মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: টাকার খেলা! by হাসান ফেরদৌস
কিছুদিন
আগে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি খবরের শিরোনাম ছিল: ‘২০১৬
সালের নির্বাচনের প্রধান বিবেচ্য: টাকা, টাকা, টাকা’। সে শিরোনাম পড়ে এ
দেশে কেউ ভ্রু কুঁচকেছেন, এ কথা শুনিনি। কারণ, কথাটা এত পুরোনো যে এ নিয়ে
অধিকাংশই কথা বলার কোনো প্রয়োজন দেখেননি।
আমেরিকায় কেন, অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন মানেই টাকার খেলা! আপনি যত অভিজ্ঞ ও যোগ্য প্রার্থী হন না কেন, বস্তাবোঝাই টাকা না থাকলে নির্বাচনে জেতা আপনার পক্ষে অসম্ভব। তবে এ কাজে অন্য সবাইকে টেক্কা দিয়েছে মার্কিনরা। তারা নিজেদের বিশ্বের সেরা গণতান্ত্রিক মডেল হিসেবে পরিচয় করাতে ভালোবাসে। কিন্তু এই দেশে, আর যা-ই হোক, টাকা না থাকলে নির্বাচনে জেতা অসম্ভব। সে কারণে এখানে গণতন্ত্রের নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডলারোক্রেসি’।
টাকা দিয়ে কীভাবে নির্বাচন জেতা বা হারা যায়, তার সেরা উদাহরণ বারাক ওবামা। ২০০৮ সালে অভাবনীয় জনপ্রিয়তার জোয়ারে ওবামা প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই জনপ্রিয়তাকে নির্বাচনী বিজয়ে পরিণত করা সম্ভব হয় টাকার জোরে। এ দেশে সরকারি তহবিল থেকে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের আইন রয়েছে। ২০০৮ সালে ওবামা চাইলে সরকারি তহবিল থেকে ৮৪ মিলিয়ন ডলার পেতে পারতেন। কিন্তু শর্ত ছিল, এর বাইরে এক পয়সাও তোলা যাবে না। ওবামা আগাগোড়া বলে এসেছেন তিনি সরকারি তহবিল নিয়েই নির্বাচন করবেন। কিন্তু যেই টের পেলেন, দশ-বিশ ডলার করে হলেও বিস্তর চাঁদা তোলার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে, অমনি জানিয়ে দিলেন, সরকারি তহবিল নিয়ে তিনি নির্বাচন করবেন না। যুক্তি দেখালেন, তাঁর প্রতিপক্ষ জন ম্যাককেইনের হয়ে রিপাবলিকান দল দেদার চাঁদা তুলছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার এ ছাড়া অন্য পথ নেই। সে বছরের নির্বাচনে ওবামা একাই ৭৫০ মিলিয়ন ডলার চাঁদা তুলেছেন।
বলা যায়, সেদিন থেকেই আমেরিকায় সরকারি খরচে জাতীয় নির্বাচনের ধারণার মৃত্যু হয়।
কথাটা হয়তো পুরোপুরি সত্য হলো না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বরাবরই ধনীদের পক্ষে গেছে। একদম প্রথম দিকের প্রেসিডেন্টদের বেলাতেও কথাটা সত্যি। এ দেশে পাঁচ-দশজন অতি ধনী এককাট্টা হয়ে বরাবরই ঠিক করে দিয়েছেন কে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন। ব্যাপারটা এতটা দৃষ্টিকটু হয়ে পড়ে যে ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে ‘পাবলিক ফিন্যান্সিং’-এর আইন প্রস্তাব করেন। এই আইন অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের ওপর ধার্য করা হয় নির্বাচনে ব্যয় নির্বাহের জন্য নামমাত্র কর। রাজনৈতিক প্রার্থী বা দলের জন্য চাঁদা দেওয়া নিষিদ্ধ নয়, তবে কে কী পরিমাণ চাঁদা দেবেন, তার সর্বোচ্চ হার বেঁধে দিয়ে একাধিক আইন পাস হয়েছে এই দেশে।
অবস্থাটা নাটকীয়ভাবে বদলে যায় ২০১০ সালে। সে বছর এ দেশের সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত দেন, যার যা খুশি চাঁদা দেওয়াটা তার শাসনতান্ত্রিক অধিকার। এর নাম নাকি ‘ফ্র স্পিচ!’ বড় বড় করপোরেশনেরও মুখ খুলে কথা বলার বা পকেট ঝেড়ে চাঁদা দেওয়ার—অধিকার আছে। ব্যস, হয়ে গেল। তখন থেকেই যথেচ্ছ চাঁদা তোলার জন্য তথাকথিত ‘সুপার পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি’ হাড্ডাহাড্ডি লড়াইেয় নেমে পড়ল। ২০১২ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই ‘সুপার প্যাক’-এর নেতৃত্বে এ দেশের নির্বাচনে কেনাবেচার তেজারতি হয় কোনো রাখঢাক ছাড়াই।
২০১৬ সালের নির্বাচনেও সেই একই মাদারির খেল হবে, তবে টাকার অঙ্কটা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি।
আমেরিকার রাজনীতিতে টাকার ভূমিকা কী রকম ভয়াবহ, সে কথা সবচেয়ে স্পষ্ট বলেছেন খোদ ওবামা। কেনেথ ভোগেলের নতুন বই বিগ মানিতে ২০১২ সালের একটি ঘটনা বলা হয়েছে। ওবামা তাঁর নিজের সমর্থকদের এক তহবিল সংগ্রহ ডিনারে আমন্ত্রণ করেছিলেন। সেখানে প্লেটপ্রতি দাম ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৯০০ ডলার। ডেমোক্রেটিক পার্টির বাঘা বাঘা দেনেওয়ালা সেখানে উপস্থিত। মাইক্রোসফটের বিল গেটসের দিকে তাকিয়ে ওবামা বললেন, ‘দেখুন, এখন আমরা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছি, যখন মাত্র শ দুয়েক লোক একটা জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারেন। অবস্থা যদি না বদলায়, তাহলে সম্ভবত আমিই হব শেষ প্রেসিডেন্ট, যে মোটা চাঁদা ছাড়াই নির্বাচনে জিতেছে। আমি মোটা টাকার চাঁদা পেয়েছি বটে, কিন্তু অধিকাংশ চাঁদাই এসেছে তৃণমূল থেকে, অল্প টাকার চাঁদা।’
২০১২ সালে তাঁর পুনর্নির্বাচনে ওবামা ছোট-বড় অঙ্ক মিলিয়ে এক বিলিয়ন ডলারের অধিক চাঁদা তুলতে সক্ষম হন। অন্যদিকে তাঁর প্রতিপক্ষ মিট রমনি তোলেন সোয়া বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে যদি ‘সুপার প্যাক’-এর চাঁদা ধরা হয়, সেখানেও রমনি ওবামার তুলনায় কম করে হলেও এক শ মিলিয়নের অধিক চাঁদা তোলেন। তারপরও যে শেষ পর্যন্ত ওবামা জিতলেন, রমনি নন, তার কারণ অবশ্য স্বতন্ত্র। তবে টাকার হিসাবে তিনি যে রমনি থেকে খুব পিছিয়ে ছিলেন না, সেটি তঁার বিজয়ের অন্যতম কারণ, সে কথাতেও কোনো সন্দেহ নেই।
২০১৬ সালের নির্বাচনে এই টাকার খেল যে অন্য যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে যাবে, তার সব লক্ষণ বর্তমান। এখনো দুই দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি, তবে ডেমোক্রেটিক দলের হয়ে হিলারি ও রিপাবলিকানদের জেব বুশ যাঁর যাঁর দলের প্রধান দাবিদার হয়ে উঠেছেন। তাঁরা দুজনের কেউই জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেননি, আপাতত সব শক্তি ও মেধা নিয়োগ করেছেন টাকা তোলায়। যত পারো টাকা তোলো। নিজেরা সরাসরি তুলতে না পারলে যার যার সুপার প্যাকের মাধ্যমে তাঁরা টাকা তুলছেন।
ব্যাপারটা কী রকম নির্লজ্জ আকার নিয়েছে, তা জেব বুশের সাম্প্রতিক আবেদনপত্র থেকেই ঠাওর করা যায়। নিজ সমর্থকদের এক চিঠিতে তিনি সরাসরি বলেছেন, আপনারা প্রত্যেকে এক মিলিয়ন ডলার করে চাঁদা দিন। টাকাটা যাবে তাঁর সুপার প্যাকের তহবিলে। মজার ব্যাপার হলো বুশ এখনো নিজের প্রার্থিতাই ঘোষণা করেননি। শর্ত আছে, কোনো ঘোষিত প্রার্থী তাঁর সুপার প্যাকের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে চাঁদা তুলতে পারবেন না। এই নামমাত্র নিয়ন্ত্রণ মাথায় রেখে আনুষ্ঠানিক প্রার্থী পদ ঘোষণার আগে বুশ দুই হাতে টাকা কুড়াচ্ছেন।
একই কথা হিলারি সম্বন্ধেও। তাঁর টার্গেট আড়াই বিলিয়ন ডলার চাঁদা তোলা। গত নির্বাচনে ওবামা ও রমনি মিলে ঠিক এই পরিমাণ চাঁদা তুলেছিলেন। হিলারিকে এই কাজে মদদ দিচ্ছেন স্বামী বিল ক্লিনটন। হিলারির সুপার প্যাকের মাধ্যমে নতুন-পুরোনো বন্ধুদের কাছে মাথার টুপিটি বাড়িয়ে বসে আছেন তাঁরা দুজনেই। কিছুদিন আগে নিউইয়র্কে এসেছিলেন হিলারি ‘ফান্ড রেইজিং ডিনারে’, সেখানে প্লেটপ্রতি চাঁদা ছিল ৫০ হাজার ডলার। জেব বুশ অবশ্য তাঁর চেয়ে এক কাঠি সরেস। তিনিও নিউইয়র্কে এসে ওয়াল স্ট্রিটের টাকার কুমিরদের ডিনারে নিমন্ত্রণ দিয়েছিলেন। সেখানে প্লেট প্রতি চাঁদা ছিল এক লাখ ডলার!
সবচেয়ে ভয়ের কথা তা হলো এ দেশের দু-চারজন ধনকুবের এবার প্রতিজ্ঞা করে বসেছেন, তাঁদের নিজেদের পছন্দের প্রার্থী পাস করিয়ে আনতে যত টাকা লাগে, তাঁরা ঢালবেন। তাঁদের মধ্যে ১ নম্বরে রয়েছেন টেক্সাসের দুই তেল ব্যবসায়ী—চার্লস ও ডেভিড কোক। তাঁরা নিজেরাই ৯০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করার কথা ঘোষণা করেছেন। আরেক বিলিয়নিয়ার, ক্যাসিনো মালিক সেল্ডন এডেলসনও জানিয়েছেন, হিলারিকে হারাতে তিনি মানিব্যাগ খুলে ধরতে পিছপা হবেন না। গত নির্বাচনে তিনি ব্যয় করেছিলেন প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার, এবার খরচ তার চেয়ে কয়েক গুণ হবে, তা নিশ্চিত।
ফলে বিস্ময়ের কিছু নেই, বিলিয়নিয়ার-মিলিয়নিয়ারদের পেছনে করজোড়ে লাইন দিচ্ছেন দুই দলের প্রত্যেক প্রার্থী। একমাত্র ব্যতিক্রম ভারমন্ট থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। এই স্বঘোষিত সমাজতন্ত্রী কোনো সুপার প্যাকের পয়সা নেবেন না। বলেছেন, যে চাঁদা তুলবেন, তার সবটাই আসবে সাধারণ মানুষের দেওয়া দশ-বিশ ডলার থেকে। নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণার প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সিনেটর স্যান্ডার্স তুলেছেন ১২ লাখ ডলার, চার দিনে ৪০ লাখ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ চাঁদার পরিমাণ ছিল ৪৩ ডলার।
তবে স্যান্ডার্স ২০১৬ মালের নির্বাচনে জিতে আসবেন, এ কথা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাহলে তিনি সম্ভবত মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। কেন, তা জানার জন্য আমাদের শুনতে হবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এই দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে কী ভাবেন। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ‘সিটিজেন ইউনাইটেড’-এর পক্ষে রায় ঘোষণার পর কার্টার ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা। আর তার একমাত্র কারণ হলো অর্থের অর্গলহীন আমদানি।
‘ডেমোক্রেসি’ নয়, এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার নাম যথার্থই ‘ডলারোক্রেসি।’
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
আমেরিকায় কেন, অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশেই নির্বাচন মানেই টাকার খেলা! আপনি যত অভিজ্ঞ ও যোগ্য প্রার্থী হন না কেন, বস্তাবোঝাই টাকা না থাকলে নির্বাচনে জেতা আপনার পক্ষে অসম্ভব। তবে এ কাজে অন্য সবাইকে টেক্কা দিয়েছে মার্কিনরা। তারা নিজেদের বিশ্বের সেরা গণতান্ত্রিক মডেল হিসেবে পরিচয় করাতে ভালোবাসে। কিন্তু এই দেশে, আর যা-ই হোক, টাকা না থাকলে নির্বাচনে জেতা অসম্ভব। সে কারণে এখানে গণতন্ত্রের নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডলারোক্রেসি’।
টাকা দিয়ে কীভাবে নির্বাচন জেতা বা হারা যায়, তার সেরা উদাহরণ বারাক ওবামা। ২০০৮ সালে অভাবনীয় জনপ্রিয়তার জোয়ারে ওবামা প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই জনপ্রিয়তাকে নির্বাচনী বিজয়ে পরিণত করা সম্ভব হয় টাকার জোরে। এ দেশে সরকারি তহবিল থেকে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের আইন রয়েছে। ২০০৮ সালে ওবামা চাইলে সরকারি তহবিল থেকে ৮৪ মিলিয়ন ডলার পেতে পারতেন। কিন্তু শর্ত ছিল, এর বাইরে এক পয়সাও তোলা যাবে না। ওবামা আগাগোড়া বলে এসেছেন তিনি সরকারি তহবিল নিয়েই নির্বাচন করবেন। কিন্তু যেই টের পেলেন, দশ-বিশ ডলার করে হলেও বিস্তর চাঁদা তোলার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে, অমনি জানিয়ে দিলেন, সরকারি তহবিল নিয়ে তিনি নির্বাচন করবেন না। যুক্তি দেখালেন, তাঁর প্রতিপক্ষ জন ম্যাককেইনের হয়ে রিপাবলিকান দল দেদার চাঁদা তুলছে। তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার এ ছাড়া অন্য পথ নেই। সে বছরের নির্বাচনে ওবামা একাই ৭৫০ মিলিয়ন ডলার চাঁদা তুলেছেন।
বলা যায়, সেদিন থেকেই আমেরিকায় সরকারি খরচে জাতীয় নির্বাচনের ধারণার মৃত্যু হয়।
কথাটা হয়তো পুরোপুরি সত্য হলো না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বরাবরই ধনীদের পক্ষে গেছে। একদম প্রথম দিকের প্রেসিডেন্টদের বেলাতেও কথাটা সত্যি। এ দেশে পাঁচ-দশজন অতি ধনী এককাট্টা হয়ে বরাবরই ঠিক করে দিয়েছেন কে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন। ব্যাপারটা এতটা দৃষ্টিকটু হয়ে পড়ে যে ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে ‘পাবলিক ফিন্যান্সিং’-এর আইন প্রস্তাব করেন। এই আইন অনুসারে প্রত্যেক নাগরিকের ওপর ধার্য করা হয় নির্বাচনে ব্যয় নির্বাহের জন্য নামমাত্র কর। রাজনৈতিক প্রার্থী বা দলের জন্য চাঁদা দেওয়া নিষিদ্ধ নয়, তবে কে কী পরিমাণ চাঁদা দেবেন, তার সর্বোচ্চ হার বেঁধে দিয়ে একাধিক আইন পাস হয়েছে এই দেশে।
