মাথার চুল কদম ফুল কোথায় হল গণ্ডগোল? by ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
গেল
কয়েকদিন ধরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকার শিরোনাম হয়ে আসছে। যা নিয়ে
শিরোনাম হচ্ছে তা একেবারে নতুন কোন ঘটনা না হলেও এর চরিত্রটা অনেকটাই
ভিন্ন, বেশ চমকপদও বটে। কেননা, এর আগেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়
হর্তাকর্তাদের ছাত্রআন্দোলন দমাতে ছাত্রসংগঠনগুলোকে ব্যবহার করার বহু নজীর
রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের আন্দোলন দমানোর জন্য ভিসির উপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন
দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের দলবেঁধে শিক্ষকদের উপর হামলার ঘটনাটি নতুন
মাত্রা। যতদূর জানা যায় তাতে, দেশ স্বাধীনের পর এধরনের ঘটনা এটাই প্রথম।
ফলে গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়াটাই স্বাভাবিক। ঘটনাটি শিক্ষকদের জন্য যেমন
তেমন গোটা জাতির জন্য লজ্জাস্কর বটে। টেলিভিশনের পর্দায় ঘটনাটি দেখার পর
বেশ ক’দিন থেকেই এ নিয়ে মর্মপীড়ায় ভুগছি, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ফলে এ
বিষয়ে কলম না ধরে স্থির থাকতে পারলাম না।
তবে এই ঘটনাটি হঠাৎ করেই ঘটেছে এটা বলা যাবে না। সবাই জানি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাটি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। আর সমস্যাটি কিন্তু শিক্ষাকার্যক্রম কিংবা শিক্ষা-গবেষণা ও শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে নয়, স্রেফ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক শিক্ষকদের দুগ্রুপের আধিপত্য বিস্তার তথা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে। গেল এপ্রিল মাসেও এ সঙ্কট চরম আকার ধারণ করলে ভিসি আমিনুল হক ভুঁইয়া দুই মাসের ছুটিতে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেছিলেন।
যতদূর জানি তাতে, চলতি বছরের শুরু থেকেই ভিসির বিরুদ্ধে ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ ও প্রশাসন পরিচালনায় ‘অযোগ্যতার’ পাশাপাশি নিয়োগে ‘অনিয়ম’ ও আর্থিক ‘অস্বচ্ছতার’ অভিযোগ এনে তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ। আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২০শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭টি প্রশাসনিক পদ ছাড়েন ৩৫ জন শিক্ষক, যাদের মধ্যে অধ্যাপক জাফর ইকবাল এবং স্ত্রীও ছিলেন। তবে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভিসি ২৩শে এপ্রিল জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে দুই মাসের ছুটিতে গেলে ভারপ্রাপ্ত ভিসি ট্রেজারার ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাসের অধীনে সেই ৩৫ জন কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ভিসি পুনরায় ক্যাম্পাসে ফিরলে এই সঙ্কট ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আর গেল রোববার ভিসি আন্দোলনরত শিক্ষকদের বাধার মুখে ছাত্রলীগের ক্যাডারসহ নিজদপ্তরে প্রবেশ করতে গেলে এ লঙ্কাকাণ্ড ঘটে। এসময় বেশ ক’জন শিক্ষককে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা- এ সংবাদ এখন সব গণমাধ্যমের শিরোনাম!
এ ঘটনায় শিক্ষকদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা পেয়েছে। ভিসির অপসারণ দাবিতে আন্দোলনে নামা শিক্ষকরা বৃহস্পতিবার প্রতীকী অনশন শেষে রোববার কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। এছাড়া ভিসি না যাওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে বলেও হুশিয়ারি দেন। অবশ্য এর আগেও আন্দোলনকারী শিক্ষকরা একই দাবিতে অনশন করেছিলেন। তবে শিক্ষকদের সঙ্গে এবার আন্দোলনে যোগ দিয়েছে শিক্ষার্থীদের একাংশ, তারা ভিসির পদত্যাগ দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামও দিয়েছে। অন্যদিকে ভিসি ‘লাঞ্ছনাকারী’ শিক্ষকদের বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষকদের একাংশ। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। বলা যাচ্ছে না পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় এবং শেষ গোলটা কোনপক্ষে যায়।
এসব বিষয় কিন্তু সরকারের উপর মহলের একেবারে অজানা নয়। এরপরও কোন সুরাহা না করে সরকারের হর্তাকর্তারা নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছেন। সবার ভাবখানা এমন যে- এ বিষয়ে কেউ যেন কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। ফলে আজ লেখার শুরুতেই আমার মনে পড়ে গেলে বহুল আলোচিত সেই ‘কদম ফুলের’ গল্পের কথা- মাথার চুল কদম ফুল কোথায় হল গণ্ডগোল? আমার মনে হয় এই গল্পের কাহিনী সবারই জানা, তাই এখানে তা উল্লেখ করে পাঠকদের বিরুক্তি ঘটাতে চাই না।
এবার আসি বিশ্ববিদ্যালয়টির সমস্যার পেছনের কথা নিয়ে। প্রসঙ্গত, গেল কয়েকদিনে এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং অনেকের নিবন্ধ পড়ে কেন জানি আমার মনে হয়েছে তারা সঙ্কটের জন্য ভিসি প্রফেসর ড. আমিনুল হক ভুঁইয়াকেই তুলোধূনা করার চেষ্টা করেছেন। তাদের মনোভাব অনেকটাই একপেশে পরিলক্ষিত হয়েছে। এতে আমার যা মনে হয়েছে, তাতে একই মতাদর্শে বিশ্বাসী লেখক-সাংবাদিকরা সরকারের মহলের ভুমিকা এবং অধ্যাপক জাফর ইকবাল একজন জনপ্রিয় লেখক, সমাজের প্রভাবশালী হওয়ার কারণেই হয়তোবা তাদের ভূমিকাটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে একজন নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ববোধ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রকৃত সমস্যাগুলোর কিছুটা জনসম্মুখে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমার অবস্থান কারও পক্ষে কিংবা বিপক্ষে নয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও জাফর ইকবাল স্যারের লেখার ভক্ত, ইতোপূর্বে একজন সাংসদ যখন তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন তখন ‘জাফর ইকবাল ও একের ভেতর চার’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। তাকে এবং তার লেখা পছন্দ করি সেটা একেবারেই ব্যক্তিগত বিষয়, আমার এই লেখায় সেটার কোন প্রভাব থাকবে বলে মনে করছি না, থাকা সমীচীনও নয়।
থাক এসব কথা, ফিরে আসি মূল বিষয়ের দিকে। এখানকার সমস্যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার সাথে কিছুটা মিল থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই বেশ অমিল ও বৈচিত্র্যময় । পত্রপত্রিকা পাঠে ও ব্যক্তিগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট ক’জনের সাথে কথা বলে যা জানতে পেলাম তাতে সমস্যাটির শেকড় অনেক গভীরে। ফলে যে সব বিষয় এখানে সঙ্কটের মুখ্য হিসেবে কাজ করছে তা নিয়ে আমার কিছু ভাবনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।
এক. পত্রপত্রিকা পাঠে ও বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট আমার পরিচিত ক’জনের সাথে কথা বলে যা জানতে পেলাম তাতে, বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্কটে সরকারের উপর মহলের লোকজন চলমান বিরোধে ঘি ঢালছেন। চলমান সঙ্কটে বিবাদমান পক্ষগুলো নিজেদের মতাদর্শের লোক বলে তারা কোনো পক্ষকেই চটাতে চাচ্ছেন না, সবাইকে ভালবাসছেন সমানতালে। ফলে এমপি-মন্ত্রীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পক্ষগুলো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এমন হুলি খেলায় মেতে উঠেছেন। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, এখানে দুটি পক্ষ সুস্পষ্ট- একদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বর্তমান ভিসি প্রফেসর ড. আমিনুল হক ভুঁইয়ার পক্ষে, অন্যদিকে ক্যাম্পাসের আওয়ামী-বাম সমর্থিত শিক্ষকদের বড় অংশ প্রফেসর জাফর ইকবালের পক্ষে ভুমিকা রাখছেন। নেতাদের ভাষ্যমতে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও মনে করেন, অধ্যাপক জাফর ইকবালসহ কিছুসংখ্যক শিক্ষক অতি বাড়াবাড়ি করছেন। এতে সরকার চাচ্ছে না বর্তমান ভিসিকে সহজেই সরাতে। আবার জাফর ইকবালকেও সরাসরি চটাতে চাচ্ছে না। ফলে সরকার এখানে অনেকটাই কৌশলী ভুমিকায় রয়েছে।
দুই. ২০১৩ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি বিদায়ী ভিসি সালেহউদ্দিন আহমেদের মেয়াদ শেষ হবার প্রায় ছয়মাস পর জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক মো. আমিনুল হক ভূঁইয়া । তবে নিজেদের মধ্য থেকেই ভিসি নিয়োগের দাবি করে আসছিলেন শিক্ষকরা। কিন্তু তাদের সে দাবি পূরণ না হওয়ায় প্রথম থেকেই তারা আমিনুল হক ভূঁইয়াকে মেনে নিতে পারেননি। ফলে প্রথম থেকেই সেখানকার আওয়ামী-বামপন্থী শিক্ষকরা অসহযোগিতা করে আসছে বলে ভিসিপন্থীদের ভাষ্য।
তিন. ক্যাম্পাস সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেরই মনোভাব হলো- এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কটের পেছনে যতটা না ভিসি দায়ী, তার চেয়েও বড় সমস্যা অধ্যাপক জাফর ইকবাল। এখানে যে কোন ব্যক্তি ভিসি হয়ে আসুক না কেন, তার (জাফর ইকবাল) কথা শুনতেই হবে, অন্যথায় শান্তিতে একদিনও থাকার সুযোগ নেই, সর্বদা এমনই মনোভাব পোষণ করেন তিনি। বিগত দিনেও সব ভিসিকেই কমবেশি তোয়াজ করতে হয়েছে তাকে। অন্যথা তার কথা যারা শোনেননি তাদেরকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বিদায় নিতে হয়েছে। যদিও এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয় বলে জাফর ইকবাল পক্ষের শিক্ষকরা দাবি করে আসছেন । এক্ষেত্রে উপাচার্যপন্থীরা সাম্প্রতিককালে জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমীন হকের ভুমিকা-বক্তব্যকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এছাড়া মার্চ-এপ্রিল মাসের পুরো সময়টা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী। বর্তমানেও অধ্যাপক ইয়াসমীন হক আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছেন। অবশ্য তাদের আন্দোলনের পেছনে যৌক্তিক কিছু কারণও রয়েছে। তবে আন্দোলনের ছক ও কৌশল পুরোটাই জাফর ইকবালের এমন দাবি ভিসিপন্থীদের।
চার. এখানে শিক্ষকদের দলবাজি আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক গ্রুপ পলিটিক্সও অন্যতম সমস্যা। আমরা কী দেখলাম! ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী দলবেধে শিক্ষকদের পিটিয়ে আহত করেছে। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে এ ধরনের ঘটনার পর জাতির অবক্ষয়ের আর বাকি থাকে কী? জাতিকে লজ্জায় ডুবিয়েছে ছাত্র নামধারী এই ক্যাডাররা। যদিও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সে দায় নিতে নারাজ। ইতোমধ্যে তারা ৩জনকে বহিষ্কারও করেছে। আক্রান্ত শিক্ষকদের অভিযোগ, ভিসির উসকানিতেই সরকারি দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠনটির কিছু নেতাকর্মী শিক্ষকদের আক্রমণ করে। অবশ্য ভিসিও এ দায় নিতে অস্বীকার করেছেন। ফলে প্রশাসনও সংশ্লিষ্ট ৪জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছে। একজন ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক, তিনি কেন শিক্ষকদের ওপর ছাত্রদের লেলিয়ে দেবেন-এমন প্রশ্ন ওঠাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু যে শিক্ষকরা এই ভিসি অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তারা আক্রান্ত হওয়াতেই প্রশ্ন উঠেছে। ভিডিও চিত্রেও প্রমাণ মিলেছে। এতে বলা যায়, ব্যক্তিকেন্দ্রিক গ্রুপগুলো ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও ব্যবহার করছে শিক্ষকরা। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য এক অশুভ ইঙ্গিত।
পাঁচ. আমরা চরমভাবে হতাশ হয়েছি জাফর ইকবারের মতো একজন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির ভুমিকায়। জাফর ইকবাল নামটি নতুন প্রজন্মের কাছে আলাদা গুরুত্ব বহন করে। জাফর ইকবাল মানে একটি সাহসী ও প্রতিবাদী কণ্ঠ। তার লেখায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, স্বাধীনতার কথা বলেন, গণতন্ত্র ও গণমানুষের কথা বলেন, দুর্নীতি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলেন। এ কারণে সবার প্রত্যাশা ছিল অন্তত: তিনি অন্যায়ের কাছে কোনোদিন নতি স্বীকার করবেন না, অন্যায়-অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দিবেন না। কিন্তু আমরা কী লক্ষ্য করলাম-
গেল রোববার ঘটনার পরপরই দেশবরেণ্য এই লেখক বললেন, এখানে যে ছাত্ররা ‘জয় বাংলা বলে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা আমার ছাত্র হয়ে থাকলে এই দৃশ্য দেখার আগেই শিক্ষক হিসেবে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিত। সেদিন ঘটনাটি ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে সারাবিশ্বে। অধ্যাপক ইকবালের প্রতি সহমর্মিতায় সবাই যখন সরব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমবেদনা আর সহানুভূতির ঝড়, প্রতিবাদে লেখনির ঝড় । তখন একদিন পরই তিনি এবং তার স্ত্রী ভোল পাল্টে ফেললেন। ফলে বুধবার সন্ধ্যা থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ইউটার্ন করেছে, যেভাবে করেছেন জাফর স্যার। ছাত্রলীগের ছেলেদের দায়মুক্তি দিয়ে এই ফিকশন লেখক জানালেন, কে হামলা করেছে? ছাত্রলীগ! ছাত্রলীগের ছেলেরা বাচ্চা, ওরা হামলা করতে পারে না। ওদের শাস্তি দেওয়াটা অন্যায়।’এর আগে অবশ্য ঘটনার দিন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্জনার শিকার তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমীন হকও সংগঠনটির কাছে নতি স্বীকার করে বলেন, ‘ওইদিনের ঘটনায় ছাত্রলীগের কোনো দোষ নেই’। এরপর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র সংবাদে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে ছবিসহ একটি বিবৃতিও দিয়েছেন স্বামীর ফেসবুকের মাধ্যমে ইয়াসমীন হক।
তবে এসবেও থামেনি সমালোচনা। ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের প্রতি এই শিক্ষক দম্পতির অবস্থানে নতুন করে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। শিক্ষক, সাংবাদিক থেকে শুরু করে আইনজীবী- সবাই ছাত্রলীগের প্রতি তাদের দায়মুক্তি ও অকৃত্রিম ভালবাসার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ইমরান বসুনিয়া সোহাগ নামে এক যুবক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ছাত্রলীগ শিক্ষক পিটাইলো আর আপনি (জাফর ইকবাল) প্রতিবাদের নামে বৃষ্টি উপভোগ করলেন। আবার সেই আপনিই বললেন, ছাত্রলীগকে শাস্তি দিলে অন্যায় হবে। শাস্তি চাইলেন ভিসির। বহুরুপী মানুষ আপনি, যারে এক কথায় কয় সুবিধাবাদী।
মুহাম্মদ আনিসুর রহমানের মন্তব্য, ‘স্যার, এভাবে চলতে থাকলে কয়েকদিন পর পাবনায় সিট বুকিং দিতে হবে যে...’
সাংবাদিক হোসাইন ইমাম সোহেল লিখেছেন, তাহলে কী এই দেশের মানুষ ধরে নেবে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা করলেও ছাত্রলীগ ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য! ক্ষোভে দুঃখে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে ইচ্ছা প্রকাশ করা শুধুই ফাঁকা বুলি। আর বৃষ্টিতে ভিজে ছবি তোলার পোজ দেয়া শুধুই ‘বৃষ্টিবিলাস’। আপনার ডাবলস্ট্যান্ড দেখে শুধু ঘৃণাই উগরে বের হতে চাইছে। আর কত দুর্গন্ধ ছড়াবেন আপনি?’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তুহিন মালিক জাফর ইকবালের বক্তব্যে ‘ছাত্রলীগের’ জায়গায় ‘ছাত্রশিবির’ শব্দ লিখে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, একজন শিক্ষক তার সন্তানতুল্য ছাত্রদের প্রতি উদারতা দেখাতেই পারেন, তবে ভবিষ্যতে সেই শিক্ষক অন্যান্য ছাত্রদের জন্যও যদি এ রকম উদারতা দেখান কেমন লাগবে তখন? নিছক সেই অনুভূতিটা কল্পনা করতেই একটি শব্দ পরিবতর্ন করতে হলো বলে দুঃখিত।
অধ্যাপক ইয়াসমীন হকের বক্তব্যেও পাঠকেরা বিরুপ মন্তব্য করেছেন। রিদাওনুল কাদির লিখেছেন, প্রথম আলো বনাম জাফর ইকবাল, খেলাটা খুবই উপভোগ্য হচ্ছে। ধন্যবাদ সোনার ছেলেদের (ছাত্রলীগ) এমন একটি চমৎকার দৃশ্য তৈরিতে তারাই তো মূল কারিগর! এ ধরনের সৃজনশীল কাজে তোমাদের উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি!
এ ঘটনা আজ গোটাজাতি যে কতটা মর্মবেদনায় ভুগছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু শিক্ষক নন, দেশের যেকোনো অনুভূতিশীল মানুষের জন্যই রোববারের ঘটনাটি মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এই একটি ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্ম কোন দিকে যাচ্ছে, নষ্ট রাজনীতি ও ক্ষমতার লোভ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের। কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেই প্রজন্ম, যাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে আগামী দিনের বাংলাদেশ। সমাজ কি এভাবেই নষ্টদের অধিকারে যাবে? শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদেরও নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে বিশ্বমানের নাগরিক তৈরি হওয়ার কথা, সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এভাবে দল বেঁধে শিক্ষকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, আক্রমণ করতে পারে, এটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এরপরও যখন দেখি জাফর ইকবাল স্যারদের মতো ব্যক্তি ওইসব বেয়াদব ছেলেদের পক্ষে কথা বলেন তখন আমাদের মনো:কষ্ট আরো বেড়ে যায়। যা এমনটি না করলেও পারতেন জাফর ইকবাল স্যার।
জাতির ঘাড়ে কালিমা লেপনের এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন, সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসন ও শিক্ষকরা কোনভাবেই এর দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। যে ছাত্ররা আজ এই ন্যাক্কারজনক কাজে জড়িত ছিল তাদের যেমন উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত, ঠিক তেমনি তাদের পক্ষে যারা সাফাই গাইছেন, যারা এই কাজে উস্কে দিচ্ছেন তাদেরও আইনের আওয়তায় আনা উচিত। সেই সাথে উপার্যের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তাও তদন্ত হওয়া উচিত। অন্যথা এই স্বার্থবাজ শিক্ষক-ছাত্ররা মিলেই বিশ্ববিদ্যালয়টির ধ্বংস ডেকে আনবে। তাই সরকারের প্রতি আহবান, আর নীরবতা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে হলেও দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এ ঘটনার দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান ও সমস্যার নিষ্পত্তি করুন।
লেখক: গবেষক
ই-মেইল: sarderanis@gmail.com
তবে এই ঘটনাটি হঠাৎ করেই ঘটেছে এটা বলা যাবে না। সবাই জানি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাটি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। আর সমস্যাটি কিন্তু শিক্ষাকার্যক্রম কিংবা শিক্ষা-গবেষণা ও শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে নয়, স্রেফ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক শিক্ষকদের দুগ্রুপের আধিপত্য বিস্তার তথা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে। গেল এপ্রিল মাসেও এ সঙ্কট চরম আকার ধারণ করলে ভিসি আমিনুল হক ভুঁইয়া দুই মাসের ছুটিতে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেছিলেন।
যতদূর জানি তাতে, চলতি বছরের শুরু থেকেই ভিসির বিরুদ্ধে ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ ও প্রশাসন পরিচালনায় ‘অযোগ্যতার’ পাশাপাশি নিয়োগে ‘অনিয়ম’ ও আর্থিক ‘অস্বচ্ছতার’ অভিযোগ এনে তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ। আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২০শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭টি প্রশাসনিক পদ ছাড়েন ৩৫ জন শিক্ষক, যাদের মধ্যে অধ্যাপক জাফর ইকবাল এবং স্ত্রীও ছিলেন। তবে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভিসি ২৩শে এপ্রিল জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে দুই মাসের ছুটিতে গেলে ভারপ্রাপ্ত ভিসি ট্রেজারার ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাসের অধীনে সেই ৩৫ জন কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ভিসি পুনরায় ক্যাম্পাসে ফিরলে এই সঙ্কট ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আর গেল রোববার ভিসি আন্দোলনরত শিক্ষকদের বাধার মুখে ছাত্রলীগের ক্যাডারসহ নিজদপ্তরে প্রবেশ করতে গেলে এ লঙ্কাকাণ্ড ঘটে। এসময় বেশ ক’জন শিক্ষককে মারধর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা- এ সংবাদ এখন সব গণমাধ্যমের শিরোনাম!
এ ঘটনায় শিক্ষকদের আন্দোলনে নতুন মাত্রা পেয়েছে। ভিসির অপসারণ দাবিতে আন্দোলনে নামা শিক্ষকরা বৃহস্পতিবার প্রতীকী অনশন শেষে রোববার কর্মবিরতির ঘোষণা দেন। এছাড়া ভিসি না যাওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে বলেও হুশিয়ারি দেন। অবশ্য এর আগেও আন্দোলনকারী শিক্ষকরা একই দাবিতে অনশন করেছিলেন। তবে শিক্ষকদের সঙ্গে এবার আন্দোলনে যোগ দিয়েছে শিক্ষার্থীদের একাংশ, তারা ভিসির পদত্যাগ দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটামও দিয়েছে। অন্যদিকে ভিসি ‘লাঞ্ছনাকারী’ শিক্ষকদের বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও শিক্ষকদের একাংশ। ফলে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হচ্ছে। বলা যাচ্ছে না পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় এবং শেষ গোলটা কোনপক্ষে যায়।
এসব বিষয় কিন্তু সরকারের উপর মহলের একেবারে অজানা নয়। এরপরও কোন সুরাহা না করে সরকারের হর্তাকর্তারা নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছেন। সবার ভাবখানা এমন যে- এ বিষয়ে কেউ যেন কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। ফলে আজ লেখার শুরুতেই আমার মনে পড়ে গেলে বহুল আলোচিত সেই ‘কদম ফুলের’ গল্পের কথা- মাথার চুল কদম ফুল কোথায় হল গণ্ডগোল? আমার মনে হয় এই গল্পের কাহিনী সবারই জানা, তাই এখানে তা উল্লেখ করে পাঠকদের বিরুক্তি ঘটাতে চাই না।
এবার আসি বিশ্ববিদ্যালয়টির সমস্যার পেছনের কথা নিয়ে। প্রসঙ্গত, গেল কয়েকদিনে এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং অনেকের নিবন্ধ পড়ে কেন জানি আমার মনে হয়েছে তারা সঙ্কটের জন্য ভিসি প্রফেসর ড. আমিনুল হক ভুঁইয়াকেই তুলোধূনা করার চেষ্টা করেছেন। তাদের মনোভাব অনেকটাই একপেশে পরিলক্ষিত হয়েছে। এতে আমার যা মনে হয়েছে, তাতে একই মতাদর্শে বিশ্বাসী লেখক-সাংবাদিকরা সরকারের মহলের ভুমিকা এবং অধ্যাপক জাফর ইকবাল একজন জনপ্রিয় লেখক, সমাজের প্রভাবশালী হওয়ার কারণেই হয়তোবা তাদের ভূমিকাটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে একজন নাগরিক হিসেবে নিজের দায়িত্ববোধ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রকৃত সমস্যাগুলোর কিছুটা জনসম্মুখে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমার অবস্থান কারও পক্ষে কিংবা বিপক্ষে নয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও জাফর ইকবাল স্যারের লেখার ভক্ত, ইতোপূর্বে একজন সাংসদ যখন তাকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন তখন ‘জাফর ইকবাল ও একের ভেতর চার’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। তাকে এবং তার লেখা পছন্দ করি সেটা একেবারেই ব্যক্তিগত বিষয়, আমার এই লেখায় সেটার কোন প্রভাব থাকবে বলে মনে করছি না, থাকা সমীচীনও নয়।
থাক এসব কথা, ফিরে আসি মূল বিষয়ের দিকে। এখানকার সমস্যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার সাথে কিছুটা মিল থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই বেশ অমিল ও বৈচিত্র্যময় । পত্রপত্রিকা পাঠে ও ব্যক্তিগতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট ক’জনের সাথে কথা বলে যা জানতে পেলাম তাতে সমস্যাটির শেকড় অনেক গভীরে। ফলে যে সব বিষয় এখানে সঙ্কটের মুখ্য হিসেবে কাজ করছে তা নিয়ে আমার কিছু ভাবনা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।
এক. পত্রপত্রিকা পাঠে ও বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট আমার পরিচিত ক’জনের সাথে কথা বলে যা জানতে পেলাম তাতে, বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্কটে সরকারের উপর মহলের লোকজন চলমান বিরোধে ঘি ঢালছেন। চলমান সঙ্কটে বিবাদমান পক্ষগুলো নিজেদের মতাদর্শের লোক বলে তারা কোনো পক্ষকেই চটাতে চাচ্ছেন না, সবাইকে ভালবাসছেন সমানতালে। ফলে এমপি-মন্ত্রীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পক্ষগুলো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এমন হুলি খেলায় মেতে উঠেছেন। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, এখানে দুটি পক্ষ সুস্পষ্ট- একদিকে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বর্তমান ভিসি প্রফেসর ড. আমিনুল হক ভুঁইয়ার পক্ষে, অন্যদিকে ক্যাম্পাসের আওয়ামী-বাম সমর্থিত শিক্ষকদের বড় অংশ প্রফেসর জাফর ইকবালের পক্ষে ভুমিকা রাখছেন। নেতাদের ভাষ্যমতে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও মনে করেন, অধ্যাপক জাফর ইকবালসহ কিছুসংখ্যক শিক্ষক অতি বাড়াবাড়ি করছেন। এতে সরকার চাচ্ছে না বর্তমান ভিসিকে সহজেই সরাতে। আবার জাফর ইকবালকেও সরাসরি চটাতে চাচ্ছে না। ফলে সরকার এখানে অনেকটাই কৌশলী ভুমিকায় রয়েছে।
দুই. ২০১৩ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি বিদায়ী ভিসি সালেহউদ্দিন আহমেদের মেয়াদ শেষ হবার প্রায় ছয়মাস পর জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক মো. আমিনুল হক ভূঁইয়া । তবে নিজেদের মধ্য থেকেই ভিসি নিয়োগের দাবি করে আসছিলেন শিক্ষকরা। কিন্তু তাদের সে দাবি পূরণ না হওয়ায় প্রথম থেকেই তারা আমিনুল হক ভূঁইয়াকে মেনে নিতে পারেননি। ফলে প্রথম থেকেই সেখানকার আওয়ামী-বামপন্থী শিক্ষকরা অসহযোগিতা করে আসছে বলে ভিসিপন্থীদের ভাষ্য।
তিন. ক্যাম্পাস সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেরই মনোভাব হলো- এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কটের পেছনে যতটা না ভিসি দায়ী, তার চেয়েও বড় সমস্যা অধ্যাপক জাফর ইকবাল। এখানে যে কোন ব্যক্তি ভিসি হয়ে আসুক না কেন, তার (জাফর ইকবাল) কথা শুনতেই হবে, অন্যথায় শান্তিতে একদিনও থাকার সুযোগ নেই, সর্বদা এমনই মনোভাব পোষণ করেন তিনি। বিগত দিনেও সব ভিসিকেই কমবেশি তোয়াজ করতে হয়েছে তাকে। অন্যথা তার কথা যারা শোনেননি তাদেরকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বিদায় নিতে হয়েছে। যদিও এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয় বলে জাফর ইকবাল পক্ষের শিক্ষকরা দাবি করে আসছেন । এক্ষেত্রে উপাচার্যপন্থীরা সাম্প্রতিককালে জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমীন হকের ভুমিকা-বক্তব্যকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এছাড়া মার্চ-এপ্রিল মাসের পুরো সময়টা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী। বর্তমানেও অধ্যাপক ইয়াসমীন হক আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছেন। অবশ্য তাদের আন্দোলনের পেছনে যৌক্তিক কিছু কারণও রয়েছে। তবে আন্দোলনের ছক ও কৌশল পুরোটাই জাফর ইকবালের এমন দাবি ভিসিপন্থীদের।
চার. এখানে শিক্ষকদের দলবাজি আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক গ্রুপ পলিটিক্সও অন্যতম সমস্যা। আমরা কী দেখলাম! ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী দলবেধে শিক্ষকদের পিটিয়ে আহত করেছে। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে এ ধরনের ঘটনার পর জাতির অবক্ষয়ের আর বাকি থাকে কী? জাতিকে লজ্জায় ডুবিয়েছে ছাত্র নামধারী এই ক্যাডাররা। যদিও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সে দায় নিতে নারাজ। ইতোমধ্যে তারা ৩জনকে বহিষ্কারও করেছে। আক্রান্ত শিক্ষকদের অভিযোগ, ভিসির উসকানিতেই সরকারি দলের সহযোগী ছাত্রসংগঠনটির কিছু নেতাকর্মী শিক্ষকদের আক্রমণ করে। অবশ্য ভিসিও এ দায় নিতে অস্বীকার করেছেন। ফলে প্রশাসনও সংশ্লিষ্ট ৪জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছে। একজন ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক, তিনি কেন শিক্ষকদের ওপর ছাত্রদের লেলিয়ে দেবেন-এমন প্রশ্ন ওঠাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু যে শিক্ষকরা এই ভিসি অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তারা আক্রান্ত হওয়াতেই প্রশ্ন উঠেছে। ভিডিও চিত্রেও প্রমাণ মিলেছে। এতে বলা যায়, ব্যক্তিকেন্দ্রিক গ্রুপগুলো ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করছে। এক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও ব্যবহার করছে শিক্ষকরা। এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য এক অশুভ ইঙ্গিত।
পাঁচ. আমরা চরমভাবে হতাশ হয়েছি জাফর ইকবারের মতো একজন জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির ভুমিকায়। জাফর ইকবাল নামটি নতুন প্রজন্মের কাছে আলাদা গুরুত্ব বহন করে। জাফর ইকবাল মানে একটি সাহসী ও প্রতিবাদী কণ্ঠ। তার লেখায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, স্বাধীনতার কথা বলেন, গণতন্ত্র ও গণমানুষের কথা বলেন, দুর্নীতি-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলেন। এ কারণে সবার প্রত্যাশা ছিল অন্তত: তিনি অন্যায়ের কাছে কোনোদিন নতি স্বীকার করবেন না, অন্যায়-অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দিবেন না। কিন্তু আমরা কী লক্ষ্য করলাম-
গেল রোববার ঘটনার পরপরই দেশবরেণ্য এই লেখক বললেন, এখানে যে ছাত্ররা ‘জয় বাংলা বলে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা আমার ছাত্র হয়ে থাকলে এই দৃশ্য দেখার আগেই শিক্ষক হিসেবে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিত। সেদিন ঘটনাটি ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে সারাবিশ্বে। অধ্যাপক ইকবালের প্রতি সহমর্মিতায় সবাই যখন সরব, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমবেদনা আর সহানুভূতির ঝড়, প্রতিবাদে লেখনির ঝড় । তখন একদিন পরই তিনি এবং তার স্ত্রী ভোল পাল্টে ফেললেন। ফলে বুধবার সন্ধ্যা থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও ইউটার্ন করেছে, যেভাবে করেছেন জাফর স্যার। ছাত্রলীগের ছেলেদের দায়মুক্তি দিয়ে এই ফিকশন লেখক জানালেন, কে হামলা করেছে? ছাত্রলীগ! ছাত্রলীগের ছেলেরা বাচ্চা, ওরা হামলা করতে পারে না। ওদের শাস্তি দেওয়াটা অন্যায়।’এর আগে অবশ্য ঘটনার দিন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্জনার শিকার তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমীন হকও সংগঠনটির কাছে নতি স্বীকার করে বলেন, ‘ওইদিনের ঘটনায় ছাত্রলীগের কোনো দোষ নেই’। এরপর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত সচিত্র সংবাদে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে ছবিসহ একটি বিবৃতিও দিয়েছেন স্বামীর ফেসবুকের মাধ্যমে ইয়াসমীন হক।
তবে এসবেও থামেনি সমালোচনা। ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের প্রতি এই শিক্ষক দম্পতির অবস্থানে নতুন করে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। শিক্ষক, সাংবাদিক থেকে শুরু করে আইনজীবী- সবাই ছাত্রলীগের প্রতি তাদের দায়মুক্তি ও অকৃত্রিম ভালবাসার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ইমরান বসুনিয়া সোহাগ নামে এক যুবক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ছাত্রলীগ শিক্ষক পিটাইলো আর আপনি (জাফর ইকবাল) প্রতিবাদের নামে বৃষ্টি উপভোগ করলেন। আবার সেই আপনিই বললেন, ছাত্রলীগকে শাস্তি দিলে অন্যায় হবে। শাস্তি চাইলেন ভিসির। বহুরুপী মানুষ আপনি, যারে এক কথায় কয় সুবিধাবাদী।
মুহাম্মদ আনিসুর রহমানের মন্তব্য, ‘স্যার, এভাবে চলতে থাকলে কয়েকদিন পর পাবনায় সিট বুকিং দিতে হবে যে...’
সাংবাদিক হোসাইন ইমাম সোহেল লিখেছেন, তাহলে কী এই দেশের মানুষ ধরে নেবে, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে শিক্ষকদের ওপর হামলা করলেও ছাত্রলীগ ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য! ক্ষোভে দুঃখে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে ইচ্ছা প্রকাশ করা শুধুই ফাঁকা বুলি। আর বৃষ্টিতে ভিজে ছবি তোলার পোজ দেয়া শুধুই ‘বৃষ্টিবিলাস’। আপনার ডাবলস্ট্যান্ড দেখে শুধু ঘৃণাই উগরে বের হতে চাইছে। আর কত দুর্গন্ধ ছড়াবেন আপনি?’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তুহিন মালিক জাফর ইকবালের বক্তব্যে ‘ছাত্রলীগের’ জায়গায় ‘ছাত্রশিবির’ শব্দ লিখে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, একজন শিক্ষক তার সন্তানতুল্য ছাত্রদের প্রতি উদারতা দেখাতেই পারেন, তবে ভবিষ্যতে সেই শিক্ষক অন্যান্য ছাত্রদের জন্যও যদি এ রকম উদারতা দেখান কেমন লাগবে তখন? নিছক সেই অনুভূতিটা কল্পনা করতেই একটি শব্দ পরিবতর্ন করতে হলো বলে দুঃখিত।
অধ্যাপক ইয়াসমীন হকের বক্তব্যেও পাঠকেরা বিরুপ মন্তব্য করেছেন। রিদাওনুল কাদির লিখেছেন, প্রথম আলো বনাম জাফর ইকবাল, খেলাটা খুবই উপভোগ্য হচ্ছে। ধন্যবাদ সোনার ছেলেদের (ছাত্রলীগ) এমন একটি চমৎকার দৃশ্য তৈরিতে তারাই তো মূল কারিগর! এ ধরনের সৃজনশীল কাজে তোমাদের উত্তরোত্তর সফলতা কামনা করছি!
এ ঘটনা আজ গোটাজাতি যে কতটা মর্মবেদনায় ভুগছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু শিক্ষক নন, দেশের যেকোনো অনুভূতিশীল মানুষের জন্যই রোববারের ঘটনাটি মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এই একটি ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্ম কোন দিকে যাচ্ছে, নষ্ট রাজনীতি ও ক্ষমতার লোভ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের। কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেই প্রজন্ম, যাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে আগামী দিনের বাংলাদেশ। সমাজ কি এভাবেই নষ্টদের অধিকারে যাবে? শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদেরও নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে বিশ্বমানের নাগরিক তৈরি হওয়ার কথা, সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এভাবে দল বেঁধে শিক্ষকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, আক্রমণ করতে পারে, এটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এরপরও যখন দেখি জাফর ইকবাল স্যারদের মতো ব্যক্তি ওইসব বেয়াদব ছেলেদের পক্ষে কথা বলেন তখন আমাদের মনো:কষ্ট আরো বেড়ে যায়। যা এমনটি না করলেও পারতেন জাফর ইকবাল স্যার।
জাতির ঘাড়ে কালিমা লেপনের এ ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন, সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসন ও শিক্ষকরা কোনভাবেই এর দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না। যে ছাত্ররা আজ এই ন্যাক্কারজনক কাজে জড়িত ছিল তাদের যেমন উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত, ঠিক তেমনি তাদের পক্ষে যারা সাফাই গাইছেন, যারা এই কাজে উস্কে দিচ্ছেন তাদেরও আইনের আওয়তায় আনা উচিত। সেই সাথে উপার্যের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে তাও তদন্ত হওয়া উচিত। অন্যথা এই স্বার্থবাজ শিক্ষক-ছাত্ররা মিলেই বিশ্ববিদ্যালয়টির ধ্বংস ডেকে আনবে। তাই সরকারের প্রতি আহবান, আর নীরবতা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকিয়ে হলেও দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এ ঘটনার দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান ও সমস্যার নিষ্পত্তি করুন।
লেখক: গবেষক
ই-মেইল: sarderanis@gmail.com
No comments