ফুলবাড়ী, সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর by আনু মুহাম্মদ
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনের নামে
সরকার বারবার যেসব পথ গ্রহণ করছে, সেগুলো দেশের জন্য সর্বনাশা পথ। ফুলবাড়ী,
সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগর পড়ছে হুমকির মুখে। সুন্দরবন-কৃষিজমি-শহর ধ্বংসী
রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র; ফুলবাড়ী-বড়পুকুরিয়ার উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত
অব্যাহত রাখা; বঙ্গোপসাগরের গ্যাস ব্লক একতরফা অধিকতর সুবিধা দিয়ে বিদেশী
কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়ার জন্য পিএসসি ২০১২ সংশোধন ও পরে তাড়াহুড়া করে
আকর্ষণীয় প্যাকেজ দেয়ার জন্য পিএসসি ২০১৫ প্রণয়ন; কুইক রেন্টালের নামে ১৪
থেকে ১৭ টাকা কিংবা তারও বেশি দরে বিদ্যুৎ ক্রয়; কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
তৈরি না করে, প্রয়োজনীয় সমীক্ষা না করে রূপপুরে বিদেশী কোম্পানিনির্ভর
পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের উদ্যোগ ইত্যাদি দেশী-বিদেশী কতিপয় গোষ্ঠীর
মুনাফা ও লুটপাটের ব্যবস্থা করছে; কিন্তু দেশের জন্য তৈরি করছে বিভিন্নমুখী
বিপদ। আর এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এসব কাজ বিঘ্নহীন করার জন্যই
জ্বালানি খাতে সব অপকর্মের দায়মুক্তি আইনের মেয়াদ সম্প্রতি আবারও
সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
জ্বালানি খাতে সরকারি চলতি বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হল- বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে জনগণের কর্তৃত্ব হ্রাস, দেশী লুটেরা ও বহুজাতিক কোম্পানির কর্তৃত্ব বৃদ্ধি, নিজেদের গ্যাস বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে ক্রয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ও ভর্তুকির চাপ বৃদ্ধি, যার ফলাফল হল একদিকে সংকট ও অনিশ্চয়তা বহাল থাকা, অন্যদিকে বারবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমা সত্ত্বেও তেল ও বিদ্যুতের দাম কমানো হয়নি। কুইক রেন্টালের মেয়াদ এখন ২০২০ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করার অর্থ হল এই বোঝা আরও বাড়ানো এবং আবারও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। সরকারের এসব ভুলনীতি ও দুর্নীতির বোঝা জনগণের ওপর ফেলতে গিয়ে বারবার জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং দেশী-বিদেশী কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে এবারও সরকার এ পথেই অগ্রসর হচ্ছে। দেশী-বিদেশী বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে দেশের মানুষ কেন এই বোঝা বহন করবে? কেন সমগ্র অর্থনীতি এই বোঝা বহন করবে?
ফুলবাড়ীতে আবারও অস্থিতিশীলতা কেন?
ফুলবাড়ী-বিরামপুর-পার্বতীপুর এলাকায় বেআইনি অনুপ্রবেশ, দুর্র্নীতি ও সন্ত্রাস বিস্তারের অপচেষ্টার মাধ্যমে বারবার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে জনপ্রত্যাখ্যাত কোম্পানি এশিয়া এনার্জি (জিসিএম)। সর্বশেষ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সূত্রপাত ২৬ নভেম্বর। ওইদিন গোপনে ফুলবাড়ীতে প্রবেশ করতে গিয়ে জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়েন এশিয়া এনার্জির প্রধান গ্যারি লাই। পরে পুলিশ তাকে জনরোষ থেকে রক্ষা করে নিয়ে আসে ঢাকায়। ২০০৬ সালে লাখো মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সরকারি বাহিনীর মাধ্যমে হামলা-ত্রাস চালিয়ে, গুলি করে মানুষ হত্যা করেও টিকতে পারেনি এই এশিয়া এনার্জি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে গভীর রাতে কোম্পানির সব কর্মকর্তা ফুলবাড়ী ছেড়ে পালিয়েছিল তখন। এ কোম্পানি দেশের আবাদি জমি, পানি ও মানুষের সর্বনাশ করে শতকরা মাত্র ৬ ভাগ রয়্যালিটি দিয়ে দেশের কয়লা বিদেশে পাচার করতে চেয়েছিল। ২৬ আগস্ট সেই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সরকারি বাহিনীর পাইকারি গুলিবর্ষণে শহীদ হন ৩ জন, গুলিবিদ্ধ হন ২০ জন, আহত হন দুই শতাধিক। ৩০ আগস্ট ফুলবাড়ী চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে জনগণের বিজয় সূচিত হয়।
কিন্তু চক্রান্ত থামেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জরুরি অবস্থার সুযোগে কোম্পানি আবারও এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা চালায়। ফুলবাড়ী আন্দোলনের সংগঠকদের ওপর হামলা, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, হুমকি, হয়রানি এবং সেইসঙ্গে সংগঠিত মিথ্যা প্রচারণা কোনোকিছুই জনগণকে হটাতে পারেনি। ২০১২ সালের নভেম্বরে সরকার দশ থানার পুলিশ আনিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে কোম্পানির প্রবেশের রাস্তা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে। জনপ্রতিরোধ সেই চেষ্টাও ব্যর্থ করে দেয়। ২০১৩ সালে বস্ত্র বিতরণের প্রতারণামূলক প্রচার করে গ্যারি লাই গং এলাকায় প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছিল, তখনও জনপ্রতিরোধের মুখে পুলিশের আশ্রয়ে পালিয়েছিল। সর্বশেষ ২৬ নভেম্বরেও তাদের জনতাড়া খেয়ে পালাতে হয়েছে। চক্রান্ত আছে, জনপ্রতিরোধও জারি আছে। এই অবিরাম প্রতিরোধের মাধ্যমে ফুলবাড়ীসহ ছয় থানার মানুষ শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, পুরো বাংলাদেশকে অচিন্তনীয় এক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা করছেন।
বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের সম্পদ নিয়ে এশিয়া এনার্জির (জিসিএম) অপতৎপরতার প্রতিবাদে, এ কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা গ্যারি লাইসহ সহযোগী ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও বিচার এবং এশিয়া এনার্জির বহিষ্কারসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী শাখা ২৬ নভেম্বর থেকে লাগাতার কর্মসূচি পালন করছে। ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দিনব্যাপী অবরোধ শেষে বিভিন্ন গ্রাম, ইউনিয়ন ও পৌরসভায় প্রায় প্রতিদিন মিছিল-সমাবেশ হচ্ছে। ২৭ ডিসেম্বর ফুলবাড়ীতে মহাসমাবেশ আহ্বান করা হয়েছে।
মিথ্যাচার, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও চক্রান্তের ওপর ভর করে দেশে-বিদেশে কোম্পানি ও তার নিযুক্ত প্রচারকদের অপপ্রচার এখনও অব্যাহত আছে। বারবার জনগণের তাড়া খাওয়ার পরও তারা দাবি করে বেড়াচ্ছে জনগণ তাদের সমর্থন করে! আইনি কোনো অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও তারা দাবি করে বেড়াচ্ছে এই খনি তাদের!! পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, সরকারের গোপন পৃষ্ঠপোষকতাতেই তারা এ রকম জালিয়াতির সাহস পাচ্ছে। কোম্পানির পক্ষে মার্কিন দূতাবাস ও ব্রিটিশ হাইকমিশনের তৎপরতাও আমরা জানি। অথচ বহু অপরাধ এ কোম্পানির। সেগুলোর মধ্যে আছে : ১. দেশের পানিসম্পদ, আবাদি জমি ও উত্তরবঙ্গের ধ্বংসযজ্ঞের একটি প্রকল্পকে ঘুষ আর কমিশন দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে প্রচার। ২. কোনো ধরনের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও ফুলবাড়ী কয়লা খনি দেখিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে লন্ডনে এ কোম্পানির শেয়ার ব্যবসা অব্যাহত রাখা। ৩. সেই মুনাফার টাকায় এ দেশে কতিপয় মন্ত্রী, আমলা, কনসালটেন্ট, বিজ্ঞাপনী সংস্থা ভাড়া করে মিথ্যাচার চালানো। ৪. সমর্থকগোষ্ঠী তৈরির চেষ্টায় এলাকায় দুর্নীতি ও মাদকদ্রব্যের বিস্তার ঘটানো। ৫. সম্পদ লুণ্ঠনের প্রয়োজনে খুন, সন্ত্রাস, জখমের নতুন চক্রান্ত ও অপতৎপরতা। এসব অপরাধে এ কোম্পানির কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও বিচার এবং কোম্পানিকে বহিষ্কারের যে দাবি উত্তরবঙ্গের মানুষ তুলেছে তা অবশ্যই ন্যায্য।
অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার ধ্বংসাত্মক উন্মুক্ত খননের বদলে কয়লা উত্তোলনের নিমিত্তে নতুন প্রযুক্তির জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছেন। সেই বক্তব্যের জন্য তিনি সাধুবাদও পেয়েছেন। কিন্তু ২০০৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ফুলবাড়ীর জনগণের কাছে করা তার অঙ্গীকার অনুসারে এশিয়া এনার্জিকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার, উন্মুক্ত কয়লা খনি ও রফতানি নিষিদ্ধসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন তিনি এখনও করেননি। এর ফলে তার সরকারেরই কোনো কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্যকে বিভিন্ন সময়ে উন্মুক্ত খননের পক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য দিতে ও তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে। লবিস্টদের চক্রান্তমূলক কর্মকাণ্ডও অব্যাহত আছে। এদের সাহসেই গ্যারি লাই এবং তার সহযোগীরা উসকানি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে সাহস পাচ্ছে।
মহাবিপদের মুখে সুন্দরবন সুন্দরবন নিয়েও সরকারের স্ববিরোধী ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী একদিকে আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনে সুন্দরবন বাঁচানোর কথা বলছেন, অন্যদিকে তার সরকার দেশী-বিদেশী মুনাফাখোরদের স্বার্থে সুন্দরবনধ্বংসী নানা তৎপরতায় সক্রিয় থাকছে। সুন্দরবনধ্বংসী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল ও বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে গত বছর ঢাকা থেকে সুন্দরবন লংমার্চ ছাড়াও প্রতিবাদী কর্মসূচি অব্যাহত আছে। বিভিন্ন প্রকাশনা, গবেষণার মধ্য দিয়ে বিশেষজ্ঞরা কেন এ কেন্দ্র বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী, সুন্দরবন ও মানববিধ্বংসী, তা বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য-যুক্তিসহ তুলে ধরেছেন। ভারতীয় কোম্পানি (এনটিপিসি) নিজ দেশের আইন ভঙ্গ করে বাংলাদেশের জন্য সর্বনাশা এ প্রকল্পে চালকশক্তি হিসেবে যুক্ত হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষার পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তি, দল, জাতীয় কমিটি ও বিশেষজ্ঞরা বিস্তারিত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে যে সুন্দরবন রক্ষা করে, অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে যা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে সেই সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে এই প্রকল্প।
সরকার এসব যুক্তির প্রতি কর্ণপাত না করে প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রেখেছে, উপরন্তু বাংলাদেশের ওরিয়ন নামে আরেকটি কোম্পানিকে সুন্দরবনের আরও নিকটবর্তী স্থানে আরও একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলে সরকারি ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জমি দখল করে সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে আরও বনজমি দখলের তৎপরতা এখন জোরদার। বিশ্বব্যাংক ও ইউএসএইডের তহবিলে তৈরি হচ্ছে নানা প্রকল্প।
বলাই বাহুল্য, সরকারের এসব ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। ইতিমধ্যে ইউনেস্কো এবং রামসার পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, প্রাণ-বৈচিত্র্যের অসাধারণ আধার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম সুন্দরবন ঘিরে একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মুনাফামুখী তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
আগ্রাসনের মুখে বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের পেট্রোবাংলা মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস আর নরওয়ের স্টেটওয়েলের সমবয়সী হলেও প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পরও এই প্রতিষ্ঠানকে নিজের সক্ষম ভিত্তি দাঁড় করাতে দেয়া হয়নি। অক্ষমতার অজুহাতে, পারি না, পারব না এ আওয়াজের মাধ্যমে লুণ্ঠন ও দুর্নীতির প্রকল্প জায়েজ করা হয়েছে, হচ্ছে। বিশাল সম্ভাবনার বঙ্গোপসাগরের সম্পদ আকর্ষণীয় প্যাকেজে এমনভাবে বিদেশী কোম্পানিকে দেয়া শুরু হয়েছে যে, এই সম্পদ দেশের উন্নয়নে কাজে লাগার পরিবর্তে হয়ে উঠতে যাচ্ছে বিপদ। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও রাশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে বঙ্গোপসাগর ভাগবাটোয়ারা করে দেয়ার আয়োজন চলছে। তার জন্য তাদের চাহিদামতো পিএসসি ২০১৫ প্রণয়নের কাজ চলছে। অথচ এ বঙ্গোপসাগরের সম্পদ বাংলাদেশের শত বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। আগেও পুঁজির অভাবের যুক্তি দিয়ে দেশের সম্পদ বিদেশী কোম্পানির হাতে দেয়া হয়েছে, যার কারণে ১০ থেকে ৩০ গুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। যে পরিমাণ পুঁজি নেই বলে এসব চুক্তি করা হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থ বিদেশী কোম্পানির পক্ষে প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ঋণগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, বারবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে এসব ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণেই। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের পথ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট একটি বাস্তবতা। তার সমাধানে যথাযথ পথ গ্রহণ তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে পথে অগ্রসর হলে এর একটি টেকসই সমাধান হতে পারে, সরকার সে পথে যেতে অনিচ্ছুক। উল্টো ভুল নীতি ও দুর্নীতিযুক্ত নানা প্রকল্প ও চুক্তির জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ছে বারবার, অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত হচ্ছে, দেশী-বিদেশী লুটেরাদের আগ্রাসী তৎপরতায় সুন্দরবন, ফুলবাড়ী ও বঙ্গোপসাগরসহ সম্পদ ও দেশ বিপদাপন্ন হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ সংকটেরও টেকসই সমাধান হচ্ছে না। দেশ ও জনস্বার্থ বিবেচনায় যে পথ-নকশা ধরে অগ্রসর হওয়া দরকার তার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হল : তলাহীন ঝুড়ির মতো দুর্নীতি ও অপচয়ের যেসব রেন্টাল-কুইক রেন্টাল চুক্তি দেশের অর্থনীতির বোঝা, সেগুলো বাতিল করে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট চালু, মেরামত ও নবায়ন করা; খনিজসম্পদ রফতানি নিষিদ্ধকরণ আইন প্রণয়ন করে শতভাগ গ্যাস ও কয়লা বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার; জনবিরোধী পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল করে স্থলভাগে ও সমুদ্রে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে জাতীয় সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ, ক্ষমতা ও বরাদ্দ প্রদান; বিদ্যুৎকে গণপণ্য হিসেবে বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেশীয় মালিকানায় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন; ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করে দেশের কয়লাসম্পদকে রাহুমুক্ত করা; নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানের বিকাশ এবং জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের জন্য বিপর্যস্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুদ্ধার, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ইত্যাদি কাজে অগ্রাধিকার প্রদান।
আনু মুহাম্মদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
জ্বালানি খাতে সরকারি চলতি বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হল- বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে জনগণের কর্তৃত্ব হ্রাস, দেশী লুটেরা ও বহুজাতিক কোম্পানির কর্তৃত্ব বৃদ্ধি, নিজেদের গ্যাস বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে ক্রয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ও ভর্তুকির চাপ বৃদ্ধি, যার ফলাফল হল একদিকে সংকট ও অনিশ্চয়তা বহাল থাকা, অন্যদিকে বারবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমা সত্ত্বেও তেল ও বিদ্যুতের দাম কমানো হয়নি। কুইক রেন্টালের মেয়াদ এখন ২০২০ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করার অর্থ হল এই বোঝা আরও বাড়ানো এবং আবারও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি। সরকারের এসব ভুলনীতি ও দুর্নীতির বোঝা জনগণের ওপর ফেলতে গিয়ে বারবার জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং দেশী-বিদেশী কতিপয় গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে এবারও সরকার এ পথেই অগ্রসর হচ্ছে। দেশী-বিদেশী বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে দেশের মানুষ কেন এই বোঝা বহন করবে? কেন সমগ্র অর্থনীতি এই বোঝা বহন করবে?
ফুলবাড়ীতে আবারও অস্থিতিশীলতা কেন?
ফুলবাড়ী-বিরামপুর-পার্বতীপুর এলাকায় বেআইনি অনুপ্রবেশ, দুর্র্নীতি ও সন্ত্রাস বিস্তারের অপচেষ্টার মাধ্যমে বারবার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে জনপ্রত্যাখ্যাত কোম্পানি এশিয়া এনার্জি (জিসিএম)। সর্বশেষ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সূত্রপাত ২৬ নভেম্বর। ওইদিন গোপনে ফুলবাড়ীতে প্রবেশ করতে গিয়ে জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়েন এশিয়া এনার্জির প্রধান গ্যারি লাই। পরে পুলিশ তাকে জনরোষ থেকে রক্ষা করে নিয়ে আসে ঢাকায়। ২০০৬ সালে লাখো মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সরকারি বাহিনীর মাধ্যমে হামলা-ত্রাস চালিয়ে, গুলি করে মানুষ হত্যা করেও টিকতে পারেনি এই এশিয়া এনার্জি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে গভীর রাতে কোম্পানির সব কর্মকর্তা ফুলবাড়ী ছেড়ে পালিয়েছিল তখন। এ কোম্পানি দেশের আবাদি জমি, পানি ও মানুষের সর্বনাশ করে শতকরা মাত্র ৬ ভাগ রয়্যালিটি দিয়ে দেশের কয়লা বিদেশে পাচার করতে চেয়েছিল। ২৬ আগস্ট সেই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সরকারি বাহিনীর পাইকারি গুলিবর্ষণে শহীদ হন ৩ জন, গুলিবিদ্ধ হন ২০ জন, আহত হন দুই শতাধিক। ৩০ আগস্ট ফুলবাড়ী চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে জনগণের বিজয় সূচিত হয়।
কিন্তু চক্রান্ত থামেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জরুরি অবস্থার সুযোগে কোম্পানি আবারও এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা চালায়। ফুলবাড়ী আন্দোলনের সংগঠকদের ওপর হামলা, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, হুমকি, হয়রানি এবং সেইসঙ্গে সংগঠিত মিথ্যা প্রচারণা কোনোকিছুই জনগণকে হটাতে পারেনি। ২০১২ সালের নভেম্বরে সরকার দশ থানার পুলিশ আনিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে কোম্পানির প্রবেশের রাস্তা পরিষ্কার করার চেষ্টা করে। জনপ্রতিরোধ সেই চেষ্টাও ব্যর্থ করে দেয়। ২০১৩ সালে বস্ত্র বিতরণের প্রতারণামূলক প্রচার করে গ্যারি লাই গং এলাকায় প্রবেশ করতে চেষ্টা করেছিল, তখনও জনপ্রতিরোধের মুখে পুলিশের আশ্রয়ে পালিয়েছিল। সর্বশেষ ২৬ নভেম্বরেও তাদের জনতাড়া খেয়ে পালাতে হয়েছে। চক্রান্ত আছে, জনপ্রতিরোধও জারি আছে। এই অবিরাম প্রতিরোধের মাধ্যমে ফুলবাড়ীসহ ছয় থানার মানুষ শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, পুরো বাংলাদেশকে অচিন্তনীয় এক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা করছেন।
বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডে বাংলাদেশের সম্পদ নিয়ে এশিয়া এনার্জির (জিসিএম) অপতৎপরতার প্রতিবাদে, এ কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা গ্যারি লাইসহ সহযোগী ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও বিচার এবং এশিয়া এনার্জির বহিষ্কারসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ফুলবাড়ী শাখা ২৬ নভেম্বর থেকে লাগাতার কর্মসূচি পালন করছে। ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দিনব্যাপী অবরোধ শেষে বিভিন্ন গ্রাম, ইউনিয়ন ও পৌরসভায় প্রায় প্রতিদিন মিছিল-সমাবেশ হচ্ছে। ২৭ ডিসেম্বর ফুলবাড়ীতে মহাসমাবেশ আহ্বান করা হয়েছে।
মিথ্যাচার, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও চক্রান্তের ওপর ভর করে দেশে-বিদেশে কোম্পানি ও তার নিযুক্ত প্রচারকদের অপপ্রচার এখনও অব্যাহত আছে। বারবার জনগণের তাড়া খাওয়ার পরও তারা দাবি করে বেড়াচ্ছে জনগণ তাদের সমর্থন করে! আইনি কোনো অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও তারা দাবি করে বেড়াচ্ছে এই খনি তাদের!! পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, সরকারের গোপন পৃষ্ঠপোষকতাতেই তারা এ রকম জালিয়াতির সাহস পাচ্ছে। কোম্পানির পক্ষে মার্কিন দূতাবাস ও ব্রিটিশ হাইকমিশনের তৎপরতাও আমরা জানি। অথচ বহু অপরাধ এ কোম্পানির। সেগুলোর মধ্যে আছে : ১. দেশের পানিসম্পদ, আবাদি জমি ও উত্তরবঙ্গের ধ্বংসযজ্ঞের একটি প্রকল্পকে ঘুষ আর কমিশন দিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে প্রচার। ২. কোনো ধরনের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও ফুলবাড়ী কয়লা খনি দেখিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে লন্ডনে এ কোম্পানির শেয়ার ব্যবসা অব্যাহত রাখা। ৩. সেই মুনাফার টাকায় এ দেশে কতিপয় মন্ত্রী, আমলা, কনসালটেন্ট, বিজ্ঞাপনী সংস্থা ভাড়া করে মিথ্যাচার চালানো। ৪. সমর্থকগোষ্ঠী তৈরির চেষ্টায় এলাকায় দুর্নীতি ও মাদকদ্রব্যের বিস্তার ঘটানো। ৫. সম্পদ লুণ্ঠনের প্রয়োজনে খুন, সন্ত্রাস, জখমের নতুন চক্রান্ত ও অপতৎপরতা। এসব অপরাধে এ কোম্পানির কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও বিচার এবং কোম্পানিকে বহিষ্কারের যে দাবি উত্তরবঙ্গের মানুষ তুলেছে তা অবশ্যই ন্যায্য।
অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার ধ্বংসাত্মক উন্মুক্ত খননের বদলে কয়লা উত্তোলনের নিমিত্তে নতুন প্রযুক্তির জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছেন। সেই বক্তব্যের জন্য তিনি সাধুবাদও পেয়েছেন। কিন্তু ২০০৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ফুলবাড়ীর জনগণের কাছে করা তার অঙ্গীকার অনুসারে এশিয়া এনার্জিকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার, উন্মুক্ত কয়লা খনি ও রফতানি নিষিদ্ধসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন তিনি এখনও করেননি। এর ফলে তার সরকারেরই কোনো কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্যকে বিভিন্ন সময়ে উন্মুক্ত খননের পক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য দিতে ও তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে। লবিস্টদের চক্রান্তমূলক কর্মকাণ্ডও অব্যাহত আছে। এদের সাহসেই গ্যারি লাই এবং তার সহযোগীরা উসকানি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে সাহস পাচ্ছে।
মহাবিপদের মুখে সুন্দরবন সুন্দরবন নিয়েও সরকারের স্ববিরোধী ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী একদিকে আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনে সুন্দরবন বাঁচানোর কথা বলছেন, অন্যদিকে তার সরকার দেশী-বিদেশী মুনাফাখোরদের স্বার্থে সুন্দরবনধ্বংসী নানা তৎপরতায় সক্রিয় থাকছে। সুন্দরবনধ্বংসী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল ও বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে গত বছর ঢাকা থেকে সুন্দরবন লংমার্চ ছাড়াও প্রতিবাদী কর্মসূচি অব্যাহত আছে। বিভিন্ন প্রকাশনা, গবেষণার মধ্য দিয়ে বিশেষজ্ঞরা কেন এ কেন্দ্র বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী, সুন্দরবন ও মানববিধ্বংসী, তা বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য-যুক্তিসহ তুলে ধরেছেন। ভারতীয় কোম্পানি (এনটিপিসি) নিজ দেশের আইন ভঙ্গ করে বাংলাদেশের জন্য সর্বনাশা এ প্রকল্পে চালকশক্তি হিসেবে যুক্ত হয়েছে। সুন্দরবন রক্ষার পক্ষে বিভিন্ন ব্যক্তি, দল, জাতীয় কমিটি ও বিশেষজ্ঞরা বিস্তারিত তথ্য ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ ও প্রকৃতিকে যে সুন্দরবন রক্ষা করে, অসাধারণ জীববৈচিত্র্যের আধার হিসেবে যা প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে সেই সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে এই প্রকল্প।
সরকার এসব যুক্তির প্রতি কর্ণপাত না করে প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রেখেছে, উপরন্তু বাংলাদেশের ওরিয়ন নামে আরেকটি কোম্পানিকে সুন্দরবনের আরও নিকটবর্তী স্থানে আরও একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছে। সুন্দরবন অঞ্চলে সরকারি ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জমি দখল করে সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে আরও বনজমি দখলের তৎপরতা এখন জোরদার। বিশ্বব্যাংক ও ইউএসএইডের তহবিলে তৈরি হচ্ছে নানা প্রকল্প।
বলাই বাহুল্য, সরকারের এসব ভূমিকা আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। ইতিমধ্যে ইউনেস্কো এবং রামসার পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, প্রাণ-বৈচিত্র্যের অসাধারণ আধার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাকৃতিক রক্ষাবর্ম সুন্দরবন ঘিরে একাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মুনাফামুখী তৎপরতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
আগ্রাসনের মুখে বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের পেট্রোবাংলা মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস আর নরওয়ের স্টেটওয়েলের সমবয়সী হলেও প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পরও এই প্রতিষ্ঠানকে নিজের সক্ষম ভিত্তি দাঁড় করাতে দেয়া হয়নি। অক্ষমতার অজুহাতে, পারি না, পারব না এ আওয়াজের মাধ্যমে লুণ্ঠন ও দুর্নীতির প্রকল্প জায়েজ করা হয়েছে, হচ্ছে। বিশাল সম্ভাবনার বঙ্গোপসাগরের সম্পদ আকর্ষণীয় প্যাকেজে এমনভাবে বিদেশী কোম্পানিকে দেয়া শুরু হয়েছে যে, এই সম্পদ দেশের উন্নয়নে কাজে লাগার পরিবর্তে হয়ে উঠতে যাচ্ছে বিপদ। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও রাশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে বঙ্গোপসাগর ভাগবাটোয়ারা করে দেয়ার আয়োজন চলছে। তার জন্য তাদের চাহিদামতো পিএসসি ২০১৫ প্রণয়নের কাজ চলছে। অথচ এ বঙ্গোপসাগরের সম্পদ বাংলাদেশের শত বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। আগেও পুঁজির অভাবের যুক্তি দিয়ে দেশের সম্পদ বিদেশী কোম্পানির হাতে দেয়া হয়েছে, যার কারণে ১০ থেকে ৩০ গুণ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। যে পরিমাণ পুঁজি নেই বলে এসব চুক্তি করা হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি অর্থ বিদেশী কোম্পানির পক্ষে প্রতি বছর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ঋণগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি, বারবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে এসব ভুল নীতি ও দুর্নীতির কারণেই। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের পথ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট একটি বাস্তবতা। তার সমাধানে যথাযথ পথ গ্রহণ তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে পথে অগ্রসর হলে এর একটি টেকসই সমাধান হতে পারে, সরকার সে পথে যেতে অনিচ্ছুক। উল্টো ভুল নীতি ও দুর্নীতিযুক্ত নানা প্রকল্প ও চুক্তির জন্য বিদ্যুতের দাম বাড়ছে বারবার, অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত হচ্ছে, দেশী-বিদেশী লুটেরাদের আগ্রাসী তৎপরতায় সুন্দরবন, ফুলবাড়ী ও বঙ্গোপসাগরসহ সম্পদ ও দেশ বিপদাপন্ন হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ সংকটেরও টেকসই সমাধান হচ্ছে না। দেশ ও জনস্বার্থ বিবেচনায় যে পথ-নকশা ধরে অগ্রসর হওয়া দরকার তার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হল : তলাহীন ঝুড়ির মতো দুর্নীতি ও অপচয়ের যেসব রেন্টাল-কুইক রেন্টাল চুক্তি দেশের অর্থনীতির বোঝা, সেগুলো বাতিল করে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট চালু, মেরামত ও নবায়ন করা; খনিজসম্পদ রফতানি নিষিদ্ধকরণ আইন প্রণয়ন করে শতভাগ গ্যাস ও কয়লা বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার; জনবিরোধী পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল করে স্থলভাগে ও সমুদ্রে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে জাতীয় সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ, ক্ষমতা ও বরাদ্দ প্রদান; বিদ্যুৎকে গণপণ্য হিসেবে বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেশীয় মালিকানায় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন; ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করে দেশের কয়লাসম্পদকে রাহুমুক্ত করা; নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাতকে শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানের বিকাশ এবং জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের জন্য বিপর্যস্ত জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুদ্ধার, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা ইত্যাদি কাজে অগ্রাধিকার প্রদান।
আনু মুহাম্মদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
No comments