ব্রিটেনের তিন বাংলাদেশি এমপিকে টুপি খোলা অভিনন্দন by আলী রীয়াজ
ব্রিটেনের নির্বাচনে সফল তিন বাংলাদেশি এমপি রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হককে অভিনন্দন |
ব্রিটেনের
নির্বাচনে কনজারভেটিভ দলের বিজয় যতটা বিস্ময়কর, তার চেয়ে বেশি
গুরুত্বপূর্ণ হলো এই বিজয়ের মাত্রা। নির্বাচনের আগে জনমত জরিপে ইঙ্গিত ছিল
লেবার দলের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের। নির্বাচনের দিন বুথ–ফেরতদের জরিপ,
যাকে বলা হয় এক্সিট পোল, তাতে ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে কনজারভেটিভরা একক
সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। এসব আঁচ-অনুমানকে ভুল প্রমাণ করে কনজারভেটিভরা
এককভাবে বিজয়ী হয়েছেন। ২০১০ সালের নির্বাচনের পর কনজারভেটিভ দলের নেতা
ডেভিড ক্যামেরনকে কোয়ালিশন সরকার করতে হয়েছিল, এবার আর তার দরকার হবে না।
নির্বাচনের ফলাফলের আরেকটি দিক হলো স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) অভাবনীয় বিজয়। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী দল হিসেবে পরিচিত এই দলের বিজয়ের মাত্রা ব্রিটেনের প্রধান দুই দলের প্রতি অনাস্থার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রকাশ। এই বিজয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের কেউ কেউ যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন, তাকে অতিরঞ্জিত বলা যাবে না এই কারণে যে স্কটল্যান্ডে গত বছরে স্বাধীনতা বিষয়ে গণভোট হয়েছিল এবং তাতে ৪৪ শতাংশের বেশি ভোটার স্বাধীনতার পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন। এই বিজয়ের পর এসএনপির নেত্রী নিকোলা স্টার জেন যদিও বলেছেন যে তাঁর দল কেবল স্বাধীনতাকামীদের প্রতিনিধিত্ব করবে না, তাঁরা স্কটল্যান্ডের সবার প্রতিনিধি, তথাপি এই বিজয়ের ভেতরে সেই বার্তা খুব অস্পষ্ট নয়।
এই নির্বাচনের আরেক দিক হলো লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের ব্যাপক পরাজয়। ক্ষমতাসীনদের সহযোগী হয়ে এই দল এক ধাক্কায় ৪৯টি আসন হারিয়েছে। গত ২৩ বছরের ইতিহাসে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের ফলাফল এত খারাপ হয়নি। ১৯৯২ সালের নির্বাচনে তাদের একক দল হিসেবে যাত্রা শুরু—সেই থেকে কখনোই এই দল ১৭ শতাংশের কম ভোট পায়নি; এই নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোট মাত্র ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। ভোটাররা কি তাহলে বলার চেষ্টা করেছেন যে কনজারভেটিভদের সহযোগী হিসেবে লিব-ড্যামদের তাঁরা দেখতে চান না, নাকি বলতে চেয়েছেন যে তাঁরা দ্বিদলীয় ব্যবস্থার বাইরে যেতে এখনো প্রস্তুত নন? নাকি ক্ষমতার সহযোগী হওয়ার পরও লিব-ড্যামদের আদর্শ বাস্তবায়নের ব্যর্থতা এর কারণ? ক্ষমতার সহযোগী ছোট দলের জন্য এর মধ্যে কি কোনো বার্তা আছে?
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এসব বিষয়ের চেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিনজন প্রার্থীর বিজয়। রুশনারা আলীর পুনর্নির্বাচন এবং নতুন সাংসদ হিসেবে রূপা আশা হক ও টিউলিপ সিদ্দিকের বিজয়। মোট ১২ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন, যার মধ্যে এই তিনজন বিজয়ী হয়েছেন। লক্ষণীয় যে লেবার পার্টি যে সময়ে খুব খারাপ ফলাফল করেছে এবং তাঁদের অনেক নেতা সহজেই ধরাশায়ী হয়েছেন, সে সময়ে লেবার দলের এই তিন প্রার্থীর বিজয় ঘটেছে। এটা নিঃসন্দেহে সুঃসংবাদ। তাঁদের এই সাফল্যের জন্য তাঁদের টুপি খোলা অভিনন্দন। ব্রিটেনপ্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের জন্য এটি নিশ্চয় একটা বড় ধরনের অর্জন। তাঁদের এই বিজয়ের আরেকটি দিক মনে রাখা দরকার, তা হলো সারা দেশে মাত্র ১৬৭টি আসন ছিল, যেখানে একজন ভোটার একজন সংখ্যালঘু বা অশ্বেতাঙ্গ প্রার্থীকে ভোট দিতে পারতেন। কোথাও কোথাও একই আসনে একাধিক সংখ্যালঘু প্রার্থীও ছিলেন।
এই ধরনের সীমিত সুযোগের ভেতরেও এই নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকে নির্বাচিত সাংসদের সংখ্যা ২০১০ সালে নির্বাচিত সংসদের চেয়ে বেশি হয়েছে; ২৭ জন থেকে তা এখন উন্নীত হয়েছে ৩৮-এ। ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রার্থীর সংখ্যা ছিল পঞ্চাশের বেশি, তার মধ্য থেকে ১০ জন বিজয়ী হয়েছেন; পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্য থেকে বিজয়ী হয়েছেন ছয়জন। ভারতীয় এবং পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্যে কয়েকজন আগেও নির্বাচিত হয়েছিলেন, যেমনটি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্যে রুশনারা আলী। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্যে যাঁর বিজয় সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পেয়েছে তিনি হলেন নাজ শাহ। জর্জ গ্যালওয়েকে হারিয়ে নাজ শাহের বিজয় মনে করিয়ে দিতে পারে যে সুষ্ঠু নির্বাচনে জয় পাওয়ার জন্য নামের চেয়ে বেশি দরকার স্থানীয় মানুষের সমর্থন লাভ করা। এই নির্বাচনে অন্য বড় নেতাদের পরাজয় আরও একবার সেই কথার জানান দিয়েছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য বলে পরিচিত প্রার্থীদের বিজয় থেকে বোঝা যায় যে ব্রিটেনে মাল্টিকালচারিজম বা বহুসংস্কৃতিবাদ নিয়ে যত সমালোচনাই হোক না কেন, একটি অংশগ্রহণমূলক সমাজ গঠনের পথে তার অবদান রয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে ব্রিটেন সবার অংশগ্রহণের চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে, বরং এই নির্বাচনের ফলাফল দেখাচ্ছে আরও কত পথ বাকি আছে। দেশের সংখ্যালঘুর হার যেখানে ১৩ শতাংশ, সেখানে সংসদে মাত্র ৬ শতাংশ প্রতিনিধি সংখ্যালঘু। এ কথা একইভাবে নারীদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে প্রযোজ্য। এবার সবচেয়ে বেশি নারী সদস্য হয়েছেন, সংসদে ১৯০ জনের মতো নারী বিজয়ী হয়েছেন, সেটা বড়জোর এক-চতুর্থাংশ। ব্রিটেনের জনসংখ্যায় নারী অর্ধেক, সেই হিসাবে তাঁদের প্রাপ্য আসনের সংখ্যা অনেক বেশি।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্যে যাঁরা বিজয়ী হয়েছেন, তাঁদের রাজনৈতিক ও পেশাগত পটভূমির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এই কারণে যে আমার কাছে মনে হয়েছে যে একটি বিষয় বাংলাদেশের মানুষ এবং ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের বিবেচনা দাবি করে। তা হলো এঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ পেশা, কর্মক্ষেত্র ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের ক্ষেত্রে অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত। শুধু তা-ই নয়, এঁরা দীর্ঘদিন যাবৎ ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁরা উঠে এসেছেন তৃণমূলের রাজনীতির পথ ধরে। কথাটা যেকোনো দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয় না হলেও, প্রসঙ্গটি তোলার কারণ আশা করি অনেকেই বুঝতে পারবেন।
ব্রিটেনে ছয় বছর জীবন যাপন করার (১৯৯৫-২০০১) এবং পরে ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর গবেষণা করার সুযোগ লাভ হয়েছিল আমার। ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর ব্রিটেনের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের আত্মপরিচয় বিষয়ে গবেষণার সময় আমি দেখেছিলাম যে ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির ভেতর বাংলাদেশের রাজনীতির প্রভাব এতটাই যে কমিউনিটির একটা বড় অংশই সেই রাজনীতির বৃত্তচক্রে আটকে গেছেন। সত্তর ও আশির দশকে প্রতিকূল পরিবেশে, বিশেষত বর্ণবাদী হামলা ও প্রকট বর্ণবাদী বৈষম্যের মোকাবিলা করতে গিয়ে, কমিউনিটির নেতারা কমিউনিটির স্বার্থ রক্ষার কাজেও সংগঠনে জোর দিতে বাধ্য হন। তাঁদের সাফল্যের কারণে বাংলাদেশি প্রবাসী এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের পক্ষে সমাজে টিকে থাকা সম্ভব হয়।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকের দিক থেকেই এই কমিউনিটির নেতারা যখন জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হতে গেছেন, তখন একদিকে কমিউনিটিতে নেতৃত্বে দেখা দিয়েছে শূন্যতা, কেননা তাঁরা তাঁদের উত্তরসূরি তৈরি করেননি, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁরা তাঁদের অবস্থান সংহত করতে পারেননি। কমিউনিটির অভ্যন্তরীণ কলহও এর একটা কারণ। আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের অনেকেই নিজ কমিউনিটির বাইরে আবেদন তৈরি করতে পারেননি, ফলে তাঁদের পক্ষে জাতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য আসন নেওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতাও তাঁদের আবেদনকে সীমিত করেছে। (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে ২০১৩ সালে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত আমার গ্রন্থ ইসলাম অ্যান্ড আইডেনটিটি পলিটিকস অ্যামাং ব্রিটিশ বাংলাদেশিজ: এ লিপ অব ফেইথ)।
গত দুই দশকে আমরা এই পরিস্থিতির বাইরে একটি প্রজন্ম দেখতে পাচ্ছি, যারা মূল ধারার রাজনীতির ভেতরে থেকেই তাদের অবস্থান তৈরি করতে সচেষ্ট হচ্ছে। বিজয়ী তিনজনের ক্ষেত্রে তা সমপরিমাণে সত্য। টিউলিপ সিদ্দিকের পারিবারিক পরিচয়ের কারণে যাঁরা তাঁকে ভিন্নভাবে দেখানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, তাঁরা যেন একবার ভেবে দেখেন এর মাধ্যমে টিউলিপ সিদ্দিকের এত দিনের অর্জনকে কোনোভাবে খাটো করা হচ্ছে কি না। আমি এ কথা বলছি না যে আমরা তাঁর পারিবারিক পরিচয় বিস্মৃত হব; একটি রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরসূরি হওয়ার কারণে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, সেটা নিশ্চয় তাঁর কার্যকলাপকে প্রভাবিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু তাঁর নিজস্ব যোগ্যতাকে এবং একইভাবে বিজয়ী অন্য দুজন সদস্যের যোগ্যতাকে যেন আমরা ছোট না করি।
কেননা আমি মনে করি, তাঁদের সাফল্য—তাঁদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে এবং নির্বাচনে—অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে মূলধারার রাজনীতিতে তৃণমূল পর্যায়ে যুক্ত হতে, স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে নিজেদের আসন তৈরি করতে। আমাদের কাজ হচ্ছে এই তিন সফল রাজনীতিবিদকে টুপি খোলা অভিনন্দন জানানো এবং অন্যদের এই পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করা। আর সম্ভব হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই পরিস্থিতি তৈরি করা।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
নির্বাচনের ফলাফলের আরেকটি দিক হলো স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) অভাবনীয় বিজয়। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী দল হিসেবে পরিচিত এই দলের বিজয়ের মাত্রা ব্রিটেনের প্রধান দুই দলের প্রতি অনাস্থার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রকাশ। এই বিজয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের কেউ কেউ যে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন, তাকে অতিরঞ্জিত বলা যাবে না এই কারণে যে স্কটল্যান্ডে গত বছরে স্বাধীনতা বিষয়ে গণভোট হয়েছিল এবং তাতে ৪৪ শতাংশের বেশি ভোটার স্বাধীনতার পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন। এই বিজয়ের পর এসএনপির নেত্রী নিকোলা স্টার জেন যদিও বলেছেন যে তাঁর দল কেবল স্বাধীনতাকামীদের প্রতিনিধিত্ব করবে না, তাঁরা স্কটল্যান্ডের সবার প্রতিনিধি, তথাপি এই বিজয়ের ভেতরে সেই বার্তা খুব অস্পষ্ট নয়।
এই নির্বাচনের আরেক দিক হলো লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের ব্যাপক পরাজয়। ক্ষমতাসীনদের সহযোগী হয়ে এই দল এক ধাক্কায় ৪৯টি আসন হারিয়েছে। গত ২৩ বছরের ইতিহাসে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের ফলাফল এত খারাপ হয়নি। ১৯৯২ সালের নির্বাচনে তাদের একক দল হিসেবে যাত্রা শুরু—সেই থেকে কখনোই এই দল ১৭ শতাংশের কম ভোট পায়নি; এই নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোট মাত্র ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। ভোটাররা কি তাহলে বলার চেষ্টা করেছেন যে কনজারভেটিভদের সহযোগী হিসেবে লিব-ড্যামদের তাঁরা দেখতে চান না, নাকি বলতে চেয়েছেন যে তাঁরা দ্বিদলীয় ব্যবস্থার বাইরে যেতে এখনো প্রস্তুত নন? নাকি ক্ষমতার সহযোগী হওয়ার পরও লিব-ড্যামদের আদর্শ বাস্তবায়নের ব্যর্থতা এর কারণ? ক্ষমতার সহযোগী ছোট দলের জন্য এর মধ্যে কি কোনো বার্তা আছে?
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এসব বিষয়ের চেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিনজন প্রার্থীর বিজয়। রুশনারা আলীর পুনর্নির্বাচন এবং নতুন সাংসদ হিসেবে রূপা আশা হক ও টিউলিপ সিদ্দিকের বিজয়। মোট ১২ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন, যার মধ্যে এই তিনজন বিজয়ী হয়েছেন। লক্ষণীয় যে লেবার পার্টি যে সময়ে খুব খারাপ ফলাফল করেছে এবং তাঁদের অনেক নেতা সহজেই ধরাশায়ী হয়েছেন, সে সময়ে লেবার দলের এই তিন প্রার্থীর বিজয় ঘটেছে। এটা নিঃসন্দেহে সুঃসংবাদ। তাঁদের এই সাফল্যের জন্য তাঁদের টুপি খোলা অভিনন্দন। ব্রিটেনপ্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের জন্য এটি নিশ্চয় একটা বড় ধরনের অর্জন। তাঁদের এই বিজয়ের আরেকটি দিক মনে রাখা দরকার, তা হলো সারা দেশে মাত্র ১৬৭টি আসন ছিল, যেখানে একজন ভোটার একজন সংখ্যালঘু বা অশ্বেতাঙ্গ প্রার্থীকে ভোট দিতে পারতেন। কোথাও কোথাও একই আসনে একাধিক সংখ্যালঘু প্রার্থীও ছিলেন।
এই ধরনের সীমিত সুযোগের ভেতরেও এই নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকে নির্বাচিত সাংসদের সংখ্যা ২০১০ সালে নির্বাচিত সংসদের চেয়ে বেশি হয়েছে; ২৭ জন থেকে তা এখন উন্নীত হয়েছে ৩৮-এ। ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রার্থীর সংখ্যা ছিল পঞ্চাশের বেশি, তার মধ্য থেকে ১০ জন বিজয়ী হয়েছেন; পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্য থেকে বিজয়ী হয়েছেন ছয়জন। ভারতীয় এবং পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্যে কয়েকজন আগেও নির্বাচিত হয়েছিলেন, যেমনটি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্যে রুশনারা আলী। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্যে যাঁর বিজয় সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পেয়েছে তিনি হলেন নাজ শাহ। জর্জ গ্যালওয়েকে হারিয়ে নাজ শাহের বিজয় মনে করিয়ে দিতে পারে যে সুষ্ঠু নির্বাচনে জয় পাওয়ার জন্য নামের চেয়ে বেশি দরকার স্থানীয় মানুষের সমর্থন লাভ করা। এই নির্বাচনে অন্য বড় নেতাদের পরাজয় আরও একবার সেই কথার জানান দিয়েছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য বলে পরিচিত প্রার্থীদের বিজয় থেকে বোঝা যায় যে ব্রিটেনে মাল্টিকালচারিজম বা বহুসংস্কৃতিবাদ নিয়ে যত সমালোচনাই হোক না কেন, একটি অংশগ্রহণমূলক সমাজ গঠনের পথে তার অবদান রয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে ব্রিটেন সবার অংশগ্রহণের চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে, বরং এই নির্বাচনের ফলাফল দেখাচ্ছে আরও কত পথ বাকি আছে। দেশের সংখ্যালঘুর হার যেখানে ১৩ শতাংশ, সেখানে সংসদে মাত্র ৬ শতাংশ প্রতিনিধি সংখ্যালঘু। এ কথা একইভাবে নারীদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে প্রযোজ্য। এবার সবচেয়ে বেশি নারী সদস্য হয়েছেন, সংসদে ১৯০ জনের মতো নারী বিজয়ী হয়েছেন, সেটা বড়জোর এক-চতুর্থাংশ। ব্রিটেনের জনসংখ্যায় নারী অর্ধেক, সেই হিসাবে তাঁদের প্রাপ্য আসনের সংখ্যা অনেক বেশি।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীদের মধ্যে যাঁরা বিজয়ী হয়েছেন, তাঁদের রাজনৈতিক ও পেশাগত পটভূমির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই এই কারণে যে আমার কাছে মনে হয়েছে যে একটি বিষয় বাংলাদেশের মানুষ এবং ব্রিটেনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের বিবেচনা দাবি করে। তা হলো এঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ পেশা, কর্মক্ষেত্র ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের ক্ষেত্রে অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত। শুধু তা-ই নয়, এঁরা দীর্ঘদিন যাবৎ ব্রিটেনের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং তাঁরা উঠে এসেছেন তৃণমূলের রাজনীতির পথ ধরে। কথাটা যেকোনো দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বিষয় না হলেও, প্রসঙ্গটি তোলার কারণ আশা করি অনেকেই বুঝতে পারবেন।
ব্রিটেনে ছয় বছর জীবন যাপন করার (১৯৯৫-২০০১) এবং পরে ব্রিটেনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ওপর গবেষণা করার সুযোগ লাভ হয়েছিল আমার। ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর ব্রিটেনের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের আত্মপরিচয় বিষয়ে গবেষণার সময় আমি দেখেছিলাম যে ব্রিটেনের বাংলাদেশি কমিউনিটির ভেতর বাংলাদেশের রাজনীতির প্রভাব এতটাই যে কমিউনিটির একটা বড় অংশই সেই রাজনীতির বৃত্তচক্রে আটকে গেছেন। সত্তর ও আশির দশকে প্রতিকূল পরিবেশে, বিশেষত বর্ণবাদী হামলা ও প্রকট বর্ণবাদী বৈষম্যের মোকাবিলা করতে গিয়ে, কমিউনিটির নেতারা কমিউনিটির স্বার্থ রক্ষার কাজেও সংগঠনে জোর দিতে বাধ্য হন। তাঁদের সাফল্যের কারণে বাংলাদেশি প্রবাসী এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকদের পক্ষে সমাজে টিকে থাকা সম্ভব হয়।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকের দিক থেকেই এই কমিউনিটির নেতারা যখন জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হতে গেছেন, তখন একদিকে কমিউনিটিতে নেতৃত্বে দেখা দিয়েছে শূন্যতা, কেননা তাঁরা তাঁদের উত্তরসূরি তৈরি করেননি, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁরা তাঁদের অবস্থান সংহত করতে পারেননি। কমিউনিটির অভ্যন্তরীণ কলহও এর একটা কারণ। আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের অনেকেই নিজ কমিউনিটির বাইরে আবেদন তৈরি করতে পারেননি, ফলে তাঁদের পক্ষে জাতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য আসন নেওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতাও তাঁদের আবেদনকে সীমিত করেছে। (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে ২০১৩ সালে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত আমার গ্রন্থ ইসলাম অ্যান্ড আইডেনটিটি পলিটিকস অ্যামাং ব্রিটিশ বাংলাদেশিজ: এ লিপ অব ফেইথ)।
গত দুই দশকে আমরা এই পরিস্থিতির বাইরে একটি প্রজন্ম দেখতে পাচ্ছি, যারা মূল ধারার রাজনীতির ভেতরে থেকেই তাদের অবস্থান তৈরি করতে সচেষ্ট হচ্ছে। বিজয়ী তিনজনের ক্ষেত্রে তা সমপরিমাণে সত্য। টিউলিপ সিদ্দিকের পারিবারিক পরিচয়ের কারণে যাঁরা তাঁকে ভিন্নভাবে দেখানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের প্রতি আমার বিনীত অনুরোধ, তাঁরা যেন একবার ভেবে দেখেন এর মাধ্যমে টিউলিপ সিদ্দিকের এত দিনের অর্জনকে কোনোভাবে খাটো করা হচ্ছে কি না। আমি এ কথা বলছি না যে আমরা তাঁর পারিবারিক পরিচয় বিস্মৃত হব; একটি রাজনৈতিক পরিবারের উত্তরসূরি হওয়ার কারণে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, সেটা নিশ্চয় তাঁর কার্যকলাপকে প্রভাবিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু তাঁর নিজস্ব যোগ্যতাকে এবং একইভাবে বিজয়ী অন্য দুজন সদস্যের যোগ্যতাকে যেন আমরা ছোট না করি।
কেননা আমি মনে করি, তাঁদের সাফল্য—তাঁদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে এবং নির্বাচনে—অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে মূলধারার রাজনীতিতে তৃণমূল পর্যায়ে যুক্ত হতে, স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে নিজেদের আসন তৈরি করতে। আমাদের কাজ হচ্ছে এই তিন সফল রাজনীতিবিদকে টুপি খোলা অভিনন্দন জানানো এবং অন্যদের এই পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করা। আর সম্ভব হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই পরিস্থিতি তৈরি করা।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments