ক্রমাগত কর্তৃত্বপরায়ণতার পথে ধাবিত বাংলাদেশ
ক্রমাগত
কর্তৃত্ব-পরায়ণতার পথে ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের
পর গুম, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের খেয়াল-খুশিমতো গ্রেপ্তার, সমালোচনাকারী
মিডিয়ার মুখ বন্ধ করে দেয়ার ঘটনা সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠেছে এখানে। সাধারণ
বিষয় হয়ে উঠেছে সম্পাদক, ব্লগার, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের সদস্যদের
অভিযুক্ত করার ঘটনা। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কণ্ঠরোধ করতেই সরকার
গুমের পথ বেছে নিচ্ছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৭
বছরে গুমের ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে ২১২টি। গুম বন্ধ, এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের
ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জাতিসংঘের
মানবাধিকারবিষয়ক কাউন্সিলের শুনানিতে বাংলাদেশ বিষয়ে এসব কথা বলা হয়েছে। এ
শুনানিতে অংশ নেয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টার,
এফআইডিএইচ, এএফএডি। গুমের বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত, বিচার ও এর জন্য যারা
দায়ী, তাদের শাস্তি দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের যে বাধ্যবাধকতা আছে তা তুলে ধরা
হয় শুনানিতে। যেসব দেশের পরিস্থিতিতে মানবাধিকারবিষয়ক কাউন্সিলের গুরুতর
উদ্বেগ বা সচেতনতা প্রয়োজন- তা নিয়ে আলোচনা হয় সেখানে। এতে বাংলাদেশ
সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বিরোধীদলীয় হাজার হাজার সদস্য ও
প্রতিবাদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেলে রয়েছেন অজ্ঞাত সংখ্যক। বিরোধী দলের
অনেক নেতা হয়তো দেশ ছাড়ার অথবা আত্মগোপনে থাকার পথ বেছে নিয়েছেন। নাস্তিক
মত প্রকাশকারী ব্লগারদের নিরাপত্তায় যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে
কর্তৃপক্ষ। এর ফলে শুধু ২০১৫ সালেই নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন ৪ ব্লগার। রানা
প্লাজা ট্র্যাজেডির পর শ্রম আইন সংস্কার করার পর শ্রমিক ইউনিয়ন করার পথ সহজ
হলেও গবেষণায় দেখা গেছে যে, তৈরী পোশাক খাতে যারা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করতে
বা এতে যোগ দিতে চাইছেন তাদের বিরুদ্ধে চলছে দমন-পীড়ন। পর্যায়ক্রমিক
সরকারগুলোর সময়ে নিরপেক্ষভাবে প্রামাণ্য হিসেবে নিরাপত্তা বাহিনীর
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ঘন ঘন তারা যে নিয়মের লঙ্ঘন করেন তা তুলে ধরা
হয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী এসব বিষয়ে প্রায় পুরোপুরি
দায়মুক্তি ভোগ করছে। ওই শুনানিতে বাংলাদেশে অব্যাহত জোরপূর্বক গুমের বিষয়ে
জরুরিভিত্তিতে নজর দেয়ার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ‘এনফোর্সড অর
ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস’ (জোর করে অথবা স্বেচ্ছায় গুম) বিষয়ের ওপর
শুনানিতে যৌথ বিবৃতি দেয় এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টার (এএলআরসি),
এফআইডিএইচ, এএফএডি। এতে বলা হয়, এতে বাংলাদেশে চলমান গুম ও দায়মুক্তির
বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় কাউন্সিলের। বলা হয়, এসব অপরাধের সঙ্গে নিপীড়ন
অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যৌথ ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ
বছর আগস্ট পর্যন্ত মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশে কমপক্ষে ২১২টি
জোরপূর্বক গুমের ঘটনা প্রামাণ্য আকারে উপস্থাপন করেছে। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী
তাদের সাক্ষ্যে বলেছেন, এসব গুমে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার এজেন্টরা। অপহরণের
ধরন ও অপহৃতের প্রোফাইল যে সাক্ষ্য দেয় তাতে দেখা যায় যে, বিরোধী রাজনৈতিক
দলকে নীরব করে দিতেই সরকার গুমের পথ বেছে নিয়েছে। গুমের শিকার ব্যক্তির
পরিবার তার সম্পর্কে তথ্য ও বিচার চাওয়ার বিষয়টিকে পুলিশ ও আদালত কর্তৃক
অবজ্ঞা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আদর্শ বিষয় হলো দায়মুক্তি। সম্প্রতি গুমের
শিকার ব্যক্তিদের পরিবার সংগঠিত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে
তাদেরকে ভয়ভীতি ও প্রতিবন্ধকতা দেয়া হয়েছে। ওই সাক্ষ্যে গুমের শিকার
ব্যক্তিদেরকে তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দিতে আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশ
কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও এ অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে
স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এতে বলা হয়, আইসিসি’র রোম স্ট্যাচুট অনুমোদন করেছে
বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে তারা জোর করে গুমকে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে
স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বাধ্য। এতে আরও বলা
হয়, প্রটেকশন অব অল পারসনস এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপেয়ারেন্সেস বিষয়ক
১৯৯২ সালের ঘোষণায় নিশ্চিত করে বলা হয়েছে যে, যেকোন দেশে জোরপূর্বক গুম
প্রতিরোধ করতে বা বিলুপ্তি ঘটাতে প্রতিটি দেশকে কার্যকর আইনি, প্রশাসনিক,
বিচারিক ও অন্যান্য পদক্ষেপ নিতে হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, জোরপূর্বক গুমের
ইতি ঘটানোর লক্ষ্য অর্জনে এসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত, বিচার ও জড়িতদের
শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে বাধ্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। গুমের শিকার
ব্যক্তিদের পরিবারগুলো ও মানবাধিকারবিষয়ক কর্মীদের কথা বলা ও শান্তিপূর্ণ
সমাবেশকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে ও তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে হবে। বিবৃতিতে
বলা হয়, আমরা বাংলাদেশ সফরের অনুরোধ করছি ওয়ার্কিং গ্রুপকে। ঘটনার জরুরি
বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকারকে এমন একটি সফর মেনে নিতে আহ্বান জানানো
হয়।
No comments