অবস্থাটা নাটকীয়ভাবে বদলে যায় ২০১০ সালে। সে বছর এ দেশের সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত দেন, যার যা খুশি চাঁদা দেওয়াটা তার শাসনতান্ত্রিক অধিকার। এর নাম নাকি ‘ফ্র স্পিচ!’ বড় বড় করপোরেশনেরও মুখ খুলে কথা বলার বা পকেট ঝেড়ে চাঁদা দেওয়ার—অধিকার আছে। ব্যস, হয়ে গেল। তখন থেকেই যথেচ্ছ চাঁদা তোলার জন্য তথাকথিত ‘সুপার পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি’ হাড্ডাহাড্ডি লড়াইেয় নেমে পড়ল। ২০১২ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে এই ‘সুপার প্যাক’-এর নেতৃত্বে এ দেশের নির্বাচনে কেনাবেচার তেজারতি হয় কোনো রাখঢাক ছাড়াই।
২০১৬ সালের নির্বাচনেও সেই একই মাদারির খেল হবে, তবে টাকার অঙ্কটা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি।
আমেরিকার রাজনীতিতে টাকার ভূমিকা কী রকম ভয়াবহ, সে কথা সবচেয়ে স্পষ্ট বলেছেন খোদ ওবামা। কেনেথ ভোগেলের নতুন বই বিগ মানিতে ২০১২ সালের একটি ঘটনা বলা হয়েছে। ওবামা তাঁর নিজের সমর্থকদের এক তহবিল সংগ্রহ ডিনারে আমন্ত্রণ করেছিলেন। সেখানে প্লেটপ্রতি দাম ধরা হয়েছিল ১৭ হাজার ৯০০ ডলার। ডেমোক্রেটিক পার্টির বাঘা বাঘা দেনেওয়ালা সেখানে উপস্থিত। মাইক্রোসফটের বিল গেটসের দিকে তাকিয়ে ওবামা বললেন, ‘দেখুন, এখন আমরা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছি, যখন মাত্র শ দুয়েক লোক একটা জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করতে পারেন। অবস্থা যদি না বদলায়, তাহলে সম্ভবত আমিই হব শেষ প্রেসিডেন্ট, যে মোটা চাঁদা ছাড়াই নির্বাচনে জিতেছে। আমি মোটা টাকার চাঁদা পেয়েছি বটে, কিন্তু অধিকাংশ চাঁদাই এসেছে তৃণমূল থেকে, অল্প টাকার চাঁদা।’
২০১২ সালে তাঁর পুনর্নির্বাচনে ওবামা ছোট-বড় অঙ্ক মিলিয়ে এক বিলিয়ন ডলারের অধিক চাঁদা তুলতে সক্ষম হন। অন্যদিকে তাঁর প্রতিপক্ষ মিট রমনি তোলেন সোয়া বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে যদি ‘সুপার প্যাক’-এর চাঁদা ধরা হয়, সেখানেও রমনি ওবামার তুলনায় কম করে হলেও এক শ মিলিয়নের অধিক চাঁদা তোলেন। তারপরও যে শেষ পর্যন্ত ওবামা জিতলেন, রমনি নন, তার কারণ অবশ্য স্বতন্ত্র। তবে টাকার হিসাবে তিনি যে রমনি থেকে খুব পিছিয়ে ছিলেন না, সেটি তঁার বিজয়ের অন্যতম কারণ, সে কথাতেও কোনো সন্দেহ নেই।
২০১৬ সালের নির্বাচনে এই টাকার খেল যে অন্য যেকোনো সময়কে ছাড়িয়ে যাবে, তার সব লক্ষণ বর্তমান। এখনো দুই দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী চূড়ান্ত হয়নি, তবে ডেমোক্রেটিক দলের হয়ে হিলারি ও রিপাবলিকানদের জেব বুশ যাঁর যাঁর দলের প্রধান দাবিদার হয়ে উঠেছেন। তাঁরা দুজনের কেউই জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেননি, আপাতত সব শক্তি ও মেধা নিয়োগ করেছেন টাকা তোলায়। যত পারো টাকা তোলো। নিজেরা সরাসরি তুলতে না পারলে যার যার সুপার প্যাকের মাধ্যমে তাঁরা টাকা তুলছেন।
ব্যাপারটা কী রকম নির্লজ্জ আকার নিয়েছে, তা জেব বুশের সাম্প্রতিক আবেদনপত্র থেকেই ঠাওর করা যায়। নিজ সমর্থকদের এক চিঠিতে তিনি সরাসরি বলেছেন, আপনারা প্রত্যেকে এক মিলিয়ন ডলার করে চাঁদা দিন। টাকাটা যাবে তাঁর সুপার প্যাকের তহবিলে। মজার ব্যাপার হলো বুশ এখনো নিজের প্রার্থিতাই ঘোষণা করেননি। শর্ত আছে, কোনো ঘোষিত প্রার্থী তাঁর সুপার প্যাকের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে চাঁদা তুলতে পারবেন না। এই নামমাত্র নিয়ন্ত্রণ মাথায় রেখে আনুষ্ঠানিক প্রার্থী পদ ঘোষণার আগে বুশ দুই হাতে টাকা কুড়াচ্ছেন।
একই কথা হিলারি সম্বন্ধেও। তাঁর টার্গেট আড়াই বিলিয়ন ডলার চাঁদা তোলা। গত নির্বাচনে ওবামা ও রমনি মিলে ঠিক এই পরিমাণ চাঁদা তুলেছিলেন। হিলারিকে এই কাজে মদদ দিচ্ছেন স্বামী বিল ক্লিনটন। হিলারির সুপার প্যাকের মাধ্যমে নতুন-পুরোনো বন্ধুদের কাছে মাথার টুপিটি বাড়িয়ে বসে আছেন তাঁরা দুজনেই। কিছুদিন আগে নিউইয়র্কে এসেছিলেন হিলারি ‘ফান্ড রেইজিং ডিনারে’, সেখানে প্লেটপ্রতি চাঁদা ছিল ৫০ হাজার ডলার। জেব বুশ অবশ্য তাঁর চেয়ে এক কাঠি সরেস। তিনিও নিউইয়র্কে এসে ওয়াল স্ট্রিটের টাকার কুমিরদের ডিনারে নিমন্ত্রণ দিয়েছিলেন। সেখানে প্লেট প্রতি চাঁদা ছিল এক লাখ ডলার!
সবচেয়ে ভয়ের কথা তা হলো এ দেশের দু-চারজন ধনকুবের এবার প্রতিজ্ঞা করে বসেছেন, তাঁদের নিজেদের পছন্দের প্রার্থী পাস করিয়ে আনতে যত টাকা লাগে, তাঁরা ঢালবেন। তাঁদের মধ্যে ১ নম্বরে রয়েছেন টেক্সাসের দুই তেল ব্যবসায়ী—চার্লস ও ডেভিড কোক। তাঁরা নিজেরাই ৯০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করার কথা ঘোষণা করেছেন। আরেক বিলিয়নিয়ার, ক্যাসিনো মালিক সেল্ডন এডেলসনও জানিয়েছেন, হিলারিকে হারাতে তিনি মানিব্যাগ খুলে ধরতে পিছপা হবেন না। গত নির্বাচনে তিনি ব্যয় করেছিলেন প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার, এবার খরচ তার চেয়ে কয়েক গুণ হবে, তা নিশ্চিত।
ফলে বিস্ময়ের কিছু নেই, বিলিয়নিয়ার-মিলিয়নিয়ারদের পেছনে করজোড়ে লাইন দিচ্ছেন দুই দলের প্রত্যেক প্রার্থী। একমাত্র ব্যতিক্রম ভারমন্ট থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। এই স্বঘোষিত সমাজতন্ত্রী কোনো সুপার প্যাকের পয়সা নেবেন না। বলেছেন, যে চাঁদা তুলবেন, তার সবটাই আসবে সাধারণ মানুষের দেওয়া দশ-বিশ ডলার থেকে। নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণার প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সিনেটর স্যান্ডার্স তুলেছেন ১২ লাখ ডলার, চার দিনে ৪০ লাখ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ চাঁদার পরিমাণ ছিল ৪৩ ডলার।
তবে স্যান্ডার্স ২০১৬ মালের নির্বাচনে জিতে আসবেন, এ কথা যদি কেউ ভেবে থাকেন, তাহলে তিনি সম্ভবত মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। কেন, তা জানার জন্য আমাদের শুনতে হবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার এই দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে কী ভাবেন। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ‘সিটিজেন ইউনাইটেড’-এর পক্ষে রায় ঘোষণার পর কার্টার ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ নির্বাচনী ব্যবস্থার একটা। আর তার একমাত্র কারণ হলো অর্থের অর্গলহীন আমদানি।
‘ডেমোক্রেসি’ নয়, এ দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার নাম যথার্থই ‘ডলারোক্রেসি।’
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments