পাহাড় by আবুল হায়াত
সকাল থেকেই মুখ কালো করে আছে আকাশটা। যখন লিখতে বসছি তখন প্রবল বৃষ্টি। ঝাপসা হয়েছে চারদিক। বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলাম প্রকৃতির এই খেলা। মনে পড়ল গানটা: ‘এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে/এসো কর স্নান নবধারা জলে’।
আমার সেই বন্ধু কদমগাছটার চেহারাটা চোখের সামনে দাঁড়াল এসে। যাকে প্রতিদিনই দেখতাম, এই বারান্দার ঠিক এখানটাতেই দাঁড়িয়ে। নগরায়ণের বলি হয়েছে সে। তার মতো আরও লাখো গাছকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হচ্ছে নানা কারণে। কয় দিন আগেই দেখলাম, কোনো এক ভিআইপির নিরাপত্তার কারণে বেশ কিছু ভালো গাছ কাটা হয়েছিল। মনে আছে, ঢাকা শহরের রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারের হাজার হাজার কৃষ্ণচূড়া গাছ নিধন করা হয়েছিল। কী এক ট্রামলাইন বসানোর দোহাই দিয়ে। এটা সেই সত্তরের দশকের শেষের দিকে।
কাকে দোষ দেব? সবাই তো দোষী।
ছোটবেলা থেকে শিক্ষকদের কাছ থেকে জেনেছি, প্রকৃতি আমাদের বন্ধু। তার সঙ্গে যেন কখনো বৈরী ব্যবহার না করি আমরা। টাইগারপাস কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রিয় কাদির স্যার কতবার বলেছেন: ‘এরোই, দরকার না হইলে কুনু সময় জোরে মাডিত্ ফা (পা) হেলিস (ফেলিস) না।’ অন্য স্যাররা গাছের ডাল ভেঙে আনার আদেশ দিতেন, আমাদেরই বেত মারার জন্য, কিন্তু কাদির স্যার কখনো করেননি তা। আসলে স্যার তো মারতেনই না ছাত্রদের।
সুন্দরী চট্টলার কথা আমি ভুলতে পারি না। জীবনের ২২টা বছর চট্টগ্রামে বাস করেছি। টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনিতে ছিল বাসা। বাড়ির পেছনের দিকটাতে ছিল পাহাড়ের সারি। আমাদের বাসাটাও ছিল পাহাড়ের এক ধাপে, রাস্তার উত্তর পাশে। দক্ষিণে এক সারি বাসা, তারও নিচে আর এক ধাপে বাসার আরেক সারি। সেই ধাপেই চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী-নাজিরহাট যাওয়ার রেললাইন।
রেললাইনের কথা থাক, পাহাড়ের কথা বলি।
‘লুসাই পাহারোত্তুন লায়ারি যারগোই কর্ণফুলী। ছোড ছোড ঢেউ তুলি...’ চট্টগ্রামে খুবই জনপ্রিয় গান। পাহাড় ছাড়া চট্টগ্রাম ভাবাই যায় না। আর বাটালি পাহাড় চট্টগ্রামের এক বিখ্যাত পাহাড়, যা ছিল আমাদের বাসার পেছনেই।
সেই পঞ্চাশের দশকে গভীর রাতে বোমা ফাটার শব্দে ভেঙে যেত ঘুম। ঘটনা কী? জানা গেল বাটালি পাহাড় ভাঙা হচ্ছে। এক ইতালিয়ান কোম্পানির ছিল এই দায়িত্ব। এরা সারা রাত ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটাত, আর সারা দিন বিশেষ ইতালিয়ান ট্রাকে করে বালু নিয়ে যেত পতেঙ্গায়। শুনেছি পরে সেখানটাতেই নেভিদের হেডকোয়ার্টার্স তৈরি হয়েছিল। স্কুলে পড়ি তখন। মন খারাপ হয়েছিল প্রিয় পাহাড়টা কাটতে দেখে। প্রতি বিকেলে দল বেঁধে উঠতাম বাটালি পাহাড়ে। দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি, সূর্যাস্ত দেখা, সমুদ্র দেখা—এসবই আমাদের অতি প্রিয় ব্যাপার ছিল।
সেই পাহাড়টা হঠাৎ নাই হয়ে যাবে—ভেবেই মন খারাপ হয়। তারপর হঠাৎ খেয়াল করলাম, একদিন ইতালিয়ান কোম্পানি কাটার কাজ ফেলে বিদায় নিল। জানা যায়, সুধী সমাজের আপত্তি, সম্ভবত মামলার কারণে পাহাড় কাটা বন্ধ হয়েছিল। সৌন্দর্য কিছুটা খোয়ালেও তার আকর্ষণ চট্টগ্রামবাসী বা পর্যটকদের কাছে কমেনি কখনো।
বর্তমানে একটা কথা বেশ চালু আছে, ‘পাকিস্তানি যা করতে পারেনি, বাঙালি তাই করে দেখিয়ে দিচ্ছে।’ হ্যাঁ, পাকিস্তানিরা বাটালি পাহাড় গুঁড়িয়ে দিতে না পারলেও আমরা বাঙালিরা উঠেপড়ে লেগে গিয়েছি। এবার ইনশা আল্লাহ্...দেখি কে ঠেকায়!
মন খারাপ করা সংবাদ নিয়ে আমার ‘নীপবন’ থেকে যাবেন তা তো হয় না। শুনুন তবে একটা ছোট্ট চুটকি: দুই বন্ধু স্কটল্যান্ডের পর্বতে উঠছে। মাঝপথে প্রচণ্ড ঝড় উঠল। সেখানে কিছু বসতি ছিল। দৌড়ে এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চায় তারা। বাড়ির মালিক এক বিধবা মহিলা। মহিলা বলেন, ‘আমি একা, বিধবা, বয়সও কম। তোমরা জওয়ান মানুষ, তোমাদের রাতে আশ্রয় দিলে আমার বদনাম হবে।’ ওরা বলে, ‘আমরা ঘরে যাব না, এই বারান্দায় থাকব। ঝড় থামলে ভোরে চলে যাব।’ আশ্রয় পাওয়া গেল।
পঁচিশ বছর পর লন্ডনে ওই দুই নওজওয়ানের একজন স্কটল্যান্ড থেকে এক উকিলের নোটিশ পেয়ে খুব চিন্তায় পড়ে অন্য বন্ধুকে ফোন করে। সেই বন্ধু তখন সাউথ আফ্রিকায়।
‘হ্যাঁ, বন্ধু, বলো।’
‘পঁচিশ বছর আগে স্কটল্যান্ডের পর্বতে ঝড়ে পড়ে এক বিধবার বাড়িতে আমরা একবার আশ্রয় নিয়েছিলাম, মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, মনে আছে।’
‘আচ্ছা, তুমি কি গভীর রাতে তাঁর ঘরে ঢুকেছিলে?’
এবার আমতা আমতা করে বন্ধু গলা খাঁকারি দেয়। ‘ইয়ে, না মানে, হ্যাঁ, বন্ধু গিয়েছিলাম, তোমাকে বলা হয়নি।’
‘তখন কি তুমি তাকে তোমার পরিচয় দিয়েছিলে?’
আবার আমতা আমতা করে বন্ধুবর ঢেঁাক গিলে বলে, ‘‘হ্যাঁ, মানে, ইচ্ছে করে তোমার নাম-ঠিকানা বলেছিলাম,’ আবার ঢেঁাক গিলে সে, ‘কেন, কী হয়েছে?’
‘তাঁর উকিল আমাকে নোটিশ পাঠিয়েছেন—মহিলা মারা গেছেন, মারা যাওয়ার আগে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আমার নামে উইল করে গেছেন।’
আসুন সবাই মিলে পাহাড় কাটা ঠেকাই, নইলে তো পাহাড়ে ওঠাই বন্ধ হয়ে যাবে।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
আমার সেই বন্ধু কদমগাছটার চেহারাটা চোখের সামনে দাঁড়াল এসে। যাকে প্রতিদিনই দেখতাম, এই বারান্দার ঠিক এখানটাতেই দাঁড়িয়ে। নগরায়ণের বলি হয়েছে সে। তার মতো আরও লাখো গাছকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হচ্ছে নানা কারণে। কয় দিন আগেই দেখলাম, কোনো এক ভিআইপির নিরাপত্তার কারণে বেশ কিছু ভালো গাছ কাটা হয়েছিল। মনে আছে, ঢাকা শহরের রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারের হাজার হাজার কৃষ্ণচূড়া গাছ নিধন করা হয়েছিল। কী এক ট্রামলাইন বসানোর দোহাই দিয়ে। এটা সেই সত্তরের দশকের শেষের দিকে।
কাকে দোষ দেব? সবাই তো দোষী।
ছোটবেলা থেকে শিক্ষকদের কাছ থেকে জেনেছি, প্রকৃতি আমাদের বন্ধু। তার সঙ্গে যেন কখনো বৈরী ব্যবহার না করি আমরা। টাইগারপাস কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রিয় কাদির স্যার কতবার বলেছেন: ‘এরোই, দরকার না হইলে কুনু সময় জোরে মাডিত্ ফা (পা) হেলিস (ফেলিস) না।’ অন্য স্যাররা গাছের ডাল ভেঙে আনার আদেশ দিতেন, আমাদেরই বেত মারার জন্য, কিন্তু কাদির স্যার কখনো করেননি তা। আসলে স্যার তো মারতেনই না ছাত্রদের।
সুন্দরী চট্টলার কথা আমি ভুলতে পারি না। জীবনের ২২টা বছর চট্টগ্রামে বাস করেছি। টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনিতে ছিল বাসা। বাড়ির পেছনের দিকটাতে ছিল পাহাড়ের সারি। আমাদের বাসাটাও ছিল পাহাড়ের এক ধাপে, রাস্তার উত্তর পাশে। দক্ষিণে এক সারি বাসা, তারও নিচে আর এক ধাপে বাসার আরেক সারি। সেই ধাপেই চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী-নাজিরহাট যাওয়ার রেললাইন।
রেললাইনের কথা থাক, পাহাড়ের কথা বলি।
‘লুসাই পাহারোত্তুন লায়ারি যারগোই কর্ণফুলী। ছোড ছোড ঢেউ তুলি...’ চট্টগ্রামে খুবই জনপ্রিয় গান। পাহাড় ছাড়া চট্টগ্রাম ভাবাই যায় না। আর বাটালি পাহাড় চট্টগ্রামের এক বিখ্যাত পাহাড়, যা ছিল আমাদের বাসার পেছনেই।
সেই পঞ্চাশের দশকে গভীর রাতে বোমা ফাটার শব্দে ভেঙে যেত ঘুম। ঘটনা কী? জানা গেল বাটালি পাহাড় ভাঙা হচ্ছে। এক ইতালিয়ান কোম্পানির ছিল এই দায়িত্ব। এরা সারা রাত ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটাত, আর সারা দিন বিশেষ ইতালিয়ান ট্রাকে করে বালু নিয়ে যেত পতেঙ্গায়। শুনেছি পরে সেখানটাতেই নেভিদের হেডকোয়ার্টার্স তৈরি হয়েছিল। স্কুলে পড়ি তখন। মন খারাপ হয়েছিল প্রিয় পাহাড়টা কাটতে দেখে। প্রতি বিকেলে দল বেঁধে উঠতাম বাটালি পাহাড়ে। দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি, সূর্যাস্ত দেখা, সমুদ্র দেখা—এসবই আমাদের অতি প্রিয় ব্যাপার ছিল।
সেই পাহাড়টা হঠাৎ নাই হয়ে যাবে—ভেবেই মন খারাপ হয়। তারপর হঠাৎ খেয়াল করলাম, একদিন ইতালিয়ান কোম্পানি কাটার কাজ ফেলে বিদায় নিল। জানা যায়, সুধী সমাজের আপত্তি, সম্ভবত মামলার কারণে পাহাড় কাটা বন্ধ হয়েছিল। সৌন্দর্য কিছুটা খোয়ালেও তার আকর্ষণ চট্টগ্রামবাসী বা পর্যটকদের কাছে কমেনি কখনো।
বর্তমানে একটা কথা বেশ চালু আছে, ‘পাকিস্তানি যা করতে পারেনি, বাঙালি তাই করে দেখিয়ে দিচ্ছে।’ হ্যাঁ, পাকিস্তানিরা বাটালি পাহাড় গুঁড়িয়ে দিতে না পারলেও আমরা বাঙালিরা উঠেপড়ে লেগে গিয়েছি। এবার ইনশা আল্লাহ্...দেখি কে ঠেকায়!
মন খারাপ করা সংবাদ নিয়ে আমার ‘নীপবন’ থেকে যাবেন তা তো হয় না। শুনুন তবে একটা ছোট্ট চুটকি: দুই বন্ধু স্কটল্যান্ডের পর্বতে উঠছে। মাঝপথে প্রচণ্ড ঝড় উঠল। সেখানে কিছু বসতি ছিল। দৌড়ে এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় চায় তারা। বাড়ির মালিক এক বিধবা মহিলা। মহিলা বলেন, ‘আমি একা, বিধবা, বয়সও কম। তোমরা জওয়ান মানুষ, তোমাদের রাতে আশ্রয় দিলে আমার বদনাম হবে।’ ওরা বলে, ‘আমরা ঘরে যাব না, এই বারান্দায় থাকব। ঝড় থামলে ভোরে চলে যাব।’ আশ্রয় পাওয়া গেল।
পঁচিশ বছর পর লন্ডনে ওই দুই নওজওয়ানের একজন স্কটল্যান্ড থেকে এক উকিলের নোটিশ পেয়ে খুব চিন্তায় পড়ে অন্য বন্ধুকে ফোন করে। সেই বন্ধু তখন সাউথ আফ্রিকায়।
‘হ্যাঁ, বন্ধু, বলো।’
‘পঁচিশ বছর আগে স্কটল্যান্ডের পর্বতে ঝড়ে পড়ে এক বিধবার বাড়িতে আমরা একবার আশ্রয় নিয়েছিলাম, মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, মনে আছে।’
‘আচ্ছা, তুমি কি গভীর রাতে তাঁর ঘরে ঢুকেছিলে?’
এবার আমতা আমতা করে বন্ধু গলা খাঁকারি দেয়। ‘ইয়ে, না মানে, হ্যাঁ, বন্ধু গিয়েছিলাম, তোমাকে বলা হয়নি।’
‘তখন কি তুমি তাকে তোমার পরিচয় দিয়েছিলে?’
আবার আমতা আমতা করে বন্ধুবর ঢেঁাক গিলে বলে, ‘‘হ্যাঁ, মানে, ইচ্ছে করে তোমার নাম-ঠিকানা বলেছিলাম,’ আবার ঢেঁাক গিলে সে, ‘কেন, কী হয়েছে?’
‘তাঁর উকিল আমাকে নোটিশ পাঠিয়েছেন—মহিলা মারা গেছেন, মারা যাওয়ার আগে তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আমার নামে উইল করে গেছেন।’
আসুন সবাই মিলে পাহাড় কাটা ঠেকাই, নইলে তো পাহাড়ে ওঠাই বন্ধ হয়ে যাবে।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments