মুক্তিযুদ্ধ: বাংলাদেশের অভ্যুদয় by প্রণব মুখার্জি
সম্প্রতি ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে পরিচিত কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা প্রণব মুখার্জির বই ‘দি ড্রামেটিক ডিকেড দি ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স প্রকাশ করেছে দিল্লির রুপা পাবলিকেশন্স। এ বইয়ের একটি অধ্যায় ‘মুক্তিযুদ্ধ: দি মেকিং অব বাংলাদেশ’-এর অবিকল তরজমা...
(প্রথম কিস্তি)
১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ই আগস্টের মধ্যরাত। ভারত ভাগ হয়ে জন্ম নিলো ভারত ও পাকিস্তান। দুই উপমহাদেশীয় প্রতিবেশী লক্ষণীয় দুই রাজনৈতিক ধারায় চিহ্নিত হলো। ভারতে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার মশাল গেল পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর হাতে, যিনি আধুনিক ভারতের রূপকার। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৬৪ সালের ২৭শে মে তিনিই ভারতকে নেতৃত্ব দেন। ভারতের জন্য একটি সুন্দর সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে তিনি আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রশাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীনতার ৫ বছরের মধ্যে শাসক নির্বাচনের অধিকার জনগণের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছিল এবং তারা তাদের এই অধিকার ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রয়োগ করলো। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে এই নির্বাচন পরিচালনা করলো।
ভারতে আধুনিক গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠা করার পরে নেহরু আধুনিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাও সূচনা করেছিলেন এবং তিনি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। এটা শিগগিরই ঔপনিবেশিকতাবাদবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হলো। এর ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে স্বাধীনতার দাবি ছড়িয়ে পড়লো। এভাবেই ভারত তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলো।
১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যুর পরে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হলো। একজন ক্যারিশমেটিক নেতার মৃত্যুর পরে এই শূন্যতা সৃষ্টি ছিল অনিবার্য। ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেস বিরাটভাবে হেরে গেল। ওই নির্বাচনে কংগ্রেস যদিও লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারলো কিন্তু বিপুল সংখ্যক রাজ্যে তাকে হারতে হলো। একাধিক রাজনৈতিক দল আঞ্চলিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠলো। সংগঠনগত দ্বন্দ্ব যা নেহরুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছিল, সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে জাতীয় কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হলো।
এরপরই এল ইন্দিরা গান্ধীর সাহসী নেতৃত্ব। তার নেতৃত্বে কংগ্রেস ডিএমকে ও সিপিআই’র মতো দলগুলোর সহায়তায় কংগ্রেস ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো। লোকসভায় পেল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ১৯৭২ সালে তারা বহু রাজ্যে বিধানসভা ফিরে পেল, যা তারা আগে হারিয়েছিল।
ভারতে যখন এই ঘটনা ঘটে চলছে, তখন পূর্ব পাকিস্তান অতি গুরুত্ববহ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পাকিস্তানের প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।
গণতন্ত্র ও নির্বাচনের দিক থেকে বছরটি (১৯৭১) পাকিস্তানের জন্য ইতিবাচকভাবেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু বছরটি শেষ হলো দেশটি দু’টুকরো হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৬শ’ কি.মি ভারতের ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন থাকা দেশটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামের দুটি দেশে পরিণত হলো।
তবে একটি অন্তর্নিহিত সংঘাত যেটা ছিল, সেটা হলো স্যার রেডক্লিফের রেখা দ্বারা নির্দিষ্ট পাকিস্তানের সত্তা। জন্মের সময়েই সেটা পরিষ্কার ছিল। আর নবগঠিত রাষ্ট্রের পরবর্তীকালের রাজনীতির ধারায় ওই সংঘাত আরও বৃদ্ধি পেল। পশ্চিম পাকিস্তান ছিল জনসংখ্যাগত দিক থেকে সংখ্যালঘু, অথচ রাজস্ব আয়ের বেশির ভাগটাই চলে যেত সেখানে, যার কারণে তারা ওই অংশে শিল্প, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং কৃষি সংস্কার করেছে। কেবল তাই নয়, পাঞ্জাবি ও আফগানিরা পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা প্রায় সেখানে বাদ পড়েছিলেন। তবে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাই কেবল পূর্ব পাকিস্তানের মনস্তত্ত্বকে আঘাত দেয়নি, সেখানে জাতিগত ও ভাষাগত বৈষম্যও ছিল। তাই সেই বিভক্তি, তখন, কি অনিবার্য না হয়ে পারে?
বাংলার রাজনীতি বিশেষ করে মুসলিম রাজনীতিক ও আইন প্রণেতারা যেটা পালন করেছিলেন, সেটা এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। এটা ভালো করে বুঝতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে দেয়া অধিকারমতে ১৯৩৭ সালে গোটা ভারত জুড়ে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। কংগ্রেস পাঁচটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো। আগ্রার অবিভক্ত প্রদেশ, উধ (উত্তর প্রদেশ), সেন্ট্রাল প্রভিসেন্স ও বেরার (বর্তমানে মধ্যপ্রদেশ), বিহার, উড়িশ্যা এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি (এখানে সকল আসনের ৭৪ ভাগ প্রাপ্তি, যা জাস্টিস পার্টিকে ছাড়িয়ে গেল)। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস ছোট দলের সমর্থনে সরকার গড়তে সক্ষম হলো। একইভাবে, বম্বেতে কংগ্রেস অল্পের জন্য অর্ধেক আসন পেল না, তবে সেখানেও কংগ্রেসপন্থি ছোট গ্রুপের সমর্থনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হলো। বেঙ্গল, আসাম ও পাঞ্জাব একটি অনিষ্পত্তিমূলক রায় পেল। যদিও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ে বিপুল সংখ্যক আসনে জয় পেল। সিন্ধে সিন্ধ ইউনাইটেড পার্টি স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ পেল।
বেঙ্গলে কংগ্রেস পেল ৫২ আসন। মুসলিম লীগ পেল ৩৯ আসন। একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি পেল ৩৬ আসন। এই বিভক্ত গণরায়ের কারণে একে ফজলুল হক প্রথমে কংগ্রেসের সমর্থনে একটি কোয়ালিশন সরকার গড়ার চেষ্টা করলেন। তিনি মুসলিম লীগের চেয়ে কংগ্রেসে এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে জোট গড়তেই মনস্থির করেছিলেন। যদিও শরৎ চন্দ্র বোস, যিনি ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বোসের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও বেঙ্গলের একজন বিশিষ্ট নেতা এবং কংগ্রেস পরিষদ দলের নেতা ফজলুল হকের সঙ্গে কোয়ালিশনে যেতে রাজি হলেন। কিন্তু কোন যৌথ কর্মসূচির বিষয়ে কোন মতৈক্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। ক্রুদ্ধ একে ফজলুল হক তখন এর পরিবর্তে মুসলিম লীগের সমর্থন চাইলেন।
‘‘এভাবেই কৃষক প্রজা পার্টি-মুসলিম লীগের কোয়ালিশন সরকার, তফসিলি সম্প্রদায় ও কতিপয় স্বতন্ত্র উচ্চ বর্ণের হিন্দু এমএলএ’র সমর্থনে ক্ষমতায় এলেন। মুসলিম লীগ বাঙালির মুসলিম জনগণের উপর তার সমর্থন বিস্তারে সরকারি কর্তৃত্বের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করলো। হক সাহেবও কোণঠাসা হলেন। এর ফলে শিগগিরই তার অনুসারী নিয়ে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দিলেন। কিন্তু বাস্তবে প্রত্যেকের স্বার্থ রক্ষায় তার যে উদ্বেগ ছিল এবং যা তার সরকারকে সমর্থন যোগাতো সেখানে হক নিজেই সরকারের ভেতরে সংখ্যালঘুতে পরিণত হলেন। এর ফলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা যায়নি, এনিয়ে তার দল কেপিপি’র মধ্যে দেখা দিলো অসন্তোষ। ১৯৩৮ সালের মার্চ পর্যন্ত কেপিপি’র সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা তাদের প্রতিবাদ জানাতে অ্যাসেম্বলিতে বিরোধী দলের সঙ্গে বসলেন... হক উপলব্ধি করলেন যে, তিনি কেবল জিন্নাহর সমর্থনেই তার মন্ত্রণালয় টেকাতে পারেন। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে মুসলিম লীগের লক্ষ্নৌ সম্মেলনের বার্ষিক অধিবেশনে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দিলেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে যদিও তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে একাত্ম হলেন, কিন্তু ভূস্বামী অধ্যুষিত ওই দলটিতে তিনি কখনও প্রীতবোধ করেননি।’’ (নিতীশ কে, সেনগুপ্ত, হিস্ট্রি অব দ্যা বেঙ্গলি স্পিকিং পিপল (নিউ দিল্লি, ২০০১, পৃ. ৪২৬-২৭)
ফজলুল হকের একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ছিল। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে তিনি বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে তিনি প্রথম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (মুসলিম লীগে যোগদানের অল্প পরেই) হয়েছিলেন। কিন্তু এই সরকার তার মেয়াদ পুরো করতে পারেনি। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে তার সরকারটি ভেঙে পড়েছিল। ১৯৪০ সালে যদিও তিনি মুসলিম লীগ কাউন্সিলে বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাব (যদিও পরে তা একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল) তুলেছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি পাকিস্তানের জন্য একটি আলাদা ভূখণ্ডের প্রস্তাব সমর্থন করেননি। এর ফলে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা মুসলিম লীগের সামনে তার দল হেরে গিয়েছিল।
বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফজলুল হকের অনন্য অবদান হচ্ছে বাংলার চাষীদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারা। মহাজনদের কবল থেকে বাংলার কৃষকদের উদ্ধারে তিনি ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করেছিলেন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, ফজলুল হকের অবদানের কারণেই একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান ঘটেছিল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে তারাই বাংলার রাজনীতির ভিত্তি হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনী রায়ে হোসেন মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দীর যোগ্য নেতৃত্ব এবং আবুল হাশিমের সাংগঠনিক সামর্থ্যের বিকাশ ঘটেছিল। ওই নির্বাচনের আগে সোহরাওয়ার্দী ফজলুল হকের কাছে একটা আপসরফা করতে চাইলেন। ৪০টি মুসলিম আসনের মনোনয়ন ভার ফজলুল হককে দেয়া হবে, যদি তিনি মুসলিম লীগ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হন। ফজলুল হক সরাসরি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং একটি পৃথক ইশতেহারের আওতায় তিনি নির্বাচনী লড়াইয়ে নামেন। এর ফলাফল ছিল স্পষ্ট। মুসলিম লীগ ১২১টি আসনের মধ্যে ১১৫টিতেই জয়লাভ করে। আর জাতীয়তাবাদী মুসলিম, ফজলুল হকের দল এবং কংগ্রেস (যদিও তারা সাধারণ আসনে ৯০টির মধ্যে ৮৭টিতে জয় পেয়েছিল) ধুয়ে মুছে যায়। সেই নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচনে লড়েছিল। তারা পায় তিনটি আসন। জ্যোতি বসু, রতনলাল ব্রাহ্মণ এবং রূপনারায়ণ রায় নির্বাচিত হন।
ওই ম্যান্ডেট সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী শিগগিরই সরকার গঠনে ব্রতী হননি। কারণ তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছিলেন যে, এধরনের একটি সরকারে জনগণের একটি বৃহৎ অংশ প্রতিনিধিত্বহীন থেকে যাবে। তাই তিনি কংগ্রেসকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার করার উদ্যোগ নিলেন। উভয় দলের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা এ জন্য বেশ চেষ্টা চালিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই চেষ্টা সফল হতে পারেনি। তাই ১৯৪৬ সালের ২৩শে এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের অপর সাত সদস্য এবং তফসিলি সম্প্রদায় ফেডারেশনের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। যোগেন মণ্ডলই ছিলেন ওই মন্ত্রিসভার একমাত্র হিন্দু মন্ত্রী। ঢাকার নওয়াব পরিবারের কোন প্রতিনিধিত্ব এতে ছিল না, কিন্তু এই মন্ত্রিসভায় বগুড়ার নওয়াব মোহাম্মদ আলী মন্ত্রিত্ব পেলেন। মন্ত্রীদের বেশির ভাগই ছিলেন উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত।
তবে সরকারের জন্য অন্ধকারতম মুহূর্ত এলো কয়েক মাস না যেতেই।
(প্রথম কিস্তি)
