সংবাদমাধ্যম কতটা স্বাধীন? by মশিউল আলম
প্রতিবছর
৩ মে বিশ্বজুড়ে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে বা মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করা
হয়। বাংলাদেশেও কোনো কোনো সংস্থা এ উপলক্ষে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে,
সংবাদপত্রে কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দিনটি
পেরিয়ে যায়। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, বিনা
বাধায় তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে চলমান অবস্থার
পরিবর্তন ঘটে না। তবে এই দিনটি উপলক্ষে দেশের সংবাদমাধ্যমের অবস্থা নিয়ে
ভাবনাচিন্তার অবকাশ সৃষ্টি হয়। কিছু প্রশ্ন নতুন করে উত্থাপনের অবকাশ মেলে।
চিরন্তন প্রশ্নটি হলো: বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম কি স্বাধীন? এ প্রশ্নের উত্তরগুলো হয় মোটা দাগে দুই ধরনের। সরকারি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, সংবাদমাধ্যম সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। সব সরকারের আমলেই এমন দাবি করা হয়। কখনো কখনো অতি উৎসাহী কোনো মন্ত্রী এমন কথাও বলেন যে তাঁর সরকারের আমলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার রেকর্ড আগের যেকোনো সময়ের থেকে ভালো। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের বক্তব্য হয় ঠিক বিপরীত—স্বাধীনতার ঘাটতির অভিযোগ সব সময় উচ্চারিত হয় সাংবাদিকদের কণ্ঠে। সংবাদ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার ঘাটতি ছাড়াও সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অনেক বাধা-বিপত্তি, বিশেষত নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ বারবার উচ্চারিত হয়। কিন্তু যেহেতু সরকার এসব অভিযোগ আমলে না নিয়ে উল্টো অস্বীকার করতে চায়, তাই সংবাদক্ষেত্রের কর্মপরিবেশের উন্নতি ঘটে না।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস ২০১৪ সালের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বৈশ্বিক সূচক প্রকাশ করে। ওই সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দেখা যায় ১৪৬। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ভুটান, মালদ্বীপ, ভারত ও নেপালের অবস্থানও আমাদের ওপরে। আমাদের ২০১৪ সালের সূচকের ভিত্তিতে সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থা আগের দুই বছরের তুলনায় দৃশ্যত পরিবর্তিত হয়নি। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এক বিবৃতিতে বলেন, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তা সম্পূর্ণ বাস্তবতা-বিবর্জিত, ভিত্তিহীন, মনগড়া ও কল্পনাপ্রসূত। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বর্তমান সরকারের আমলে গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত ও বিকশিত হয়েছে।
কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের এ বক্তব্য যে ঠিক নয়, তা যাঁরা সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন, তাঁরা উপলব্ধি করছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে নির্যাতন, হয়রানি ও হুমকির শিকার হয়েছেন ১১ জন সাংবাদিক। সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, সন্ত্রাসী ও পরিচয় গোপনকারীদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছেন নয়জন সাংবাদিক। সংবাদ প্রকাশের জন্য মামলা হয়েছে তিনটি। সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্যাতন, আক্রমণ, হুমকি, হয়রানি ও বোমা নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১৫ জন। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের দ্বারা হামলা, নির্যাতন, হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৭ জন। বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের দ্বারাও একই ধরনের অপরাধের শিকার হয়েছেন দুজন। ককটেল হামলার শিকার হয়েছেন সাতজন এবং বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের মেয়রদের কাছ থেকে হুমকি পেয়েছেন ৩০ জন সাংবাদিক। আর অধিকার-এর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৩ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৭৭২ জন, হামলার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৮ জনকে, অপহরণের শিকার হয়েছেন তিনজন, হুমকি দেওয়া হয়েছে ২৯৩ জনকে, চারজনকে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে, মামলা দায়ের করা হয়েছে ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে এবং বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৫৫ জন সাংবাদিক।
স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন মহলের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে সদ্য সমাপ্ত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলাকালে। সেদিন সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা অন্তত ছয়জন সাংবাদিককে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছেন, ভয়ভীতি দেখিয়ে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রেখেছেন আরও ১৫ জনকে। সাংবাদিক পেটানোর দৃশ্যগুলো চেয়ে চেয়ে দেখেছেন পুলিশের সদস্যরা। আমার এক সহকর্মী যখন মার খাচ্ছিলেন, তখন তিনি পুলিশের সাহায্য চাইলে এক পুলিশ সদস্য তাঁকে বলেন, ‘আপনে ঝামেলা করছেন, এখন নিজেই সামলান।’ ভোটকেন্দ্রে একজন সাংবাদিক কী ঝামেলা করতে পারেন? তিনি জাল ভোট দেওয়ার ছবি তুলছিলেন।
সাংবাদিকদের প্রতি পুলিশের বৈরিতা ও সহিংস আচরণের এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত প্রথম আলোর বাউফল প্রতিনিধি মিজানুর রহমান। সামান্য কথা-কাটাকাটির জের ধরে পুলিশ তাঁকে থানায় ধরে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে অকথ্য নির্যাতন করেছে যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন। গুরুতর জখমসহ তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়েছে, যখন তিনি দাঁড়াতেই পারছিলেন না, তবু তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে। এ ঘটনার পেছনে আছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সাংসদ।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ, পুলিশি হয়রানি, মিথ্যা মামলাসহ নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতনের অজস্র ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর কোনো আইনি প্রতিকার হয়নি। গত বছরের অক্টোবর মাসে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য সাংবাদিকেরা গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করেন। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ হয় রাজনৈতিক দলের লোকজন, পুলিশ, অপরাধী চক্র এমনকি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজনের তরফ থেকেও। রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে সংবাদ, আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন রাজনৈতিক কর্মীদের দ্বারা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেসক্লাবে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। সাংবাদিকদের হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। প্রত্যক্ষ নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন ছাড়াও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা হয়েছে আইনি হাতিয়ার প্রয়োগের মাধ্যমেও। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানির ঘটনাও বিস্তর। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এ নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের একটি পোস্টারের ছবি ছাপা হলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেন, হিযবুত তাহ্রীরের পোস্টার ছাপিয়ে যারা তাদের মদদ দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে এ রকম হুমকি উচ্চারিত হলে পুরো সংবাদমাধ্যমের কাছে যে বার্তা পৌঁছে, তা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ তুলে ধরে না।
যেকোনো অভিযোগেই হোক, একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের প্রকাশনা এই সরকারের আমলে বন্ধ করা হয়েছে এবং সেটির সম্পাদককে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। দুটি টিভি চ্যানেলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে চ্যানেল দুটির লাইসেন্স বাতিল করা হয়নি। এ দেশের সম্প্রচারমাধ্যমের পক্ষে কোনো আইনি সুরক্ষা নেই, টিভি চ্যানেলগুলো চলছে সরকারের মর্জিমাফিক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্বাহী আদেশের বলে। কিছুদিন আগে সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য একটি সম্প্রচার নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে, যেটি কার্যকর হলে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর যেটুকু স্বাধীনতা আছে, তা-ও বিলুপ্ত হবে। কিন্তু সম্প্রচারমাধ্যমের সাংবাদিকেরা এর যথেষ্ট প্রতিবাদ জানানোরও সাহস পাননি, প্রতিবাদ-সমালোচনা করে যেটুকু লেখালেখি হয়েছে, তার অধিকাংশই হয়েছে সংবাদপত্রগুলোতে। বলা বাহুল্য, সম্প্রচারমাধ্যমের ওপর সরকারের চাপ অপেক্ষাকৃত বেশি, যেহেতু সরকার ইচ্ছা করলেই যেকোনো টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে পারে। যাঁরা সরকারের সমালোচনা করেন, টিভি টক শোগুলোতে তাঁদের আমন্ত্রণ না জানানোর ব্যাপারে সরকারের দিকে থেকে চাপ দেওয়া হয় এমন অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়ও এ বিষয়টি লক্ষ করা গেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে যা-ই দাবি করা হোক না কেন, বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না, তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের এক সাম্প্রতিক বিবৃতিতে। ওই বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর জেলা সংবাদদাতাদের ওপর পুলিশ, প্রভাবশালী রাজনীতিক ও স্থানীয় অপরাধীদের নির্যাতন-হয়রানির ক্রমবর্ধমান ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
কোন রাষ্ট্র কতটা গণতান্ত্রিক, তা নির্ণয়ের এক ভালো উপায় সেই দেশে সংবাদমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তা পর্যবেক্ষণ করা। গণতন্ত্র সংবাদমাধ্যমের সহায়। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে না, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো রকমের চাপের মধ্যে রাখে না, ভয়ভীতি দেখায় না, পীড়ন করে না, তাঁদের কাজে বাধার সৃষ্টি করে না। বরং সরকারের বাইরের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের দ্বারা সংবাদমাধ্যম বাধাপ্রাপ্ত হলে গণতান্ত্রিক সরকার সেসব বাধা দূর করার চেষ্টা করে। গণতান্ত্রিক সরকার সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সুরক্ষার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখে। সাংবাদিকেরা নির্যাতনের শিকার হলে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে এবং শাস্তি প্রদানের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বেশ পোক্ত।
সাংবাদিকেরা খুন হলে খুনিরা বিচারের ঊর্ধ্বে থেকে যায়, কিংবা দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকেরা আক্রান্ত হলে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নীরব দর্শকের মতো চেয়ে চেয়ে দেখেন, পুলিশের সদস্যরা মিথ্যা অভিযোগে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাঁকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে রাতভর নির্মম নির্যাতন করেন, আর সেই সাংবাদিক আদালতে জামিন চাইলে বিচারকও তাঁকে জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানান—এই ধরনের ঘটনাবলি কোনো গণতান্ত্রিক দেশে ঘটা অসম্ভব। সংবাদমাধ্যম সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজে সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে, অন্যভাবে বললে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন কর্মসম্পাদন এমন হয় যে তা আপনাআপনিই সুশাসনের পথ প্রশস্ত করে। সরকারের নেতৃবৃন্দের উপলব্ধি করা উচিত যে সংবাদমাধ্যম কোনোভাবেই সরকারের প্রতিপক্ষ নয়; যদি সে কখনো সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়, ক্ষমতা অপব্যবহারের সমালোচনা করে, তবে তা সরকারের শুধরে নেওয়ার সুযোগই সৃষ্টি করে দেয়।
মশিউল আলম: লেখক ও সাংবাদিক৷
mashiul.alam@gmail.com
চিরন্তন প্রশ্নটি হলো: বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম কি স্বাধীন? এ প্রশ্নের উত্তরগুলো হয় মোটা দাগে দুই ধরনের। সরকারি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, সংবাদমাধ্যম সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। সব সরকারের আমলেই এমন দাবি করা হয়। কখনো কখনো অতি উৎসাহী কোনো মন্ত্রী এমন কথাও বলেন যে তাঁর সরকারের আমলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার রেকর্ড আগের যেকোনো সময়ের থেকে ভালো। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের বক্তব্য হয় ঠিক বিপরীত—স্বাধীনতার ঘাটতির অভিযোগ সব সময় উচ্চারিত হয় সাংবাদিকদের কণ্ঠে। সংবাদ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার ঘাটতি ছাড়াও সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অনেক বাধা-বিপত্তি, বিশেষত নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ বারবার উচ্চারিত হয়। কিন্তু যেহেতু সরকার এসব অভিযোগ আমলে না নিয়ে উল্টো অস্বীকার করতে চায়, তাই সংবাদক্ষেত্রের কর্মপরিবেশের উন্নতি ঘটে না।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্যারিসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস ২০১৪ সালের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বৈশ্বিক সূচক প্রকাশ করে। ওই সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দেখা যায় ১৪৬। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে ভুটান, মালদ্বীপ, ভারত ও নেপালের অবস্থানও আমাদের ওপরে। আমাদের ২০১৪ সালের সূচকের ভিত্তিতে সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থা আগের দুই বছরের তুলনায় দৃশ্যত পরিবর্তিত হয়নি। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এক বিবৃতিতে বলেন, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তা সম্পূর্ণ বাস্তবতা-বিবর্জিত, ভিত্তিহীন, মনগড়া ও কল্পনাপ্রসূত। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বর্তমান সরকারের আমলে গণমাধ্যম সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারিত ও বিকশিত হয়েছে।
কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের এ বক্তব্য যে ঠিক নয়, তা যাঁরা সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন, তাঁরা উপলব্ধি করছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে নির্যাতন, হয়রানি ও হুমকির শিকার হয়েছেন ১১ জন সাংবাদিক। সরকারি দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, সন্ত্রাসী ও পরিচয় গোপনকারীদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছেন নয়জন সাংবাদিক। সংবাদ প্রকাশের জন্য মামলা হয়েছে তিনটি। সন্ত্রাসীদের দ্বারা নির্যাতন, আক্রমণ, হুমকি, হয়রানি ও বোমা নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ১৫ জন। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের দ্বারা হামলা, নির্যাতন, হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৭ জন। বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা–কর্মীদের দ্বারাও একই ধরনের অপরাধের শিকার হয়েছেন দুজন। ককটেল হামলার শিকার হয়েছেন সাতজন এবং বিভিন্ন সিটি করপোরেশনের মেয়রদের কাছ থেকে হুমকি পেয়েছেন ৩০ জন সাংবাদিক। আর অধিকার-এর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৩ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৭৭২ জন, হামলার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৮ জনকে, অপহরণের শিকার হয়েছেন তিনজন, হুমকি দেওয়া হয়েছে ২৯৩ জনকে, চারজনকে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে, মামলা দায়ের করা হয়েছে ১৫৫ জনের বিরুদ্ধে এবং বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৫৫ জন সাংবাদিক।
স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকদের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন মহলের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে সদ্য সমাপ্ত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলাকালে। সেদিন সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকেরা অন্তত ছয়জন সাংবাদিককে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছেন, ভয়ভীতি দেখিয়ে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রেখেছেন আরও ১৫ জনকে। সাংবাদিক পেটানোর দৃশ্যগুলো চেয়ে চেয়ে দেখেছেন পুলিশের সদস্যরা। আমার এক সহকর্মী যখন মার খাচ্ছিলেন, তখন তিনি পুলিশের সাহায্য চাইলে এক পুলিশ সদস্য তাঁকে বলেন, ‘আপনে ঝামেলা করছেন, এখন নিজেই সামলান।’ ভোটকেন্দ্রে একজন সাংবাদিক কী ঝামেলা করতে পারেন? তিনি জাল ভোট দেওয়ার ছবি তুলছিলেন।
সাংবাদিকদের প্রতি পুলিশের বৈরিতা ও সহিংস আচরণের এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত প্রথম আলোর বাউফল প্রতিনিধি মিজানুর রহমান। সামান্য কথা-কাটাকাটির জের ধরে পুলিশ তাঁকে থানায় ধরে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে অকথ্য নির্যাতন করেছে যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন। গুরুতর জখমসহ তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়েছে, যখন তিনি দাঁড়াতেই পারছিলেন না, তবু তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করা হয়েছে। এ ঘটনার পেছনে আছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সাংসদ।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ, পুলিশি হয়রানি, মিথ্যা মামলাসহ নানা ধরনের অত্যাচার-নির্যাতনের অজস্র ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর কোনো আইনি প্রতিকার হয়নি। গত বছরের অক্টোবর মাসে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কয়েকটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের ঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্য সাংবাদিকেরা গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করেন। সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ হয় রাজনৈতিক দলের লোকজন, পুলিশ, অপরাধী চক্র এমনকি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজনের তরফ থেকেও। রাজনৈতিক কর্মসূচি চলাকালে সংবাদ, আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন রাজনৈতিক কর্মীদের দ্বারা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেসক্লাবে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। সাংবাদিকদের হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। প্রত্যক্ষ নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন ছাড়াও সাংবাদিকদের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা হয়েছে আইনি হাতিয়ার প্রয়োগের মাধ্যমেও। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানির ঘটনাও বিস্তর। ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এ নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের একটি পোস্টারের ছবি ছাপা হলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেন, হিযবুত তাহ্রীরের পোস্টার ছাপিয়ে যারা তাদের মদদ দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে এ রকম হুমকি উচ্চারিত হলে পুরো সংবাদমাধ্যমের কাছে যে বার্তা পৌঁছে, তা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ তুলে ধরে না।
যেকোনো অভিযোগেই হোক, একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রের প্রকাশনা এই সরকারের আমলে বন্ধ করা হয়েছে এবং সেটির সম্পাদককে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। দুটি টিভি চ্যানেলও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে চ্যানেল দুটির লাইসেন্স বাতিল করা হয়নি। এ দেশের সম্প্রচারমাধ্যমের পক্ষে কোনো আইনি সুরক্ষা নেই, টিভি চ্যানেলগুলো চলছে সরকারের মর্জিমাফিক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্বাহী আদেশের বলে। কিছুদিন আগে সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য একটি সম্প্রচার নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে, যেটি কার্যকর হলে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর যেটুকু স্বাধীনতা আছে, তা-ও বিলুপ্ত হবে। কিন্তু সম্প্রচারমাধ্যমের সাংবাদিকেরা এর যথেষ্ট প্রতিবাদ জানানোরও সাহস পাননি, প্রতিবাদ-সমালোচনা করে যেটুকু লেখালেখি হয়েছে, তার অধিকাংশই হয়েছে সংবাদপত্রগুলোতে। বলা বাহুল্য, সম্প্রচারমাধ্যমের ওপর সরকারের চাপ অপেক্ষাকৃত বেশি, যেহেতু সরকার ইচ্ছা করলেই যেকোনো টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে পারে। যাঁরা সরকারের সমালোচনা করেন, টিভি টক শোগুলোতে তাঁদের আমন্ত্রণ না জানানোর ব্যাপারে সরকারের দিকে থেকে চাপ দেওয়া হয় এমন অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়ও এ বিষয়টি লক্ষ করা গেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে যা-ই দাবি করা হোক না কেন, বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম যে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না, তা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের এক সাম্প্রতিক বিবৃতিতে। ওই বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর জেলা সংবাদদাতাদের ওপর পুলিশ, প্রভাবশালী রাজনীতিক ও স্থানীয় অপরাধীদের নির্যাতন-হয়রানির ক্রমবর্ধমান ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
কোন রাষ্ট্র কতটা গণতান্ত্রিক, তা নির্ণয়ের এক ভালো উপায় সেই দেশে সংবাদমাধ্যম কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে তা পর্যবেক্ষণ করা। গণতন্ত্র সংবাদমাধ্যমের সহায়। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করে না, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো রকমের চাপের মধ্যে রাখে না, ভয়ভীতি দেখায় না, পীড়ন করে না, তাঁদের কাজে বাধার সৃষ্টি করে না। বরং সরকারের বাইরের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের দ্বারা সংবাদমাধ্যম বাধাপ্রাপ্ত হলে গণতান্ত্রিক সরকার সেসব বাধা দূর করার চেষ্টা করে। গণতান্ত্রিক সরকার সাংবাদিকদের নিরাপত্তা সুরক্ষার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখে। সাংবাদিকেরা নির্যাতনের শিকার হলে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে এবং শাস্তি প্রদানের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বেশ পোক্ত।
সাংবাদিকেরা খুন হলে খুনিরা বিচারের ঊর্ধ্বে থেকে যায়, কিংবা দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকেরা আক্রান্ত হলে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নীরব দর্শকের মতো চেয়ে চেয়ে দেখেন, পুলিশের সদস্যরা মিথ্যা অভিযোগে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে তাঁকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে রাতভর নির্মম নির্যাতন করেন, আর সেই সাংবাদিক আদালতে জামিন চাইলে বিচারকও তাঁকে জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানান—এই ধরনের ঘটনাবলি কোনো গণতান্ত্রিক দেশে ঘটা অসম্ভব। সংবাদমাধ্যম সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজে সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে, অন্যভাবে বললে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন কর্মসম্পাদন এমন হয় যে তা আপনাআপনিই সুশাসনের পথ প্রশস্ত করে। সরকারের নেতৃবৃন্দের উপলব্ধি করা উচিত যে সংবাদমাধ্যম কোনোভাবেই সরকারের প্রতিপক্ষ নয়; যদি সে কখনো সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়, ক্ষমতা অপব্যবহারের সমালোচনা করে, তবে তা সরকারের শুধরে নেওয়ার সুযোগই সৃষ্টি করে দেয়।
মশিউল আলম: লেখক ও সাংবাদিক৷
mashiul.alam@gmail.com
No comments