ঘটনা দুটি—মূল কারণ একটাই by সৈয়দ আবুল মকসুদ
ঝিল থেকে ১২ লাশ উদ্ধার |
রামপুরা ঝিলপাড়ে দাঁড়িয়ে ধারণা হলো আমাদের একটি রাষ্ট্র আছে কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র নেই |
রামপুরার ঝিলপাড় এলাকায় দোতলা বস্তিঘর পানিতে দেবে মারা গেছে অন্তত ১৩ জন |
তাজ্জব
সব ঘটনা ঘটে বাংলার মাটিতে শুধু নয়, বাংলার পানিতেও। ঘটনা ও দুর্ঘটনা শুধু
বাংলার নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, পাহাড়-বনভূমিতে ঘটে তা-ই নয়, বাংলার
রাজধানীর সবচেয়ে বড় উদ্যানেও ঘটে, ঝিলের পানিতেও ঘটে। ব্যাবিলনের
শূন্যোদ্যানের কথা আমরা জানি, কিন্তু জলাশয়ের পানির ভেতর নড়বড়ে খাম্বার
ওপর বহু কামরাবিশিষ্ট দোতলা বাড়ি বানানোর কথা কখনো শুনিনি। জমিদার
পরিবারের মানুষ দেওয়ান হাসন রাজা দালানে থাকতেন। তা সত্ত্বেও বাউলা বলেছেন,
ঘরবাড়ি ভালা না আমার। জোতজমি বিষয়সম্পত্তি যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও তিনি
বলেছেন, কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার। অবশ্য সবাই শূন্যের মাঝারে ভালা
ভালা দোতলা বাড়ি বানাতে পারেন না। সরকারি দলের লোক হলে শূন্যের মাঝারেও
বাড়ি বানাতে পারেন, ঝিলের পানির ওপরেও দোতলা তুলতে পারেন। সে রকম একটি
দোতলা বাড়ি সেদিন ঝিলের পানির মধ্যে দেবে গেছে। তাতে অপমৃত্যু ঘটেছে
পৌনে ১৩ জনের।
ঘটনাস্থলে আমি একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম, লাশ উদ্ধার করা হয়েছে কয়টি। তিনি জানালেন, ১২ জন মারা গেছে। আমি তাঁকে বললাম, সংখ্যাটি সঠিক নয়, অপমৃত্যু ঘটেছে বা হত্যা করা হয়েছে পৌনে ১৩ জনকে। পৌনে ১৩ সংখ্যাটি শুনে তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি তাঁকে বোঝালাম: ১২+পৌনে ১ = পৌনে ১৩।
সবুজ মিয়ার স্ত্রী রোখসানা ছিলেন ছয় মাসের গর্ভবতী। অনাগত শিশুটি তার পেটে হাত-পা ছুড়ত।
ছেলে হোক মেয়ে হোক, সে তার সন্তানের একটি নামও ঠিক করে রেখেছিল। নাতনি বা নাতির জন্য পুরোনো কাপড় জোড়া দিয়ে সবুজের মা কিছু ছোট ছোট কাঁথাও সেলাই করে রেখে থাকবেন। কয়েক মাস পরেই শিশুটি পৃথিবীতে আসত। নিজের ভাড়া ঘরের ভেতরে বসে সবুজের বাবা-মা ও স্ত্রী ঝিলের পানিতে ডুবে মারা যান। তাঁদের সঙ্গে তাঁদের বংশধর জন্মের আগেই একটি নির্মম ভূখণ্ড থেকে বিদায় নিল।
রাতে মাথা গোঁজার জন্য সব মানুষেরই একটা ঘর চাই। সে ঘর হতে পারে কোনো বস্তির ঝুপড়ি অথবা অভিজাত এলাকায় কোনো বিলাসবহুল প্রাসাদ। প্রাসাদবাসীর যেমন প্রাসাদ, তেমনি বস্তিবাসীর কাছে তার ঝুপড়ি প্রিয়। বেকার হোক, নিষ্কর্মা হোক, কর্মজীবী হোক, দিনের একসময় তাকে ঘরে ফিরে আসতে হয়। ঝিলপাড়ের দোতলা বাড়ির বাসিন্দাদেরও অনেকে সেদিন দুপুরে ঘরে ফেরেন। কেউ ঘরেই আগে থেকে ছিলেন রান্নাবান্নার কাজে। প্রায় সবারই দুপুরের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কেউ খেয়ে বিছানায় একটু লম্বা হয়ে চোখ বুজেছিলেন। ওই চোখ বোজাই যে তাঁর শেষ চোখ বোজা হবে, তা জানতেন না। বিকেল পৌনে চারটা। মটমট কড়কড় আওয়াজ। দুলে ওঠে ঘরের মেঝে, যেমন ঢেউয়ের মধ্যে নদীতে নৌকার পাটাতন। কেউ একজন পান মুখে দিয়ে বলতে চান, ‘কেরা রে খুঁটি ধইর্যা টানা মারে—!’ তাঁর কথা শেষ করার আগেই পুরো একতলা পানির নিচে দেবে যায়। দোতলার বাসিন্দারা ছিলেন ভাগ্যবান। তাঁরা মিনিট খানেক সময় পান দৌড়ে বা লাফিয়ে আত্মরক্ষা করার।
রাতের খবরে দেখেছিলাম ফায়ার সার্ভিসের ত্রাণকর্মীদের উদ্ধার তৎপরতা।
পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা পানির জলাশয়। হাজার হাজার মানুষের মলমূত্রমিশ্রিত পানির রং আলকাতরার চেয়ে সামান্য বেশি কালো। সেই পানিতে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা লাশের সন্ধান করছেন। জলাশয়ের বিভিন্ন জায়গায় জলজ গুল্ম। গরিবের ঘরেও অনেক জিনিস থাকে। পানিতে ভাসছে প্লাস্টিকের বদনা, ফুটবল, শার্ট, লুঙ্গি, শাড়ি, স্যান্ডেল, টুপি, ব্লাউজ, হাতপাখা, বাসন, পেয়ালা, ভাঙা বালতি, হাতব্যাগ, ছেঁড়া মাদুর প্রভৃতি। প্রায় মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাওয়ায় পানির একদিকে ভাসছে পুরোনো এক ফ্রিজের ডালা, অন্যদিকে ফ্রিজের খোল।
ঝিলের পাড়ে বস্তিবাসীর ভিড়। সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। কথা হলো ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টর (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ ও উপপরিচালক এ বি এম নুরুল হকের সঙ্গে। নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের বাহিনী কাজ করছে। এখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনাব হক ও মেজর শাকিলের মতো সজ্জন ও যোগ্য অফিসার রয়েছেন। তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে মানুষের উপকার হতো।
কেউ কোনো বাড়ি বানালে তা ধসে পড়বে না বা দেবে যাবে না, তা বলা যায় না। পৃথিবীতে গত হাজার বছরে বহু ভবন ধসে গেছে। তবে সেগুলো বৈধভাবে কেনা জমিতে বৈধভাবে নির্মিত, জনগণের খাস জমিতে নয়। কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, যে বাড়িটি দেবে গেছে, তার কোনো ফাউন্ডেশন ছিল না। রড ও কংক্রিটের পিলারের ওপর লোহার অ্যাঙ্গেল বসিয়ে তৈরি ঘরটির পাটাতন ছিল কাঠের। ওই কাঠের ওপর কংক্রিটের আস্তরণ দিয়ে ছাদ করা হয়। বাড়িটির একতলা পানিতে দেবে যাওয়ায় নিচতলার বাসিন্দারা কংক্রিটের ছাদের নিচে চাপা পড়েন।
বাড়িটিতে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সবকিছুরই সংযোগ ছিল। জলাশয়ের নরম মাটিতে পোঁতা বাঁশের খুঁটি ও কাঠের পাটাতনের ওপর সিমেন্ট ঢালাই দেওয়া বাড়ি রাজউকের রাজত্বে হাজার হাজার। দেবে যাওয়া বাড়িটির ‘মালিক’ ক্ষমতাসীন দলের একজন স্থানীয় নেতা। তাঁর পদের নাম তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। বাড়িটি ধসে যাওয়ার পর থেকে তিনি অতি নিরিবিলি কোনো জায়গায় বসে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গভীর কোনো বিষয়ে গবেষণা করছেন। এবং মুচকি মুচকি হাসছেন। আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তিনি ‘গ্রেপ্তার’ হলেও হতে পারেন শুধু জামিন পাওয়ার জন্য।
রামপুরা ঝিলপাড়ে দাঁড়িয়ে আমার ধারণা হলো, আমাদের একটি রাষ্ট্র আছে কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র নেই। আমাদের রাষ্ট্র কর্মকর্তায় ভরপুর, কিন্তু প্রশাসন বলতে কিছু নেই। আমাদের সিটি করপোরেশন একটা নয় দুটো, কিন্তু তার বেতনভুক কর্মচারীদের চোখে দেখেনি নগরবাসী। আমাদের রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু রাজধানীর কোথায় কী হচ্ছে, তা তাদের দেখাশোনার প্রয়োজন নেই। ওই এলাকায় ঝিল ভরাট করে নির্মিত ‘ঢাকা মহানগর মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থা’র অফিস কাম রেসিডেন্সের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো, এই জায়গাটি ঢাকা জেলা প্রশাসন, রাজউক, সিটি করপোরেশনের আওতার বাইরে শুধু নয়, বাংলাদেশেরই বাইরে। তবে বস্তির বাসিন্দারা জানালেন, অন্য কোনো সময় নয়, দুই ঈদের আগে আগে জেলা প্রশাসন, রাজউক, ডিসিসি শুধু নয়, তাবৎ সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারা এখানে চোখ লাল করে পদধূলি দেন।
এই নগরের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে মাদানী নামের বেহেশতবাসী একজন ব্যক্তিকে। তাঁর উত্তরসূরিদের প্রতি মানুষের নেই কিছুমাত্র শ্রদ্ধা। চাকরি রক্ষা করাটাই তাঁদের জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য। কবি বলেছেন, তাঁর চেতনার রঙে পান্না হয় সবুজ। বাংলার মাটিতে বিশেষ করে বাংলার প্রশাসনে কর্মকর্তাদের চেতনার কারণে ঘটে ঘন ঘন পদোন্নতি, বাড়ে চাকরির মেয়াদ। বন্ধ হয়ে যায় যোগ্যতর কারও পদোন্নতির দরজা। এই নগরের কোনো উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নেই, আছে অতি সক্রিয় ধ্বংসকারীরা। ঝিলপাড়ে দাঁড়িয়ে কানের তালা ফাটার জো হলো মাইকের ঘোষণায়: ভাইসব, অমুক মার্কায়...।
জলাশয়ে বাঁশের খুঁটির ওপর কংক্রিটের ছাদঅলা দ্বিতল বাড়ি তৈরি হয় এবং তা দেবে যায় রাজনীতির কারণে। নদীতে লঞ্চ ডুবে শত শত মানুষ মরে, শাস্তি হয় না কারও, মূল কারণ রাজনীতি। সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ থেকে ২০ জন নিহত হয়, কেউ গ্রেপ্তার হয় না রাজনীতির কারণে। পেট্রলবোমায় মানুষ পোড়ে, কেউ গ্রেপ্তার হয় না, মূল কারণ রাজনীতি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে নারকীয়তা, কারণ রাজনীতি। বাংলা নববর্ষে লাখ লাখ মানুষের সামনে পুলিশ প্রহরায় মেয়েদের বিবস্ত্র করা হয়, কারণ একটাই—রাজনীতি।
নববর্ষে নারীর বিবস্ত্র হওয়া এবং ঝিলপাড়ে বাড়ি দেবে যাওয়া—দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দুটোরই মূলে রাজনীতি। পয়লা বৈশাখের পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গিয়ে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছে যা শুনলাম, তাতে মাথাটা নত হলো। পয়লা বৈশাখ নারী নির্যাতনের ঘটনা এবং তারপর তা নিয়ে যা হয়েছে, তাতে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিব্রত হয়েছেন কি না জানি না, তবে সামান্য আক্কেল আছে এমন সাধারণ মানুষ বিস্মিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। হাসপাতালে ডিউটিতে যাচ্ছিলেন একজন মধ্যবয়সী নার্স। তিনি আমাকে দেখে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘স্যার, একটা কথা লেইখেন, সবকিছু নিয়া রাজনীতি করা ভালো না।’