১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ই আগস্টের মধ্যরাত। ভারত ভাগ হয়ে জন্ম নিলো ভারত ও পাকিস্তান। দুই উপমহাদেশীয় প্রতিবেশী লক্ষণীয় দুই রাজনৈতিক ধারায় চিহ্নিত হলো। ভারতে ১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার মশাল গেল পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর হাতে, যিনি আধুনিক ভারতের রূপকার। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ১৯৬৪ সালের ২৭শে মে তিনিই ভারতকে নেতৃত্ব দেন। ভারতের জন্য একটি সুন্দর সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে তিনি আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রশাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীনতার ৫ বছরের মধ্যে শাসক নির্বাচনের অধিকার জনগণের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছিল এবং তারা তাদের এই অধিকার ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রয়োগ করলো। সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে এই নির্বাচন পরিচালনা করলো।
ভারতে আধুনিক গণতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠা করার পরে নেহরু আধুনিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাও সূচনা করেছিলেন এবং তিনি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে যোগ দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। এটা শিগগিরই ঔপনিবেশিকতাবাদবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হলো। এর ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে স্বাধীনতার দাবি ছড়িয়ে পড়লো। এভাবেই ভারত তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলো।
১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যুর পরে একটি রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হলো। একজন ক্যারিশমেটিক নেতার মৃত্যুর পরে এই শূন্যতা সৃষ্টি ছিল অনিবার্য। ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেস বিরাটভাবে হেরে গেল। ওই নির্বাচনে কংগ্রেস যদিও লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারলো কিন্তু বিপুল সংখ্যক রাজ্যে তাকে হারতে হলো। একাধিক রাজনৈতিক দল আঞ্চলিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠলো। সংগঠনগত দ্বন্দ্ব যা নেহরুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছিল, সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে জাতীয় কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হলো।
এরপরই এল ইন্দিরা গান্ধীর সাহসী নেতৃত্ব। তার নেতৃত্বে কংগ্রেস ডিএমকে ও সিপিআই’র মতো দলগুলোর সহায়তায় কংগ্রেস ১৯৭১ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো। লোকসভায় পেল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ১৯৭২ সালে তারা বহু রাজ্যে বিধানসভা ফিরে পেল, যা তারা আগে হারিয়েছিল।
ভারতে যখন এই ঘটনা ঘটে চলছে, তখন পূর্ব পাকিস্তান অতি গুরুত্ববহ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পাকিস্তানের প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।
গণতন্ত্র ও নির্বাচনের দিক থেকে বছরটি (১৯৭১) পাকিস্তানের জন্য ইতিবাচকভাবেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু বছরটি শেষ হলো দেশটি দু’টুকরো হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৬শ’ কি.মি ভারতের ভূখণ্ড দ্বারা বিচ্ছিন্ন থাকা দেশটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামের দুটি দেশে পরিণত হলো।
তবে একটি অন্তর্নিহিত সংঘাত যেটা ছিল, সেটা হলো স্যার রেডক্লিফের রেখা দ্বারা নির্দিষ্ট পাকিস্তানের সত্তা। জন্মের সময়েই সেটা পরিষ্কার ছিল। আর নবগঠিত রাষ্ট্রের পরবর্তীকালের রাজনীতির ধারায় ওই সংঘাত আরও বৃদ্ধি পেল। পশ্চিম পাকিস্তান ছিল জনসংখ্যাগত দিক থেকে সংখ্যালঘু, অথচ রাজস্ব আয়ের বেশির ভাগটাই চলে যেত সেখানে, যার কারণে তারা ওই অংশে শিল্প, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং কৃষি সংস্কার করেছে। কেবল তাই নয়, পাঞ্জাবি ও আফগানিরা পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা প্রায় সেখানে বাদ পড়েছিলেন। তবে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাই কেবল পূর্ব পাকিস্তানের মনস্তত্ত্বকে আঘাত দেয়নি, সেখানে জাতিগত ও ভাষাগত বৈষম্যও ছিল। তাই সেই বিভক্তি, তখন, কি অনিবার্য না হয়ে পারে?
বাংলার রাজনীতি বিশেষ করে মুসলিম রাজনীতিক ও আইন প্রণেতারা যেটা পালন করেছিলেন, সেটা এই প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। এটা ভালো করে বুঝতে হলে আমাদেরকে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে দেয়া অধিকারমতে ১৯৩৭ সালে গোটা ভারত জুড়ে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। কংগ্রেস পাঁচটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলো। আগ্রার অবিভক্ত প্রদেশ, উধ (উত্তর প্রদেশ), সেন্ট্রাল প্রভিসেন্স ও বেরার (বর্তমানে মধ্যপ্রদেশ), বিহার, উড়িশ্যা এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি (এখানে সকল আসনের ৭৪ ভাগ প্রাপ্তি, যা জাস্টিস পার্টিকে ছাড়িয়ে গেল)। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস ছোট দলের সমর্থনে সরকার গড়তে সক্ষম হলো। একইভাবে, বম্বেতে কংগ্রেস অল্পের জন্য অর্ধেক আসন পেল না, তবে সেখানেও কংগ্রেসপন্থি ছোট গ্রুপের সমর্থনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হলো। বেঙ্গল, আসাম ও পাঞ্জাব একটি অনিষ্পত্তিমূলক রায় পেল। যদিও কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ে বিপুল সংখ্যক আসনে জয় পেল। সিন্ধে সিন্ধ ইউনাইটেড পার্টি স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ পেল।
বেঙ্গলে কংগ্রেস পেল ৫২ আসন। মুসলিম লীগ পেল ৩৯ আসন। একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি পেল ৩৬ আসন। এই বিভক্ত গণরায়ের কারণে একে ফজলুল হক প্রথমে কংগ্রেসের সমর্থনে একটি কোয়ালিশন সরকার গড়ার চেষ্টা করলেন। তিনি মুসলিম লীগের চেয়ে কংগ্রেসে এবং অন্যান্য জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে জোট গড়তেই মনস্থির করেছিলেন। যদিও শরৎ চন্দ্র বোস, যিনি ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বোসের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ও বেঙ্গলের একজন বিশিষ্ট নেতা এবং কংগ্রেস পরিষদ দলের নেতা ফজলুল হকের সঙ্গে কোয়ালিশনে যেতে রাজি হলেন। কিন্তু কোন যৌথ কর্মসূচির বিষয়ে কোন মতৈক্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। ক্রুদ্ধ একে ফজলুল হক তখন এর পরিবর্তে মুসলিম লীগের সমর্থন চাইলেন।
‘‘এভাবেই কৃষক প্রজা পার্টি-মুসলিম লীগের কোয়ালিশন সরকার, তফসিলি সম্প্রদায় ও কতিপয় স্বতন্ত্র উচ্চ বর্ণের হিন্দু এমএলএ’র সমর্থনে ক্ষমতায় এলেন। মুসলিম লীগ বাঙালির মুসলিম জনগণের উপর তার সমর্থন বিস্তারে সরকারি কর্তৃত্বের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করলো। হক সাহেবও কোণঠাসা হলেন। এর ফলে শিগগিরই তার অনুসারী নিয়ে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দিলেন। কিন্তু বাস্তবে প্রত্যেকের স্বার্থ রক্ষায় তার যে উদ্বেগ ছিল এবং যা তার সরকারকে সমর্থন যোগাতো সেখানে হক নিজেই সরকারের ভেতরে সংখ্যালঘুতে পরিণত হলেন। এর ফলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা যায়নি, এনিয়ে তার দল কেপিপি’র মধ্যে দেখা দিলো অসন্তোষ। ১৯৩৮ সালের মার্চ পর্যন্ত কেপিপি’র সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা তাদের প্রতিবাদ জানাতে অ্যাসেম্বলিতে বিরোধী দলের সঙ্গে বসলেন... হক উপলব্ধি করলেন যে, তিনি কেবল জিন্নাহর সমর্থনেই তার মন্ত্রণালয় টেকাতে পারেন। ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বরে মুসলিম লীগের লক্ষ্নৌ সম্মেলনের বার্ষিক অধিবেশনে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দিলেন। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে যদিও তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিতে একাত্ম হলেন, কিন্তু ভূস্বামী অধ্যুষিত ওই দলটিতে তিনি কখনও প্রীতবোধ করেননি।’’ (নিতীশ কে, সেনগুপ্ত, হিস্ট্রি অব দ্যা বেঙ্গলি স্পিকিং পিপল (নিউ দিল্লি, ২০০১, পৃ. ৪২৬-২৭)
ফজলুল হকের একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ছিল। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে তিনি বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে তিনি প্রথম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী (মুসলিম লীগে যোগদানের অল্প পরেই) হয়েছিলেন। কিন্তু এই সরকার তার মেয়াদ পুরো করতে পারেনি। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে তার সরকারটি ভেঙে পড়েছিল। ১৯৪০ সালে যদিও তিনি মুসলিম লীগ কাউন্সিলে বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাব (যদিও পরে তা একটি পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল) তুলেছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি পাকিস্তানের জন্য একটি আলাদা ভূখণ্ডের প্রস্তাব সমর্থন করেননি। এর ফলে ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠা মুসলিম লীগের সামনে তার দল হেরে গিয়েছিল।
বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফজলুল হকের অনন্য অবদান হচ্ছে বাংলার চাষীদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারা। মহাজনদের কবল থেকে বাংলার কৃষকদের উদ্ধারে তিনি ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করেছিলেন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, ফজলুল হকের অবদানের কারণেই একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান ঘটেছিল এবং পরবর্তী বছরগুলোতে তারাই বাংলার রাজনীতির ভিত্তি হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনী রায়ে হোসেন মোহাম্মদ সোহরাওয়ার্দীর যোগ্য নেতৃত্ব এবং আবুল হাশিমের সাংগঠনিক সামর্থ্যের বিকাশ ঘটেছিল। ওই নির্বাচনের আগে সোহরাওয়ার্দী ফজলুল হকের কাছে একটা আপসরফা করতে চাইলেন। ৪০টি মুসলিম আসনের মনোনয়ন ভার ফজলুল হককে দেয়া হবে, যদি তিনি মুসলিম লীগ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হন। ফজলুল হক সরাসরি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং একটি পৃথক ইশতেহারের আওতায় তিনি নির্বাচনী লড়াইয়ে নামেন। এর ফলাফল ছিল স্পষ্ট। মুসলিম লীগ ১২১টি আসনের মধ্যে ১১৫টিতেই জয়লাভ করে। আর জাতীয়তাবাদী মুসলিম, ফজলুল হকের দল এবং কংগ্রেস (যদিও তারা সাধারণ আসনে ৯০টির মধ্যে ৮৭টিতে জয় পেয়েছিল) ধুয়ে মুছে যায়। সেই নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচনে লড়েছিল। তারা পায় তিনটি আসন। জ্যোতি বসু, রতনলাল ব্রাহ্মণ এবং রূপনারায়ণ রায় নির্বাচিত হন।
ওই ম্যান্ডেট সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী শিগগিরই সরকার গঠনে ব্রতী হননি। কারণ তিনি এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছিলেন যে, এধরনের একটি সরকারে জনগণের একটি বৃহৎ অংশ প্রতিনিধিত্বহীন থেকে যাবে। তাই তিনি কংগ্রেসকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার করার উদ্যোগ নিলেন। উভয় দলের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা এ জন্য বেশ চেষ্টা চালিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই চেষ্টা সফল হতে পারেনি। তাই ১৯৪৬ সালের ২৩শে এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের অপর সাত সদস্য এবং তফসিলি সম্প্রদায় ফেডারেশনের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। যোগেন মণ্ডলই ছিলেন ওই মন্ত্রিসভার একমাত্র হিন্দু মন্ত্রী। ঢাকার নওয়াব পরিবারের কোন প্রতিনিধিত্ব এতে ছিল না, কিন্তু এই মন্ত্রিসভায় বগুড়ার নওয়াব মোহাম্মদ আলী মন্ত্রিত্ব পেলেন। মন্ত্রীদের বেশির ভাগই ছিলেন উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত।
তবে সরকারের জন্য অন্ধকারতম মুহূর্ত এলো কয়েক মাস না যেতেই।
No comments