খুনি কামরুলও কি নূর হোসেন হবে? by সোহরাব হাসান
সিলেটের
হতভাগ্য শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন খুনের ঘটনায় মানুষের মধ্যে যেভাবে
দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দেখা গেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষুব্ধ
প্রতিক্রিয়া ছিল ১৫ মাস আগে সংঘটিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায়। সিলেটের
ঘাতকেরা ভুয়া অভিযোগ এনে দরিদ্র পরিবারের সবজি বিক্রেতা রাজনকে পিটিয়ে
হত্যা করেছে। আর নারায়ণগঞ্জের হত্যাকাণ্ডটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত। রাজন
হত্যার দৃশ্যটি ফেসবুকের মাধ্যমে দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং চাঞ্চল্য
সৃষ্টি হয়। আবার সময়ের ব্যবধানে সেই চাঞ্চল্য হারিয়েও যাবে। কেবল যাবে না
স্বজনের কান্না, কষ্ট ও আহাজারি। এ রকম নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রায়
প্রতিদিনই আমাদের চারপাশে ঘটছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন আমরা বিচলিত হই
না। সব গা সওয়া হয়ে গেছে।
রাজন হত্যার পর সারা দেশে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, তাতে কি দেশে খুনিদের দৌরাত্ম্য, অপরাধীদের আস্ফালন এতটুকু কমেছে? কমেনি, তার প্রমাণ প্রতিদিনের পত্রিকায়, টেলিভিশনে হত্যা ও দস্যুতার খবর। আমাদের সমাজটি যেন ধীরে ধীরে বসবাস অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। সমাজে যাঁরা বিত্তশালী, যারা ক্ষমতাবান, তাঁরা আইন মানেন না, আইনকে নিজের মতো ব্যবহার করেন। আর যাঁরা প্রান্তিক ও দুর্বল, তাঁরা প্রায়ই আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। এই যে সমাজে ঘৃণ্য ও নিষ্ঠুর সব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, কারা তার শিকার হচ্ছে? প্রধানত নারী ও শিশুরা, যারা প্রতিবাদ করতে পারে না, প্রতিবাদ করলেও বেআইনি বল প্রয়োগে সেই প্রতিবাদের ভাষা স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।
গত কয়েক দিনে রাজধানীতেই ঘটেছে বেশ কটি রোমহর্ষক ঘটনা। তরুণীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তাঁর সৎভাই। দুর্বৃত্তদের হাতে ধর্ষিত হয়েছে স্কুলছাত্রী ও গৃহবধূ। সাভারে এক নরপশু যৌতুকের জন্য তাঁর স্ত্রীর চোখ তুলে নিয়েছে। টাঙ্গাইলে নদীতে গোসল করতে গিয়ে স্ত্রীকে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে আরেক পাষণ্ড। খুলনায় ক্ষমতাবানেরা ছাগল চুরির অভিযোগে দুটি শিশুকে যেভাবে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে মারধর করেছে, তা পৌরাণিক কাহিনিকেও হার মানায়। আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি, কিন্তু আমাদের ভাষা ও আচরণে রয়ে গেছে অসভ্যতার ছাপ। ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থে আমরা পারি না, এমন কাজ নেই। না হলে মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তঃসত্ত্বা নারী কেন গুলিবিদ্ধ হবেন? কেনই–বা সেখানে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে একজন নিরীহ মানুষ জীবন দেবেন? রাজনীতি এখন মানুষকে পথ দেখানোর বদলে বিপথগামী করতেই বেশি তৎপর।
এ কথা ঠিক যে শিশু রাজনের ঘাতকদের ধরতে গ্রামবাসী এবং এমনকি অভিযুক্তদের পরিবারগুলো যথেষ্ট তৎপরতা দেখিয়েছে। অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে রাজনের শোকসন্তপ্ত স্বজনকে সান্ত্বনা দিয়ে এসেছেন। পরিবারটিকে চলার জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু এই ঢাকা শহরে এক সাংসদের ছেলের গুলিতে যে একজন রিকশাচালক ও অটোরিকশাচালক মারা গেলেন, তাঁদের অসহায় পরিবারের কাছে কাউকে যেতে দেখলাম না। দেশে অনেক মানবাধিকার সংগঠন আছে, অথচ একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এই পরিবার দুটি কীভাবে চলছে, তার খোঁজও কেউ নেয়নি। ঈদের দিনেও তাদের ঘরে চুলা জ্বলেনি। হায় আমাদের মানবতাবোধ!
রাজন হত্যার অধিকাংশ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। কয়েকজন অভিযুক্তের বাবা-মা পুলিশের হাতে সন্তানকে তুলে দিয়েছেন। আমরা তাঁদের অভিনন্দন জানাই। সমাজে এ ধরনের দৃষ্টান্ত যত বেশি ঘটবে, অপরাধের মাত্রা ও অপরাধীর সংখ্যা তত কমবে। তবে রাজন হত্যার আসামিদের ধরতে পরে যেমন পুলিশ সক্রিয় হয়েছে, তেমনি এই বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য গোড়ার দিকে তাদের বাঁচানোরও চেষ্টা করেছেন। রাজনের পরিবার ও স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে রাজন হত্যার আসামি কামরুল ইসলামকে সৌদি আরব যেতে সহায়তা করেছেন। উল্লেখ্য, ঘটনার দুই দিন পরই এই ঘাতক সৌদি আরব পালিয়ে যান এবং এখন সৌদি আরবের জেলে আছে। রাতের আঁধারে সড়ক বা সমুদ্রপথে সেই ঘাতক পালিয়ে যায়নি, দিনদুপুরে থানা–পুলিশ–ইমিগ্রেশন পেরিয়ে বিমানে চড়েছে। তাই সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। পুলিশ বিভাগের তৈরি তদন্ত কমিটি উৎকোচের কথা স্বীকার না করলেও পুলিশের গাফিলতির কথা স্পষ্ট করেই বলেছে।
সরকারের এত সব তৎপরতার পরও প্রশ্ন জাগে যে শেষ পর্যন্ত রাজনের হত্যার বিচার হবে কি না? খুনিরা শাস্তি পাবে কি না? মামলার পলাতক আসামি কামরুল ইসলামকে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনা যাবে কি না? না এ রকম আরেকটি কিংবা এর চেয়েও নৃশংস কোনো হত্যাকাণ্ডের পর আমরা রাজনের কথা ভুলে যাব? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান রাজনের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, কামরুলকে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনতে সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে। সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে, সেটি তাঁরা কাজে লাগাবেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, দ্রুত বিচার আইনে রাজন হত্যার বিচার হবে।
কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় যত সহজে বললেন, কামরুলকে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনাটা ততটা সহজ নয়। সে দেশের নিজস্ব আইনকানুন আছে। আর তাকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে রাজন হত্যার বিচারও প্রলম্বিত হবে। এখানে ফরিয়াদি খুবই গরিব, দিন আনেন দিন খান অবস্থা। তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা কিংবা আসামিপক্ষের হুমকি মোকাবিলা করা কঠিন। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসবাণী আমাদের খুব আশ্বস্ত করে না। বিদেশে পলাতক কম আসামিকেই আমরা দেশে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। একমাত্র ব্যতিক্রম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি বজলুল হুদা। তাঁকে থাইল্যান্ড থেকে ফিরিয়ে এনে সরকার ফাঁসি দিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক মহিউদ্দিনকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বের করে দিয়েছিল সে দেশে অবৈধভাবে অবস্থানের কারণে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই।
এ ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন, যিনি এখন কলকাতায় কারাগারে আটক হয়ে বিচারের মুখোমুখি, তাঁর কথা উল্লেখ করা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। গত বছরের ২৭ এপ্রিল নূর হোসেনের পরিকল্পনায় সাত খুনের ঘটনা ঘটার বেশ কয়েক দিন তিনি দেশের ভেতরেই বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে ছিলেন। সেই মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হলেও সরকার নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের অনেকেই নূর হোসেনকে অনতিবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। একইভাবে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া এবং রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ১৫ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও তাঁকে ফিরিয়ে আনা যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদি আরবের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলেছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তিও আছে, যা সৌদি আরবের সঙ্গে নেই। ফলে ভারত থেকে বাংলাদেশের এই দুর্ধর্ষ হত্যার আসামিকে ফিরিয়ে আনা অনেক সহজ ছিল।
নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে গেছেন ১৫ মাস। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা হলেও এখনো চার্জ গঠন করা হয়নি। কবে হবে কেউ জানে না। গত সপ্তাহে কলকাতার একটি আদালত নূর হোসেনের সহযোগীর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। সেই পরোয়ানা কবে তামিল হবে, কবে মামলার চার্জশিট হয়ে বিচার হবে, সেটিও কেউ বলতে পারে না। সেখানে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এখানে সংঘটিত কোনো অপরাধের কারণে নয়। তিনি সেখানে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছেন। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বাড়িভাড়া নিয়েছেন। তাঁর কাছে বিদেশি মুদ্রা ইত্যাদি পাওয়া গেছে। যেগুলো খুবই মামুলি ঘটনা।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেখানে উলফার দুর্ধর্ষ নেতাদের বাংলাদেশ ফিরিয়ে দিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ চাইলে চুনোপুঁটি নূর হোসেনকে ফেরত আনা কঠিন নয়। প্রশ্ন হলো, সরকার তাঁকে ফেরত এনে সাত হত্যার বিচারকে ত্বরান্বিত করতে চায় কি না? অনেকের মতে, দেশে-বিদেশে নূর হোসেনের খুঁটি বেশ শক্ত। সম্প্রতি সাত খুনের মামলায় সরকার চার্জ গঠন করলেও নারাজি পিটিশন দিয়েছেন নিহত কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম, যিনি পরবর্তীকালে স্বামীর আসনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর দাবি, মামলার এজাহারে নূর হোসেনসহ যে ছয়জনকে আসামি করা হয়েছিল, পুলিশ কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি। নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে গেলেও অন্যরা দেশেই আছেন।
আমরা মনে করি, ন্যায়বিচারের স্বার্থেই কামরুল ও নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনা ছাড়া যেমন সাত খুনের বিচার সম্ভব নয়, তেমনি রাজন হত্যার বিচার করতেও কামরুলকে লাগবে। এখন সরকার সত্যি সত্যি কামরুলকে ফিরিয়ে আনতে চায়, না মন্ত্রী–নেতাদের আশ্বাসবাণী বিচারপ্রার্থী ক্ষুব্ধ স্বজন ও জনগণকে শান্ত রাখার কৌশল, সেই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য হয়তো আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
রাজন হত্যার পর সারা দেশে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে, তাতে কি দেশে খুনিদের দৌরাত্ম্য, অপরাধীদের আস্ফালন এতটুকু কমেছে? কমেনি, তার প্রমাণ প্রতিদিনের পত্রিকায়, টেলিভিশনে হত্যা ও দস্যুতার খবর। আমাদের সমাজটি যেন ধীরে ধীরে বসবাস অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। সমাজে যাঁরা বিত্তশালী, যারা ক্ষমতাবান, তাঁরা আইন মানেন না, আইনকে নিজের মতো ব্যবহার করেন। আর যাঁরা প্রান্তিক ও দুর্বল, তাঁরা প্রায়ই আইনি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন। এই যে সমাজে ঘৃণ্য ও নিষ্ঠুর সব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, কারা তার শিকার হচ্ছে? প্রধানত নারী ও শিশুরা, যারা প্রতিবাদ করতে পারে না, প্রতিবাদ করলেও বেআইনি বল প্রয়োগে সেই প্রতিবাদের ভাষা স্তব্ধ করে দেওয়া হয়।
গত কয়েক দিনে রাজধানীতেই ঘটেছে বেশ কটি রোমহর্ষক ঘটনা। তরুণীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তাঁর সৎভাই। দুর্বৃত্তদের হাতে ধর্ষিত হয়েছে স্কুলছাত্রী ও গৃহবধূ। সাভারে এক নরপশু যৌতুকের জন্য তাঁর স্ত্রীর চোখ তুলে নিয়েছে। টাঙ্গাইলে নদীতে গোসল করতে গিয়ে স্ত্রীকে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে আরেক পাষণ্ড। খুলনায় ক্ষমতাবানেরা ছাগল চুরির অভিযোগে দুটি শিশুকে যেভাবে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে মারধর করেছে, তা পৌরাণিক কাহিনিকেও হার মানায়। আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করি, কিন্তু আমাদের ভাষা ও আচরণে রয়ে গেছে অসভ্যতার ছাপ। ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থে আমরা পারি না, এমন কাজ নেই। না হলে মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তঃসত্ত্বা নারী কেন গুলিবিদ্ধ হবেন? কেনই–বা সেখানে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের গোলাগুলিতে একজন নিরীহ মানুষ জীবন দেবেন? রাজনীতি এখন মানুষকে পথ দেখানোর বদলে বিপথগামী করতেই বেশি তৎপর।
এ কথা ঠিক যে শিশু রাজনের ঘাতকদের ধরতে গ্রামবাসী এবং এমনকি অভিযুক্তদের পরিবারগুলো যথেষ্ট তৎপরতা দেখিয়েছে। অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ঘটনাস্থলে গিয়ে রাজনের শোকসন্তপ্ত স্বজনকে সান্ত্বনা দিয়ে এসেছেন। পরিবারটিকে চলার জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। কিন্তু এই ঢাকা শহরে এক সাংসদের ছেলের গুলিতে যে একজন রিকশাচালক ও অটোরিকশাচালক মারা গেলেন, তাঁদের অসহায় পরিবারের কাছে কাউকে যেতে দেখলাম না। দেশে অনেক মানবাধিকার সংগঠন আছে, অথচ একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এই পরিবার দুটি কীভাবে চলছে, তার খোঁজও কেউ নেয়নি। ঈদের দিনেও তাদের ঘরে চুলা জ্বলেনি। হায় আমাদের মানবতাবোধ!
রাজন হত্যার অধিকাংশ আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। কয়েকজন অভিযুক্তের বাবা-মা পুলিশের হাতে সন্তানকে তুলে দিয়েছেন। আমরা তাঁদের অভিনন্দন জানাই। সমাজে এ ধরনের দৃষ্টান্ত যত বেশি ঘটবে, অপরাধের মাত্রা ও অপরাধীর সংখ্যা তত কমবে। তবে রাজন হত্যার আসামিদের ধরতে পরে যেমন পুলিশ সক্রিয় হয়েছে, তেমনি এই বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য গোড়ার দিকে তাদের বাঁচানোরও চেষ্টা করেছেন। রাজনের পরিবার ও স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশ কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে রাজন হত্যার আসামি কামরুল ইসলামকে সৌদি আরব যেতে সহায়তা করেছেন। উল্লেখ্য, ঘটনার দুই দিন পরই এই ঘাতক সৌদি আরব পালিয়ে যান এবং এখন সৌদি আরবের জেলে আছে। রাতের আঁধারে সড়ক বা সমুদ্রপথে সেই ঘাতক পালিয়ে যায়নি, দিনদুপুরে থানা–পুলিশ–ইমিগ্রেশন পেরিয়ে বিমানে চড়েছে। তাই সংশ্লিষ্টরা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। পুলিশ বিভাগের তৈরি তদন্ত কমিটি উৎকোচের কথা স্বীকার না করলেও পুলিশের গাফিলতির কথা স্পষ্ট করেই বলেছে।
সরকারের এত সব তৎপরতার পরও প্রশ্ন জাগে যে শেষ পর্যন্ত রাজনের হত্যার বিচার হবে কি না? খুনিরা শাস্তি পাবে কি না? মামলার পলাতক আসামি কামরুল ইসলামকে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনা যাবে কি না? না এ রকম আরেকটি কিংবা এর চেয়েও নৃশংস কোনো হত্যাকাণ্ডের পর আমরা রাজনের কথা ভুলে যাব? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান রাজনের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, কামরুলকে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনতে সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে। সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে, সেটি তাঁরা কাজে লাগাবেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, দ্রুত বিচার আইনে রাজন হত্যার বিচার হবে।
কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় যত সহজে বললেন, কামরুলকে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনাটা ততটা সহজ নয়। সে দেশের নিজস্ব আইনকানুন আছে। আর তাকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে রাজন হত্যার বিচারও প্রলম্বিত হবে। এখানে ফরিয়াদি খুবই গরিব, দিন আনেন দিন খান অবস্থা। তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা কিংবা আসামিপক্ষের হুমকি মোকাবিলা করা কঠিন। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসবাণী আমাদের খুব আশ্বস্ত করে না। বিদেশে পলাতক কম আসামিকেই আমরা দেশে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। একমাত্র ব্যতিক্রম বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি বজলুল হুদা। তাঁকে থাইল্যান্ড থেকে ফিরিয়ে এনে সরকার ফাঁসি দিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক মহিউদ্দিনকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বের করে দিয়েছিল সে দেশে অবৈধভাবে অবস্থানের কারণে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কোনো কৃতিত্ব নেই।
এ ক্ষেত্রে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেন, যিনি এখন কলকাতায় কারাগারে আটক হয়ে বিচারের মুখোমুখি, তাঁর কথা উল্লেখ করা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না। গত বছরের ২৭ এপ্রিল নূর হোসেনের পরিকল্পনায় সাত খুনের ঘটনা ঘটার বেশ কয়েক দিন তিনি দেশের ভেতরেই বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে ছিলেন। সেই মামলার বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হলেও সরকার নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। সে সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের অনেকেই নূর হোসেনকে অনতিবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। একইভাবে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া এবং রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ১৫ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও তাঁকে ফিরিয়ে আনা যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদি আরবের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা বলেছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তিও আছে, যা সৌদি আরবের সঙ্গে নেই। ফলে ভারত থেকে বাংলাদেশের এই দুর্ধর্ষ হত্যার আসামিকে ফিরিয়ে আনা অনেক সহজ ছিল।
নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে গেছেন ১৫ মাস। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা হলেও এখনো চার্জ গঠন করা হয়নি। কবে হবে কেউ জানে না। গত সপ্তাহে কলকাতার একটি আদালত নূর হোসেনের সহযোগীর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। সেই পরোয়ানা কবে তামিল হবে, কবে মামলার চার্জশিট হয়ে বিচার হবে, সেটিও কেউ বলতে পারে না। সেখানে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এখানে সংঘটিত কোনো অপরাধের কারণে নয়। তিনি সেখানে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছেন। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বাড়িভাড়া নিয়েছেন। তাঁর কাছে বিদেশি মুদ্রা ইত্যাদি পাওয়া গেছে। যেগুলো খুবই মামুলি ঘটনা।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেখানে উলফার দুর্ধর্ষ নেতাদের বাংলাদেশ ফিরিয়ে দিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ চাইলে চুনোপুঁটি নূর হোসেনকে ফেরত আনা কঠিন নয়। প্রশ্ন হলো, সরকার তাঁকে ফেরত এনে সাত হত্যার বিচারকে ত্বরান্বিত করতে চায় কি না? অনেকের মতে, দেশে-বিদেশে নূর হোসেনের খুঁটি বেশ শক্ত। সম্প্রতি সাত খুনের মামলায় সরকার চার্জ গঠন করলেও নারাজি পিটিশন দিয়েছেন নিহত কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম, যিনি পরবর্তীকালে স্বামীর আসনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর দাবি, মামলার এজাহারে নূর হোসেনসহ যে ছয়জনকে আসামি করা হয়েছিল, পুলিশ কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি। নূর হোসেন ভারতে পালিয়ে গেলেও অন্যরা দেশেই আছেন।
আমরা মনে করি, ন্যায়বিচারের স্বার্থেই কামরুল ও নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনা ছাড়া যেমন সাত খুনের বিচার সম্ভব নয়, তেমনি রাজন হত্যার বিচার করতেও কামরুলকে লাগবে। এখন সরকার সত্যি সত্যি কামরুলকে ফিরিয়ে আনতে চায়, না মন্ত্রী–নেতাদের আশ্বাসবাণী বিচারপ্রার্থী ক্ষুব্ধ স্বজন ও জনগণকে শান্ত রাখার কৌশল, সেই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য হয়তো আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com
No comments