পরিবর্তনের রাশ টানুন by ডেসমন্ড টুটু ও ট্রেভর ম্যানুয়েল
আজকাল মানুষ নৈতিকভাবে সঠিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক—এ দুটি বিষয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। বটেই, তাদের এ বেছে নেওয়ার ব্যাপারটা কখনো কখনো পারস্পরিক নির্ভরশীল ব্যাপার বলে মনে হয় না। ফলে মানুষ কোন পথটা বেছে নেবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের জন্য খুবই কঠিন হয়। আবার কখনো কখনো নৈতিক সঠিকতা ও অর্থনৈতিক স্বার্থ এক বিন্দুতে মিলিত হয়।
বিষয়টির নৈতিক অপরিহার্যতা সন্দেহাতীত। কারণ, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, তাপমাত্রা পরিবর্তন ও সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি—এসবের ফল ভোগ করতে হয় দুনিয়ার গরিব মানুষকেই। আবার যে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কারণে এ জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, এই দরিদ্র মানুষই তার সুবিধা পায় সবচেয়ে কম। তারপরও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুনিয়ায় দারিদ্র্য ও অসমতা বাড়তে পারে। অর্থাৎ, আমরা যদি সময়মতো বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে বা এমনকি সে সুযোগ তারা নাও পেতে পারে। ফলে খুব সাধারণভাবে বললে, আজ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ হ্রাস করাই হচ্ছে সঠিক কাজ।
সৌভাগ্যবশত, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আমলে নেওয়ার অর্থনৈতিক সুবিধাদি কী, তা পরিষ্কার। সর্বোপরি, জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক। যেমন: ঘন ঘন হয় এমন চরম মাত্রার পরিবেশগত ঘটনার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। তারপরও ভবিষ্যতের জন্য টেকসই উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্রমবিকাশমান প্রাযুক্তিক উন্নয়নের ভিত্তিতে ‘সবুজ’ অর্থনীতি গড়ে তোলাই হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ, যা একই সঙ্গে সবচেয়ে কার্যকরও বটে।
এ লক্ষ্যে ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক, শহর ও জাতীয় পর্যায়ে কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক সমস্যা, আর এর সমাধানও হবে বৈশ্বিক। এ ক্ষেত্রে সঠিক কাজটা করতে দুনিয়ার হাতে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত মতৈক্য। এর মধ্যে বিপুল অঙ্কের অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে। সে কারণে দুনিয়ার নেতাদের উচিত হবে, এ বছরের ডিসেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ইউনাইটেড নেশনস ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈশ্বিক পর্যায়ে অভিন্ন একটি কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করা।
বস্তুত, বিশ্বনেতারা ইতিমধ্যে তা করার অঙ্গীকার করেছেন। ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্যোগে সে দেশে অনুষ্ঠিত ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্সে যত শিগগির সম্ভব জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক বৈশ্বিক পর্যায়ে একটি আইনি চুক্তিতে আসার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে সেটা হওয়ার কথা।
ডারবান সম্মেলনের পর গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। গত মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো, গ্যাবন, মেক্সিকো, নরওয়ে, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ৩০টি দেশ ২০২০ সাল-উত্তর তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনা পেশ করেছে। আগামী দিনগুলোয় এ প্রক্রিয়া আরও জোরদার হবে। আশা করা যাচ্ছে, ব্রাজিল, চীন ও ভারত অঙ্গীকারনামা পেশ করবে।
প্যারিস সম্মেলন সফল হতে হলে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী দেশকে যত শিগগির সম্ভব ২০২০ সাল-পরবর্তী সময়ের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ সম্পর্কে জানাতে হবে। নৈতিক অপরিহার্যতা পূরণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার অর্থনৈতিক সুবিধা—এ দুই পরিপ্রেক্ষিতেই সেটা করতে হবে। আর চূড়ান্ত চুক্তির মধ্যে আগামী ৫০ বছরের জন্য কার্বন হ্রাসের কার্যকর ও উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা থাকতে হবে।
সত্য কথা হচ্ছে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের সরকার বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার হার প্রাক্-শিল্পযুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস নির্ধারণ করার যে প্রতিশ্রুতি ২০০৯ সালে দিয়েছিল ও ২০১০ সালে যেটা পুনর্ব্যক্ত করেছিল, তা এ স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে আনুক্রমিকভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর নীতি গ্রহণ করা উচিত। যাতে এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে পরিষ্কার সংকেত দেওয়া যায় যে সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তরিক।
নিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী শিল্পে বিনিয়োগে প্রণোদনা দেওয়া হবে—এমন কৌশলের মধ্যে তা থাকতে পারে। আগামী ১৫ বছরে সারা দুনিয়ায় অবকাঠামো নির্মাণে ৯০ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে, সে ক্ষেত্রে একদম নিশ্চায়ক না হলেও এমন মনোভঙ্গির প্রভাব বিবেচনাযোগ্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টেনে ধরার ক্ষেত্রে নৈতিক ও অর্থনৈতিক অপরিহার্যতার চেয়ে শক্তিশালী কিছু হতে পারে না। যদিও সামনে এগোনোর পথ বন্ধুর, প্রতি পদক্ষেপে আমাদের নতুন ও অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। নেলসন ম্যান্ডেলার বিখ্যাত বাণী থেকে আমরা উৎসাহ নিতে পারি: ‘না হওয়া পর্যন্ত সবকিছুই অসম্ভব মনে হয়।’ টেকসই, সমৃদ্ধ ও ন্যায়সংগত ভবিষ্যৎ নির্মাণে আমাদের হাতে এখন নজিরবিহীন সুযোগ এসেছে। সেই ভবিষ্যৎ নির্মাণের কাজ এখনই শুরু করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
* ডেসমন্ড টুটু: শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী আর্চবিশপ।
* ট্রেভর ম্যানুয়েল: দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অর্থমন্ত্রী।
বিষয়টির নৈতিক অপরিহার্যতা সন্দেহাতীত। কারণ, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, তাপমাত্রা পরিবর্তন ও সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি—এসবের ফল ভোগ করতে হয় দুনিয়ার গরিব মানুষকেই। আবার যে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কারণে এ জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে, এই দরিদ্র মানুষই তার সুবিধা পায় সবচেয়ে কম। তারপরও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুনিয়ায় দারিদ্র্য ও অসমতা বাড়তে পারে। অর্থাৎ, আমরা যদি সময়মতো বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিই, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষে উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে বা এমনকি সে সুযোগ তারা নাও পেতে পারে। ফলে খুব সাধারণভাবে বললে, আজ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ হ্রাস করাই হচ্ছে সঠিক কাজ।
সৌভাগ্যবশত, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আমলে নেওয়ার অর্থনৈতিক সুবিধাদি কী, তা পরিষ্কার। সর্বোপরি, জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক। যেমন: ঘন ঘন হয় এমন চরম মাত্রার পরিবেশগত ঘটনার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। তারপরও ভবিষ্যতের জন্য টেকসই উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্রমবিকাশমান প্রাযুক্তিক উন্নয়নের ভিত্তিতে ‘সবুজ’ অর্থনীতি গড়ে তোলাই হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ, যা একই সঙ্গে সবচেয়ে কার্যকরও বটে।
এ লক্ষ্যে ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক, শহর ও জাতীয় পর্যায়ে কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক সমস্যা, আর এর সমাধানও হবে বৈশ্বিক। এ ক্ষেত্রে সঠিক কাজটা করতে দুনিয়ার হাতে সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত মতৈক্য। এর মধ্যে বিপুল অঙ্কের অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যাবে। সে কারণে দুনিয়ার নেতাদের উচিত হবে, এ বছরের ডিসেম্বরে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ইউনাইটেড নেশনস ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈশ্বিক পর্যায়ে অভিন্ন একটি কর্মোদ্যোগ গ্রহণ করা।
বস্তুত, বিশ্বনেতারা ইতিমধ্যে তা করার অঙ্গীকার করেছেন। ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্যোগে সে দেশে অনুষ্ঠিত ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্সে যত শিগগির সম্ভব জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক বৈশ্বিক পর্যায়ে একটি আইনি চুক্তিতে আসার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে সেটা হওয়ার কথা।
ডারবান সম্মেলনের পর গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। গত মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রগুলো, গ্যাবন, মেক্সিকো, নরওয়ে, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ৩০টি দেশ ২০২০ সাল-উত্তর তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনা পেশ করেছে। আগামী দিনগুলোয় এ প্রক্রিয়া আরও জোরদার হবে। আশা করা যাচ্ছে, ব্রাজিল, চীন ও ভারত অঙ্গীকারনামা পেশ করবে।
প্যারিস সম্মেলন সফল হতে হলে প্রতিটি অংশগ্রহণকারী দেশকে যত শিগগির সম্ভব ২০২০ সাল-পরবর্তী সময়ের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ সম্পর্কে জানাতে হবে। নৈতিক অপরিহার্যতা পূরণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার অর্থনৈতিক সুবিধা—এ দুই পরিপ্রেক্ষিতেই সেটা করতে হবে। আর চূড়ান্ত চুক্তির মধ্যে আগামী ৫০ বছরের জন্য কার্বন হ্রাসের কার্যকর ও উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা থাকতে হবে।
সত্য কথা হচ্ছে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের সরকার বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ার হার প্রাক্-শিল্পযুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস নির্ধারণ করার যে প্রতিশ্রুতি ২০০৯ সালে দিয়েছিল ও ২০১০ সালে যেটা পুনর্ব্যক্ত করেছিল, তা এ স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে আনুক্রমিকভাবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর নীতি গ্রহণ করা উচিত। যাতে এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে পরিষ্কার সংকেত দেওয়া যায় যে সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তরিক।
নিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী শিল্পে বিনিয়োগে প্রণোদনা দেওয়া হবে—এমন কৌশলের মধ্যে তা থাকতে পারে। আগামী ১৫ বছরে সারা দুনিয়ায় অবকাঠামো নির্মাণে ৯০ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে, সে ক্ষেত্রে একদম নিশ্চায়ক না হলেও এমন মনোভঙ্গির প্রভাব বিবেচনাযোগ্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টেনে ধরার ক্ষেত্রে নৈতিক ও অর্থনৈতিক অপরিহার্যতার চেয়ে শক্তিশালী কিছু হতে পারে না। যদিও সামনে এগোনোর পথ বন্ধুর, প্রতি পদক্ষেপে আমাদের নতুন ও অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। নেলসন ম্যান্ডেলার বিখ্যাত বাণী থেকে আমরা উৎসাহ নিতে পারি: ‘না হওয়া পর্যন্ত সবকিছুই অসম্ভব মনে হয়।’ টেকসই, সমৃদ্ধ ও ন্যায়সংগত ভবিষ্যৎ নির্মাণে আমাদের হাতে এখন নজিরবিহীন সুযোগ এসেছে। সেই ভবিষ্যৎ নির্মাণের কাজ এখনই শুরু করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
* ডেসমন্ড টুটু: শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী আর্চবিশপ।
* ট্রেভর ম্যানুয়েল: দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অর্থমন্ত্রী।
No comments