যেকোনো অপকর্মের জন্য ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দিকে আঙুল উঁচালে ওই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিটি শক্তিশালী হয়। মধ্যপ্রাচ্যপন্থী ও মধ্যযুগপন্থীদের জনগণ চেনে। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ তাদের নীতি ও কর্মসূচির বিরুদ্ধে। ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতা যত হুংকারই দিক, তা এ মাটিতে অচল। তাদের দমন করার সোজা পথই আছে, বাঁকা পথে যাওয়ার দরকার নেই।
নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত শতকরা ১ ভাগ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া যায়, ৯৯ ভাগকে নয়। তাঁদের বুঝতে হবে, প্রগতিশীল বলে যাঁরা নিজেদের দাবি করেন, তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, মানুষের আর দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না।
সাধারণ মানুষ যখন দেখে কোথাও ন্যায়বিচার নেই, সত্য বলে কিছু নেই, তখন মানুষ ক্রোধ থেকে নৈরাজ্যের পথ বেছে নেয়। তাতে ক্ষতি সবার; জনগণেরও, সরকারেরও। উপযুক্ত ফাউন্ডেশন না থাকায় ঝিলপাড়ের বাড়িটি দেবে গেছে। পয়লা বৈশাখের ঘটনা ঘটেছে নৈতিকতার অভাবে। ন্যূনতম নৈতিক মানদণ্ড ও দার্শনিক ভিত্তি না থাকায় হয়তো একদিন বাংলাদেশও অজানা অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাবে। বাস্তবে নয়, প্রতীকী অর্থে। অসত্যের নোংরা কাদা ও ভাবাবেগের চোরাবালির মধ্যে নয়, রক্তার্জিত বাংলাদেশকে শক্ত আদর্শিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার সাধনাই হওয়া উচিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের। তা ছাড়া মুক্তি নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
ঘটনাস্থলে আমি একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করলাম, লাশ উদ্ধার করা হয়েছে কয়টি। তিনি জানালেন, ১২ জন মারা গেছে। আমি তাঁকে বললাম, সংখ্যাটি সঠিক নয়, অপমৃত্যু ঘটেছে বা হত্যা করা হয়েছে পৌনে ১৩ জনকে। পৌনে ১৩ সংখ্যাটি শুনে তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি তাঁকে বোঝালাম: ১২+পৌনে ১ = পৌনে ১৩।
সবুজ মিয়ার স্ত্রী রোখসানা ছিলেন ছয় মাসের গর্ভবতী। অনাগত শিশুটি তার পেটে হাত-পা ছুড়ত।
ছেলে হোক মেয়ে হোক, সে তার সন্তানের একটি নামও ঠিক করে রেখেছিল। নাতনি বা নাতির জন্য পুরোনো কাপড় জোড়া দিয়ে সবুজের মা কিছু ছোট ছোট কাঁথাও সেলাই করে রেখে থাকবেন। কয়েক মাস পরেই শিশুটি পৃথিবীতে আসত। নিজের ভাড়া ঘরের ভেতরে বসে সবুজের বাবা-মা ও স্ত্রী ঝিলের পানিতে ডুবে মারা যান। তাঁদের সঙ্গে তাঁদের বংশধর জন্মের আগেই একটি নির্মম ভূখণ্ড থেকে বিদায় নিল।
রাতে মাথা গোঁজার জন্য সব মানুষেরই একটা ঘর চাই। সে ঘর হতে পারে কোনো বস্তির ঝুপড়ি অথবা অভিজাত এলাকায় কোনো বিলাসবহুল প্রাসাদ। প্রাসাদবাসীর যেমন প্রাসাদ, তেমনি বস্তিবাসীর কাছে তার ঝুপড়ি প্রিয়। বেকার হোক, নিষ্কর্মা হোক, কর্মজীবী হোক, দিনের একসময় তাকে ঘরে ফিরে আসতে হয়। ঝিলপাড়ের দোতলা বাড়ির বাসিন্দাদেরও অনেকে সেদিন দুপুরে ঘরে ফেরেন। কেউ ঘরেই আগে থেকে ছিলেন রান্নাবান্নার কাজে। প্রায় সবারই দুপুরের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কেউ খেয়ে বিছানায় একটু লম্বা হয়ে চোখ বুজেছিলেন। ওই চোখ বোজাই যে তাঁর শেষ চোখ বোজা হবে, তা জানতেন না। বিকেল পৌনে চারটা। মটমট কড়কড় আওয়াজ। দুলে ওঠে ঘরের মেঝে, যেমন ঢেউয়ের মধ্যে নদীতে নৌকার পাটাতন। কেউ একজন পান মুখে দিয়ে বলতে চান, ‘কেরা রে খুঁটি ধইর্যা টানা মারে—!’ তাঁর কথা শেষ করার আগেই পুরো একতলা পানির নিচে দেবে যায়। দোতলার বাসিন্দারা ছিলেন ভাগ্যবান। তাঁরা মিনিট খানেক সময় পান দৌড়ে বা লাফিয়ে আত্মরক্ষা করার।
রাতের খবরে দেখেছিলাম ফায়ার সার্ভিসের ত্রাণকর্মীদের উদ্ধার তৎপরতা।
পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা পানির জলাশয়। হাজার হাজার মানুষের মলমূত্রমিশ্রিত পানির রং আলকাতরার চেয়ে সামান্য বেশি কালো। সেই পানিতে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা লাশের সন্ধান করছেন। জলাশয়ের বিভিন্ন জায়গায় জলজ গুল্ম। গরিবের ঘরেও অনেক জিনিস থাকে। পানিতে ভাসছে প্লাস্টিকের বদনা, ফুটবল, শার্ট, লুঙ্গি, শাড়ি, স্যান্ডেল, টুপি, ব্লাউজ, হাতপাখা, বাসন, পেয়ালা, ভাঙা বালতি, হাতব্যাগ, ছেঁড়া মাদুর প্রভৃতি। প্রায় মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে যাওয়ায় পানির একদিকে ভাসছে পুরোনো এক ফ্রিজের ডালা, অন্যদিকে ফ্রিজের খোল।
ঝিলের পাড়ে বস্তিবাসীর ভিড়। সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। কথা হলো ফায়ার সার্ভিসের ডিরেক্টর (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ ও উপপরিচালক এ বি এম নুরুল হকের সঙ্গে। নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁদের বাহিনী কাজ করছে। এখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনাব হক ও মেজর শাকিলের মতো সজ্জন ও যোগ্য অফিসার রয়েছেন। তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে মানুষের উপকার হতো।
কেউ কোনো বাড়ি বানালে তা ধসে পড়বে না বা দেবে যাবে না, তা বলা যায় না। পৃথিবীতে গত হাজার বছরে বহু ভবন ধসে গেছে। তবে সেগুলো বৈধভাবে কেনা জমিতে বৈধভাবে নির্মিত, জনগণের খাস জমিতে নয়। কর্মকর্তা ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, যে বাড়িটি দেবে গেছে, তার কোনো ফাউন্ডেশন ছিল না। রড ও কংক্রিটের পিলারের ওপর লোহার অ্যাঙ্গেল বসিয়ে তৈরি ঘরটির পাটাতন ছিল কাঠের। ওই কাঠের ওপর কংক্রিটের আস্তরণ দিয়ে ছাদ করা হয়। বাড়িটির একতলা পানিতে দেবে যাওয়ায় নিচতলার বাসিন্দারা কংক্রিটের ছাদের নিচে চাপা পড়েন।
বাড়িটিতে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সবকিছুরই সংযোগ ছিল। জলাশয়ের নরম মাটিতে পোঁতা বাঁশের খুঁটি ও কাঠের পাটাতনের ওপর সিমেন্ট ঢালাই দেওয়া বাড়ি রাজউকের রাজত্বে হাজার হাজার। দেবে যাওয়া বাড়িটির ‘মালিক’ ক্ষমতাসীন দলের একজন স্থানীয় নেতা। তাঁর পদের নাম তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। বাড়িটি ধসে যাওয়ার পর থেকে তিনি অতি নিরিবিলি কোনো জায়গায় বসে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে গভীর কোনো বিষয়ে গবেষণা করছেন। এবং মুচকি মুচকি হাসছেন। আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তিনি ‘গ্রেপ্তার’ হলেও হতে পারেন শুধু জামিন পাওয়ার জন্য।
রামপুরা ঝিলপাড়ে দাঁড়িয়ে আমার ধারণা হলো, আমাদের একটি রাষ্ট্র আছে কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র নেই। আমাদের রাষ্ট্র কর্মকর্তায় ভরপুর, কিন্তু প্রশাসন বলতে কিছু নেই। আমাদের সিটি করপোরেশন একটা নয় দুটো, কিন্তু তার বেতনভুক কর্মচারীদের চোখে দেখেনি নগরবাসী। আমাদের রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু রাজধানীর কোথায় কী হচ্ছে, তা তাদের দেখাশোনার প্রয়োজন নেই। ওই এলাকায় ঝিল ভরাট করে নির্মিত ‘ঢাকা মহানগর মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থা’র অফিস কাম রেসিডেন্সের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার মনে হলো, এই জায়গাটি ঢাকা জেলা প্রশাসন, রাজউক, সিটি করপোরেশনের আওতার বাইরে শুধু নয়, বাংলাদেশেরই বাইরে। তবে বস্তির বাসিন্দারা জানালেন, অন্য কোনো সময় নয়, দুই ঈদের আগে আগে জেলা প্রশাসন, রাজউক, ডিসিসি শুধু নয়, তাবৎ সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারা এখানে চোখ লাল করে পদধূলি দেন।
এই নগরের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে মাদানী নামের বেহেশতবাসী একজন ব্যক্তিকে। তাঁর উত্তরসূরিদের প্রতি মানুষের নেই কিছুমাত্র শ্রদ্ধা। চাকরি রক্ষা করাটাই তাঁদের জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য। কবি বলেছেন, তাঁর চেতনার রঙে পান্না হয় সবুজ। বাংলার মাটিতে বিশেষ করে বাংলার প্রশাসনে কর্মকর্তাদের চেতনার কারণে ঘটে ঘন ঘন পদোন্নতি, বাড়ে চাকরির মেয়াদ। বন্ধ হয়ে যায় যোগ্যতর কারও পদোন্নতির দরজা। এই নগরের কোনো উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নেই, আছে অতি সক্রিয় ধ্বংসকারীরা। ঝিলপাড়ে দাঁড়িয়ে কানের তালা ফাটার জো হলো মাইকের ঘোষণায়: ভাইসব, অমুক মার্কায়...।
জলাশয়ে বাঁশের খুঁটির ওপর কংক্রিটের ছাদঅলা দ্বিতল বাড়ি তৈরি হয় এবং তা দেবে যায় রাজনীতির কারণে। নদীতে লঞ্চ ডুবে শত শত মানুষ মরে, শাস্তি হয় না কারও, মূল কারণ রাজনীতি। সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ থেকে ২০ জন নিহত হয়, কেউ গ্রেপ্তার হয় না রাজনীতির কারণে। পেট্রলবোমায় মানুষ পোড়ে, কেউ গ্রেপ্তার হয় না, মূল কারণ রাজনীতি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে নারকীয়তা, কারণ রাজনীতি। বাংলা নববর্ষে লাখ লাখ মানুষের সামনে পুলিশ প্রহরায় মেয়েদের বিবস্ত্র করা হয়, কারণ একটাই—রাজনীতি।
নববর্ষে নারীর বিবস্ত্র হওয়া এবং ঝিলপাড়ে বাড়ি দেবে যাওয়া—দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দুটোরই মূলে রাজনীতি। পয়লা বৈশাখের পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গিয়ে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছে যা শুনলাম, তাতে মাথাটা নত হলো। পয়লা বৈশাখ নারী নির্যাতনের ঘটনা এবং তারপর তা নিয়ে যা হয়েছে, তাতে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিব্রত হয়েছেন কি না জানি না, তবে সামান্য আক্কেল আছে এমন সাধারণ মানুষ বিস্মিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম কয়েকজন তরুণের সঙ্গে। হাসপাতালে ডিউটিতে যাচ্ছিলেন একজন মধ্যবয়সী নার্স। তিনি আমাকে দেখে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘স্যার, একটা কথা লেইখেন, সবকিছু নিয়া রাজনীতি করা ভালো না।’
যেকোনো অপকর্মের জন্য ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দিকে আঙুল উঁচালে ওই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিটি শক্তিশালী হয়। মধ্যপ্রাচ্যপন্থী ও মধ্যযুগপন্থীদের জনগণ চেনে। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ তাদের নীতি ও কর্মসূচির বিরুদ্ধে। ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতা যত হুংকারই দিক, তা এ মাটিতে অচল। তাদের দমন করার সোজা পথই আছে, বাঁকা পথে যাওয়ার দরকার নেই।
নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত শতকরা ১ ভাগ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া যায়, ৯৯ ভাগকে নয়। তাঁদের বুঝতে হবে, প্রগতিশীল বলে যাঁরা নিজেদের দাবি করেন, তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, মানুষের আর দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না।
সাধারণ মানুষ যখন দেখে কোথাও ন্যায়বিচার নেই, সত্য বলে কিছু নেই, তখন মানুষ ক্রোধ থেকে নৈরাজ্যের পথ বেছে নেয়। তাতে ক্ষতি সবার; জনগণেরও, সরকারেরও। উপযুক্ত ফাউন্ডেশন না থাকায় ঝিলপাড়ের বাড়িটি দেবে গেছে। পয়লা বৈশাখের ঘটনা ঘটেছে নৈতিকতার অভাবে। ন্যূনতম নৈতিক মানদণ্ড ও দার্শনিক ভিত্তি না থাকায় হয়তো একদিন বাংলাদেশও অজানা অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাবে। বাস্তবে নয়, প্রতীকী অর্থে। অসত্যের নোংরা কাদা ও ভাবাবেগের চোরাবালির মধ্যে নয়, রক্তার্জিত বাংলাদেশকে শক্ত আদর্শিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার সাধনাই হওয়া উচিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের। তা ছাড়া মুক্তি নেই।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments