ভারতে যে কারণে ‘অভ্যুত্থান’ ঘটে না
ব্যাপকভিত্তিক ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ ব্যবস্থার মাধ্যমে সত্তরের দশক নাগাদ ভারতের সেনাবাহিনী পুরোপুরি ‘ক্যু-রোধক’ হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের টেকসই অবস্থান সুনিশ্চিত হয়েছে। ছবি: রয়টার্স |
ঔপনিবেশিক
এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে হুটহাট সামরিক শাসন আসে। ব্যতিক্রম ভারত।
অনেকের আশঙ্কা সত্ত্বেও দেশটিতে কখনো অভ্যুত্থান বা ক্যু হয়নি, আসেনি
সামরিক শাসন। বরং ভারত আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ। কোন জাদুবলে
গণতন্ত্রকে এতটা টেকসই করেছে ভারত?
প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশেষ করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভারতে সামরিক শাসন আসা অসম্ভব ছিল না। এমনকি দেশটিতে ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের সময় দ্য টাইমস এর সংবাদদাতা নেভিল ম্যাক্সওয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এটাই হতে যাচ্ছে সম্ভবত শেষ নির্বাচন।
নেভিল একা নন, আরও অনেকেরই ধারণা ছিল, ভারত সামরিক শাসনের অধীনে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—দেশটিতে তেমন ঘটনা কখনোই ঘটেনি।
কিন্তু কেন?
ভারতের সেনাবাহিনী কেন কখনো ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেনি—এই প্রশ্নের উত্তরে প্রায়ই জোর দিয়ে বলা হয়, তারা সুশৃঙ্খল, উঁচু মাত্রায় পেশাদার। এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ঐতিহ্যের কথাও উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু এসব তত্ত্ব ধোপে টেকে না। প্রতিবেশী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্মও একই ঐতিহ্য থেকে। তাই বলে তারা ক্ষমতা দখল থেকে বিরত নেই। তারাও পেশাদার। প্রয়োজনে তারা বসে থাকে না। সংকটে এগিয়ে আসা তারা দায়িত্ব মনে করে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী স্টিভেন উইলকিনসন তাঁর ‘আর্মি অ্যান্ড নেশন’ বইয়ে ওই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করেছেন। ভারতে সামরিক অভ্যুত্থান না হওয়ার কারণ জানতে ফিরে তাকাতে হবে পাকিস্তানের দিকে। দেশটিতে সামরিক শাসনের একটি প্রাক-ইতিহাস আছে, যার সূত্রপাত হয়েছিল অবিভক্ত ভারত আমলে।
শুরু থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য দেখা যায়। ভারতে কংগ্রেস ছিল টেকসই ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়া দল। আর পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ছিল অনেকটা ‘জিন্নাহ এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ আদলের দল। বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তানে ভয়ংকর কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়।
‘মার্শাল ল’ আশীর্বাদ!
পাকিস্তানে অপ্রত্যাশিতভাবে সামরিক শাসন আসেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে লাহোরে দাঙ্গা হয়। দাঙ্গা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয় বেসামরিক প্রশাসন। শেষমেশ তলব করা হয় সেনাবাহিনী। তারা দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত করে। এরপর সেনাবাহিনী আরও কিছুদিন মাঠে থাকে। এই সময়ে তারা দীর্ঘ দিন ধরে অবহেলিত বেশ কিছু জনসেবামূলক কাজ করে মানুষের মন জয় করে। বছরের পর বছর ধরে যে কাজ বেসামরিক প্রশাসন করতে ব্যর্থ হয়েছে, মাত্র কয়েক দিনে তা করে জনগণের কাছ থেকে বিপুল সম্মান ও শ্রদ্ধা কুড়ায় সেনাবাহিনী।
রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে ‘মার্শাল ল’ জারি এবং সেনা তলব করেন গর্ভনর জেনারেল। এতে সেখানকার জনগণের একটা অংশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। এমনকি তারা এটাকে আশীর্বাদ হিসেবেও বিবেচনা করে। এরপর সচরাচর অবশ্যম্ভাবীভাবে যা হয়, দেশটির সামরিক সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
সুরক্ষা বেড়ি
পাকিস্তানের মতো একই ঐতিহ্য থেকে জন্ম ভারতের সেনাবাহিনীর। ব্রিটিশ ভারতে ভারতীয় জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান উপভোগ করত সেনাবাহিনী। নীতিগত বিষয়েও তাদের ভূমিকা ছিল।
কিন্তু স্বাধীনতার পর অবস্থা বদলাতে থাকে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিশ্বাস করতেন, নতুন ভারতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা পুনরায় বিবেচনা করা দরকার। সেনাবাহিনী পুরোপুরি বেসামরিক সরকারের অধীনস্ত করতে নতুন এক নীতির প্রবর্তন করেন তিনি। এরপর ধারাবাহিকভাবে বাজেটে কাটছাঁট করা হয়।
সামরিক বাহিনীকে সুরক্ষা বেড়ির আওতায় আনতে এবং ভারতীয় সমাজে তাদের প্রভাব কমাতে বছরের পর বছর ধরে একটি পদ্ধতিগত কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হয়। সামরিক বাহিনীকে দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের জন্য নির্ধারিত পরিধির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
স্বীকৃতিবিহীন অর্জন
ব্যাপকভিত্তিক ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ ব্যবস্থার মাধ্যমে সত্তরের দশক নাগাদ ভারতের সেনাবাহিনী পুরোপুরি ‘ক্যু-রোধক’ হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের টেকসই অবস্থান সুনিশ্চিত হয়েছে। এটি নেহরু যুগের অন্যতম সেরা অর্জন হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো—এই অর্জন যথেষ্ট স্বীকৃতি পায়নি। এমনকি ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোও এই অর্জনকে অবজ্ঞা করেছে। আর ওই দেশগুলো সত্যিকারের সামরিক অভ্যুত্থান অথবা অভ্যুত্থানচেষ্টার মুখোমুখি হয়েছে।
‘ক্যু-রোধক’ ব্যবস্থা কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন রাজনৈতিক বিজ্ঞানী স্টিভেন উইলকিনসন। ‘ক্যু’ করা থেকে সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরি বিরত রাখতে সতর্কতার সঙ্গে চিন্তাভাবনা প্রসূত বিস্তারিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্রের মাধ্যমে কঠোর নির্দেশাবলী ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রতিষ্ঠা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে অর্ডার অব প্রেসিডেনস পুনর্নির্ধারণ, পদোন্নতির প্রতি গভীর মনোযোগ সৃষ্টি, জনসমক্ষে সেনা কর্মকর্তাদের বিবৃতি দিতে অনুমতি না দেওয়া, প্রতি ভারসাম্যমূলক আধাসামরিক বাহিনী তৈরি প্রভৃতি। কোয়ার্টজ ইন্ডিয়া অবলম্বনে
প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশেষ করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ভারতে সামরিক শাসন আসা অসম্ভব ছিল না। এমনকি দেশটিতে ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের সময় দ্য টাইমস এর সংবাদদাতা নেভিল ম্যাক্সওয়েল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এটাই হতে যাচ্ছে সম্ভবত শেষ নির্বাচন।
নেভিল একা নন, আরও অনেকেরই ধারণা ছিল, ভারত সামরিক শাসনের অধীনে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—দেশটিতে তেমন ঘটনা কখনোই ঘটেনি।
কিন্তু কেন?
ভারতের সেনাবাহিনী কেন কখনো ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেনি—এই প্রশ্নের উত্তরে প্রায়ই জোর দিয়ে বলা হয়, তারা সুশৃঙ্খল, উঁচু মাত্রায় পেশাদার। এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ঐতিহ্যের কথাও উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু এসব তত্ত্ব ধোপে টেকে না। প্রতিবেশী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্মও একই ঐতিহ্য থেকে। তাই বলে তারা ক্ষমতা দখল থেকে বিরত নেই। তারাও পেশাদার। প্রয়োজনে তারা বসে থাকে না। সংকটে এগিয়ে আসা তারা দায়িত্ব মনে করে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী স্টিভেন উইলকিনসন তাঁর ‘আর্মি অ্যান্ড নেশন’ বইয়ে ওই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করেছেন। ভারতে সামরিক অভ্যুত্থান না হওয়ার কারণ জানতে ফিরে তাকাতে হবে পাকিস্তানের দিকে। দেশটিতে সামরিক শাসনের একটি প্রাক-ইতিহাস আছে, যার সূত্রপাত হয়েছিল অবিভক্ত ভারত আমলে।
শুরু থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে একটা বড় পার্থক্য দেখা যায়। ভারতে কংগ্রেস ছিল টেকসই ও স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়া দল। আর পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ছিল অনেকটা ‘জিন্নাহ এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা’ আদলের দল। বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তানে ভয়ংকর কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়।
‘মার্শাল ল’ আশীর্বাদ!
পাকিস্তানে অপ্রত্যাশিতভাবে সামরিক শাসন আসেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে লাহোরে দাঙ্গা হয়। দাঙ্গা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয় বেসামরিক প্রশাসন। শেষমেশ তলব করা হয় সেনাবাহিনী। তারা দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত করে। এরপর সেনাবাহিনী আরও কিছুদিন মাঠে থাকে। এই সময়ে তারা দীর্ঘ দিন ধরে অবহেলিত বেশ কিছু জনসেবামূলক কাজ করে মানুষের মন জয় করে। বছরের পর বছর ধরে যে কাজ বেসামরিক প্রশাসন করতে ব্যর্থ হয়েছে, মাত্র কয়েক দিনে তা করে জনগণের কাছ থেকে বিপুল সম্মান ও শ্রদ্ধা কুড়ায় সেনাবাহিনী।
রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে ‘মার্শাল ল’ জারি এবং সেনা তলব করেন গর্ভনর জেনারেল। এতে সেখানকার জনগণের একটা অংশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। এমনকি তারা এটাকে আশীর্বাদ হিসেবেও বিবেচনা করে। এরপর সচরাচর অবশ্যম্ভাবীভাবে যা হয়, দেশটির সামরিক সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
সুরক্ষা বেড়ি
পাকিস্তানের মতো একই ঐতিহ্য থেকে জন্ম ভারতের সেনাবাহিনীর। ব্রিটিশ ভারতে ভারতীয় জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান উপভোগ করত সেনাবাহিনী। নীতিগত বিষয়েও তাদের ভূমিকা ছিল।
কিন্তু স্বাধীনতার পর অবস্থা বদলাতে থাকে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বিশ্বাস করতেন, নতুন ভারতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা পুনরায় বিবেচনা করা দরকার। সেনাবাহিনী পুরোপুরি বেসামরিক সরকারের অধীনস্ত করতে নতুন এক নীতির প্রবর্তন করেন তিনি। এরপর ধারাবাহিকভাবে বাজেটে কাটছাঁট করা হয়।
সামরিক বাহিনীকে সুরক্ষা বেড়ির আওতায় আনতে এবং ভারতীয় সমাজে তাদের প্রভাব কমাতে বছরের পর বছর ধরে একটি পদ্ধতিগত কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হয়। সামরিক বাহিনীকে দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের জন্য নির্ধারিত পরিধির মধ্যে আবদ্ধ রাখতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
স্বীকৃতিবিহীন অর্জন
ব্যাপকভিত্তিক ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ ব্যবস্থার মাধ্যমে সত্তরের দশক নাগাদ ভারতের সেনাবাহিনী পুরোপুরি ‘ক্যু-রোধক’ হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের টেকসই অবস্থান সুনিশ্চিত হয়েছে। এটি নেহরু যুগের অন্যতম সেরা অর্জন হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো—এই অর্জন যথেষ্ট স্বীকৃতি পায়নি। এমনকি ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোও এই অর্জনকে অবজ্ঞা করেছে। আর ওই দেশগুলো সত্যিকারের সামরিক অভ্যুত্থান অথবা অভ্যুত্থানচেষ্টার মুখোমুখি হয়েছে।
‘ক্যু-রোধক’ ব্যবস্থা কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন রাজনৈতিক বিজ্ঞানী স্টিভেন উইলকিনসন। ‘ক্যু’ করা থেকে সামরিক বাহিনীকে পুরোপুরি বিরত রাখতে সতর্কতার সঙ্গে চিন্তাভাবনা প্রসূত বিস্তারিত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্রের মাধ্যমে কঠোর নির্দেশাবলী ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামো প্রতিষ্ঠা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে অর্ডার অব প্রেসিডেনস পুনর্নির্ধারণ, পদোন্নতির প্রতি গভীর মনোযোগ সৃষ্টি, জনসমক্ষে সেনা কর্মকর্তাদের বিবৃতি দিতে অনুমতি না দেওয়া, প্রতি ভারসাম্যমূলক আধাসামরিক বাহিনী তৈরি প্রভৃতি। কোয়ার্টজ ইন্ডিয়া অবলম্বনে
No comments