মোদির ‘ঐতিহাসিক’ সফর by মিজানুর রহমান খান
নরেন্দ্র
মোদির সফরকে শেখ হাসিনা বলেছেন ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’। ভারতীয় কর্মকর্তাদের
কথায়, এই সফর ‘অত্যন্ত ঐতিহাসিক’। পানিসম্পদ প্রশ্নে মোদি আমাদের নতুন করে
স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করেছেন। বলেছেন যে ‘বিরোধ নয়, আমাদের নদী হওয়া উচিত
আমাদের সম্পর্ক প্রতিপালনের উৎস।’ সামনের দিনগুলোতে ভারতীয় সহযোগিতা
পাওয়ার বিষয়টি আমরা প্রধানত বুঝব নদী প্রতিপালনের ভিত্তিতে। মোদির কথায়,
‘পানি ভাগাভাগি সবার ওপরে একটি মানবিক বিষয়। এটা সীমান্তের উভয় পাশের জীবন ও
জীবিকাকে প্রভাবিত করে।’ এটা করে বলেই আন্তর্জাতিক নদী আইনে ‘ন্যায্য’
কথাটি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এটা দুঃখের বিষয় যে তিস্তার ‘ন্যায্য সমাধানের’
নির্দিষ্ট সময়সীমা তিনি দেননি। বরং ‘তিস্তা ও ফেনী নদী’ প্রশ্নে ‘রাজ্য
সরকারগুলোর’ সমর্থননির্ভরতার কথা খোলাখুলি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা ব্যারাজের প্রস্তাব দিলে মোদি তা পরীক্ষার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি নিশ্চয় ৪৬ বছর আগে ফিরবেন না। ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে দিল্লিতে দুই দেশের সচিব পর্যায়ের আলোচনায় গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করলে ভারতীয় ভূখণ্ডের কী ক্ষতি হবে, তা চিহ্নিত করতে ভারত একটি যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব দিয়েছিল। পাকিস্তান তা মেনে নিয়েছিল। ভারতও পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞদের তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প পরিদর্শন করতে দিতে সম্মত হয়েছিল। সুতরাং পানি ভাগাভাগি খুবই পুরোনো অমীমাংসিত প্রশ্ন। বিজেপি শাসনামলে পানির প্রশ্নে সিদ্ধান্ত হয়নি।
জনসংঘের নেতা অটল বিহারি বাজপেয়িকে দেওয়া সম্মাননা মোদির হাতে তুলে দেওয়া সত্যি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হিন্দু মৌলবাদী দল জনসংঘ, যা পরে বিজেপিতে রূপান্তরিত হয়, সেই দলটি কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে গোড়া থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর পাশে দাঁড়ায়। একাত্তরে প্রকাশিত জনসংঘের মুখপত্র তার সাক্ষ্য দেবে। বাজপেয়ি তখন ইন্দিরাকে ‘দুর্গা দেবী’ বলে প্রশংসা করেছিলেন। এক পাকিস্তান ভেঙে ‘দুটি পাকিস্তান’ করা নিয়ে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের একাংশ তখন দ্বিধান্বিত ছিল। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক মানেই যে কংগ্রেস নয়, তাতে যে মোদির দল বিজেপিরও ভূমিকা রয়েছে, তা প্রথম পাদপ্রদীপে এল। এখন তিস্তাসহ গঙ্গা চুক্তি পর্যালোচনার মতো বিষয় দুই দেশ নতুন উদ্যমে শুরু করতে পারে। অনতিবিলম্বে তিস্তা চুক্তি মোদির জন্য অগ্নিপরীক্ষা।
মোদির বহুল আলোচিত সফর, যাতে ভারত আরও বেশি সন্তুষ্ট, তার রেশ ধরে রাখাটাই মুখ্য চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সত্যিই ‘নতুন উচ্চতায়’ উঠছে কি না, তার মাপকাঠি হবে জনগণের আবেগ। এতে যাতে আঘাত না লাগে, তাদের মধ্যে বঞ্চনার বোধ যাতে না আসে। কানেক্টিভিটি কত ভালো, সেটা যেমন শেখ হাসিনা অকপটে বলেন; গঙ্গা ব্যারেজ কত ভালো, এখন সেটা তেমনি মোদির কণ্ঠে শুনতে চাই। ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’—শুধু এমন কিছুর উচ্চারণই দুই দেশের সম্পর্কের গুণগত স্থায়ী পরিবর্তনের নির্দেশক হতে পারে।
১৯৬৫ সালের আগের অবস্থায়, অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে রেল, নৌ ও সড়কপথের যোগাযোগকে পুনরুজ্জীবিত করতে ভারতের একটি বিশেষ আগ্রহ আমরা দেখতে পাচ্ছি। একে স্বাগত জানাই। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, সমুদ্রবন্দর ব্যবহারসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক সহযোগিতা বাড়তে থাকুক, একই সঙ্গে অভিন্ন পানিসম্পদ ব্যবহারের উন্নয়নও সমানতালে হতে হবে। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারে দিল্লির মনোভাব বদলাচ্ছে কি না, সেটা এখনো অস্পষ্ট। লক্ষণীয় যে বাংলাদেশের উদ্বেগের কারণে নয়, টিপাইমুখ প্রকল্প ‘বর্তমান রূপে’ না করার যুক্তি হিসেবে নির্দিষ্টভাবে ভারতের ‘সংবিধিবদ্ধ প্রয়োজনের’ কথা বলা হয়েছে। আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প, মানে এক নদীর পানি অন্য নদীতে টেনে নিয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা, এর ফলে নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিরাট ক্ষতির আশঙ্কা রয়ে গেছে। যৌথ ঘোষণায় যদিও কেতাদুরস্ত কূটনৈতিক রীতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জন্য প্রতিকূল হয় এমনভাবে তারা নদী সংযোগ করবে না’, কিন্তু নদী সংযোগের ধারণাই ক্ষতিকর। ভারতে কার্যকর নদী সংযোগ প্রকল্প পানি চুক্তি অকার্যকর করে দিতে পারে।
ইন্দিরাপুত্র সঞ্জয় গান্ধীর স্ত্রী মানেকা গান্ধী¦, মোদি যাঁকে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী করেছেন, তিনি¦ বলেছেন, ‘ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প অত্যন্ত ভয়ংকর। যেসব নদী যুক্ত করা হবে, সেসব নদীকে হত্যা করা হবে।’ (দ্য হিন্দু, ১৪ আগস্ট, ২০১৪) ভারতে এ নিয়ে বিতর্ক আগেও ছিল, এখনো আছে। কিন্তু মোদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির এটা ছিল স্বপ্নের প্রকল্প। মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকার ভারতের প্রথম নদী সংযোগ প্রকল্প ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। অল্প কদিন আগে আসামের দৈনিক অসমতে নদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে খবর দেখলাম। ভারতের পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভেদকার বলেছেন, ‘যেসব নদী কাছাকাছি, সেগুলোকে আগে যুক্ত করা হবে।’ ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ইকোনমিক টাইমস-এর শিরোনাম: ‘নদী সংযোগ শিগগিরই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী মোদি অবিলম্বে প্রকল্প হাতে নিতে চান।’ মোদি ইতিমধ্যে পূর্ণাঙ্গ নদী মানচিত্র তৈরি করতে বলেছেন। স্যাটেলাইট ও থ্রিডি প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রামবাসীর জন্য উৎকৃষ্ট সেচব্যবস্থার বুদ্ধি বাতলাতে বলেছেন। মোদির এই সফর নিশ্চয় ‘ঐতিহাসিক’, কিন্তু তা অধিকতর অর্থপূর্ণ হবে, যদি মোদির উন্নয়ন-দর্শনে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নদীর ফারাকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
৬ জুন মোদি ঢাকায় ‘আমাদের নদীগুলোকে পরিচ্ছন্ন ও নব জীবনদানে’ একত্রে কাজ করতে বলেছেন। কানেক্টিভিটি প্রসঙ্গে নদীর ওপরও জোর দিয়েছেন। উদারনৈতিক নৌপরিবহন প্রটোকল চুক্তিও হয়েছে। সত্যিই আমাদের নদীগুলোর নবজীবন দরকার। ভারতীয় বিনিয়োগকে কার্যকর করতেও নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যৌথ নদী কমিশনের উচিত হবে মোদির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘আমাদের নদীগুলোকে নবজীবন দানে’ একটি সমীক্ষা চালানো। মোদির কণ্ঠে জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ বড় ভালো লেগেছে। তবে কথা হলো, ‘ধানসিড়িটি’ তো রক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের এটি এমন একটি সুবর্ণ প্রেক্ষাপট, যখন সীমান্ত সমস্যার চিরকালীন মীমাংসার উপলক্ষকে আমরা বড় করে দেখছি। মোদি নিজেই একে ‘বার্লিন দেয়াল’ ভেঙে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করে আমাদের চমকে দিয়েছেন। মোদি সরকারের নদী সংযোগ দর্শন হলো ‘সুজালম, সুফালম, মাতারাম’। আশা করব, আমাদের ‘সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা’ এই বাংলার মুখ মলিন হওয়া তিনি চাইবেন না। সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার আয়তনের এই ‘বার্লিন দেয়ালের’ বিশেষত্ব হলো গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র, যা এই দেয়ালকে চিরস্থায়ী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিয়েছে। এই নদীগুলোর প্রবাহ এমনিতে থাকবে না। একে বাঁচাতে হবে। বাণিজ্য ও ট্রান্সশিপমেন্টে লব্ধ অর্থ যদি জীবনের জন্য হয়, তাহলে বাংলাদেশি বাঙালির সেই জীবনের পিদিম না নেভাতে খরস্রোতা নদী চাই। মোদি বর্ণিত ‘নতুন অর্থনৈতিক মাত্রায়’ ট্রানজিট ও নানা সওদা বেচে আমাদের অনেক টাকাপয়সা হবে, কিন্তু তা কে খাবে?
যৌথ নদী কমিশনের উচিত হবে মোদির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘আমাদের নদীগুলোকে নবজীবন দানে’ একটি সমীক্ষা চালানো। মোদির কণ্ঠে জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ বড় ভালো লেগেছে। তবে কথা হলো, ‘ধানসিড়িটি’ তো রক্ষা করতে হবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তির্যক মন্তব্য করেছিলেন, হিন্দুদের পানিতে উর্বর হতে দেওয়ার চেয়ে পাকিস্তানকে তিনি মরুভূমি দেখতে চাইবেন। এর উত্তরে জওহর লাল নেহরু বলেছিলেন, ‘ভারতীয় পানি নিয়ে ভারত কী করবে, সেটা ভারতের ব্যাপার।’ (হিন্দুস্তান টাইমস, ২ জুন ২০১৫) কিন্তু নেহরু ঠিকই ‘ভারতীয় পানি’ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে সুজালম, সুফালম করার বন্দোবস্ত করেছিলেন, আধা ডজন কাশ্মীরি নদী নিয়ে করা সেই চুক্তি ইন্দাজ ট্রিটি নামে পরিচিত। সেটাই ছিল সত্যিকারের ‘অত্যন্ত ঐতিহাসিক’ পানি চুক্তি। যৌথ বিবৃতিতে ছয় নদীর বিষয়ে চুক্তির অঙ্গিকার আছে। তাই সার্থক কানেক্টিভিটির জন্য দুই দেশেরই বৈধ পানিস্বার্থ রক্ষা করে নদী ও সড়ক দুটিকেই তরতাজা করা লাগবে।
তিস্তা শুকিয়ে যাচ্ছে। গত মার্চের শেষ ১০ দিনে তিস্তায় পানি ছিল মাত্র ৩১৫ কিউসেক, ইতিহাসের সর্বনিম্ন; এর আগের বছরে একই সময়ের তুলনায় যা ২৩৫ কিউসেক কম। এই তিস্তায় ২০১১ সালে চূড়ান্ত হওয়া ৫০: ৫০ ভাগাভাগির ‘অন্তবর্তীকালীন’ চুক্তিটাও এখন করা যাচ্ছে না। মমতা তিস্তার একটি পয়েন্টে নাকি রাজ্যের হিস্যার গ্যারান্টি চান। ইন্দাজ চুক্তিতে নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে পাকিস্তানকে প্রায় ৮০ শতাংশ পানির গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল। আর ৬ জুন ওয়াটার: এশিয়াজ নিউ ব্যাটল গ্রাউন্ড বইয়ের লেখক ব্রহ্মাচেলানি হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেছেন, ‘এই শতাব্দীতে বিশ্বে বড় কোনো পানি ভাগের চুক্তি হয়নি। নেহরু যা পেরেছিলেন, এখন আর তা সম্ভব নয়, কারণ রাজ্যগুলো তাদের অধিকার খাটাচ্ছে।’ তবু আশা, মোদি আমাদের জীবনে ইন্দাজের স্মৃতিধন্য নেহরু হয়ে উঠুন।
সামনে হয়তো অন্তর্বর্তীকালীন তিস্তা চুক্তি পাব, সুষম পানিধারা পাব কি? যৌথ বিবৃতির ‘অববাহিকা ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা’র বাস্তবায়ন ছাড়া তো তা সম্ভব মনে হয় না। ৫৪টি সীমান্ত নদীর জন্য আলাদা চুক্তি বাস্তবসম্মত মনে হয় না। ইন্দাজের মতো উল্লেখযোগ্য নদী নিয়ে একটি আমব্রেলা চুক্তি হতে পারে। সমাধানটা রাজনৈতিক। ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন স্মৃতিচারণ করেছেন: ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিটা দফায় দফায় বৈঠকের পরও তিন-চারটি বিষয়ে আটকে গিয়েছিল। উভয় দিকের কর্মকর্তারা ধাঁধায় পড়েন। স্মিতহাস্য বঙ্গবন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরাকে বলেছিলেন, ‘আপনাদের দার্জিলিং, শিলং, শিমলা আছে। বলুন তো আমি কেন বলব না যে আমাদের একটি হিলি (পার্বত্য) স্টেশন লিখে দিন!’
সেদিন যে চেতনায় সীমান্ত চুক্তি সই হয়েছিল, সেই চেতনায় মোদির বাংলাদেশ নীতির গ্রন্থনা চাই। দিল্লির ওই সভায় উচ্চারিত বঙ্গবন্ধুর উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য: ‘আয়তনে ভারত কত বৃহৎ, জনসংখ্যায় “বড়” হলেও বাংলাদেশ মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইলের। কোনো “ধূসর” বিষয় থাকলে আপনারা নিশ্চয় অনিচ্ছাভরে তা বাংলাদেশকে দেবেন না। তবে ব্যাপকভিত্তিক নীতি হিসেবে অনেক ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের দেশ হিসেবে বিষয়গুলো আমাদের অনুকূলেই নিষ্পত্তি করুন। এক উত্তম প্রতিবেশী হিসেবে আমরা আপনাদের কাছে তাই আশা করি।’
মোদির কণ্ঠে যখন শুনলাম, পাখি, বাতাস ও পানির ভিসা লাগে না, ‘পানি নিয়ে রাজনীতি নয়,’ চকিতে মুগ্ধ হলাম।
তাঁর সফর বাংলাদেশের জন্য ‘অত্যন্ত ঐতিহাসিক’ হবে সেই আশায় রইলাম।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
শেখ হাসিনা ব্যারাজের প্রস্তাব দিলে মোদি তা পরীক্ষার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি নিশ্চয় ৪৬ বছর আগে ফিরবেন না। ১৯৬৯ সালের জুলাইয়ে দিল্লিতে দুই দেশের সচিব পর্যায়ের আলোচনায় গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করলে ভারতীয় ভূখণ্ডের কী ক্ষতি হবে, তা চিহ্নিত করতে ভারত একটি যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব দিয়েছিল। পাকিস্তান তা মেনে নিয়েছিল। ভারতও পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞদের তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প পরিদর্শন করতে দিতে সম্মত হয়েছিল। সুতরাং পানি ভাগাভাগি খুবই পুরোনো অমীমাংসিত প্রশ্ন। বিজেপি শাসনামলে পানির প্রশ্নে সিদ্ধান্ত হয়নি।
জনসংঘের নেতা অটল বিহারি বাজপেয়িকে দেওয়া সম্মাননা মোদির হাতে তুলে দেওয়া সত্যি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হিন্দু মৌলবাদী দল জনসংঘ, যা পরে বিজেপিতে রূপান্তরিত হয়, সেই দলটি কিন্তু বাংলাদেশ প্রশ্নে গোড়া থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর পাশে দাঁড়ায়। একাত্তরে প্রকাশিত জনসংঘের মুখপত্র তার সাক্ষ্য দেবে। বাজপেয়ি তখন ইন্দিরাকে ‘দুর্গা দেবী’ বলে প্রশংসা করেছিলেন। এক পাকিস্তান ভেঙে ‘দুটি পাকিস্তান’ করা নিয়ে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের একাংশ তখন দ্বিধান্বিত ছিল। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক মানেই যে কংগ্রেস নয়, তাতে যে মোদির দল বিজেপিরও ভূমিকা রয়েছে, তা প্রথম পাদপ্রদীপে এল। এখন তিস্তাসহ গঙ্গা চুক্তি পর্যালোচনার মতো বিষয় দুই দেশ নতুন উদ্যমে শুরু করতে পারে। অনতিবিলম্বে তিস্তা চুক্তি মোদির জন্য অগ্নিপরীক্ষা।
মোদির বহুল আলোচিত সফর, যাতে ভারত আরও বেশি সন্তুষ্ট, তার রেশ ধরে রাখাটাই মুখ্য চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সত্যিই ‘নতুন উচ্চতায়’ উঠছে কি না, তার মাপকাঠি হবে জনগণের আবেগ। এতে যাতে আঘাত না লাগে, তাদের মধ্যে বঞ্চনার বোধ যাতে না আসে। কানেক্টিভিটি কত ভালো, সেটা যেমন শেখ হাসিনা অকপটে বলেন; গঙ্গা ব্যারেজ কত ভালো, এখন সেটা তেমনি মোদির কণ্ঠে শুনতে চাই। ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’—শুধু এমন কিছুর উচ্চারণই দুই দেশের সম্পর্কের গুণগত স্থায়ী পরিবর্তনের নির্দেশক হতে পারে।
১৯৬৫ সালের আগের অবস্থায়, অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে রেল, নৌ ও সড়কপথের যোগাযোগকে পুনরুজ্জীবিত করতে ভারতের একটি বিশেষ আগ্রহ আমরা দেখতে পাচ্ছি। একে স্বাগত জানাই। ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, সমুদ্রবন্দর ব্যবহারসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক সহযোগিতা বাড়তে থাকুক, একই সঙ্গে অভিন্ন পানিসম্পদ ব্যবহারের উন্নয়নও সমানতালে হতে হবে। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহারে দিল্লির মনোভাব বদলাচ্ছে কি না, সেটা এখনো অস্পষ্ট। লক্ষণীয় যে বাংলাদেশের উদ্বেগের কারণে নয়, টিপাইমুখ প্রকল্প ‘বর্তমান রূপে’ না করার যুক্তি হিসেবে নির্দিষ্টভাবে ভারতের ‘সংবিধিবদ্ধ প্রয়োজনের’ কথা বলা হয়েছে। আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প, মানে এক নদীর পানি অন্য নদীতে টেনে নিয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা, এর ফলে নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিরাট ক্ষতির আশঙ্কা রয়ে গেছে। যৌথ ঘোষণায় যদিও কেতাদুরস্ত কূটনৈতিক রীতিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জন্য প্রতিকূল হয় এমনভাবে তারা নদী সংযোগ করবে না’, কিন্তু নদী সংযোগের ধারণাই ক্ষতিকর। ভারতে কার্যকর নদী সংযোগ প্রকল্প পানি চুক্তি অকার্যকর করে দিতে পারে।
ইন্দিরাপুত্র সঞ্জয় গান্ধীর স্ত্রী মানেকা গান্ধী¦, মোদি যাঁকে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী করেছেন, তিনি¦ বলেছেন, ‘ভারতের নদী সংযোগ প্রকল্প অত্যন্ত ভয়ংকর। যেসব নদী যুক্ত করা হবে, সেসব নদীকে হত্যা করা হবে।’ (দ্য হিন্দু, ১৪ আগস্ট, ২০১৪) ভারতে এ নিয়ে বিতর্ক আগেও ছিল, এখনো আছে। কিন্তু মোদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির এটা ছিল স্বপ্নের প্রকল্প। মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকার ভারতের প্রথম নদী সংযোগ প্রকল্প ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। অল্প কদিন আগে আসামের দৈনিক অসমতে নদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে খবর দেখলাম। ভারতের পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভেদকার বলেছেন, ‘যেসব নদী কাছাকাছি, সেগুলোকে আগে যুক্ত করা হবে।’ ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪ ইকোনমিক টাইমস-এর শিরোনাম: ‘নদী সংযোগ শিগগিরই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী মোদি অবিলম্বে প্রকল্প হাতে নিতে চান।’ মোদি ইতিমধ্যে পূর্ণাঙ্গ নদী মানচিত্র তৈরি করতে বলেছেন। স্যাটেলাইট ও থ্রিডি প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রামবাসীর জন্য উৎকৃষ্ট সেচব্যবস্থার বুদ্ধি বাতলাতে বলেছেন। মোদির এই সফর নিশ্চয় ‘ঐতিহাসিক’, কিন্তু তা অধিকতর অর্থপূর্ণ হবে, যদি মোদির উন্নয়ন-দর্শনে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক নদীর ফারাকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
৬ জুন মোদি ঢাকায় ‘আমাদের নদীগুলোকে পরিচ্ছন্ন ও নব জীবনদানে’ একত্রে কাজ করতে বলেছেন। কানেক্টিভিটি প্রসঙ্গে নদীর ওপরও জোর দিয়েছেন। উদারনৈতিক নৌপরিবহন প্রটোকল চুক্তিও হয়েছে। সত্যিই আমাদের নদীগুলোর নবজীবন দরকার। ভারতীয় বিনিয়োগকে কার্যকর করতেও নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যৌথ নদী কমিশনের উচিত হবে মোদির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘আমাদের নদীগুলোকে নবজীবন দানে’ একটি সমীক্ষা চালানো। মোদির কণ্ঠে জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ বড় ভালো লেগেছে। তবে কথা হলো, ‘ধানসিড়িটি’ তো রক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের এটি এমন একটি সুবর্ণ প্রেক্ষাপট, যখন সীমান্ত সমস্যার চিরকালীন মীমাংসার উপলক্ষকে আমরা বড় করে দেখছি। মোদি নিজেই একে ‘বার্লিন দেয়াল’ ভেঙে দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করে আমাদের চমকে দিয়েছেন। মোদি সরকারের নদী সংযোগ দর্শন হলো ‘সুজালম, সুফালম, মাতারাম’। আশা করব, আমাদের ‘সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা’ এই বাংলার মুখ মলিন হওয়া তিনি চাইবেন না। সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার আয়তনের এই ‘বার্লিন দেয়ালের’ বিশেষত্ব হলো গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র, যা এই দেয়ালকে চিরস্থায়ী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিয়েছে। এই নদীগুলোর প্রবাহ এমনিতে থাকবে না। একে বাঁচাতে হবে। বাণিজ্য ও ট্রান্সশিপমেন্টে লব্ধ অর্থ যদি জীবনের জন্য হয়, তাহলে বাংলাদেশি বাঙালির সেই জীবনের পিদিম না নেভাতে খরস্রোতা নদী চাই। মোদি বর্ণিত ‘নতুন অর্থনৈতিক মাত্রায়’ ট্রানজিট ও নানা সওদা বেচে আমাদের অনেক টাকাপয়সা হবে, কিন্তু তা কে খাবে?
যৌথ নদী কমিশনের উচিত হবে মোদির আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘আমাদের নদীগুলোকে নবজীবন দানে’ একটি সমীক্ষা চালানো। মোদির কণ্ঠে জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ বড় ভালো লেগেছে। তবে কথা হলো, ‘ধানসিড়িটি’ তো রক্ষা করতে হবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তির্যক মন্তব্য করেছিলেন, হিন্দুদের পানিতে উর্বর হতে দেওয়ার চেয়ে পাকিস্তানকে তিনি মরুভূমি দেখতে চাইবেন। এর উত্তরে জওহর লাল নেহরু বলেছিলেন, ‘ভারতীয় পানি নিয়ে ভারত কী করবে, সেটা ভারতের ব্যাপার।’ (হিন্দুস্তান টাইমস, ২ জুন ২০১৫) কিন্তু নেহরু ঠিকই ‘ভারতীয় পানি’ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে সুজালম, সুফালম করার বন্দোবস্ত করেছিলেন, আধা ডজন কাশ্মীরি নদী নিয়ে করা সেই চুক্তি ইন্দাজ ট্রিটি নামে পরিচিত। সেটাই ছিল সত্যিকারের ‘অত্যন্ত ঐতিহাসিক’ পানি চুক্তি। যৌথ বিবৃতিতে ছয় নদীর বিষয়ে চুক্তির অঙ্গিকার আছে। তাই সার্থক কানেক্টিভিটির জন্য দুই দেশেরই বৈধ পানিস্বার্থ রক্ষা করে নদী ও সড়ক দুটিকেই তরতাজা করা লাগবে।
তিস্তা শুকিয়ে যাচ্ছে। গত মার্চের শেষ ১০ দিনে তিস্তায় পানি ছিল মাত্র ৩১৫ কিউসেক, ইতিহাসের সর্বনিম্ন; এর আগের বছরে একই সময়ের তুলনায় যা ২৩৫ কিউসেক কম। এই তিস্তায় ২০১১ সালে চূড়ান্ত হওয়া ৫০: ৫০ ভাগাভাগির ‘অন্তবর্তীকালীন’ চুক্তিটাও এখন করা যাচ্ছে না। মমতা তিস্তার একটি পয়েন্টে নাকি রাজ্যের হিস্যার গ্যারান্টি চান। ইন্দাজ চুক্তিতে নিম্ন অববাহিকার দেশ হিসেবে পাকিস্তানকে প্রায় ৮০ শতাংশ পানির গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল। আর ৬ জুন ওয়াটার: এশিয়াজ নিউ ব্যাটল গ্রাউন্ড বইয়ের লেখক ব্রহ্মাচেলানি হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেছেন, ‘এই শতাব্দীতে বিশ্বে বড় কোনো পানি ভাগের চুক্তি হয়নি। নেহরু যা পেরেছিলেন, এখন আর তা সম্ভব নয়, কারণ রাজ্যগুলো তাদের অধিকার খাটাচ্ছে।’ তবু আশা, মোদি আমাদের জীবনে ইন্দাজের স্মৃতিধন্য নেহরু হয়ে উঠুন।
সামনে হয়তো অন্তর্বর্তীকালীন তিস্তা চুক্তি পাব, সুষম পানিধারা পাব কি? যৌথ বিবৃতির ‘অববাহিকা ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা’র বাস্তবায়ন ছাড়া তো তা সম্ভব মনে হয় না। ৫৪টি সীমান্ত নদীর জন্য আলাদা চুক্তি বাস্তবসম্মত মনে হয় না। ইন্দাজের মতো উল্লেখযোগ্য নদী নিয়ে একটি আমব্রেলা চুক্তি হতে পারে। সমাধানটা রাজনৈতিক। ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন স্মৃতিচারণ করেছেন: ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিটা দফায় দফায় বৈঠকের পরও তিন-চারটি বিষয়ে আটকে গিয়েছিল। উভয় দিকের কর্মকর্তারা ধাঁধায় পড়েন। স্মিতহাস্য বঙ্গবন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরাকে বলেছিলেন, ‘আপনাদের দার্জিলিং, শিলং, শিমলা আছে। বলুন তো আমি কেন বলব না যে আমাদের একটি হিলি (পার্বত্য) স্টেশন লিখে দিন!’
সেদিন যে চেতনায় সীমান্ত চুক্তি সই হয়েছিল, সেই চেতনায় মোদির বাংলাদেশ নীতির গ্রন্থনা চাই। দিল্লির ওই সভায় উচ্চারিত বঙ্গবন্ধুর উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য: ‘আয়তনে ভারত কত বৃহৎ, জনসংখ্যায় “বড়” হলেও বাংলাদেশ মাত্র ৫৫ হাজার বর্গমাইলের। কোনো “ধূসর” বিষয় থাকলে আপনারা নিশ্চয় অনিচ্ছাভরে তা বাংলাদেশকে দেবেন না। তবে ব্যাপকভিত্তিক নীতি হিসেবে অনেক ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের দেশ হিসেবে বিষয়গুলো আমাদের অনুকূলেই নিষ্পত্তি করুন। এক উত্তম প্রতিবেশী হিসেবে আমরা আপনাদের কাছে তাই আশা করি।’
মোদির কণ্ঠে যখন শুনলাম, পাখি, বাতাস ও পানির ভিসা লাগে না, ‘পানি নিয়ে রাজনীতি নয়,’ চকিতে মুগ্ধ হলাম।
তাঁর সফর বাংলাদেশের জন্য ‘অত্যন্ত ঐতিহাসিক’ হবে সেই আশায় রইলাম।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments