বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সুন্দরবনে
উদ্বেগ,
উৎকণ্ঠা সর্বত্র। নানা শঙ্কা চারদিকে। তেল দূষণে পরিবেশের ওপর প্রভাব নিয়ে
দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন। ইতিমধ্যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে
সুন্দরবনে। সুন্দরবনকে ঘিরে বিরল প্রজাতির ইরাবতী ডলফিন বসবাসের অভয়ারণ্য।
দূষণের প্রভাবে ডলফিন বিলুপ্তির শঙ্কাও রয়েছে। ভয়াবহ দূষণে পরিবেশের ওপর
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ারও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ওদিকে তেলের আস্তরণে
গতকাল রাসায়নিক পদার্থ ছিটানো শুরু করলে বন বিভাগের বাধায় তা স্থগিত করা
হয়। তবে খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কেমিস্ট রাসায়নিকটি পরীক্ষা করছেন।
ওদিকে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে ঘটনার ৪ দিন পরও ভেসে
থাকা তেলের ক্ষেত্রে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার থেকে ভাসমান
তেল সংগ্রহে মাঠে নেমেছে স্থানীয়রা। তারা ফোম, ছালার চট-কলাপাতা দিয়ে তেল
সংগ্রহ করছে। পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এ তেল কিনে রাখছে ৩০ টাকা লিটার দরে।
গতকাল পর্যন্ত ১০০০ লিটার তেল সংগ্রহ হয়েছে। ভাসমান তেল সংগ্রহে জনগণকে
আগ্রহী করতে মাইকিং করা হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বন ও পরিবেশ
মন্ত্রণালয়ের করা পৃথক দুটি কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ইতিমধ্যে
সরকারের ভেতর-বাইরে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তেল ছড়িয়ে পড়ার পর সরকারের
বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছেন আওয়ামী লীগের
উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য
সুন্দরবন নিয়ে নৌমন্ত্রণালয় এতখানি উদাসীনতা দেখাবে তা আমি আশা করিনি।
স্থানীয় পদ্ধতিতে তেল সংগ্রহকে তিনি তুলনা করেছেন রোগীর মৃত্যুর পর
অস্ত্রোপচার সফল হওয়ার দাবির সঙ্গে। ওদিকে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বিবিসিকে
বলেছেন। রোববার বৃটিশ তেল শোধনাগার কোম্পানির লোকজন আসছেন বাংলাদেশে। তারা
তেল অপসারণে কাজ করবে।
বালি পরিবহনের কার্গো দিয়ে পরিবহন হচ্ছিল তেল
রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে জানান, সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েল বোঝাই সাউদার্ন স্টার-৭ ট্যাঙ্কার তেল পরিবহনের উপযোগী ছিল না। এ নৌযানটি মূলত বালি পরিবহন কার্গো ছিল। অধিক মুনাফা লাভের আশায় কার্গোটি রাতারাতি তেলবাহী পরিবহন হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। কার্গোর মালিক ভোলার মেসার্স হারুন অ্যান্ড কোং। নাম আমির হোসেন ফরিদ। তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের শ্যালক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। তার ট্যাঙ্কারের তেল পরিবহনের যথাযথ কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীর শ্যালক হওয়ায় দাপট দেখিয়ে কাজ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনার চারদিন পরও দুর্ঘটনাস্থলে আসেনি ট্যাঙ্কারের মালিক। তার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও মুখ খুলছে না। এর মধ্যে একটি মহল ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। শুক্রবার বেলা আড়াইটায় টাগবোটে অবস্থানরত পরিবেশ অধিদফতরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেন জানান, এই অয়েল স্পিলড ডিসপারসেন্ট কোন দেশ থেকে আমদানি করা, এটি তৈরি ও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ, এর আমদানি কোড এবং রাসায়নিক নাম ঢাকার পরিবেশ অধিদপ্তরের পরীক্ষাগারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলেই এটি ছিটানো শুরু হবে। টাগবোটের ভেতরেই খুলনা পরিবেশ অধিদফতর থেকে আসা একজন কেমিস্ট রাসায়নিকটি পরীক্ষা করছেন জানিয়ে মল্লিক আনোয়ার আরও জানান, এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল ইতিবাচক হলে এক দিনেই কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। কোন কোন রুটে এই রাসায়নিকটি ছিটানো হবে? তিনি বলেন, যে চ্যানেলে জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে সেই চ্যানেলেই রাসায়নিকটি ছিটানো হবে। তিনি আরও বলেন, ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহের জন্য বৃহস্পতিবার থেকেই জেলে ও স্থানীয়রা কাজ করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানির লোকজন ওই সংগৃহীত তেল কিনে নিচ্ছেন।
এদিকে ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার ফলে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি জলজ প্রাণীর ব্যাপক প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার পর সমন্বয়হীনতার অভাবে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নৌপরিবহন, মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষ, বন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পরিবেশ অধিদফতর যৌথভাবে কোন কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারিনি। যে কারণে ঘটনার চারদিন পরও নদীতে তেল ভাসছে। জ্বালানি তেল পরিবহন ব্যবসায়ী সুলতান মাহমুদ পিন্টু জানান, জ্বালানি তেল নৌপথে পরিবহনের জন্য ট্যাঙ্কার ব্যবহার করার বিধি বিধান রয়েছে। এজন্য ট্যাঙ্কারগুলো শুধুমাত্র তেল পরিবহনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। যাতে ঢেউ বা কোন আঘাত লাগলে এক হ্যাচের তেল অন্য কোন দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে না।
ছোটখাটো আঘাতেও সেই ট্যাঙ্কারের কোন ক্ষতি হয় না। ওটি সাউদান স্টার-৭ গত ৭ই ডিসেম্বর খালিশপুরস্থ পদ্মা ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস ওয়েল বোঝাই করে গোপালগঞ্জ বিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য যাচ্ছিলেন। যার বাজার মূল্য দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা। পদ্মা তেল কোম্পানির ডিপো ম্যানেজার আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ট্যাঙ্কারের পরিবর্তে কার্গোতে ফার্নেল অয়েল সরবরাহ করলেন কেন? জানাতে চাইলে তিনি জানান, সরকার যখন জরুরি বিদ্যুৎ প্লান্ট তৈরি করে তখনই জরুরি ভিত্তিতে ফার্নেস অয়েল পরিবহনের জন্য এই ধরনের কার্গোকে সাময়িক অনুমতি দিয়ে ছিল। সে কারণে তারা ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করেন। পদ্মা তেল কোম্পানির সহকারী জেনারেল ম্যানেজার ইব্রাহিম হাফিজুর রহমান জানান, বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর জন্য তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করেন। তিনি জানান, পরিবহন ঠিকাদার তাদের জানিয়েছেন শ্যালা নদীতে কুয়াশার জন্য নৌ-যানটি নোঙর করেছিল এবং পরে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। তিনি জানান, ঠিকাদার নিয়োগ করে বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর কর্তৃপক্ষ। এখানে তাদের কিছু করণীয় নাই। এ ব্যাপারে পরিবহন ঠিকাদার ভোলার মেসার্স হারুন অ্যান্ড কো. এর মালিক আমির হোসেন ফরিদ জানান, কার্গোটি প্রথমে বালি পরিবহন করা হলেও পরে তেল পরিবহন করার জন্য মিনি ট্যাঙ্কারে রূপান্তর করা হয়। এবং আটটি পাম্প বসানো হয়েছে। এটি কত সালে তৈরি তা তিনি বলতে পারেননি। অতিরিক্ত তেল ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি দাবি করেন, কার্গোটির বীমা করা থাকলেও ফার্নেস অয়েল পরিবহনের কোন বীমা ছিল না। সুন্দরবন বিভাগের নির্দেশ থাকলেও কার্গোটি বন বিভাগের জেটিতে নোঙর না করে কেন নদীর মাঝখানে নোঙর করা হলো- এমন প্রশ্ন করলে আমির হোসেন ফরিদ জানান, মাস্টারকে না পাওয়া গেলে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া যাবে না। নিজেকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের শ্যালক কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তিনি আমার ছোট ভগ্নিপতি। আমার পিতার নাম খোরশেদুর রহমান তালুকদার। গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার ধনিয়ায়। তিনি বরিশাল শহরের ব্রান্ড কম্পাউন্ড রোডের সাজমী ভবন নামের একটি বাড়িতে বসবাস করেন। অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা নেয়ার কথা জানতে চাওয়া হলে তিনি অভিযোগটি সঠিক নয় বলে সাংবাদিকদের জানান। উল্লেখ্য, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচলরত সকল নৌযান নোঙর করলে বন বিভাগের জেটিতে নোঙর করে থাকার বিধি বিধান রয়েছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থপনা ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও মো. জাহিদুল কবির জানান, ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার ফলে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি জলজ প্রাণীর ব্যাপক প্রাণ নাশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু জলজ প্রাণী রয়েছে যারা সূর্যের আলোক রশ্মির মাধ্যমে যে খাদ্য তৈরি হয় তা গ্রহণ করে। নদীতে তেল ভাসার কারণে সূর্যের রশ্মি প্রবেশ না করতে পারায় বেশ কিছু জলজ প্রাণীর খাদ্য তৈরি হবে না। যার ফলে খাদ্যের অভাবে মাছসহ কিছু জলজ প্রাণী মারা যেতে পারে। যে এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটি ছিল ডলফিনের অভয়ারণ্য কিন্তু দুর্ঘটনার পর থেকে ওই এলাকায় কোন ডলফিন দেখা যাচ্ছে না। আমরা ধারণা করছি, ডলফিন এলাকা ছেড়ে অনত্র চলে গেছে। এছাড়া এই তেল বন্য প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করলে দু’এক সপ্তাহের মধ্যে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। এ ঘটনায় মাটি ও পানির দীর্ঘস্থায়ী কোন ক্ষতির সম্ভাবনা আছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করার জন্য আমরা নমুনা সংগ্রহ করেছি। তবে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঘটনার পরপরই নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নিলে এতটা বিপর্যয় ঘটত না। সুন্দরবনের নদী-খালগুলোতে বিপুল পরিমাণ ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়াই দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কটে পড়তে পারে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের। চারদিনেও তেল অপসারণ না হওয়ায় নদীর মাছ ও বনের গাছ মরে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাঘ ও হরিণসহ সুন্দরবনের সব পশুপাখি সঙ্কটে পড়বে।
এ ব্যাপারে খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ফরেস্টি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. নবিউল ইসলাম খান বলেন, ফার্নেস অয়েল জোয়ারের সময় সুন্দরবনের ভেতর ঢুকছে এবং গাছপালার গায়ে ও মাটিতে ঢুকে পড়েছে। এতে মাটির নিচে যে শেকড় রয়েছে তা পচে যাবে। তার ধারণা আগামী ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে বিষয়টি দৃশ্যমান হতে পারে। এদিকে নৌ-বাহিনীর ‘শহীদ আখতার উদ্দিন’ ও ‘শাহ পরাণ’ জাহাজ দু’টি ডাইভিং এবং স্যালভেজ টিমসহকারে ঘটনাস্থল ও আশেপাশে এলাকায় বাঁশ ও রাবারের ফ্রেম দিয়ে বুম তৈরি করে আরও ফার্নেস ওয়েল যাতে নদীতে ছড়িয়ে না পড়ে সে লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নৌবাহিনী উক্ত নদী পথে নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রণে যথাযথ তদারকি করছে।
এদিকে মংলাবন্দরের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, তেল অপসারণে করণীয় নির্ধারণে মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষের সম্মেলন কক্ষে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান শামসুজ্জোহা খন্দকারের সভাপতিত্বে বন বিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে স্থানীয় জেলেদের সহায়তা নিয়ে আগামী তিন দিনের মধ্যে তেল অপসারণের একটি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কাণ্ডারী-১০ দুপুরে সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট এলাকায় আসলেও তা থেকে তেল শোধনের পাউডার ছিটানো নিয়ে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়। পাউডারের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া তা ছিটানোর বিপক্ষে বন বিভাগ অবস্থান নেয়। বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান শামসুজ্জোহা খন্দকার সাংবাদিকদের জানান, নদীতে ছড়িয়ে পড়া তেল স্থানীয় জেলেদের সহায়তায় আগামী তিন দিন ফোমের সাহায্যে সংগ্রহ করা হবে। এ কারণে পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত এই চ্যানেলে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, কাণ্ডারী-১০ এসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পাউডার ছিটানোর কথা থাকলেও সকালে জরুরি বৈঠকে পাউডার ছিটানোর ক্ষতিকর দিক বিবেচনা ও ছাড়পত্র পাওয়ার পর তা ছিটানোর জন্য বন বিভাগের পক্ষ থেকে মত দেয়া হয়েছে। ফলে পাউডার ছিটানোর ব্যাপারে আপতত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ছাড়পত্রে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে তিনি জানান। জয়মনি এলাকার জাহাজ নিরাপত্তা কমিটির সভাপতি মো. রনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবার পর থেকে সুন্দরবনের নদীগুলোতে বিষাক্ত কালো কালো তেলের কালো থাবা যেন খামচে খাচ্ছে প্রাকৃতিক এ সুন্দরবনকে। তিনি আরও জানান, জয়মনি এলাকার কোল ঘেঁষে খরমা নদী। প্রতিদিনই সেই নদী পার হয়ে এলাকার গবাদি পশু সুন্দরবনে প্রবেশ করে। কিন্তু তিন দিন ধরে ওই খালে কোন গবাদি পশু পার হয় না। বর্তমানে খালে মাছ, সাপ, হাঁস, মরে পড়ে রয়েছে। জয়মনি এলাকার ভ্যানচালক রাজেন (৪৩) বলেন তেলের গন্ধে রাতে ঘুমাতে পারি না। এমন কি নদীতে নেমে কেউ পুকুরে পা ধুতে গেলে ওই পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে মাছ মরে যাচ্ছে। চাঁদপাই ফরেস্ট স্টেশনের রেঞ্জার আবুল কালাম আজাদ ঘটনার ভয়াবহতা স্বীকার করে বলেন, তেলের বিষক্রিয়ায় ছোট ছোট মাছ আগেই মারা গেছে। এখন বড় মাছ মরার কারণে এটা চোখে পড়ছে।
সুন্দরবনের সম্পদ এখন সঙ্কটে: সুন্দরবনে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে বাংলাদেশ অংশে স্থল ভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার। আর ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খাল নিয়ে জল ভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ। মানুষের কারণে সুন্দরবনের আয়তন আজ এখানে এসে ঠেকেছে। সুন্দরবনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, এ উদ্ভিদকূলের ৭৩ ভাগই হচ্ছে সুন্দরী গাছ, ১৬ ভাগ গেওয়া। ১শ৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রল হরিণসহ ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩শ’ প্রজাতির পাখি। বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, কুমির, ২১০ প্রজাতির মাছ, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১ প্রজাতির লবস্টার ও ৪২ প্রজাতির শামুক, ঝিনুক রয়েছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের সম্পদের হিসাব করা কঠিন। সুন্দরবনে দৃশ্যমান সম্পদের পরিমাণ ১৫৮ কোটি ৯ হাজার ৮শ’৭ পয়েন্ট ৮০ বিলিয়ন টাকা। এসব কারণে পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন হচ্ছে প্রকৃতির অপর বিস্ময়। সুন্দরবনের এ সম্পদের সবটাই এখন সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক হিসাব মতে, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের নন্দপাড়া নদী থেকে শ্যালা নদী হয়ে আন্ধারমানিক নদী পর্যন্ত মাছসহ জলজ প্রাণিসহ ডলফিনের অভয়াশ্রম এখন চরম অস্তিত্ব সঙ্কটে। গত মঙ্গলবার এ অয়েল ট্যাঙ্কার ডুবির পর থেকে ডলফিনের এ অভয়াশ্রমে আর ডলফিনের দেখা মিলছে না। এসব এলাকার প্রায় ৫০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গাছপালার শ্বাসমূলে তেলের আস্তরণ পড়ায় ম্যানগ্রোভ বনের গাছপালা দু’সপ্তাহার মধ্যে মরতে শুরু করবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এমন মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগের মুখোমুখি সুন্দরবন আর কখনো পড়েনি।
তেল সরানোর প্রস্তাব দিয়েছে একটি বৃটিশ প্রতিষ্ঠান
বৃটিশ একটি প্রতিষ্ঠান তেল সরানোর কাজে বাংলাদেশকে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এ কথা জানিয়েছেন। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে তিনি বলেন, লন্ডনভিত্তিক একটি দল আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে। তারা রোববার ঢাকায় এসে পৌঁছুবে বলে আশা করছি। আমরা তাদের নিয়ে বৈঠক করব। আশা করি, এ বৈঠকে আমরা ভাল একটা ফল পাবো। তারা তেল উত্তোলনের ক্ষেত্রে কি ধরনের সাহায্য করতে পারবে আমাদের সে প্রস্তাব দেবে। আমরা যদি দেখি সেটা উপযোগী আমরা সেই কাজটি করার জন্য তাদের সুযোগ করে দেবো। ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বা এ কাজে তাদের অভিজ্ঞতা আছে কিনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মন্ত্রী বলেন, তিনি এখনও বিস্তারিত জানেন না। মাত্র একটা প্রস্তাব তারা পেয়েছেন। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টা রোববারের সভায় আমরা জানতে পারবো। প্রতিষ্ঠানটি নিজেরাই এ প্রস্তাব দিয়েছে এবং তারা এ কাজ করে থাকে জানিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সরকার প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করেছে এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, মূলত তাদের কাছে খবরই দেরিতে এসেছে। সরকার প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করেছে এটা সঠিক নয়। বনের ভেতর বাণিজ্যক নৌযান চলাচল বন্ধে ইউএনডিপি যে আহ্বান জানিয়েছে সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এখন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। আর বিকল্প একটি যাত্রাপথ তৈরির কাজ চলছে যা এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পরিবেশ মন্ত্রনালয়ে বিশেষজ্ঞরা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে তেল অপসারণের কাজ আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, রাসায়নিক পদার্থ ছিটানো হলে আরও ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। একটি বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেবে। প্রধান বন সংরক্ষক ইউনূস আলী বলেছেন, কেমিস্টদের একটি দল ঢাকা থেকে আজ ঘটনাস্থলে যাবেন। ঘটনার চার দিনের মাথায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষজ্ঞ দলকে গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সে দলের একজন সদস্য এবং খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিষয়ক শিক্ষক দিলিপ কুমার দত্ত বলেছেন, ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে। এখন সেটাকে বাদ দিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে। গ্রামবাসী আর জেলেদের উদ্বুদ্ধ করে পুরোনো পদ্ধতিতে নদী থেকে তেল সরানোর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে ছোট ছোট নৌকায় করে স্থানীয়রা বালতি আর হাড়ি পাতিল নিয়ে ফোম দিয়ে তেল তুলছেন। স্থানীয় নিবাসীদের সহায়তায় তেল সরানোর কাজ এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
এপি: হুমকির মুখে জলজ প্রাণিকুল
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বাংলাদেশের সুন্দরবনে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার পর দেশটির কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে পরিবেশ বিপর্যয়ের মাত্রা পর্যালোচনা করছে। কর্মকর্তারা এবং স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটটিতে তেল ছড়িয়ে পড়ার পর হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার জীববৈচিত্র্য। গতকাল কর্মকর্তারা জানিয়েছে, শেলা নদীতে প্রায় ৭০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়েছে। জলজ প্রাণীদের অভয়ারণ্য সুন্দরবন এখন হুমকির মুখে। শেলা নদীর সঙ্গে কমপক্ষে ২০টি খালের সংযোগ রয়েছে। এছাড়া সংযোগ আছে আরেকটি নদী পশুরের সঙ্গে। প্রভাব পড়েছে এসব নদী নালাতেও। বাংলাদেশ বন বিভাগের প্রধান রক্ষক তপন কুমার দে জানিয়েছেন, বিরল প্রজাতির ইরাবতি ডলফিনসহ অনেক জলজ প্রাণী এখন হুমকির মুখে। তিনি আরও বলেস, জীববৈচিত্র্যে ক্ষতির উচ্চমাত্রায় ঝুঁকি রয়েছে। তবে এখনও ডলফিন বা কুমিরসহ অন্য কোন কোন প্রাণীর মৃত্যুর সংবাদ আসেনি। ডুবে যাওয়া ট্যাংকার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা গিয়াসুদ্দিন জানিয়েছেন, ট্যাংকারটি ডুবে যাওয়ার ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় পর উদ্ধার করা হয়েছে। তপন কুমার দে বলেন, প্রাথমিক প্রভাবের মাত্র নির্ণয় করতে বিভিন্ন দল প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। এটা বড় ধরনের বিপর্যয় আর আমরা পুরো পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন স্থানে ডলফিনদের বাতাসের জন্য পানি থেকে উপরে উঠতে দেখা গেছে। আর এ বিপর্যয়ের পর কুমিরদের আনাগোনা কমে গেছে। তাদের কি অবস্থা তা বোঝার চেষ্টা চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আল-জাজিরা: স্পঞ্জ-বস্তা দিয়ে তেল সংগ্রহ করছে গ্রামবাসী
স্পঞ্জ আর বস্তা দিয়ে তেল সংগ্রহ শুরু করেছে গ্রামবাসী। ব্যাপক পরিমাণ তেল ছড়িয়ে পড়ার পর পরিবেশবিদরা বিরল প্রাণী ডলফিনের অভয়ারণ্য এ এলাকায় বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার একটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার অপর একটি জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষের পর এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে হাজার হাজার লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে। এ সুন্দরবনে বিরল ইরাবতি আর গঙ্গা ডলফিনদের বাস। বাংলাদেশ সরকার তেল অপসারণের সরঞ্জাম সহ একটি জাহাজ ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, ছড়িয়ে পড়া রাসায়নিক দ্রব্য সুন্দরবনের সংবেদনশীল জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সুন্দরবনের প্রধান বন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেছেন, করণীয় কোনটা সর্বোত্তম হবে কর্তৃপক্ষ এখনও নিশ্চিত নয়। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেছেন, সুন্দরবনে এটা নজিরবিহীন বিপর্যয় আর এটা কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে তা আমরা জানি না। তিনি আরও বলেছেন, আমরা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন কারণ এটা ঘটেছে সংবেদনশীল ও নাজুক ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে। কর্মকর্তারা বলছেন, যা ক্ষতি হবার ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, কেননা তেল দ্বিতীয় আরেকটি নদীতে এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত সুন্দরবনের খালগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সমাজের বাংলাদেশ প্রধান রুবায়াত মানসুর বলেছেন, বেশির ভাগ তেল ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি জানান, গতকাল সকালে যখন তিনি ডুবে যাওয়া ট্রলারে যান তখন সেখানে মাত্র কয়েক শ’ লিটার তেল অবশিষ্ট ছিল। তিনি আরও বলেছেন, তেল অপসারণ সরঞ্জামগুলো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের উপযোগী নয়। এজন্য তিনি গ্রামবাসীদের নদীতে পাতা তাদের জাল দিয়ে তেল সংগ্রহে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন। সুন্দরবনে শ’ শ’ বিপন্ন ডলফিন রয়েছে কয়েকটি গবেষণা এ তথ্য সামনে আসার পর ২০১১ সালে বাংলাদেশ সুন্দরবনকে অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলেছে। এখানে মাছধরা নিষিদ্ধ হলেও ট্যাঙ্কার বা অন্যান্য নৌকা যাতায়াতের অনুমতি রয়েছে।
বালি পরিবহনের কার্গো দিয়ে পরিবহন হচ্ছিল তেল
রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে জানান, সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস অয়েল বোঝাই সাউদার্ন স্টার-৭ ট্যাঙ্কার তেল পরিবহনের উপযোগী ছিল না। এ নৌযানটি মূলত বালি পরিবহন কার্গো ছিল। অধিক মুনাফা লাভের আশায় কার্গোটি রাতারাতি তেলবাহী পরিবহন হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। কার্গোর মালিক ভোলার মেসার্স হারুন অ্যান্ড কোং। নাম আমির হোসেন ফরিদ। তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের শ্যালক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। তার ট্যাঙ্কারের তেল পরিবহনের যথাযথ কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীর শ্যালক হওয়ায় দাপট দেখিয়ে কাজ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনার চারদিন পরও দুর্ঘটনাস্থলে আসেনি ট্যাঙ্কারের মালিক। তার বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও মুখ খুলছে না। এর মধ্যে একটি মহল ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। শুক্রবার বেলা আড়াইটায় টাগবোটে অবস্থানরত পরিবেশ অধিদফতরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেন জানান, এই অয়েল স্পিলড ডিসপারসেন্ট কোন দেশ থেকে আমদানি করা, এটি তৈরি ও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ, এর আমদানি কোড এবং রাসায়নিক নাম ঢাকার পরিবেশ অধিদপ্তরের পরীক্ষাগারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলেই এটি ছিটানো শুরু হবে। টাগবোটের ভেতরেই খুলনা পরিবেশ অধিদফতর থেকে আসা একজন কেমিস্ট রাসায়নিকটি পরীক্ষা করছেন জানিয়ে মল্লিক আনোয়ার আরও জানান, এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল ইতিবাচক হলে এক দিনেই কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। কোন কোন রুটে এই রাসায়নিকটি ছিটানো হবে? তিনি বলেন, যে চ্যানেলে জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে সেই চ্যানেলেই রাসায়নিকটি ছিটানো হবে। তিনি আরও বলেন, ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহের জন্য বৃহস্পতিবার থেকেই জেলে ও স্থানীয়রা কাজ করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানির লোকজন ওই সংগৃহীত তেল কিনে নিচ্ছেন।
এদিকে ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার ফলে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি জলজ প্রাণীর ব্যাপক প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার পর সমন্বয়হীনতার অভাবে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নৌপরিবহন, মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষ, বন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পরিবেশ অধিদফতর যৌথভাবে কোন কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারিনি। যে কারণে ঘটনার চারদিন পরও নদীতে তেল ভাসছে। জ্বালানি তেল পরিবহন ব্যবসায়ী সুলতান মাহমুদ পিন্টু জানান, জ্বালানি তেল নৌপথে পরিবহনের জন্য ট্যাঙ্কার ব্যবহার করার বিধি বিধান রয়েছে। এজন্য ট্যাঙ্কারগুলো শুধুমাত্র তেল পরিবহনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়। যাতে ঢেউ বা কোন আঘাত লাগলে এক হ্যাচের তেল অন্য কোন দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে না।
ছোটখাটো আঘাতেও সেই ট্যাঙ্কারের কোন ক্ষতি হয় না। ওটি সাউদান স্টার-৭ গত ৭ই ডিসেম্বর খালিশপুরস্থ পদ্মা ডিপো থেকে ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস ওয়েল বোঝাই করে গোপালগঞ্জ বিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য যাচ্ছিলেন। যার বাজার মূল্য দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা। পদ্মা তেল কোম্পানির ডিপো ম্যানেজার আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ট্যাঙ্কারের পরিবর্তে কার্গোতে ফার্নেল অয়েল সরবরাহ করলেন কেন? জানাতে চাইলে তিনি জানান, সরকার যখন জরুরি বিদ্যুৎ প্লান্ট তৈরি করে তখনই জরুরি ভিত্তিতে ফার্নেস অয়েল পরিবহনের জন্য এই ধরনের কার্গোকে সাময়িক অনুমতি দিয়ে ছিল। সে কারণে তারা ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করেন। পদ্মা তেল কোম্পানির সহকারী জেনারেল ম্যানেজার ইব্রাহিম হাফিজুর রহমান জানান, বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর জন্য তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ফার্নেস অয়েল সরবরাহ করেন। তিনি জানান, পরিবহন ঠিকাদার তাদের জানিয়েছেন শ্যালা নদীতে কুয়াশার জন্য নৌ-যানটি নোঙর করেছিল এবং পরে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। তিনি জানান, ঠিকাদার নিয়োগ করে বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোর কর্তৃপক্ষ। এখানে তাদের কিছু করণীয় নাই। এ ব্যাপারে পরিবহন ঠিকাদার ভোলার মেসার্স হারুন অ্যান্ড কো. এর মালিক আমির হোসেন ফরিদ জানান, কার্গোটি প্রথমে বালি পরিবহন করা হলেও পরে তেল পরিবহন করার জন্য মিনি ট্যাঙ্কারে রূপান্তর করা হয়। এবং আটটি পাম্প বসানো হয়েছে। এটি কত সালে তৈরি তা তিনি বলতে পারেননি। অতিরিক্ত তেল ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি দাবি করেন, কার্গোটির বীমা করা থাকলেও ফার্নেস অয়েল পরিবহনের কোন বীমা ছিল না। সুন্দরবন বিভাগের নির্দেশ থাকলেও কার্গোটি বন বিভাগের জেটিতে নোঙর না করে কেন নদীর মাঝখানে নোঙর করা হলো- এমন প্রশ্ন করলে আমির হোসেন ফরিদ জানান, মাস্টারকে না পাওয়া গেলে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া যাবে না। নিজেকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের শ্যালক কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তিনি আমার ছোট ভগ্নিপতি। আমার পিতার নাম খোরশেদুর রহমান তালুকদার। গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার ধনিয়ায়। তিনি বরিশাল শহরের ব্রান্ড কম্পাউন্ড রোডের সাজমী ভবন নামের একটি বাড়িতে বসবাস করেন। অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা নেয়ার কথা জানতে চাওয়া হলে তিনি অভিযোগটি সঠিক নয় বলে সাংবাদিকদের জানান। উল্লেখ্য, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচলরত সকল নৌযান নোঙর করলে বন বিভাগের জেটিতে নোঙর করে থাকার বিধি বিধান রয়েছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থপনা ও প্রাকৃতিক সংরক্ষণ বিভাগের ডিএফও মো. জাহিদুল কবির জানান, ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার ফলে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি জলজ প্রাণীর ব্যাপক প্রাণ নাশের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু জলজ প্রাণী রয়েছে যারা সূর্যের আলোক রশ্মির মাধ্যমে যে খাদ্য তৈরি হয় তা গ্রহণ করে। নদীতে তেল ভাসার কারণে সূর্যের রশ্মি প্রবেশ না করতে পারায় বেশ কিছু জলজ প্রাণীর খাদ্য তৈরি হবে না। যার ফলে খাদ্যের অভাবে মাছসহ কিছু জলজ প্রাণী মারা যেতে পারে। যে এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটি ছিল ডলফিনের অভয়ারণ্য কিন্তু দুর্ঘটনার পর থেকে ওই এলাকায় কোন ডলফিন দেখা যাচ্ছে না। আমরা ধারণা করছি, ডলফিন এলাকা ছেড়ে অনত্র চলে গেছে। এছাড়া এই তেল বন্য প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করলে দু’এক সপ্তাহের মধ্যে রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। এ ঘটনায় মাটি ও পানির দীর্ঘস্থায়ী কোন ক্ষতির সম্ভাবনা আছে কিনা তা যাচাই-বাছাই করার জন্য আমরা নমুনা সংগ্রহ করেছি। তবে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঘটনার পরপরই নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নিলে এতটা বিপর্যয় ঘটত না। সুন্দরবনের নদী-খালগুলোতে বিপুল পরিমাণ ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়াই দীর্ঘমেয়াদি সঙ্কটে পড়তে পারে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের। চারদিনেও তেল অপসারণ না হওয়ায় নদীর মাছ ও বনের গাছ মরে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাঘ ও হরিণসহ সুন্দরবনের সব পশুপাখি সঙ্কটে পড়বে।
এ ব্যাপারে খুলনা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ফরেস্টি বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. নবিউল ইসলাম খান বলেন, ফার্নেস অয়েল জোয়ারের সময় সুন্দরবনের ভেতর ঢুকছে এবং গাছপালার গায়ে ও মাটিতে ঢুকে পড়েছে। এতে মাটির নিচে যে শেকড় রয়েছে তা পচে যাবে। তার ধারণা আগামী ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে বিষয়টি দৃশ্যমান হতে পারে। এদিকে নৌ-বাহিনীর ‘শহীদ আখতার উদ্দিন’ ও ‘শাহ পরাণ’ জাহাজ দু’টি ডাইভিং এবং স্যালভেজ টিমসহকারে ঘটনাস্থল ও আশেপাশে এলাকায় বাঁশ ও রাবারের ফ্রেম দিয়ে বুম তৈরি করে আরও ফার্নেস ওয়েল যাতে নদীতে ছড়িয়ে না পড়ে সে লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নৌবাহিনী উক্ত নদী পথে নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রণে যথাযথ তদারকি করছে।
এদিকে মংলাবন্দরের চেয়ারম্যান কমোডর হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, তেল অপসারণে করণীয় নির্ধারণে মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষের সম্মেলন কক্ষে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান শামসুজ্জোহা খন্দকারের সভাপতিত্বে বন বিভাগ, বিআইডব্লিউটিএ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও মংলাবন্দর কর্তৃপক্ষের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে স্থানীয় জেলেদের সহায়তা নিয়ে আগামী তিন দিনের মধ্যে তেল অপসারণের একটি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। কাণ্ডারী-১০ দুপুরে সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট এলাকায় আসলেও তা থেকে তেল শোধনের পাউডার ছিটানো নিয়ে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হয়। পাউডারের ক্ষতিকর দিক বিবেচনা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া তা ছিটানোর বিপক্ষে বন বিভাগ অবস্থান নেয়। বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান শামসুজ্জোহা খন্দকার সাংবাদিকদের জানান, নদীতে ছড়িয়ে পড়া তেল স্থানীয় জেলেদের সহায়তায় আগামী তিন দিন ফোমের সাহায্যে সংগ্রহ করা হবে। এ কারণে পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত এই চ্যানেলে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আমির হোসাইন চৌধুরী জানান, কাণ্ডারী-১০ এসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পাউডার ছিটানোর কথা থাকলেও সকালে জরুরি বৈঠকে পাউডার ছিটানোর ক্ষতিকর দিক বিবেচনা ও ছাড়পত্র পাওয়ার পর তা ছিটানোর জন্য বন বিভাগের পক্ষ থেকে মত দেয়া হয়েছে। ফলে পাউডার ছিটানোর ব্যাপারে আপতত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ছাড়পত্রে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বলে তিনি জানান। জয়মনি এলাকার জাহাজ নিরাপত্তা কমিটির সভাপতি মো. রনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবার পর থেকে সুন্দরবনের নদীগুলোতে বিষাক্ত কালো কালো তেলের কালো থাবা যেন খামচে খাচ্ছে প্রাকৃতিক এ সুন্দরবনকে। তিনি আরও জানান, জয়মনি এলাকার কোল ঘেঁষে খরমা নদী। প্রতিদিনই সেই নদী পার হয়ে এলাকার গবাদি পশু সুন্দরবনে প্রবেশ করে। কিন্তু তিন দিন ধরে ওই খালে কোন গবাদি পশু পার হয় না। বর্তমানে খালে মাছ, সাপ, হাঁস, মরে পড়ে রয়েছে। জয়মনি এলাকার ভ্যানচালক রাজেন (৪৩) বলেন তেলের গন্ধে রাতে ঘুমাতে পারি না। এমন কি নদীতে নেমে কেউ পুকুরে পা ধুতে গেলে ওই পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে মাছ মরে যাচ্ছে। চাঁদপাই ফরেস্ট স্টেশনের রেঞ্জার আবুল কালাম আজাদ ঘটনার ভয়াবহতা স্বীকার করে বলেন, তেলের বিষক্রিয়ায় ছোট ছোট মাছ আগেই মারা গেছে। এখন বড় মাছ মরার কারণে এটা চোখে পড়ছে।
সুন্দরবনের সম্পদ এখন সঙ্কটে: সুন্দরবনে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে বাংলাদেশ অংশে স্থল ভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার। আর ৪৫০টি ছোট-বড় নদী ও খাল নিয়ে জল ভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গ কিলোমিটার। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ। মানুষের কারণে সুন্দরবনের আয়তন আজ এখানে এসে ঠেকেছে। সুন্দরবনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, এ উদ্ভিদকূলের ৭৩ ভাগই হচ্ছে সুন্দরী গাছ, ১৬ ভাগ গেওয়া। ১শ৬৫ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির অর্কিড। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রল হরিণসহ ৩২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৩শ’ প্রজাতির পাখি। বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, কুমির, ২১০ প্রজাতির মাছ, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১ প্রজাতির লবস্টার ও ৪২ প্রজাতির শামুক, ঝিনুক রয়েছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের সম্পদের হিসাব করা কঠিন। সুন্দরবনে দৃশ্যমান সম্পদের পরিমাণ ১৫৮ কোটি ৯ হাজার ৮শ’৭ পয়েন্ট ৮০ বিলিয়ন টাকা। এসব কারণে পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন হচ্ছে প্রকৃতির অপর বিস্ময়। সুন্দরবনের এ সম্পদের সবটাই এখন সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক হিসাব মতে, পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের নন্দপাড়া নদী থেকে শ্যালা নদী হয়ে আন্ধারমানিক নদী পর্যন্ত মাছসহ জলজ প্রাণিসহ ডলফিনের অভয়াশ্রম এখন চরম অস্তিত্ব সঙ্কটে। গত মঙ্গলবার এ অয়েল ট্যাঙ্কার ডুবির পর থেকে ডলফিনের এ অভয়াশ্রমে আর ডলফিনের দেখা মিলছে না। এসব এলাকার প্রায় ৫০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে গাছপালার শ্বাসমূলে তেলের আস্তরণ পড়ায় ম্যানগ্রোভ বনের গাছপালা দু’সপ্তাহার মধ্যে মরতে শুরু করবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এমন মানুষ সৃষ্ট দুর্যোগের মুখোমুখি সুন্দরবন আর কখনো পড়েনি।
তেল সরানোর প্রস্তাব দিয়েছে একটি বৃটিশ প্রতিষ্ঠান
বৃটিশ একটি প্রতিষ্ঠান তেল সরানোর কাজে বাংলাদেশকে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান এ কথা জানিয়েছেন। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে তিনি বলেন, লন্ডনভিত্তিক একটি দল আমাদের প্রস্তাব দিয়েছে। তারা রোববার ঢাকায় এসে পৌঁছুবে বলে আশা করছি। আমরা তাদের নিয়ে বৈঠক করব। আশা করি, এ বৈঠকে আমরা ভাল একটা ফল পাবো। তারা তেল উত্তোলনের ক্ষেত্রে কি ধরনের সাহায্য করতে পারবে আমাদের সে প্রস্তাব দেবে। আমরা যদি দেখি সেটা উপযোগী আমরা সেই কাজটি করার জন্য তাদের সুযোগ করে দেবো। ওই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বা এ কাজে তাদের অভিজ্ঞতা আছে কিনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মন্ত্রী বলেন, তিনি এখনও বিস্তারিত জানেন না। মাত্র একটা প্রস্তাব তারা পেয়েছেন। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টা রোববারের সভায় আমরা জানতে পারবো। প্রতিষ্ঠানটি নিজেরাই এ প্রস্তাব দিয়েছে এবং তারা এ কাজ করে থাকে জানিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। সরকার প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করেছে এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, মূলত তাদের কাছে খবরই দেরিতে এসেছে। সরকার প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি করেছে এটা সঠিক নয়। বনের ভেতর বাণিজ্যক নৌযান চলাচল বন্ধে ইউএনডিপি যে আহ্বান জানিয়েছে সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এখন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। আর বিকল্প একটি যাত্রাপথ তৈরির কাজ চলছে যা এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পরিবেশ মন্ত্রনালয়ে বিশেষজ্ঞরা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে তেল অপসারণের কাজ আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, রাসায়নিক পদার্থ ছিটানো হলে আরও ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। একটি বিশেষজ্ঞ দল ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেবে। প্রধান বন সংরক্ষক ইউনূস আলী বলেছেন, কেমিস্টদের একটি দল ঢাকা থেকে আজ ঘটনাস্থলে যাবেন। ঘটনার চার দিনের মাথায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষজ্ঞ দলকে গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সে দলের একজন সদস্য এবং খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিষয়ক শিক্ষক দিলিপ কুমার দত্ত বলেছেন, ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে। এখন সেটাকে বাদ দিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে। গ্রামবাসী আর জেলেদের উদ্বুদ্ধ করে পুরোনো পদ্ধতিতে নদী থেকে তেল সরানোর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে ছোট ছোট নৌকায় করে স্থানীয়রা বালতি আর হাড়ি পাতিল নিয়ে ফোম দিয়ে তেল তুলছেন। স্থানীয় নিবাসীদের সহায়তায় তেল সরানোর কাজ এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
এপি: হুমকির মুখে জলজ প্রাণিকুল
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বাংলাদেশের সুন্দরবনে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার পর দেশটির কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে পরিবেশ বিপর্যয়ের মাত্রা পর্যালোচনা করছে। কর্মকর্তারা এবং স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটটিতে তেল ছড়িয়ে পড়ার পর হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার জীববৈচিত্র্য। গতকাল কর্মকর্তারা জানিয়েছে, শেলা নদীতে প্রায় ৭০ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়েছে। জলজ প্রাণীদের অভয়ারণ্য সুন্দরবন এখন হুমকির মুখে। শেলা নদীর সঙ্গে কমপক্ষে ২০টি খালের সংযোগ রয়েছে। এছাড়া সংযোগ আছে আরেকটি নদী পশুরের সঙ্গে। প্রভাব পড়েছে এসব নদী নালাতেও। বাংলাদেশ বন বিভাগের প্রধান রক্ষক তপন কুমার দে জানিয়েছেন, বিরল প্রজাতির ইরাবতি ডলফিনসহ অনেক জলজ প্রাণী এখন হুমকির মুখে। তিনি আরও বলেস, জীববৈচিত্র্যে ক্ষতির উচ্চমাত্রায় ঝুঁকি রয়েছে। তবে এখনও ডলফিন বা কুমিরসহ অন্য কোন কোন প্রাণীর মৃত্যুর সংবাদ আসেনি। ডুবে যাওয়া ট্যাংকার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা গিয়াসুদ্দিন জানিয়েছেন, ট্যাংকারটি ডুবে যাওয়ার ৩০ ঘণ্টারও বেশি সময় পর উদ্ধার করা হয়েছে। তপন কুমার দে বলেন, প্রাথমিক প্রভাবের মাত্র নির্ণয় করতে বিভিন্ন দল প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। এটা বড় ধরনের বিপর্যয় আর আমরা পুরো পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন স্থানে ডলফিনদের বাতাসের জন্য পানি থেকে উপরে উঠতে দেখা গেছে। আর এ বিপর্যয়ের পর কুমিরদের আনাগোনা কমে গেছে। তাদের কি অবস্থা তা বোঝার চেষ্টা চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আল-জাজিরা: স্পঞ্জ-বস্তা দিয়ে তেল সংগ্রহ করছে গ্রামবাসী
স্পঞ্জ আর বস্তা দিয়ে তেল সংগ্রহ শুরু করেছে গ্রামবাসী। ব্যাপক পরিমাণ তেল ছড়িয়ে পড়ার পর পরিবেশবিদরা বিরল প্রাণী ডলফিনের অভয়ারণ্য এ এলাকায় বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার একটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার অপর একটি জাহাজের সঙ্গে সংঘর্ষের পর এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে হাজার হাজার লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে। এ সুন্দরবনে বিরল ইরাবতি আর গঙ্গা ডলফিনদের বাস। বাংলাদেশ সরকার তেল অপসারণের সরঞ্জাম সহ একটি জাহাজ ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছে। পরিবেশবিদরা বলছেন, ছড়িয়ে পড়া রাসায়নিক দ্রব্য সুন্দরবনের সংবেদনশীল জীববৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সুন্দরবনের প্রধান বন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেছেন, করণীয় কোনটা সর্বোত্তম হবে কর্তৃপক্ষ এখনও নিশ্চিত নয়। বার্তা সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেছেন, সুন্দরবনে এটা নজিরবিহীন বিপর্যয় আর এটা কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে তা আমরা জানি না। তিনি আরও বলেছেন, আমরা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন কারণ এটা ঘটেছে সংবেদনশীল ও নাজুক ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে। কর্মকর্তারা বলছেন, যা ক্ষতি হবার ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, কেননা তেল দ্বিতীয় আরেকটি নদীতে এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত সুন্দরবনের খালগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সমাজের বাংলাদেশ প্রধান রুবায়াত মানসুর বলেছেন, বেশির ভাগ তেল ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি জানান, গতকাল সকালে যখন তিনি ডুবে যাওয়া ট্রলারে যান তখন সেখানে মাত্র কয়েক শ’ লিটার তেল অবশিষ্ট ছিল। তিনি আরও বলেছেন, তেল অপসারণ সরঞ্জামগুলো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের উপযোগী নয়। এজন্য তিনি গ্রামবাসীদের নদীতে পাতা তাদের জাল দিয়ে তেল সংগ্রহে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন। সুন্দরবনে শ’ শ’ বিপন্ন ডলফিন রয়েছে কয়েকটি গবেষণা এ তথ্য সামনে আসার পর ২০১১ সালে বাংলাদেশ সুন্দরবনকে অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলেছে। এখানে মাছধরা নিষিদ্ধ হলেও ট্যাঙ্কার বা অন্যান্য নৌকা যাতায়াতের অনুমতি রয়েছে।
No comments