নাম কমল কর। ভারতভিত্তিক সম্প্রদায়চালিত সম্পূর্ণ শৌচব্যবস্থা ফা​উন্ডেশনের (সিএলটিএস) প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শেখাতে যাননি, শিখতে গিয়েছিলেন। মরমি কবি রশিদ উদ্দিনের গানের ‘মানুষের ভেতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন’ই যেন তাঁর আচরিত তত্ত্ব। তাঁর আবিষ্কারটা খুবই সরল: করুণা নয়, মর্যাদা; সাহায্য নয়, ক্ষমতায়ন।
তিনি দেখলেন, সরকার থেকে শুরু করে এনজিওগুলোর বিস্তর ব্যয়ে দেওয়া পাকা ল্যাট্রিন কাজে লাগছে না। মলকূপের ঢালাই রিংগুলো গরুকে খইল খাওয়ানোর পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোথাকার কোন ঠনঠনের এক রাজাকে তাঁর বন্ধু এক জোড়া জরি লাগানো দামি নাগরাই জুতা উপহার দিয়েছিলেন। রাজামশাইয়ের অভ্যাসও নেই, জানাও নেই এর ব্যবহার। তো একদিন তিনি নাগরাই জোড়ার একপাটি মাথার পাগড়ির সঙ্গে লাগিয়ে দরবারে দেখা দিলেন। লোকে যা বোঝার বুঝল। বিদেশে বসে তৃতীয় দুনিয়ায় দেওয়া অনেক উন্নয়ন-দাওয়াইয়ের হালও এমনই হয়েছে।
কমল কর সে সময় এসেছিলেন একটি এনজিওর হয়ে স্যানিটেশন কর্মসূচির মূল্যায়ন করতে। দেখলেন, শুনলেন এবং অন্যরা যা বুঝছিল না, সেটা ধরতে পারলেন। বুঝলেন, দান–খয়রাত করে মানুষের অভ্যাস বদলানো যাবে না। তাদের বর্তমান জীবন নিয়ে বিশ্লেষণের জরুরত বোঝাতে হবে।
ওপর থেকে উন্নয়নের জায়গায় তিনি জোর দিলেন তলার মানুষের জাগরণের ওপর। অর্থাৎ, উন্নয়ন যাদের দরকার, তাদের হাতেই এর দায়ভার দিতে হবে। তাঁর ক্ষমতায়ন তত্ত্ব রাষ্ট্র বা সাহায্য সংস্থার অভিভাবকত্ব মানে না, তা সম্প্রদায়ভিত্তিক। এই চিন্তার জোরেই প্রখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফরেন পলিসি ২০১০ সালে তাঁকে বিশ্বের সেরা ১০০ চিন্তকের মধ্যে ৮৪তম স্থান দিয়েছিল। এশিয়া ও আফ্রিকার সাতটি দেশ এ পদ্ধতি গ্রহণ করে, অনেক এনজিওর কর্মধারা বদলে যায়।
আমাদের জন্য বুনিয়াদি প্রশ্নটা এখানেই, মানুষ কখন বদলায়? যখন সে নিজেকে জানতে পারে, নিজের বা অপরের আয়নায় সত্যটা দেখতে পারে। তিনি ও তাঁর দল প্রথমে রাজশাহীর ওই মসমইল গ্রামের মানুষদের তাঁদের প্রাকৃতিক কর্মের দগদগে চিত্রটা দেখালেন। জাগিয়ে তুললেন পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি। মায়েদেরও হুঁশ জাগলো যে সন্তানদের কীসের মধ্যে ছেড়ে রাখছি?
মনসুর কথা দিয়েছিলেন, দুই মাসের মধ্যে গ্রামটিকে নির্মল করে তুলবেন, ৫৫ দিনের মাথায় তিনি সাফল্যের সংবাদ পাঠালেন। ওই গ্রামটি বিশ্বের নজর কাড়ল। বাংলাদেশে জন্মাল আরেকটি সামাজিক উন্নয়নের মডেল। যে ভারতের মানুষ কমল কর, সেই ভারত কিন্তু এখনো বিশ্বের মধ্যে মুক্ত মলত্যাগের শীর্ষ দেশ। অথচ হাজার কোটি রুপি খরচ হয়ে গেলেও মানুষ জাগেনি। কারণ, ​সে দেশের সরকার বাংলাদেশের মডেলটা আমলে নেয়নি।
সম্পূর্ণ নির্মল বাংলাদেশ হওয়ার প্রাক্কালে এবার ঢাকায় এক সম্মেলনে এসেছিলেন কমল। সেই সূত্রে প্রথম আলোয় আসা। কমল করের ভাষায়, ‘ক্ষমতায়ন হলে কেউ মানুষকে আটকাতে পরে না।’ আর কেমন সেই ক্ষমতায়ন? ‘তুমি, আমি একসঙ্গে’। আমাদের গ্রামদেশে এই ধারণা এজমালি বলে পরিচিত। বলছিলেন তিনি, ‘প্রতিটি দেশের গ্রামে গ্রামে এই সহযোগিতার সংস্কৃতি আছে। ডেভেলপমেন্ট এসে এই যৌথ সম্প্রদায়ভিত্তিক উদ্যোগের ধারণাটা ভুলিয়ে দিয়েছে।’
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শহুরে প্রশিক্ষিত এনজিও–কর্মীরা গ্রামের বঞ্চিত মানুষের মধ্যে হীনম্মন্যতা ও অপরাধবোধ জাগিয়ে তোলেন। যেন তার দুর্দশার জন্য সে-ই দায়ী। অথচ হাজার বছর ধরে এ ধরনের সহযোগিতার সংস্কৃতিই কৃষক সমাজের প্রধান সামাজিক পুঁজি। ধান কাটায়, বন্যা ঠেকানোয়, এমনকি বিদ্রোহ-সংগ্রামে এটাই তাদের প্রধান শক্তি। ব্রিটিশ নদীবিশেষজ্ঞ স্যার উইলিয়ম উইলকক্স কলকাতায় দেওয়া এক বক্তৃতায় (১৯৩০) বলেছিলেন, বাংলার মানুষের মধ্যে যে সহযোগিতার সংস্কৃতি দেখা যায়, তার উৎস লোকায়ত বন্যানিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা। এই শক্তি অসাধ্য সাধন করতে পারে।
মোটেই অবাক করার বিষয় নয়, কমল করের ধারণা যেন সেই পুরোনো সমবায়ী সমাজের আদর্শকেই প্রতিফলিত করে। এরই অবাক করা ফল ফলেছে আমাদের হাওরাঞ্চলে। সেটা যেন প্রকৃতির গামলা। সেই গামলায় শুষ্ক মৌসুমে অগাধ ধানের সমারোহ, আর বর্ষায় তা সাগরসমান জলরাশি। হঠাৎ বন্যায় কোটি কোটি টাকার ধান ভেসে যাওয়া ছিল সেখানকার অভিশাপ। ধান কাটার সময়টা পাহাড়ি ঢল আসারও সময়। সে সময় দু-এক দিনের মধ্যেই ধানের প্রান্তর হাওর বনে যেত। কিশোরগঞ্জের কেওড়াজুড়ি ইউনিয়নের মানুষ এই অভিশাপ দূর করেছিল এজমালি উদ্যোগে। ২০০৬ সালে, মাত্র পাঁচ দিনে ছয় হাজার মানুষ মিলে। এভাবে প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার এলাকায় বাঁধ দেওয়া এক দারুণ মানবিক কর্মমেলা। পুরুষেরা বাঁধ ওঠাচ্ছে মাটি কেটে, তাদের পেছনে মেয়েরা উৎসবের আমেজে রান্না চড়িয়েছে, বাচ্চারা পেয়েছে হুল্লোড়ের আনন্দ।
এভাবে হাওরের পানিপ্রবাহ ঠিক রাখা ও ফসল বাঁচানোর পদ্ধতি বাংলার সনাতন উপচানো সেচব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। পরের বছরও এভাবে বাঁধ বাঁধা হয়। আশপাশের গ্রামের মানুষও যোগ দেয়। গাইবান্ধার বন্যা উপদ্রুত হোসেনপুর ও কিশোরগাড়ির গল্পটাও এমন। সেখানে গ্রামবাসী শুধু বাঁধ সংস্কারই করেনি, সরকারের পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বাধ্য করেছিল দুই কিলোমিটারের বেশি এলাকার অসম্পূর্ণ বাঁধ পূর্ণ করতে। এতে করে ফসল বেঁচেছে প্রায় ১১ কোটি টাকার।
আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা সংক্রামক ব্যাপার। এই গ্রামগুলো শিক্ষা ও স্যানিটেশনেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। এই এজমালি চর্চার জেরে উত্তরবঙ্গের বেশ কটি জেলায় নারী শ্রমিকেরা পুরুষ শ্রমিক ও জমির মালিকদের সঙ্গে বসে সমান মজুরি আদায় করে নিচ্ছেন। এটা শুধু জীবনের উত্তরণই নয়, সমাজের তলার মানুষের উঠে আসার গল্পও। এই সামাজিক নায়ক-নায়িকারা পরে নেতা হয়েছেন, কেউ কৃষিতে নতুন উদ্যোগ দিয়েছেন। যেখানেই এই জনশক্তির বিনিয়োগ হবে, সেখানেই দিন বদলে যাবে। ক্ষমতায়ন তাই শুধু স্লোগান নয়, তা এক রাজনৈতিক উত্থানের জ্বালামুখ। যখন কেবলই গ্রাম পতনের শব্দ শুনি, জাতীয় অবক্ষয়ের নৈরাশ্য দেখি; তখন দেশের তলানিতে সঞ্চিত এই শক্তির সহায় নিতে পারা যায় কিন্তু।
এবার নিজেদের দিকে তাকাই। উন্নতির সোপানে ওঠার নামে আমরা তৈলাক্ত লাঠি বাওয়ার কসরত করছি, আবার অতি উৎসাহে সেটা ভাঙতেও কসুর করছি না। অনৈক্য, হানাহানি, স্বার্থপরতা, লোভ ও হিংসার বিষ্ঠা প্রতিদিন ছড়াচ্ছি আমরাই। ক্ষমতা ও অন্যায়ের বিষ্ঠায় মাখামাখি হচ্ছি প্রতিদিনই। দেশটা আর বাসযোগ্য থাকছে না। কবে আমরা মসমইলের ওই মনসুরের মতো করে বলে উঠতে পারব, ‘একে অন্যের গু খেয়েআর এক দিনও থাকা যায় না!’ এমন অমর্যাদায় কে বাঁচতে চায়?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
 bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.