প্রণবের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে মুখ খুললেন বেগম খালেদা জিয়া
এ নিয়ে কথা হয়েছে বিস্তর। আলোচনা-সমালোচনা
শেষ হয়নি আজও। কেন ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করেননি
বেগম খালেদা জিয়া? নানা মুনির নানা মত। কিন্তু খালেদা জিয়া ছিলেন নিশ্চুপ।
এতদিন পর এই প্রথম এ ব্যাপারে মুখ খুললেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। জানালেন,
প্রাণনাশের হুমকি থাকার কারণেই প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা করতে যেতে
পারেন নি তিনি। নিজের এ বক্তব্যকে প্রকৃত সত্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন খালেদা
জিয়া।
ভারতের দ্যা সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠক বানচাল করতে বাংলাদেশ সরকার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। গত ৭ই জুন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের কয়েকঘণ্টা পর গুলশান কার্যালয়ে বসে দ্যা সানডে গার্ডিয়ানের সাংবাদিক সৌরভ স্যানালকে সাক্ষাৎকারটি দেন বেগম খালেদা জিয়া। সানডে গার্ডিয়ান পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক এম জে আকবর। যিনি ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বাতিল হওয়া বৈঠক নিয়ে খালেদা জিয়ার মুখ খোলার পর অনেকেই স্মরণ করছেন ২০১৩ সালের ৪ঠা মার্চ দিনটির কথা। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করে তখন রাজপথ ছিল উত্তপ্ত। জামায়াতের ডাকা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের সেদিন ছিল দ্বিতীয় দিন। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আসা ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি অবস্থান নেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে। এখানেই প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল খালেদা জিয়ার। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে বৈঠকটির সময় নির্ধারিত ছিল। সেসময় বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠক বাতিলের কারণ হিসেবে নিরাপত্তার কথাই বলা হয়েছিল। বৈঠকের নির্ধারিত সময়ের কাছাকাছি সময়ে হোটেল সোনারগাঁওয়ের পাশে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। যে বিস্ফোরণের খবর আবার খুব দ্রুতই প্রচারিত হয় ভারতীয় মিডিয়ায়।
দ্যা সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কথা বলেছেন বেগম খালেদা জিয়া। এখানে সাক্ষাৎকারটির হুবহু তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন: বেগম জিয়া, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ কেমন হলো?
উত্তর: বৈঠক অত্যন্ত সন্তোষজনক হয়েছে। মোদিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল চমৎকার। আমি অবশ্যই বলবো, খুবই আন্তরিক পরিবেশে বৈঠক হয়েছে। এতে আমি খুবই সন্তুষ্ট।
প্রশ্ন: আপনাদের আলোচনায় মূল কি কি ইস্যু ছিল?
উত্তর: যেমনটি আমি বলেছি, বৈঠক হয়েছে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে এবং ফলপ্রসূ। আপনারা দেখেছেন বৈঠকটি ছিল ওয়ান-টু-ওয়ান। আমরা যেসব বিষয়ে আলোচনা করেছি বাস্তবেই সবটা বলতে পারছি না। তবে এটা বলতে পারি যে, অবশ্যই বৈঠক হয়েছে সন্তোষজনক।
প্রশ্ন: নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সবাই ছিলেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। শেষ পর্যন্ত আপনি যখন প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে পৌঁছালেন, তখন কি এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব শেষ হয়ে গেছে? কেন এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব?
উত্তর: কি নিয়ে এতসব সংশয়? একবারও কি আমি বলেছি যে, আমি মোদিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো না? নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হওয়ার পর ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। আমার দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একজনও নেতার মুখ থেকে কি শুনেছেন যে, আমি মোদিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো না? বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের নেতা মোদিজি। তিনি দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক শক্তিশালী করার বাসনা নিয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বার্তা দেয়ার জন্য বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। তা করতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। মোদিজির সঙ্গে আমার যাতে সাক্ষাৎ না হয় তা নিশ্চিত করতে এমন কিছু নেই যা তারা করেনি।
প্রশ্ন: ম্যাডাম, প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সম্মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র হয়েছিল এই অভিযোগই করছেন? এর নেপথ্যে কে ছিল?
উত্তর: সোজাসুজি আসল কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে অবস্থানকালে তার সঙ্গে যাতে আমার কোন সাক্ষাতের সম্ভাবনা প্রকাশ্যে নাকচ করে দেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এরপরই নয়াদিল্লি বাস্তবতা প্রকাশ করে দেয়। বাংলাদেশের দেয়া বিবৃতির কয়েক ঘণ্টা পরেই ও প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রাক্কালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর নয়াদিল্লিতে বলেন যে, সাক্ষাৎ হবে। আপনি এ বিষয়টিকে কিভাবে বিচার করবেন? আমার সঙ্গে এই সাক্ষাৎ ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার যত রকম পারে সেভাবেই প্রচেষ্টা নিয়েছে। তারপরও সাক্ষাৎ হয়েছে। এ জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তারা আসলে চায়নি যে, মোদিজির সঙ্গে আমার কোন আলোচনা হোক।
প্রশ্ন: এরপর আমি আপনাকে সরাসরি একটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনি যেমনটা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সম্ভবত ক্ষমতাসীন সরকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ যাতে কখনও না হয় তা নিশ্চিত করতে কূটচাল চেলেছিল। কিন্তু আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই, যখন ২০১৩ সালের মার্চে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, আপনি কিন্তু তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নি...।
উত্তর: আমাকে এ প্রশ্নটি করার জন্য আমি খুব খুশি। এটা সত্য কথা যে, আমি প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের সময় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি নি। ওই সময় ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তিন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বান করেছিল জামায়াতে ইসলামী। ওই সময়ে আমি জানতে পারি যে, যদি আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই তাহলে আমার ওপর আক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে সেটা হতে পারতো প্রাণনাশের হুমকি। প্রেসিডেন্ট যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন তার কাছেই একটি পেট্রলবোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। আমার তো ওই পথ দিয়েই যাওয়ার কথা ছিল।
প্রশ্ন: কিন্তু জামায়াতে ইসলামী তো আপনার রাজনৈতিক মিত্র। তারা কেন আপনার ওপর হামলা চালাবে?
উত্তর: যথার্থ কথা। এটাই পয়েন্ট। যদি ওইদিন আমার কিছু হতো তাহলে পুরো দায় গিয়ে বর্তাতো জামায়াতের ওপর। আমার বিরোধী পক্ষ তো এই গেম খেলার পরিকল্পনা করেছিল। এটা আমরা বুঝতে পারি এবং তারপরই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওই সাক্ষাৎ বাতিল করি। আজ আপনার সঙ্গে প্রকৃত সত্য ভাগাভাগি করলাম।
প্রশ্ন: বেগম জিয়া, ঢাকায় প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আপনি কেন সাক্ষাৎ করেন নি সে বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরলেন। কিন্তু বাকি বিশ্ব মনে করে, এটা আপনার ভারতবিরোধী আরেকটি অবস্থান...।
উত্তর: কেন আমি ভারতবিরোধী হবো? দেখুন, আমি আপনাকে এ বিষয়টিই বলার চেষ্টা করছি। ক্ষমতাসীন সরকার আমাকে ভারত ও হিন্দুবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে সমন্বিতভাবে চেষ্টা করছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী বন্ধন। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান আমরা সর্বাঙ্গীণ স্বীকার করি। প্রধানমন্ত্রীর সফর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। এ সুযোগ নিয়ে তারা আমাকে ভারতবিরোধী হিসেবে দেখাতে চায়। তাদের একটি সুসংগঠিত প্রচারণাবিষয়ক মেশিনারি আছে যা, বেপরোয়াভাবে আমাকে ও বিএনপিকে ভারতবিরোধী হিসেবে দেখাতে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: জামায়াতে ইসলামী আপনার জোটের শরিক। তাদেরকে ধর্মীয় কট্টরপন্থি হিসেবে দেখা হয় এবং মনোভাবে তারা ভারতপন্থি না...।
উত্তর: জামায়াত আমাদের জোটের শরিক। এর বেশি কিছু নয়। জোটে থেকে তাদেরকে বিএনপির কথা শুনতে হয়। আমরা যখন এসব কথা নিয়ে এখানে আলোচনা করছি, তখন আপনার কাছে বলি যে, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুরা যে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে তা জেনে আপনি বিস্মিত হবেন। তাদের বাড়িঘর লুট করা হয়েছে। জমিজমা কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর উল্টো আমাদেরকে বলা হচ্ছে আমরা হিন্দুবিরোধী? আমরা হিন্দুদের সঙ্গে আছি। দেশের প্রতিটি নাগরিকের কল্যাণের জন্য আমরা আছি। বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। আমাদের ওপর হামলা হচ্ছে। আমার নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে। প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মী নিখোঁজ রয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যে-ই কথা বলছে তাকেই চিহ্নিত করে তার ওপর হামলা করা হচ্ছে। এখানে জরুরি অবস্থার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমি কথা বললেই আমাকে পাকিস্তানি এজেন্টের তকমা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমার স্বামী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তখন তিনি ছিলেন একজন মেজর। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। আমরা কি সে কথা ভুলতে পারি?
প্রশ্ন: কিন্তু বেগম জিয়া, আপনি তো নির্বাচন থেকে সরে এসে আওয়ামী লীগকে দৃশ্যত একটি বিজয় দিয়ে দিয়েছেন। এখন আপনি বলছেন, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে...।
উত্তর: এরও আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছে। আমরা তা মেনে নিয়েছি এবং অতীতে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সংবিধান সংশোধন করে। এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিধি বাতিল করা হয়। যেহেতু তারা নির্বাচনে জালিয়াতির জন্য পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ও পুলিশকে ব্যবহার করবে তাই আমরা বুঝতে পারি যে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সবেমাত্র অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কি হলো দেখুন। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গেলে তাদেরকে বলা হলো বাড়ি চলে যেতে। কারণ, ইতিমধ্যেই তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। নির্বাচনের সময় একজন পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে পরিষ্কার শোনা যায় যে, তিনি কিভাবে অন্যদের বলছেন, কিভাবে পুলিশ নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখানে কি আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করতে পারি? এখন যে ভবনটিতে বসে আছি এখানেই ৯২ দিন আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। তারা যোগাযোগের সব লাইন কেটে দিয়েছিল। পেপার স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছে। খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছিল। এক পর্যায়ে পানিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এটাই হলো বাস্তব কাহিনী।
প্রশ্ন: তাহলে সামনের পথ কোনদিকে বেগম জিয়া?
উত্তর: আমরা চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের এই একটিই পথ আছে। এ জন্য বাংলাদেশের বিষয়ে অবশ্যই দৃষ্টি দেয়া উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।
ভারতের দ্যা সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার বৈঠক বানচাল করতে বাংলাদেশ সরকার সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। গত ৭ই জুন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের কয়েকঘণ্টা পর গুলশান কার্যালয়ে বসে দ্যা সানডে গার্ডিয়ানের সাংবাদিক সৌরভ স্যানালকে সাক্ষাৎকারটি দেন বেগম খালেদা জিয়া। সানডে গার্ডিয়ান পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক এম জে আকবর। যিনি ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বাতিল হওয়া বৈঠক নিয়ে খালেদা জিয়ার মুখ খোলার পর অনেকেই স্মরণ করছেন ২০১৩ সালের ৪ঠা মার্চ দিনটির কথা। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করে তখন রাজপথ ছিল উত্তপ্ত। জামায়াতের ডাকা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের সেদিন ছিল দ্বিতীয় দিন। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আসা ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি অবস্থান নেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে। এখানেই প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল খালেদা জিয়ার। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে বৈঠকটির সময় নির্ধারিত ছিল। সেসময় বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠক বাতিলের কারণ হিসেবে নিরাপত্তার কথাই বলা হয়েছিল। বৈঠকের নির্ধারিত সময়ের কাছাকাছি সময়ে হোটেল সোনারগাঁওয়ের পাশে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। যে বিস্ফোরণের খবর আবার খুব দ্রুতই প্রচারিত হয় ভারতীয় মিডিয়ায়।
দ্যা সানডে গার্ডিয়ানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কথা বলেছেন বেগম খালেদা জিয়া। এখানে সাক্ষাৎকারটির হুবহু তুলে ধরা হলো:
প্রশ্ন: বেগম জিয়া, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ কেমন হলো?
উত্তর: বৈঠক অত্যন্ত সন্তোষজনক হয়েছে। মোদিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল চমৎকার। আমি অবশ্যই বলবো, খুবই আন্তরিক পরিবেশে বৈঠক হয়েছে। এতে আমি খুবই সন্তুষ্ট।
প্রশ্ন: আপনাদের আলোচনায় মূল কি কি ইস্যু ছিল?
উত্তর: যেমনটি আমি বলেছি, বৈঠক হয়েছে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে এবং ফলপ্রসূ। আপনারা দেখেছেন বৈঠকটি ছিল ওয়ান-টু-ওয়ান। আমরা যেসব বিষয়ে আলোচনা করেছি বাস্তবেই সবটা বলতে পারছি না। তবে এটা বলতে পারি যে, অবশ্যই বৈঠক হয়েছে সন্তোষজনক।
প্রশ্ন: নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সবাই ছিলেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। শেষ পর্যন্ত আপনি যখন প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে পৌঁছালেন, তখন কি এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব শেষ হয়ে গেছে? কেন এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব?
উত্তর: কি নিয়ে এতসব সংশয়? একবারও কি আমি বলেছি যে, আমি মোদিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো না? নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হওয়ার পর ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। আমার দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একজনও নেতার মুখ থেকে কি শুনেছেন যে, আমি মোদিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো না? বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের নেতা মোদিজি। তিনি দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক শক্তিশালী করার বাসনা নিয়ে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল বার্তা দেয়ার জন্য বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। তা করতে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। মোদিজির সঙ্গে আমার যাতে সাক্ষাৎ না হয় তা নিশ্চিত করতে এমন কিছু নেই যা তারা করেনি।
প্রশ্ন: ম্যাডাম, প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের সময় আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য সম্মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র হয়েছিল এই অভিযোগই করছেন? এর নেপথ্যে কে ছিল?
উত্তর: সোজাসুজি আসল কথা বলি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে অবস্থানকালে তার সঙ্গে যাতে আমার কোন সাক্ষাতের সম্ভাবনা প্রকাশ্যে নাকচ করে দেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এরপরই নয়াদিল্লি বাস্তবতা প্রকাশ করে দেয়। বাংলাদেশের দেয়া বিবৃতির কয়েক ঘণ্টা পরেই ও প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের প্রাক্কালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্কর নয়াদিল্লিতে বলেন যে, সাক্ষাৎ হবে। আপনি এ বিষয়টিকে কিভাবে বিচার করবেন? আমার সঙ্গে এই সাক্ষাৎ ঠেকাতে বাংলাদেশ সরকার যত রকম পারে সেভাবেই প্রচেষ্টা নিয়েছে। তারপরও সাক্ষাৎ হয়েছে। এ জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তারা আসলে চায়নি যে, মোদিজির সঙ্গে আমার কোন আলোচনা হোক।
প্রশ্ন: এরপর আমি আপনাকে সরাসরি একটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনি যেমনটা ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সম্ভবত ক্ষমতাসীন সরকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ যাতে কখনও না হয় তা নিশ্চিত করতে কূটচাল চেলেছিল। কিন্তু আমরা যদি একটু পেছন ফিরে তাকাই, যখন ২০১৩ সালের মার্চে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, আপনি কিন্তু তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নি...।
উত্তর: আমাকে এ প্রশ্নটি করার জন্য আমি খুব খুশি। এটা সত্য কথা যে, আমি প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশ সফরের সময় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি নি। ওই সময় ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তিন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বান করেছিল জামায়াতে ইসলামী। ওই সময়ে আমি জানতে পারি যে, যদি আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই তাহলে আমার ওপর আক্রমণ হতে পারে। এক্ষেত্রে সেটা হতে পারতো প্রাণনাশের হুমকি। প্রেসিডেন্ট যে হোটেলে অবস্থান করছিলেন তার কাছেই একটি পেট্রলবোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। আমার তো ওই পথ দিয়েই যাওয়ার কথা ছিল।
প্রশ্ন: কিন্তু জামায়াতে ইসলামী তো আপনার রাজনৈতিক মিত্র। তারা কেন আপনার ওপর হামলা চালাবে?
উত্তর: যথার্থ কথা। এটাই পয়েন্ট। যদি ওইদিন আমার কিছু হতো তাহলে পুরো দায় গিয়ে বর্তাতো জামায়াতের ওপর। আমার বিরোধী পক্ষ তো এই গেম খেলার পরিকল্পনা করেছিল। এটা আমরা বুঝতে পারি এবং তারপরই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওই সাক্ষাৎ বাতিল করি। আজ আপনার সঙ্গে প্রকৃত সত্য ভাগাভাগি করলাম।
প্রশ্ন: বেগম জিয়া, ঢাকায় প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আপনি কেন সাক্ষাৎ করেন নি সে বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির কথা তুলে ধরলেন। কিন্তু বাকি বিশ্ব মনে করে, এটা আপনার ভারতবিরোধী আরেকটি অবস্থান...।
উত্তর: কেন আমি ভারতবিরোধী হবো? দেখুন, আমি আপনাকে এ বিষয়টিই বলার চেষ্টা করছি। ক্ষমতাসীন সরকার আমাকে ভারত ও হিন্দুবিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে সমন্বিতভাবে চেষ্টা করছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী বন্ধন। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান আমরা সর্বাঙ্গীণ স্বীকার করি। প্রধানমন্ত্রীর সফর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে। এ সুযোগ নিয়ে তারা আমাকে ভারতবিরোধী হিসেবে দেখাতে চায়। তাদের একটি সুসংগঠিত প্রচারণাবিষয়ক মেশিনারি আছে যা, বেপরোয়াভাবে আমাকে ও বিএনপিকে ভারতবিরোধী হিসেবে দেখাতে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: জামায়াতে ইসলামী আপনার জোটের শরিক। তাদেরকে ধর্মীয় কট্টরপন্থি হিসেবে দেখা হয় এবং মনোভাবে তারা ভারতপন্থি না...।
উত্তর: জামায়াত আমাদের জোটের শরিক। এর বেশি কিছু নয়। জোটে থেকে তাদেরকে বিএনপির কথা শুনতে হয়। আমরা যখন এসব কথা নিয়ে এখানে আলোচনা করছি, তখন আপনার কাছে বলি যে, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুরা যে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে তা জেনে আপনি বিস্মিত হবেন। তাদের বাড়িঘর লুট করা হয়েছে। জমিজমা কেড়ে নেয়া হয়েছে। আর উল্টো আমাদেরকে বলা হচ্ছে আমরা হিন্দুবিরোধী? আমরা হিন্দুদের সঙ্গে আছি। দেশের প্রতিটি নাগরিকের কল্যাণের জন্য আমরা আছি। বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। আমাদের ওপর হামলা হচ্ছে। আমার নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে। প্রায় ২০ হাজার নেতাকর্মী নিখোঁজ রয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যে-ই কথা বলছে তাকেই চিহ্নিত করে তার ওপর হামলা করা হচ্ছে। এখানে জরুরি অবস্থার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমি কথা বললেই আমাকে পাকিস্তানি এজেন্টের তকমা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমার স্বামী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তখন তিনি ছিলেন একজন মেজর। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। আমরা কি সে কথা ভুলতে পারি?
প্রশ্ন: কিন্তু বেগম জিয়া, আপনি তো নির্বাচন থেকে সরে এসে আওয়ামী লীগকে দৃশ্যত একটি বিজয় দিয়ে দিয়েছেন। এখন আপনি বলছেন, বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে...।
উত্তর: এরও আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছে। আমরা তা মেনে নিয়েছি এবং অতীতে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সংবিধান সংশোধন করে। এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত বিধি বাতিল করা হয়। যেহেতু তারা নির্বাচনে জালিয়াতির জন্য পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ও পুলিশকে ব্যবহার করবে তাই আমরা বুঝতে পারি যে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সবেমাত্র অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কি হলো দেখুন। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গেলে তাদেরকে বলা হলো বাড়ি চলে যেতে। কারণ, ইতিমধ্যেই তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। নির্বাচনের সময় একজন পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে পরিষ্কার শোনা যায় যে, তিনি কিভাবে অন্যদের বলছেন, কিভাবে পুলিশ নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখানে কি আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করতে পারি? এখন যে ভবনটিতে বসে আছি এখানেই ৯২ দিন আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। তারা যোগাযোগের সব লাইন কেটে দিয়েছিল। পেপার স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছে। খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছিল। এক পর্যায়ে পানিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এটাই হলো বাস্তব কাহিনী।
প্রশ্ন: তাহলে সামনের পথ কোনদিকে বেগম জিয়া?
উত্তর: আমরা চাই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের এই একটিই পথ আছে। এ জন্য বাংলাদেশের বিষয়ে অবশ্যই দৃষ্টি দেয়া উচিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।
No comments