মোটিভ ও কু পাওয়ার দাবি তদন্ত কর্মকর্তার by সরকার মাজহারুল মান্নান
রংপুরে
দুর্বৃত্তদের গুলিতে জাপানি নাগরিক কোনিও হোসি হত্যার কু ও মোটিভ গতকাল ছয়
দিনের মাথায় পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান রংপুর রেঞ্জ
ডিআইজি হুমায়ুন কবির। এ দিকে ঘটনার পরপরই আটক চারজনের মধ্যে একজনকে এ হত্যা
মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলেও বাকি তিনজনের বিষয়ে পুলিশ খোলাসা করে কিছু না
বলায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে তাদের পরিবার পরিজন। এ ছাড়া এ মামলায় গ্রেফতারের
পর রিমান্ডে নেয়ায় মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ উন নবী খান বিপ্লবের পরিবার
দাবি করেছে রাজনৈতিক কারণেই তাকে এ মামলায় জড়ানো হয়েছে। অন্য দিকে রংপুরে
কোনিওর লাশ দাফনের ব্যাপারে সিটি মেয়রের সাথে কথা বলেছেন জাপান দূতাবাসের
ফার্স্ট সিকিউরিটি অফিসার।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টু জানান, গতকাল বেলা ১টায় জাপান দূতাবাস থেকে ফার্স্ট সেক্রেটারি আমাকে ফোন করে বলেন, ‘রংপুরে কোনিও হোসির লাশ দাফন করতে হলে কী করতে হবে। দাফন করার জন্য কী কী করতে হবে। আমি বলেছি, মুসলমান হলে তার কাগজপত্র দিতে। এরপর নামাজে জানাজা ও দাফন কিভাবে করতে হবে তা জানিয়েছি তাকে। জাপানি দূতাবাস যদি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাহলে তাকে মুন্সিপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হবে। এ জন্য প্রক্রিয়া শুরু হলে আজ শুক্রবার তার লাশ দাফন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
মেয়র আরো বলেন, ‘আমি তাকে আরো বলেছি, আমি পত্রিকায় দেখেছি, টিভিতে দেখানো হয়েছে। সবই আমি দেখেছি। কিন্তু আমার কাছে কোনো এভিডেন্স নেই। উনি মুসলিম, অর নট। এভিডেন্স আমার হাতে পৌঁছলে ব্যবস্থা নেয়া হবে আগামীকালকে।’
কোনিও হোসির লাশ ময়নাতদন্ত শেষে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে।
এ দিকে জাপানি নাগরিক কোনিও হোসি হত্যা মামলায় স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলের ছোট ভাই রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ উন নবী খান বিপ্লবকে রাজনৈতিক কারণে জড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছে তার পরিবার। তার রিমান্ড বাতিল করে নিশর্ত মুক্তিরও দাবি করেছেন তারা। বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর গুপ্তপাড়ায় খান ম্যানসনে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন বিপ্লøবের মা বেগম আখতার বানু, স্ত্রী শিরিন আখতার দিপা ও কন্যা সিদরাতুল মুনতাহা নেহা।
বেগম আখতার বানু সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিপ্লব ওপরে দোতালায় থাকে। বিকেল পর্যন্ত ঘুমায়। ওর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। ওই দিন আমি ওকে একবার ডেকে খাওয়াই। পরে মেয়েটা স্কুল থেকে এসে উপরে যায়। কিন্তু বিকেল ৫টার দিকে হঠাৎ করে দুইজন লোক পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওকে তুলে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার সময় বলে আপনারা থানায় দেখা করেন। আমরা তখন মনে করি তাকে রাজনীতির মামলায় জড়ানো হবে। কিন্তু দুই দিন পর আমরা টিভির মাধ্যমে জানতে পারলাম আমার সন্তানকে জাপানি নাগরিক হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ও আমার ছোট ছেলে, আমাদের পরিবার রাজনৈতিক পরিবার হলেও ও রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নয়। ওই জাপানির সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের পরিবার বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে বিপ্লবকে ওই মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে হু হু করে কাঁদতে থাকেন এ বৃদ্ধ মা।
সরকারি কৌঁসুলির বক্তব্য ও মামলার এজহারে বর্ণিত কোনিও হোসি যেখানে খুন হয়েছেন সেই আলুটারীতে বিপ্লবদের আগের বাড়ি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিপ্লবের মা বলেন, আমার শ্বশুরবাড়ি জামালপুর, আমার মায়ের বাড়ি বগুড়ায়। আমার স্বামী খান সাহেব কারমাইকেল কলেজ গণিতের প্রফেসরি চাকরি করার সুবাধে আমরা রংপুরে প্রথমে এসে উঠি কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে। পরে আমার স্বামী রিটায়ার্ড হয়ে গেলে গুপ্তপাড়ায় বাড়ি করি। এখানেই ৪০-৫০ বছর ধরে আছি। আলুটারীতে বাড়ি থাকাতো দূরের কথা ওই নামটিই আমরা জানলাম পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ হত্যা মামলা থেকে বিপ্লবকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বিপ্লবের স্ত্রী স্থানীয় ইন্টারন্যাশনাল গ্রামার স্কুলের শিক্ষিকা শিরিন আখতার দিপা জানান, ২২ বছর ধরে আমি আমার স্বামীর সংসার করছি। প্রত্যেকটি বিষয়ে তার সাথে আমার শেয়ার হয়। ওই জাপানি ভদ্রলোককে আমার স্বামী কোনো দিন চিনতও না জানতও না। তার সাথে আমার স্বামীর দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু বিএনপি পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণেই বিপ্লবকে ওই মামলায় জড়ানো হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তার স্বামীর রিমান্ড বাতিল করে নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।
বিপ্লবের একমাত্র মেয়ে রংপুর মিলেনিয়াম স্টারস স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী সিদরাতুল মুনতাহা নেহা বলেন, আমার বাবা ঘুমেই ছিলেন। আমি স্কুল থেকে এসে বাবাকে ওপরে জড়িয়ে ধরে নিচে নেমেছি। আমার বাবা টিভিও দেখেননি। ওই জাপানি যে হত্যা হয়েছে সেটি তিনি জানেন না। কিন্তু তারা সরাসরি ওপরে গিয়ে বাবাকে তুল নিয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে নেহা বলেন, আমার বাবা অসুস্থ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি আমার বাবাকে যেন রিমান্ড বাতিল করে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়।
এ দিকে রংপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে জাপানি নাগরিক কোনিও হোসি হত্যার কু ও মোটিভ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি হুমায়ুন কবির। তিনি বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের কু পাওয়া গেছে, যার সূত্র ধরে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শিগগিরই এ মামলার মোটিভ পরিষ্কার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে কি কু ও মোটিভ পাওয়া গেছে, কারা জড়িত এ বিষয়ে তদন্তের স্বার্থে অপেক্ষা করতে বলেছেন সাংবাদিকদের।
অন্য দিকে ঘটনার পরপরই আটক চারজনের মধ্যে একজনকে এ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলেও বাকি তিনজনের বিষয়ে পুলিশ খোলাসা করে কিছু না বলায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে তাদের পরিবার পরিজন।
শনিবার রংপুর মহানগরীর উপকণ্ঠে কাউনিয়ার কাচু আলুটারী এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন জাপানি নাগরিক কোনিও হোসি। ঘটনার পরপরই আটক করা হয় ভাড়াবাসার মালিক জাকারিয়া বালা, হোসির ব্যবসায়িক অংশীদার হুমায়ুন কবির হীরা, রিকশাচালক মোন্নাফ ও ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির মালিকের ছোট ভাই মুরাদকে। এর মধ্যে হীরাকে সোমবার ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। এ ছাড়াও একই মামলায় গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়া হয় ঘটনার দিন বিকেলে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ উন নবী খান বিপ্লবকে। ঘটনার পর আটক জাকারিয়া বালা অসুস্থ হয়ে রংপুর মেডিক্যালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর মুরাদ ও মোন্নাফের বিষয়ে কিছুই জানতে পারছেন না তাদের পরিবার। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর আতঙ্ক বিরাজ করছে এসব পরিবারে।
আটক মুরাদের ভাবি নূরজাহান বেগম জানান, আমার স্বামী ব্যবসার কাজে বাইরে থাকে। সব কিছু দেখাশুনা করে আমার দেবর মুরাদ। ঘটনার সময় আমার দেবর বাড়ির অদূরে গুরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে গেছে। আমাদের সব মোবাইলও নিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত আমরা মুরাদের কোনো খোঁজ পাইনি। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে কিছুই জানি না আমরা। থানায় খোঁজ নিয়েও কোনো সন্ধান পাইনি। তিনি অবিলম্বে মুরাদকে মুক্তি দিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান।
অন্য দিকে, পাটবাড়ি এলাকার রেললাইনের বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক মোন্নাফের মা ছকিনা বেওয়া জানান, মোন্নাফ রিকশা চালায়। শহর থেকে রিকশায় উঠেছে। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোথায় রাখা হয়েছে আমরা কিছুই জানি না। মোন্নাফকে আটক করার কারণে পরিবারটি খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছে। একমাত্র রোজগারের মানুষ ছিলেন তিনি।
মোন্নাফের স্ত্রী জানান, আমার স্বামী নির্দোষ। রিকশা চালিয়ে চালডাল কিনে আনে। তার পর সন্তানসন্ততিসহ রান্না করে খাই। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে কোথায় রাখল। আমরা কোনো খোঁজ খবর পাচ্ছি না। অবিলম্বে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান এ স্ত্রী।
প্রসঙ্গত শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় রংপুর মহানগরীর উপকণ্ঠ কাউনিয়ার কাচু আলুটারী এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন হোসি। ওই সময় গ্রেফতার করা হয় ভাড়াবাসার মালিক জাকারিয়া বালা, ব্যবসায়িক বন্ধু হুমায়ুন কবির হিরা, তার শ্যালক তিতাস, রিকশাচালক মোন্নাফ ও ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির মালিকের ছোট ভাই মুরাদকে। এর মধ্যে শুধু হীরাকে গ্রেফতার দেখানো হয় ওই মামলায়। এ ঘটনায় কাউনিয়া থানার ওসি তিন অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে হত্যা মামলা করেন। ঘটনা তদন্তে র্যাব, পুলিশ, সিআইডি, জাপানি দূতাবাসের স্পেশাল টিম মাঠে কাজ করছে। গঠন করা হয়েছে ডিআইজির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত টিম। ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে। জাপানি টিমের কাছে ঢাকায় নেয়ার জন্য কোনিও হোসির লাশ হস্তান্তর করার কথা। তবে কবে কখন লাশ হস্তান্তর করা হবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যেকোনো মুহূর্তে ঢাকায় নেয়ার জন্য তার লাশ হস্তান্তরের সব কিছু প্রস্তুত রেখেছে হাসপাতাল কর্তৃপ।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা: জাকির হোসেন জানান, আমরা মর্গের হিমঘরে কোনিও হোসির লাশ রেখেছি। সব প্রস্তুতি আছে। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ লাশ গ্রহণের বিষয়ে যোগাযোগ করেনি। যোগাযোগ করা মাত্রই আমরা তা হস্তান্তর করব।
এ দিকে ডিসি অফিস সূত্র জানিয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রংপুর জেলা প্রশাসন লাশ হস্তান্তরের জন্য সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রিয় সিন্ধু তালুকদারকে নিযুক্ত করে রেখেছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টু জানান, গতকাল বেলা ১টায় জাপান দূতাবাস থেকে ফার্স্ট সেক্রেটারি আমাকে ফোন করে বলেন, ‘রংপুরে কোনিও হোসির লাশ দাফন করতে হলে কী করতে হবে। দাফন করার জন্য কী কী করতে হবে। আমি বলেছি, মুসলমান হলে তার কাগজপত্র দিতে। এরপর নামাজে জানাজা ও দাফন কিভাবে করতে হবে তা জানিয়েছি তাকে। জাপানি দূতাবাস যদি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাহলে তাকে মুন্সিপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হবে। এ জন্য প্রক্রিয়া শুরু হলে আজ শুক্রবার তার লাশ দাফন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
মেয়র আরো বলেন, ‘আমি তাকে আরো বলেছি, আমি পত্রিকায় দেখেছি, টিভিতে দেখানো হয়েছে। সবই আমি দেখেছি। কিন্তু আমার কাছে কোনো এভিডেন্স নেই। উনি মুসলিম, অর নট। এভিডেন্স আমার হাতে পৌঁছলে ব্যবস্থা নেয়া হবে আগামীকালকে।’
কোনিও হোসির লাশ ময়নাতদন্ত শেষে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে।
এ দিকে জাপানি নাগরিক কোনিও হোসি হত্যা মামলায় স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলের ছোট ভাই রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ উন নবী খান বিপ্লবকে রাজনৈতিক কারণে জড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছে তার পরিবার। তার রিমান্ড বাতিল করে নিশর্ত মুক্তিরও দাবি করেছেন তারা। বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর গুপ্তপাড়ায় খান ম্যানসনে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন বিপ্লøবের মা বেগম আখতার বানু, স্ত্রী শিরিন আখতার দিপা ও কন্যা সিদরাতুল মুনতাহা নেহা।
বেগম আখতার বানু সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিপ্লব ওপরে দোতালায় থাকে। বিকেল পর্যন্ত ঘুমায়। ওর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। ওই দিন আমি ওকে একবার ডেকে খাওয়াই। পরে মেয়েটা স্কুল থেকে এসে উপরে যায়। কিন্তু বিকেল ৫টার দিকে হঠাৎ করে দুইজন লোক পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওকে তুলে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার সময় বলে আপনারা থানায় দেখা করেন। আমরা তখন মনে করি তাকে রাজনীতির মামলায় জড়ানো হবে। কিন্তু দুই দিন পর আমরা টিভির মাধ্যমে জানতে পারলাম আমার সন্তানকে জাপানি নাগরিক হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ও আমার ছোট ছেলে, আমাদের পরিবার রাজনৈতিক পরিবার হলেও ও রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নয়। ওই জাপানির সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের পরিবার বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে বিপ্লবকে ওই মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে হু হু করে কাঁদতে থাকেন এ বৃদ্ধ মা।
সরকারি কৌঁসুলির বক্তব্য ও মামলার এজহারে বর্ণিত কোনিও হোসি যেখানে খুন হয়েছেন সেই আলুটারীতে বিপ্লবদের আগের বাড়ি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিপ্লবের মা বলেন, আমার শ্বশুরবাড়ি জামালপুর, আমার মায়ের বাড়ি বগুড়ায়। আমার স্বামী খান সাহেব কারমাইকেল কলেজ গণিতের প্রফেসরি চাকরি করার সুবাধে আমরা রংপুরে প্রথমে এসে উঠি কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে। পরে আমার স্বামী রিটায়ার্ড হয়ে গেলে গুপ্তপাড়ায় বাড়ি করি। এখানেই ৪০-৫০ বছর ধরে আছি। আলুটারীতে বাড়ি থাকাতো দূরের কথা ওই নামটিই আমরা জানলাম পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ হত্যা মামলা থেকে বিপ্লবকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে বিপ্লবের স্ত্রী স্থানীয় ইন্টারন্যাশনাল গ্রামার স্কুলের শিক্ষিকা শিরিন আখতার দিপা জানান, ২২ বছর ধরে আমি আমার স্বামীর সংসার করছি। প্রত্যেকটি বিষয়ে তার সাথে আমার শেয়ার হয়। ওই জাপানি ভদ্রলোককে আমার স্বামী কোনো দিন চিনতও না জানতও না। তার সাথে আমার স্বামীর দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু বিএনপি পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণেই বিপ্লবকে ওই মামলায় জড়ানো হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তার স্বামীর রিমান্ড বাতিল করে নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।
বিপ্লবের একমাত্র মেয়ে রংপুর মিলেনিয়াম স্টারস স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী সিদরাতুল মুনতাহা নেহা বলেন, আমার বাবা ঘুমেই ছিলেন। আমি স্কুল থেকে এসে বাবাকে ওপরে জড়িয়ে ধরে নিচে নেমেছি। আমার বাবা টিভিও দেখেননি। ওই জাপানি যে হত্যা হয়েছে সেটি তিনি জানেন না। কিন্তু তারা সরাসরি ওপরে গিয়ে বাবাকে তুল নিয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে নেহা বলেন, আমার বাবা অসুস্থ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি আমার বাবাকে যেন রিমান্ড বাতিল করে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়।
এ দিকে রংপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে জাপানি নাগরিক কোনিও হোসি হত্যার কু ও মোটিভ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি হুমায়ুন কবির। তিনি বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের কু পাওয়া গেছে, যার সূত্র ধরে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শিগগিরই এ মামলার মোটিভ পরিষ্কার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে কি কু ও মোটিভ পাওয়া গেছে, কারা জড়িত এ বিষয়ে তদন্তের স্বার্থে অপেক্ষা করতে বলেছেন সাংবাদিকদের।
অন্য দিকে ঘটনার পরপরই আটক চারজনের মধ্যে একজনকে এ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলেও বাকি তিনজনের বিষয়ে পুলিশ খোলাসা করে কিছু না বলায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে তাদের পরিবার পরিজন।
শনিবার রংপুর মহানগরীর উপকণ্ঠে কাউনিয়ার কাচু আলুটারী এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন জাপানি নাগরিক কোনিও হোসি। ঘটনার পরপরই আটক করা হয় ভাড়াবাসার মালিক জাকারিয়া বালা, হোসির ব্যবসায়িক অংশীদার হুমায়ুন কবির হীরা, রিকশাচালক মোন্নাফ ও ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির মালিকের ছোট ভাই মুরাদকে। এর মধ্যে হীরাকে সোমবার ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। এ ছাড়াও একই মামলায় গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়া হয় ঘটনার দিন বিকেলে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ উন নবী খান বিপ্লবকে। ঘটনার পর আটক জাকারিয়া বালা অসুস্থ হয়ে রংপুর মেডিক্যালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর মুরাদ ও মোন্নাফের বিষয়ে কিছুই জানতে পারছেন না তাদের পরিবার। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর আতঙ্ক বিরাজ করছে এসব পরিবারে।
আটক মুরাদের ভাবি নূরজাহান বেগম জানান, আমার স্বামী ব্যবসার কাজে বাইরে থাকে। সব কিছু দেখাশুনা করে আমার দেবর মুরাদ। ঘটনার সময় আমার দেবর বাড়ির অদূরে গুরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে গেছে। আমাদের সব মোবাইলও নিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত আমরা মুরাদের কোনো খোঁজ পাইনি। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে কিছুই জানি না আমরা। থানায় খোঁজ নিয়েও কোনো সন্ধান পাইনি। তিনি অবিলম্বে মুরাদকে মুক্তি দিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান।
অন্য দিকে, পাটবাড়ি এলাকার রেললাইনের বস্তির বাসিন্দা রিকশাচালক মোন্নাফের মা ছকিনা বেওয়া জানান, মোন্নাফ রিকশা চালায়। শহর থেকে রিকশায় উঠেছে। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোথায় রাখা হয়েছে আমরা কিছুই জানি না। মোন্নাফকে আটক করার কারণে পরিবারটি খেয়ে না খেয়ে জীবনযাপন করছে। একমাত্র রোজগারের মানুষ ছিলেন তিনি।
মোন্নাফের স্ত্রী জানান, আমার স্বামী নির্দোষ। রিকশা চালিয়ে চালডাল কিনে আনে। তার পর সন্তানসন্ততিসহ রান্না করে খাই। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে কোথায় রাখল। আমরা কোনো খোঁজ খবর পাচ্ছি না। অবিলম্বে তাকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান এ স্ত্রী।
প্রসঙ্গত শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় রংপুর মহানগরীর উপকণ্ঠ কাউনিয়ার কাচু আলুটারী এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন হোসি। ওই সময় গ্রেফতার করা হয় ভাড়াবাসার মালিক জাকারিয়া বালা, ব্যবসায়িক বন্ধু হুমায়ুন কবির হিরা, তার শ্যালক তিতাস, রিকশাচালক মোন্নাফ ও ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির মালিকের ছোট ভাই মুরাদকে। এর মধ্যে শুধু হীরাকে গ্রেফতার দেখানো হয় ওই মামলায়। এ ঘটনায় কাউনিয়া থানার ওসি তিন অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে হত্যা মামলা করেন। ঘটনা তদন্তে র্যাব, পুলিশ, সিআইডি, জাপানি দূতাবাসের স্পেশাল টিম মাঠে কাজ করছে। গঠন করা হয়েছে ডিআইজির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত টিম। ময়নাতদন্ত শেষে তার লাশ রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে। জাপানি টিমের কাছে ঢাকায় নেয়ার জন্য কোনিও হোসির লাশ হস্তান্তর করার কথা। তবে কবে কখন লাশ হস্তান্তর করা হবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যেকোনো মুহূর্তে ঢাকায় নেয়ার জন্য তার লাশ হস্তান্তরের সব কিছু প্রস্তুত রেখেছে হাসপাতাল কর্তৃপ।
রংপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা: জাকির হোসেন জানান, আমরা মর্গের হিমঘরে কোনিও হোসির লাশ রেখেছি। সব প্রস্তুতি আছে। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ লাশ গ্রহণের বিষয়ে যোগাযোগ করেনি। যোগাযোগ করা মাত্রই আমরা তা হস্তান্তর করব।
এ দিকে ডিসি অফিস সূত্র জানিয়েছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রংপুর জেলা প্রশাসন লাশ হস্তান্তরের জন্য সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রিয় সিন্ধু তালুকদারকে নিযুক্ত করে রেখেছেন।
No comments