বিএনপি ভোটে শক্তিশালী সংগঠনে বিপর্যস্ত by নজরুল ইসলাম
দলের
সক্রিয় কর্মী, নীরব সমর্থক এবং সরকারবিরোধী নেগেটিভ ভোটে বিএনপি অনেকটা
এগিয়ে রয়েছে। এমন তথ্যের প্রমাণ মিলেছে বিগত বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার
নির্বাচনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভোটের আন্দোলনে মাঠে বিএনপি ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগের কাছে বারবারই মার খাচ্ছে। ফলে ভোটের মাঠে পাস করলেও আন্দোলনের
মাঠে দলটির ফলাফল বড়ই হতাশাজনক। পদে পদে দলের ভুল সিদ্ধান্ত এবং সাংগঠনিক
দুর্বলতার কারণেই এমনটা ঘটছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে
বিএনপির আন্দোলন সফল না হওয়ার পেছনে সাংগঠনিক দুর্বলতা ছাড়াও সরকারের কঠোর
মনোভাবই মূল কারণ বলে মনে করেন দলটির নীতিনির্ধারক মহল। এ রকম অবস্থায়
পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, অনেকগুলো ভুলের খেসারত হিসেবে কয়েক দফায় সরকার
পরিচালনার স্বাদ গ্রহণ করা বৃহত্তম এই দলটি এখন ঘরে-বাইরে তীব্র সমস্যার
মধ্যে রয়েছে।
এদিকে দলীয় সূত্র জানিয়েছে, দলের এই কঠিন সময়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকা এবং নেতায় নেতায় সন্দেহ-অবিশ্বাস ও বৈরিতার চিত্রও কম নয়। বিশেষ করে যে কোনো নির্বাচন বা দলের কমিটি গঠনের প্রসঙ্গ এলেই পর্দার আড়ালের এসব নেতিবাচক দৃশ্য বাইরে চলে আসে। এসব কারণে এখন পর্যন্ত দলের মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদটিও ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালানো হচ্ছে। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল ভারমুক্ত মহাসচিব পদে কাউকে বসাতে পারেনি। একই পথে আটকা পড়েছে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর কমিটিও। এখানে আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটির দেখা মিলছে না।
পরিস্থিতি উত্তরণের পথ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, এখন সবকিছুর আগে সংগঠনকে কার্যকরভাবে শক্তিশালী করতে হবে। কেননা সংগঠন শক্তিশালী না হলে সব আন্দোলন বিফলে যাবে। এরপরও বিদ্যমান পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। তবে যোগ্যতম তরুণ নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপিতে বর্তমানে এ রকম নেতৃত্বের প্রবল ঘাটতি রয়েছে। তাই তরুণ নেতৃত্ব খুবই প্রয়োজন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির সক্রিয়, নীরব ও সরকারবিরোধী ভোটের বড় একটি অংশ তাদের পক্ষে রয়েছে। এ কারণে বিএনপি ভোটের মাঠে বেশ শক্তিশালী। তবে সাংগঠনিকভাবে অনেকটা দুর্বল হওয়ায় তারা ভোটের ফলাফল ঘরে তুলতে পারছে না। তিনি বলেন, আসলে বর্তমানে তাদের নেতৃত্ব দেয়ার মতো গ্রহণযোগ্য নেতা নেই। বেশির ভাগ নেতাই কারাগারে। আর যারা বাইরে আছেন তারা মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এছাড়া বাকি অংশ মামলা এড়াতে সব ধরনের দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে আছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহলের অনেকে মনে করেন, বাংলা ভাইসহ জঙ্গি সংগঠন জেএমবিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া, সরকারের ভেতরে-বাইরে অনেকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির প্রবল অভিযোগ ২০০১-২০০৬ মেয়াদের শেষদিকে বিএনপিকে খুব দুর্বল করে ফেলে। এতে করে জনসমর্থন কম থাকে। এরপর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক করতে গিয়ে আরও বেকায়দায় পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই সময় বিএনপির প্রথম সারির বেশির ভাগ নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। এতে করে দলটির জনসমর্থন অনেকটা কমে আসে। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় সেনা সমর্থিত দুবছর মেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্কিত হয়ে পড়ে এবং ক্রমেই সাধারণ মানুষ ওই সরকারের ওপর তিক্ত ও বিরক্ত হতে থাকে। অনেকে সে সময় ক্ষুব্ধ হয়ে একথাও বলেন যে, বিএনপির ভুলের কারণে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্ম হয়েছে। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় এবং বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দুবছরের মধ্যে নানা কারণে আওয়ামী লীগ সরকারও বিতর্কিত হতে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ অনেক উন্নয়ন করলেও সুশাসন নিশ্চিত না হওয়ায় সরকারের প্রতি জনসমর্থনের চিত্র পাল্টাতে থাকে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের এ রকম আশংকা সত্যি হিসেবে প্রমাণিত হয় সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে এসে ছয়টি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের বিজয় জানান দিতে সক্ষম হয় যে, ভিতরে ভিতরে বিএনপির ভোট বেড়েছে। কেউ কেউ এই ভোটের পরিসংখ্যানকে এভাবে দেখতে চান যে, বিএনপি সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা যে ভোট পেয়েছেন তার পুরোটা তাদের ভোট নয়। মূলত প্রাপ্ত ভোটের একটি অংশ তাদের কর্মী-সমর্থকদের। বাকি ভোটের অর্ধেক নীরব ভোট ও সরকারের প্রতি নানা কারণে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষের নেগেটিভ ভোট।
এদিকে এ রকম একটি শুভ বার্তা পাওয়ার পরও বিএনপি গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। দলের হাইকমান্ডের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মতবিরোধ আছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিরাট ভুল করেছে। নির্বাচনে অংশ নিলেই মাঠের চিত্র নির্ঘাত পাল্টে যেত। আর সব আশার ঝাঁপি ছাপিয়েও যদি নিন্দুকদের আশংকা সত্যি হতো, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসত, তাহলে তো বিএনপি আজ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে থাকতে পারত। আর পরিস্থিতি সেরকম হলে আজ দলের এমন বেহাল দশা হতো না। সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করলে আন্দোলনে নামলে সে আন্দোলনের চেহারা বর্তমানের মতো নিশ্চয় হতো না। সবশেষে, গত তিন মাসের টানা আন্দোলন অর্জন নিয়েও দলের ভিতরে ও বাইরে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। কেউ বলতে চান সঠিক ছিল, কেউ বলেন, অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই আন্দোলন বিএনপিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষ করে পেট্রোলবোমা সন্ত্রাসের কথিত এই আন্দোলনে জামায়াত-শিবির প্রধান ভূমিকা পালন করলেও সব দায় এসে পড়েছে বিএনপির ঘাড়ে। এতে করে বিএনপির ভোটব্যাংক কিছুটা হলেও ক্ষতির মুখে পড়ে।
টানা আন্দোলনের এক্সিট রুট হিসেবে বিএনপি ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে অংশ নেয়ার সুযোগ পেলেও এখানে রাজনৈতিক লড়াইয়ের শেষ দৃশ্যে এসে ফলাফলটা ঘরে তুলতে পারেনি। নির্বাচনের আগে থেকে সুশীল সমাজের যারা ভোট পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছিলেন তাদের অনেকের ধারণা ছিল, বিএনপি তিন সিটির মধ্যে একটিতে জিততে পারে। আবার নাও পারে। কিন্তু ভোটের ফলাফল চিত্র সে জরিপকে অনেকটা ভুল প্রমাণিত করে দেয়। কেননা, গণকারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা দুপুর ১২টার মধ্যে তিন সিটির নির্বাচন বয়কট করলেও নীরব ভোটের চিত্র অবাক করার মতো। ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল পান ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। বিপরীতে বিএনপি সমর্থিত মির্জা আব্বাস পান ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আ জ ম নাছির ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মঞ্জুর আলম পান ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট। নির্বাচন শেষে ভোটের এই ফলাফল চিত্র দেখে অনেকের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। বিএনপি শিবিরে অনেককে আফসোসও করতে দেখা যায়। কেউ কেউ বলেন, ভোট কারচুপি হলেও বিএনপি ৩ সিটিতে না হলেও নীরব ভোটে দুই সিটিতে জিতে আসতে পারত।
এদিকে ভোটের এমন ফলাফল দেখে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, পর্দার আড়ালে ভোটের শক্তিতে বিএনপি এগিয়ে আছে। কিন্তু সে ভোট ঘরে তুলে আনার মতো সাংগঠনিক শক্তি দলটির নেই। এর প্রমাণও পদে পদে মিলেছে সদ্য শেষ হওয়া সিটি নির্বাচনে। অনেক ভোট কেন্দ্রে বিএনপি পোলিং এজেন্ট দিতেই পারেনি। আর শেষ পর্যন্ত যাদের দেয়া হয়েছিল তারা একেবারে দলের থার্ড ক্যারিয়ার হিসেবে পরিচিত। কেননা, দলের সক্রিয় ও সামর্থ্যবান নেতাকর্মীদের অনেকে হামলা-মামলার ভয়ে পালিয়ে আছেন। কিন্তু তারা মনে করেন, ২০০৯ সাল থেকেই বিএনপি যদি দল গোছানোর দিকে কার্যকর পদ্ধতিতে নজর দিতে পারত তাহলে আজ এমন বেহালদশা হতো না।
বিএনপির এমন পরিণতির বিষয়ে জানতে চাইলে সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিএনপির কোনো মালিকানা নেই। আছে শুধু পরিবারতন্ত্র এবং ভবিষ্যৎ পরিবারের দুই সদস্যের আজ্ঞার ওপর নির্ভর করে। সংগঠনে কোনো পেশাদারিত্ব নেই। অপকর্ম তো আছেই; যার কারণে দলটির নেতাকর্মীরা নৈতিকভাবে দুর্বল। তার মতে, এ দলটির সফলতা বলতে যা বুঝায় তা হচ্ছে সরকারি দলের ব্যর্থতা। তাই জনগণ তাদের সমর্থন করে। যদিও বিএনপিরও অনেক ব্যর্থতা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সরকারের চেয়ে যারা আন্দোলন করে তাদের বেশি গণতান্ত্রিক হতে হয়। কিন্তু বিএনপিতে তো সেটা নেই। তাহলে কেন জনগণ তাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে? তিনি বলেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে দলটির জন্ম। এছাড়া বিএনপি কোনো ক্যাডারভিত্তিক দল নয়। এ কারণে এ দলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত ধাপে ধাপে কোনো নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় না। বিএনপি সব সময়ই আওয়ামী লীগ বিরোধী এক নীরব জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করা একটি দল। তাই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ কোনো নির্বাচন হলে বিএনপি ভালো করবে বলে মনে করে দলটি। যদিও এখন তাদের কাক্সিক্ষত ফল পেতে সময় লাগবে। তিনি মনে করেন, তবে একটা সময় সাধারণ মানুষও সরকারের নানা ব্যর্থতার কারণে বিরক্ত হয়ে আন্দোলনে রাজপথে নামবে এবং বিস্ফোরণ ঘটবে বলে মনে করেন এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ মানুষ বিএনপিকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। এর বাস্তব প্রতিফলন সদ্য শেষ হওয়া তিন সিটি নির্বাচন। তার মতে, ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃংখলা বাহিনী দিয়ে জালভোট ও ভোটকেন্দ্রে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিএনপির অর্জন হাইজ্যাক করেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলাই তাদের প্রধান কাজ। এজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
এদিকে দলীয় সূত্র জানিয়েছে, দলের এই কঠিন সময়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় না থাকা এবং নেতায় নেতায় সন্দেহ-অবিশ্বাস ও বৈরিতার চিত্রও কম নয়। বিশেষ করে যে কোনো নির্বাচন বা দলের কমিটি গঠনের প্রসঙ্গ এলেই পর্দার আড়ালের এসব নেতিবাচক দৃশ্য বাইরে চলে আসে। এসব কারণে এখন পর্যন্ত দলের মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদটিও ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চালানো হচ্ছে। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল ভারমুক্ত মহাসচিব পদে কাউকে বসাতে পারেনি। একই পথে আটকা পড়েছে রাজধানী ঢাকা মহানগরীর কমিটিও। এখানে আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটির দেখা মিলছে না।
পরিস্থিতি উত্তরণের পথ হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, এখন সবকিছুর আগে সংগঠনকে কার্যকরভাবে শক্তিশালী করতে হবে। কেননা সংগঠন শক্তিশালী না হলে সব আন্দোলন বিফলে যাবে। এরপরও বিদ্যমান পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। তবে যোগ্যতম তরুণ নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। বিএনপিতে বর্তমানে এ রকম নেতৃত্বের প্রবল ঘাটতি রয়েছে। তাই তরুণ নেতৃত্ব খুবই প্রয়োজন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির সক্রিয়, নীরব ও সরকারবিরোধী ভোটের বড় একটি অংশ তাদের পক্ষে রয়েছে। এ কারণে বিএনপি ভোটের মাঠে বেশ শক্তিশালী। তবে সাংগঠনিকভাবে অনেকটা দুর্বল হওয়ায় তারা ভোটের ফলাফল ঘরে তুলতে পারছে না। তিনি বলেন, আসলে বর্তমানে তাদের নেতৃত্ব দেয়ার মতো গ্রহণযোগ্য নেতা নেই। বেশির ভাগ নেতাই কারাগারে। আর যারা বাইরে আছেন তারা মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এছাড়া বাকি অংশ মামলা এড়াতে সব ধরনের দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে আছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহলের অনেকে মনে করেন, বাংলা ভাইসহ জঙ্গি সংগঠন জেএমবিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া, সরকারের ভেতরে-বাইরে অনেকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির প্রবল অভিযোগ ২০০১-২০০৬ মেয়াদের শেষদিকে বিএনপিকে খুব দুর্বল করে ফেলে। এতে করে জনসমর্থন কম থাকে। এরপর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক করতে গিয়ে আরও বেকায়দায় পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ওই সময় বিএনপির প্রথম সারির বেশির ভাগ নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। এতে করে দলটির জনসমর্থন অনেকটা কমে আসে। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় সেনা সমর্থিত দুবছর মেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্কিত হয়ে পড়ে এবং ক্রমেই সাধারণ মানুষ ওই সরকারের ওপর তিক্ত ও বিরক্ত হতে থাকে। অনেকে সে সময় ক্ষুব্ধ হয়ে একথাও বলেন যে, বিএনপির ভুলের কারণে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্ম হয়েছে। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় এবং বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। কিন্তু দুবছরের মধ্যে নানা কারণে আওয়ামী লীগ সরকারও বিতর্কিত হতে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ অনেক উন্নয়ন করলেও সুশাসন নিশ্চিত না হওয়ায় সরকারের প্রতি জনসমর্থনের চিত্র পাল্টাতে থাকে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের এ রকম আশংকা সত্যি হিসেবে প্রমাণিত হয় সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে এসে ছয়টি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের বিজয় জানান দিতে সক্ষম হয় যে, ভিতরে ভিতরে বিএনপির ভোট বেড়েছে। কেউ কেউ এই ভোটের পরিসংখ্যানকে এভাবে দেখতে চান যে, বিএনপি সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা যে ভোট পেয়েছেন তার পুরোটা তাদের ভোট নয়। মূলত প্রাপ্ত ভোটের একটি অংশ তাদের কর্মী-সমর্থকদের। বাকি ভোটের অর্ধেক নীরব ভোট ও সরকারের প্রতি নানা কারণে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষের নেগেটিভ ভোট।
এদিকে এ রকম একটি শুভ বার্তা পাওয়ার পরও বিএনপি গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। দলের হাইকমান্ডের এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মতবিরোধ আছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিরাট ভুল করেছে। নির্বাচনে অংশ নিলেই মাঠের চিত্র নির্ঘাত পাল্টে যেত। আর সব আশার ঝাঁপি ছাপিয়েও যদি নিন্দুকদের আশংকা সত্যি হতো, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসত, তাহলে তো বিএনপি আজ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের আসনে থাকতে পারত। আর পরিস্থিতি সেরকম হলে আজ দলের এমন বেহাল দশা হতো না। সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করলে আন্দোলনে নামলে সে আন্দোলনের চেহারা বর্তমানের মতো নিশ্চয় হতো না। সবশেষে, গত তিন মাসের টানা আন্দোলন অর্জন নিয়েও দলের ভিতরে ও বাইরে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। কেউ বলতে চান সঠিক ছিল, কেউ বলেন, অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই আন্দোলন বিএনপিকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষ করে পেট্রোলবোমা সন্ত্রাসের কথিত এই আন্দোলনে জামায়াত-শিবির প্রধান ভূমিকা পালন করলেও সব দায় এসে পড়েছে বিএনপির ঘাড়ে। এতে করে বিএনপির ভোটব্যাংক কিছুটা হলেও ক্ষতির মুখে পড়ে।
টানা আন্দোলনের এক্সিট রুট হিসেবে বিএনপি ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে অংশ নেয়ার সুযোগ পেলেও এখানে রাজনৈতিক লড়াইয়ের শেষ দৃশ্যে এসে ফলাফলটা ঘরে তুলতে পারেনি। নির্বাচনের আগে থেকে সুশীল সমাজের যারা ভোট পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছিলেন তাদের অনেকের ধারণা ছিল, বিএনপি তিন সিটির মধ্যে একটিতে জিততে পারে। আবার নাও পারে। কিন্তু ভোটের ফলাফল চিত্র সে জরিপকে অনেকটা ভুল প্রমাণিত করে দেয়। কেননা, গণকারচুপির অভিযোগ এনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা দুপুর ১২টার মধ্যে তিন সিটির নির্বাচন বয়কট করলেও নীরব ভোটের চিত্র অবাক করার মতো। ঢাকা উত্তরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তাবিথ আউয়াল পান ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সাঈদ খোকন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। বিপরীতে বিএনপি সমর্থিত মির্জা আব্বাস পান ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আ জ ম নাছির ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এম মঞ্জুর আলম পান ৩ লাখ ৪ হাজার ৮৩৭ ভোট। নির্বাচন শেষে ভোটের এই ফলাফল চিত্র দেখে অনেকের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। বিএনপি শিবিরে অনেককে আফসোসও করতে দেখা যায়। কেউ কেউ বলেন, ভোট কারচুপি হলেও বিএনপি ৩ সিটিতে না হলেও নীরব ভোটে দুই সিটিতে জিতে আসতে পারত।
এদিকে ভোটের এমন ফলাফল দেখে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অনেকের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, পর্দার আড়ালে ভোটের শক্তিতে বিএনপি এগিয়ে আছে। কিন্তু সে ভোট ঘরে তুলে আনার মতো সাংগঠনিক শক্তি দলটির নেই। এর প্রমাণও পদে পদে মিলেছে সদ্য শেষ হওয়া সিটি নির্বাচনে। অনেক ভোট কেন্দ্রে বিএনপি পোলিং এজেন্ট দিতেই পারেনি। আর শেষ পর্যন্ত যাদের দেয়া হয়েছিল তারা একেবারে দলের থার্ড ক্যারিয়ার হিসেবে পরিচিত। কেননা, দলের সক্রিয় ও সামর্থ্যবান নেতাকর্মীদের অনেকে হামলা-মামলার ভয়ে পালিয়ে আছেন। কিন্তু তারা মনে করেন, ২০০৯ সাল থেকেই বিএনপি যদি দল গোছানোর দিকে কার্যকর পদ্ধতিতে নজর দিতে পারত তাহলে আজ এমন বেহালদশা হতো না।
বিএনপির এমন পরিণতির বিষয়ে জানতে চাইলে সুজনের (সুশাসনের জন্য নাগরিক) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিএনপির কোনো মালিকানা নেই। আছে শুধু পরিবারতন্ত্র এবং ভবিষ্যৎ পরিবারের দুই সদস্যের আজ্ঞার ওপর নির্ভর করে। সংগঠনে কোনো পেশাদারিত্ব নেই। অপকর্ম তো আছেই; যার কারণে দলটির নেতাকর্মীরা নৈতিকভাবে দুর্বল। তার মতে, এ দলটির সফলতা বলতে যা বুঝায় তা হচ্ছে সরকারি দলের ব্যর্থতা। তাই জনগণ তাদের সমর্থন করে। যদিও বিএনপিরও অনেক ব্যর্থতা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সরকারের চেয়ে যারা আন্দোলন করে তাদের বেশি গণতান্ত্রিক হতে হয়। কিন্তু বিএনপিতে তো সেটা নেই। তাহলে কেন জনগণ তাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবে? তিনি বলেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে দলটির জন্ম। এছাড়া বিএনপি কোনো ক্যাডারভিত্তিক দল নয়। এ কারণে এ দলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত ধাপে ধাপে কোনো নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় না। বিএনপি সব সময়ই আওয়ামী লীগ বিরোধী এক নীরব জনগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করা একটি দল। তাই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ কোনো নির্বাচন হলে বিএনপি ভালো করবে বলে মনে করে দলটি। যদিও এখন তাদের কাক্সিক্ষত ফল পেতে সময় লাগবে। তিনি মনে করেন, তবে একটা সময় সাধারণ মানুষও সরকারের নানা ব্যর্থতার কারণে বিরক্ত হয়ে আন্দোলনে রাজপথে নামবে এবং বিস্ফোরণ ঘটবে বলে মনে করেন এ রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ মানুষ বিএনপিকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। এর বাস্তব প্রতিফলন সদ্য শেষ হওয়া তিন সিটি নির্বাচন। তার মতে, ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃংখলা বাহিনী দিয়ে জালভোট ও ভোটকেন্দ্রে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিএনপির অর্জন হাইজ্যাক করেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলাই তাদের প্রধান কাজ। এজন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
No comments