বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ by আনিসুল হক
আজকে সিরিয়াস দার্শনিক বিষয় নিয়ে আলোচনা
করব। যদিও কলামটির নাম গদ্যকার্টুন। এই কলামে রসিকতা করার ব্যাপক চেষ্টা
করা হয়! সেই চেষ্টা প্রায়ই নিদারুণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বটে।
তার আগে একটা পরামর্শ দিই। বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় হাটে-বাজারে-স্টেশনে-টার্মিনালে মোড়ে মোড়ে সত্যিকারের সিসি টিভি বা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসান।
শক্তিশালী ক্যামেরা। যা সত্যিকারের ভিডিও ফুটেজ দেবে। যা থেকে মানুষদের নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা যাবে। ধরা যাক, পয়লা বৈশাখে টিএসসি এলাকার ক্যামেরাগুলো যদি শক্তিশালী হতো, তাহলে আমরা সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারতাম, কারা আসলে ওই ভিড়ের মধ্যে নখরযুক্ত থাবা নিয়ে হামলে পড়েছিল মেয়েদের ওপরে। যেমন চলন্ত মাইক্রোবাসে ধর্ষণের ঘটনার অপরাধীদের ধরা গেছে বলে দাবি করেছে র্যা ব। ভদ্রমহিলা যে দোকানে কাজ করতেন, সেখানকার ভিডিও ফুটেজ দেখার মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভবপর হয়েছে।
এবার আমার দার্শনিক আলোচনা।
মিশেল ফুকো কারাগারের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, কারাগারে একটা উঁচু টাওয়ার থাকে। সেখানে অবস্থান নিয়ে প্রহরীরা সারাক্ষণ নজর রাখে কে কোথায় কী করছে। তেমনিভাবে আমাদের সমাজ হলো, প্যান-অপটিক সমাজ। স্তরে স্তরে এখানে পাহারাদাররা বসে আছে। কে কোথায় কী করছে, তা ওয়াচ করছে। তা মনিটর করছে।
মানুষের চলাফেরার কথা বলার কোনো স্বাধীনতা নেই। এটা কেবল কারাগারে নয়, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বেলাতেই সত্য। সেটা হাসপাতাল হতে পারে, স্কুল হতে পারে, কোনো একটা অফিস হতে পারে। সর্বত্রই নজরদারি। সর্বত্রই মানুষকে শিকলে বন্দী করে রাখার চেষ্টা। মানুষ আসলে স্বাধীন নয়। কিন্তু প্রগতিশীলের কর্তব্য হবে, প্রতিনিয়ত স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে যাওয়া।
এই যে কে কোথায় কী করছে, এটা যদি সব সময় সবাই দেখে ফেলে, তা আসলে কতটা কাম্য। কতটা স্বাস্থ্যকর সামাজিকভাবে? আমরা কি কেউ কাচের ঘরে বসবাস করতে পারব? ধরা যাক, আমাদের ঘরগুলোর দেয়াল স্বচ্ছ কাচের তৈরি। বাইরে থেকে সব দেখা যায়। সেই ঘরে আমাদের বসবাস করতে হবে দিনরাত। এটা কি সম্ভব?
ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা এই রকমের রাষ্ট্র-ব্যবস্থা নিয়ে খুব ভেবেছেন, উপন্যাস লিখেছেন। যেখানে রাষ্ট্র সবকিছু মনিটর করার চেষ্টা করছে, পুলিশ চারপাশের সবকিছু রেকর্ড করছে।
তবে আমাদের ভাবনার কিছু নেই। আমাদের দেশে আইন হয়ে গেছে, আইন অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ আমাদের সবার সব ফোনালাপ রেকর্ড করতে পারে। তা তারা করছেও। এবং দরকারমতো কোনো কোনো ফোনালাপ প্রকাশও করে দেওয়া হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাগরিকদের ফোনালাপ আড়ি পেতে শোনে, রেকর্ড করে, সেই অধিকার আইন করে তাদের দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেই ফোনালাপ নেটে ছেড়ে দেওয়ার অধিকার কি দেওয়া হয়েছে? তাহলে ফোনালাপগুলো বাইরে আসে কী করে?
তবে আসল সমস্যা হলো, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। সেখানে আমরা কী করি, কী খাই, কী লিখি—সব বিক্রি করে দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে, তা থেকে তারা বের করে ফেলে কার কী অভ্যাস, কে কী ধরনের পণ্য পছন্দ করে, কী দেখতে চায়, কী কিনতে চায়!
এখন বুঝুন তাহলে অবস্থাটা। আপনি ফোনে যা যা আলাপ করছেন, তা রেকর্ড হতে পারে। আপনি ফেসবুকে কী করছেন, তার মাধ্যমে আপনার সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করছে কেউ না কেউ। আর সিসি ক্যামেরা থাকলে আপনি কখন কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কার সঙ্গে আছেন, তার ভিডিও রেকর্ড করা হচ্ছে সর্বত্র!
আমরা কি একটা কাফকার জগতে বসবাস করছি? কাফকার দুঃস্বপ্নের জগতে?
মিলান কুন্ডেরা একটা সত্যিকারের কাহিনি শুনিয়েছিলেন প্রাগ শহর নিয়ে, সেই সময়ের কাহিনি, যখন তা সোভিয়েতদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
একজন ইঞ্জিনিয়ার একটা সেমিনারে অংশ নিতে প্রাগ শহর থেকে গেছেন লন্ডনে। ফিরেও এসেছেন ঠিক সময়ে। এসে দেখলেন, খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে, এই ইঞ্জিনিয়ার চেক সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লন্ডনে বক্তব্য দিয়েছেন এবং তিনি আর দেশে ফিরবেন না।
যা ছাপা হয়েছে, তা ঘোরতর মিথ্যা। তিনি ছুটলেন খবরের কাগজের অফিসে। সম্পাদক দোষ স্বীকার করলেন। বললেন, এই খবর এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দোষ স্বীকার করে বলল, কিছু করার নেই, এটা এসেছে আমাদের লন্ডন দূতাবাস থেকে। গোয়েন্দারা পাঠিয়েছে এই খবর।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে ছোটাছুটি করে অবশেষে একদিন সত্যি সত্যি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। বাঁচার তাগিদে।
মিলান কুন্ডেরা বলেন, ফ্রানৎস কাফকার গল্পে এই রকম ঘটে। আগে শাস্তি হয়, পরে অপরাধ খোঁজা হয়। কাফকার ট্রায়াল উপন্যাসে একদিন জোসেফ কে নামের প্রধান চরিত্রটি দেখে, তার ঘরে দুজন লোক ঢুকে গেছে। তারা তাকে বলছে, তোমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জোসেফ কে-র নাশতা তারা খেয়ে ফেলে। জোসেফ কে তখনো রাত্রি-পোশাকে। তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলতে কিছুই থাকে না।
আর কাফকার গল্প মেটামরফসিসের প্রথম লাইন তো বিখ্যাত: দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে একদিন সকালে গ্রেগর সামসা দেখতে পায় সে একটা ভয়াবহ পোকায় পরিণত হয়ে গেছে।
আমাদের দেশটা কি কাফকার দুঃস্বপ্নের জগতে পরিণত হচ্ছে?
লিমন কিংবা কাদেরকে চিরটাকাল খুঁজতে হবে তাঁদের অপরাধ কী!
মিলান কুন্ডেরাই বলেছিলেন, প্রাগে একজন লোকের শাস্তি হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরোধিতাকারী হিসেবে, তিনি জেলে ছিলেন, কিন্তু আজীবন তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে গেছেন, কারণ তিনি বলেন, না হলে তো আমার পুরো জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস বজায় রাখলে তবু সান্ত্বনা আসে, মহান সমাজতন্ত্র রক্ষার জন্য আমাকে কারাবাস করতে হচ্ছে।
আমরাও বিশ্বাস হারাচ্ছি না। আমেরিকানরা আমাদের ফেসবুক নজরদারি করে, কিংবা আমাদের ফোনালাপ রেকর্ড করা হয়, এসবই করা হচ্ছে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে।
কিন্তু একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যদি দেখি, একটা বড় পোকায় পরিণত হয়েছি, উল্টে আছি মেঝেতে, পা ছুড়ছি, কিন্তু সোজা হতে পারছি না... তখন...
না। আর বলব না। জর্জ ওরওয়েলের লেখা নাইনটি এইটিফোরে এই রকম একটা একনায়কবাদী রাষ্ট্রের বর্ণনা আছে, যেখানে আছে এই বিখ্যাত সংলাপটি, বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ...
আমরা আমাদের ব্যক্তিগত পরিসরটুকুনের ওপরে কেউ খবরদারি করুক, সেটা চাই না, কিন্তু যে অপরাধীরা ধর্ষণ করে, খুন করে, বোমাবাজি করে, পেট্রলবোমা ছোড়ে, তারা সবাই ধরা পড়ুক সিসি ক্যামেরার কল্যাণে, সেটাও চাই।
একটা ভালো রাষ্ট্র, একটা ভালো শাসন তা দেওয়ার চেষ্টাই তো করবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
তার আগে একটা পরামর্শ দিই। বাংলাদেশের রাস্তায় রাস্তায় হাটে-বাজারে-স্টেশনে-টার্মিনালে মোড়ে মোড়ে সত্যিকারের সিসি টিভি বা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসান।
শক্তিশালী ক্যামেরা। যা সত্যিকারের ভিডিও ফুটেজ দেবে। যা থেকে মানুষদের নির্ভুলভাবে শনাক্ত করা যাবে। ধরা যাক, পয়লা বৈশাখে টিএসসি এলাকার ক্যামেরাগুলো যদি শক্তিশালী হতো, তাহলে আমরা সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারতাম, কারা আসলে ওই ভিড়ের মধ্যে নখরযুক্ত থাবা নিয়ে হামলে পড়েছিল মেয়েদের ওপরে। যেমন চলন্ত মাইক্রোবাসে ধর্ষণের ঘটনার অপরাধীদের ধরা গেছে বলে দাবি করেছে র্যা ব। ভদ্রমহিলা যে দোকানে কাজ করতেন, সেখানকার ভিডিও ফুটেজ দেখার মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভবপর হয়েছে।
এবার আমার দার্শনিক আলোচনা।
মিশেল ফুকো কারাগারের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, কারাগারে একটা উঁচু টাওয়ার থাকে। সেখানে অবস্থান নিয়ে প্রহরীরা সারাক্ষণ নজর রাখে কে কোথায় কী করছে। তেমনিভাবে আমাদের সমাজ হলো, প্যান-অপটিক সমাজ। স্তরে স্তরে এখানে পাহারাদাররা বসে আছে। কে কোথায় কী করছে, তা ওয়াচ করছে। তা মনিটর করছে।
মানুষের চলাফেরার কথা বলার কোনো স্বাধীনতা নেই। এটা কেবল কারাগারে নয়, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বেলাতেই সত্য। সেটা হাসপাতাল হতে পারে, স্কুল হতে পারে, কোনো একটা অফিস হতে পারে। সর্বত্রই নজরদারি। সর্বত্রই মানুষকে শিকলে বন্দী করে রাখার চেষ্টা। মানুষ আসলে স্বাধীন নয়। কিন্তু প্রগতিশীলের কর্তব্য হবে, প্রতিনিয়ত স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে যাওয়া।
এই যে কে কোথায় কী করছে, এটা যদি সব সময় সবাই দেখে ফেলে, তা আসলে কতটা কাম্য। কতটা স্বাস্থ্যকর সামাজিকভাবে? আমরা কি কেউ কাচের ঘরে বসবাস করতে পারব? ধরা যাক, আমাদের ঘরগুলোর দেয়াল স্বচ্ছ কাচের তৈরি। বাইরে থেকে সব দেখা যায়। সেই ঘরে আমাদের বসবাস করতে হবে দিনরাত। এটা কি সম্ভব?
ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা এই রকমের রাষ্ট্র-ব্যবস্থা নিয়ে খুব ভেবেছেন, উপন্যাস লিখেছেন। যেখানে রাষ্ট্র সবকিছু মনিটর করার চেষ্টা করছে, পুলিশ চারপাশের সবকিছু রেকর্ড করছে।
তবে আমাদের ভাবনার কিছু নেই। আমাদের দেশে আইন হয়ে গেছে, আইন অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ আমাদের সবার সব ফোনালাপ রেকর্ড করতে পারে। তা তারা করছেও। এবং দরকারমতো কোনো কোনো ফোনালাপ প্রকাশও করে দেওয়া হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নাগরিকদের ফোনালাপ আড়ি পেতে শোনে, রেকর্ড করে, সেই অধিকার আইন করে তাদের দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেই ফোনালাপ নেটে ছেড়ে দেওয়ার অধিকার কি দেওয়া হয়েছে? তাহলে ফোনালাপগুলো বাইরে আসে কী করে?
তবে আসল সমস্যা হলো, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। সেখানে আমরা কী করি, কী খাই, কী লিখি—সব বিক্রি করে দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে, তা থেকে তারা বের করে ফেলে কার কী অভ্যাস, কে কী ধরনের পণ্য পছন্দ করে, কী দেখতে চায়, কী কিনতে চায়!
এখন বুঝুন তাহলে অবস্থাটা। আপনি ফোনে যা যা আলাপ করছেন, তা রেকর্ড হতে পারে। আপনি ফেসবুকে কী করছেন, তার মাধ্যমে আপনার সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ করছে কেউ না কেউ। আর সিসি ক্যামেরা থাকলে আপনি কখন কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, কার সঙ্গে আছেন, তার ভিডিও রেকর্ড করা হচ্ছে সর্বত্র!
আমরা কি একটা কাফকার জগতে বসবাস করছি? কাফকার দুঃস্বপ্নের জগতে?
মিলান কুন্ডেরা একটা সত্যিকারের কাহিনি শুনিয়েছিলেন প্রাগ শহর নিয়ে, সেই সময়ের কাহিনি, যখন তা সোভিয়েতদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
একজন ইঞ্জিনিয়ার একটা সেমিনারে অংশ নিতে প্রাগ শহর থেকে গেছেন লন্ডনে। ফিরেও এসেছেন ঠিক সময়ে। এসে দেখলেন, খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে, এই ইঞ্জিনিয়ার চেক সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লন্ডনে বক্তব্য দিয়েছেন এবং তিনি আর দেশে ফিরবেন না।
যা ছাপা হয়েছে, তা ঘোরতর মিথ্যা। তিনি ছুটলেন খবরের কাগজের অফিসে। সম্পাদক দোষ স্বীকার করলেন। বললেন, এই খবর এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দোষ স্বীকার করে বলল, কিছু করার নেই, এটা এসেছে আমাদের লন্ডন দূতাবাস থেকে। গোয়েন্দারা পাঠিয়েছে এই খবর।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে ছোটাছুটি করে অবশেষে একদিন সত্যি সত্যি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। বাঁচার তাগিদে।
মিলান কুন্ডেরা বলেন, ফ্রানৎস কাফকার গল্পে এই রকম ঘটে। আগে শাস্তি হয়, পরে অপরাধ খোঁজা হয়। কাফকার ট্রায়াল উপন্যাসে একদিন জোসেফ কে নামের প্রধান চরিত্রটি দেখে, তার ঘরে দুজন লোক ঢুকে গেছে। তারা তাকে বলছে, তোমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জোসেফ কে-র নাশতা তারা খেয়ে ফেলে। জোসেফ কে তখনো রাত্রি-পোশাকে। তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলতে কিছুই থাকে না।
আর কাফকার গল্প মেটামরফসিসের প্রথম লাইন তো বিখ্যাত: দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে একদিন সকালে গ্রেগর সামসা দেখতে পায় সে একটা ভয়াবহ পোকায় পরিণত হয়ে গেছে।
আমাদের দেশটা কি কাফকার দুঃস্বপ্নের জগতে পরিণত হচ্ছে?
লিমন কিংবা কাদেরকে চিরটাকাল খুঁজতে হবে তাঁদের অপরাধ কী!
মিলান কুন্ডেরাই বলেছিলেন, প্রাগে একজন লোকের শাস্তি হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরোধিতাকারী হিসেবে, তিনি জেলে ছিলেন, কিন্তু আজীবন তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে গেছেন, কারণ তিনি বলেন, না হলে তো আমার পুরো জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস বজায় রাখলে তবু সান্ত্বনা আসে, মহান সমাজতন্ত্র রক্ষার জন্য আমাকে কারাবাস করতে হচ্ছে।
আমরাও বিশ্বাস হারাচ্ছি না। আমেরিকানরা আমাদের ফেসবুক নজরদারি করে, কিংবা আমাদের ফোনালাপ রেকর্ড করা হয়, এসবই করা হচ্ছে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে।
কিন্তু একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে যদি দেখি, একটা বড় পোকায় পরিণত হয়েছি, উল্টে আছি মেঝেতে, পা ছুড়ছি, কিন্তু সোজা হতে পারছি না... তখন...
না। আর বলব না। জর্জ ওরওয়েলের লেখা নাইনটি এইটিফোরে এই রকম একটা একনায়কবাদী রাষ্ট্রের বর্ণনা আছে, যেখানে আছে এই বিখ্যাত সংলাপটি, বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ...
আমরা আমাদের ব্যক্তিগত পরিসরটুকুনের ওপরে কেউ খবরদারি করুক, সেটা চাই না, কিন্তু যে অপরাধীরা ধর্ষণ করে, খুন করে, বোমাবাজি করে, পেট্রলবোমা ছোড়ে, তারা সবাই ধরা পড়ুক সিসি ক্যামেরার কল্যাণে, সেটাও চাই।
একটা ভালো রাষ্ট্র, একটা ভালো শাসন তা দেওয়ার চেষ্টাই তো করবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments