আমলাতন্ত্র উন্নয়নের প্রতিবন্ধক by ড. ইশা মোহাম্মদ
আমলারা আমলাতন্ত্রের পক্ষে লিখবেই।
আমলাতন্ত্রকে রাজনীতিকরাও ভয় পায়। কারণ রাজনীতিকদের দুর্বলতা ও দুর্নীতির
সব খবরই আমলারা রাখে। কোনো রাজনীতিক আমলাদের বিরুদ্ধে লাগলে তাকে তারা জেল
খাটাতেও পারে। বাংলাদেশ হওয়ার পর থেকেই আমলাদের মাতব্বরি বেড়ে গেছে। কারণ
রাজনীতিকদের দুর্বলতা। যারা ওই সময়ে আওয়ামী লীগ করত, তারা সবাই উচ্চ মেধার
লোক ছিল না। অনেকেই ভালো করে ইংরেজি পড়তে বা লিখতে পারত না। বাংলাও যে খুব
একটা ভালো জানত, তাও নয়। প্রথমদিকে দেখা গেছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় যারা
চাকরি পেয়েছে, তারা সবদিক থেকেই ছিল দুর্বল। এহেন পরিস্থিতিতে আমলারা সুযোগ
নিতেই পারে। তখন থেকেই আমলারা স্বার্থের কারণে একতাবদ্ধ হয়। কিন্তু
আমলাতন্ত্র যে কেবল বাংলাদেশেই রয়েছে তা তো নয়। সারা বিশ্বই চলছে
আমলাতন্ত্র দ্বারা।
সম্প্রতি একজন যোগ্য আমলা অবসরে গিয়েও আমলাতন্ত্রের পক্ষে লিখেছেন। তিনি ‘শুভকাজ’ না হওয়ার কারণ হিসেবে রাজনীতিকদের মেধা ও যোগ্যতাকে দায়ী করেছেন এবং প্রকারান্তরে আমলাতন্ত্রের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। রাজনীতিকরা যোগ্য হলেই আমলাতন্ত্র বাধ্যগত হবে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আমলাতন্ত্র সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা পরিষ্কার নয়। আমলাতন্ত্রের ইতিহাস যারা জানে, তারা সম্ভবত বিষয়টি বোঝে। অন্যরা যথেষ্ট না বুঝে মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেয়। রাষ্ট্র আধুনিক রূপ পাওয়ার আগেই আমলারা রাষ্ট্র দখল করেছে। রাজা ও রাজরক্তই আমলাতন্ত্রের প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করেছে। এখনও সেই একই ধারা অব্যাহত আছে। আমলাদের প্রশিক্ষণের সময় শেখানো হয় তারা শাসক, আর রাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রজা। তারা শাসক হিসেবে প্রজা শাসন করে। এ কথাই শেখানো হতো আমলাতন্ত্রের প্রাথমিক যুগে। যখন কারও শরীরে রাজরক্ত না থাকলে সে আমলা হতে পারত না। একসময় দেখা গিয়েছিল, সেনাবাহিনীতে চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকলে তারা আমলা হতে পারত না। সাধারণ নাগরিকদের মধ্য থেকে আমলা না হলেও তাদের অধীনে কামলা হতে পারত। মধ্যবিত্তদের মধ্য থেকে কেরানিকুলের জন্ম হয়েছিল। কেরানিরা কখনোই অফিসার হতে পারত না। এখন যেমন কেরানিরা পদোন্নতি পেতে পেতে অফিসার হয়ে যায়, তেমনটি পৃথিবীর কোথাও দেখা যায়নি। সম্ভবত বাংলাদেশেই প্রথম কেউ পিওন থেকে অফিসার হয়েছে। তার ফলাফল ভালো হয়েছে নাকি খারাপ হয়েছে, সেটি রাষ্ট্রনায়করা ভালো বলতে পারবেন।
যারা রাজরক্ত দেহে ধারণ করে, তারা শাসক হতেই পারে। কিন্তু ধনতন্ত্র শাসক পছন্দ করে না। যে কারণে র্যাশনাল বুরোক্রেসি কথাটা এসেছে। আমলারা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। একই সঙ্গে দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করেই
তাদের প্রকৃত আমলায় পরিণত হতে হয়। এই প্রথম সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়ার যোগ্যতাকে পরিহার করার সুযোগ তৈরি হল। রোমান আমলাতন্ত্র তার ঐতিহ্য হারাল। রাশিয়ার জারের আমলাতন্ত্রও অযোগ্য
প্রমাণিত হল। আধুনিক জ্ঞান আভিজাত্যকে অতিক্রম করে গেল। কিন্তু আমলারা
কাল্পনিক আভিজাত্যে আক্রান্ত হল। সাধারণ পরিবার থেকে এসেও আমলা হওয়ার পর
দেখা গেল, তারা নিজেরা নিজেদের অভিজাত মনে করছে।
কাল্পনিক আভিজাত্য থেকে নিজেদের কাল্পনিক শাসকও মনে করার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্রে সরকার থাকে, সেহেতু তারা সরকারের সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্ব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য একটি ‘গোপন রাষ্ট্র’ তৈরি করে রাষ্ট্রের মধ্যেই। ওই গোপন রাষ্ট্রের অধিশ্বর তারাই। সেখানে সরকারের কোনো মাতব্বরি থাকে না। যে কোনো রাষ্ট্র সম্পর্কেই একথা বলা যায়। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রকৃত ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া। গণতান্ত্রিক দেশ হলেই জনগণের শাসন বর্তমান আছে- এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেখানকার আমলাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা বোঝে আমলাতন্ত্র কী জিনিস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই কেবল আমলারা প্রাধান্যে আসতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের শাসক বলতে একটি শ্রেণীকে বোঝায়। শ্রেণীই রাষ্ট্র চালায়। শ্রেণীস্বার্থে রাষ্ট্র একটি যন্ত্র। ধনতন্ত্রে রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে কী, তা বুঝতে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। মার্কস-এঙ্গেলস কেন রাষ্ট্রকে শ্রেণীর যন্ত্র বলেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রকে দেখলেই বোঝা যায়। তারপরও সেখানে এক বিশেষ জাতীয় আমলাতন্ত্র তৈরি হয়েছে। সামরিক বাহিনী সেখানে একটি ‘গোপন রাষ্ট্র’ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘যুদ্ধবাজ’ চেহারা, তা ওই কারণেই। সমাজতন্ত্রেও যে আমলারা সরকারনির্ভর, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। সমাজতন্ত্রে পার্টি রাষ্ট্র চালায়। কিন্তু আমলারা পার্টি ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটা বিশেষ অবস্থান তৈরি করে নিজেদের অস্তিত্ব নিরাপদ করে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রবল হয়ে রাষ্ট্র দখল করে। ট্রটস্কি ও স্টালিনের আমলাতন্ত্র নিয়ে ঝগড়া-বিবাদের ইতিহাস মনে হয় সবাই জানে। ট্রটস্কি অভিযোগ করেছিলেন, স্টালিন প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বকে ব্যুরোক্রেট দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছেন। স্টালিনের আমলারা এতই ক্ষমতাধর ছিল যে, তাদের বিরোধিতাকারী কমরেডদের হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করত না। ট্রটস্কিও নিহত হয়েছিলেন। স্টালিনের সময়ে অসংখ্য কমরেড খুন হয়েছিলেন। এখন জানা যাচ্ছে, কেবল ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণেই নয়, আমলতন্ত্র পার্টিকেও দখল ও বশে আনার জন্য কমরেডদের খুন করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার জন্য
পার্টির দুর্বলতাই দায়ী। আর পার্টির দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল প্রকৃত কমরেডরা নিহত
হওয়ার কারণেই।
আমলাতন্ত্র অবশ্যই উন্নয়নের প্রতিবন্ধক। উন্নয়ন হলে একপর্যায়ে আমলাদের মাতব্বরি দূর হয়। যে কারণে আমলারা প্রকৃত উন্নয়নের ধারা প্রতিহত করে। অনেকটা সামন্ত যুগের জমিদারদের মতো। প্রজার জীবনযাত্রার মান বেড়ে গেলে, তাদের অবস্থার উন্নতি হলে জমিদার ভেসে যায়। যে কারণে জমিদাররা তাদের জমিদারিতে কাউকেই বাড়তে দিত না। কিন্তু আমলাতন্ত্র ক্ষতিকর বলে আমলাদের তাড়িয়ে দেয়া যাবে না। আমলাদের বিপরীতে আমলা তৈরি করতে হবে। যেমন সমবায় কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা বিপরীত স্রোতের আমলাদের মতো কাজ করে। লেবার অফিসার যেমন লেবারদের স্বার্থ দেখে, মালিকের স্বার্থ দেখে না, তেমনি ধরনের আমলাদের প্রতিপক্ষ গণআমলা তৈরি করা সম্ভব। যারা রাষ্ট্রের পক্ষে থাকবে না। জনগণের পক্ষে থাকবে। এভাবে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী আমলা তৈরি করতে পারলে আমলাতন্ত্রের ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে নেয়া যায়।
সরকারের সঙ্গে যারা কাজ করছে, সেই পণ্ডিতরা চিন্তাভাবনা করে একটি প্রতি-আমলাতন্ত্র তৈরি করতে পারে। এদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের থাকবে না। কমিউনিটির দায়িত্বে তারা তৈরি হবে এবং দায়ী থাকবে কমিউনিটির কাছে। তারা পুরোপুরি সরকারি হওয়া সত্ত্বেও সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যেখানে আইনের শাসন বলবৎ থাকে, সেখানে এমন ধরনের প্রতি-আমলাতন্ত্র তৈরি করা সম্ভব এবং তা গ্রহণযোগ্যও হবে। যেহেতু তারা গণস্বার্থে দায়িত্ব পালন করবে, সেহেতু কমিউনিটি তাদের ‘বন্ধু’ ভাববে। সাধারণ মানুষ আমলাতন্ত্রের ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় জানে না। আমলারাই পারে আমলাদের প্রতিপক্ষ হতে, তাদের শায়েস্তা করতে।
আমলাতন্ত্র নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তার সময় এসেছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতেই হবে। আমলাতন্ত্রের পক্ষ-প্রতিপক্ষ তৈরি করতে হবে। রাজনীতিকরা উচ্চ মেধাসম্পন্ন হলে তারা আমলাদের ঠিকই নিয়ন্ত্রণ করতে পারত।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিকদের অবস্থা
দেখে সেটি অসম্ভব বলেই মনে হয়। রাজনীতিকদের চেয়ে আমলাদের মেধা উৎকৃষ্ট। তারাই পারে দেশপ্রেমে সিক্ত হয়ে গণআমলাতন্ত্র তৈরি করতে।
ড. ইশা মোহাম্মদ : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
সম্প্রতি একজন যোগ্য আমলা অবসরে গিয়েও আমলাতন্ত্রের পক্ষে লিখেছেন। তিনি ‘শুভকাজ’ না হওয়ার কারণ হিসেবে রাজনীতিকদের মেধা ও যোগ্যতাকে দায়ী করেছেন এবং প্রকারান্তরে আমলাতন্ত্রের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। রাজনীতিকরা যোগ্য হলেই আমলাতন্ত্র বাধ্যগত হবে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আমলাতন্ত্র সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা পরিষ্কার নয়। আমলাতন্ত্রের ইতিহাস যারা জানে, তারা সম্ভবত বিষয়টি বোঝে। অন্যরা যথেষ্ট না বুঝে মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেয়। রাষ্ট্র আধুনিক রূপ পাওয়ার আগেই আমলারা রাষ্ট্র দখল করেছে। রাজা ও রাজরক্তই আমলাতন্ত্রের প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করেছে। এখনও সেই একই ধারা অব্যাহত আছে। আমলাদের প্রশিক্ষণের সময় শেখানো হয় তারা শাসক, আর রাষ্ট্রের নাগরিকরা প্রজা। তারা শাসক হিসেবে প্রজা শাসন করে। এ কথাই শেখানো হতো আমলাতন্ত্রের প্রাথমিক যুগে। যখন কারও শরীরে রাজরক্ত না থাকলে সে আমলা হতে পারত না। একসময় দেখা গিয়েছিল, সেনাবাহিনীতে চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকলে তারা আমলা হতে পারত না। সাধারণ নাগরিকদের মধ্য থেকে আমলা না হলেও তাদের অধীনে কামলা হতে পারত। মধ্যবিত্তদের মধ্য থেকে কেরানিকুলের জন্ম হয়েছিল। কেরানিরা কখনোই অফিসার হতে পারত না। এখন যেমন কেরানিরা পদোন্নতি পেতে পেতে অফিসার হয়ে যায়, তেমনটি পৃথিবীর কোথাও দেখা যায়নি। সম্ভবত বাংলাদেশেই প্রথম কেউ পিওন থেকে অফিসার হয়েছে। তার ফলাফল ভালো হয়েছে নাকি খারাপ হয়েছে, সেটি রাষ্ট্রনায়করা ভালো বলতে পারবেন।
যারা রাজরক্ত দেহে ধারণ করে, তারা শাসক হতেই পারে। কিন্তু ধনতন্ত্র শাসক পছন্দ করে না। যে কারণে র্যাশনাল বুরোক্রেসি কথাটা এসেছে। আমলারা আইনের ঊর্ধ্বে নয়। একই সঙ্গে দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করেই
তাদের প্রকৃত আমলায় পরিণত হতে হয়। এই প্রথম সামরিক বাহিনীর সদস্য হওয়ার যোগ্যতাকে পরিহার করার সুযোগ তৈরি হল। রোমান আমলাতন্ত্র তার ঐতিহ্য হারাল। রাশিয়ার জারের আমলাতন্ত্রও অযোগ্য
প্রমাণিত হল। আধুনিক জ্ঞান আভিজাত্যকে অতিক্রম করে গেল। কিন্তু আমলারা
কাল্পনিক আভিজাত্যে আক্রান্ত হল। সাধারণ পরিবার থেকে এসেও আমলা হওয়ার পর
দেখা গেল, তারা নিজেরা নিজেদের অভিজাত মনে করছে।
কাল্পনিক আভিজাত্য থেকে নিজেদের কাল্পনিক শাসকও মনে করার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু যেহেতু আধুনিক রাষ্ট্রে সরকার থাকে, সেহেতু তারা সরকারের সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্ব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য একটি ‘গোপন রাষ্ট্র’ তৈরি করে রাষ্ট্রের মধ্যেই। ওই গোপন রাষ্ট্রের অধিশ্বর তারাই। সেখানে সরকারের কোনো মাতব্বরি থাকে না। যে কোনো রাষ্ট্র সম্পর্কেই একথা বলা যায়। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রকৃত ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া। গণতান্ত্রিক দেশ হলেই জনগণের শাসন বর্তমান আছে- এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেখানকার আমলাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা বোঝে আমলাতন্ত্র কী জিনিস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই কেবল আমলারা প্রাধান্যে আসতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের শাসক বলতে একটি শ্রেণীকে বোঝায়। শ্রেণীই রাষ্ট্র চালায়। শ্রেণীস্বার্থে রাষ্ট্র একটি যন্ত্র। ধনতন্ত্রে রাষ্ট্র প্রকৃত অর্থে কী, তা বুঝতে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। মার্কস-এঙ্গেলস কেন রাষ্ট্রকে শ্রেণীর যন্ত্র বলেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রকে দেখলেই বোঝা যায়। তারপরও সেখানে এক বিশেষ জাতীয় আমলাতন্ত্র তৈরি হয়েছে। সামরিক বাহিনী সেখানে একটি ‘গোপন রাষ্ট্র’ তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের যে ‘যুদ্ধবাজ’ চেহারা, তা ওই কারণেই। সমাজতন্ত্রেও যে আমলারা সরকারনির্ভর, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। সমাজতন্ত্রে পার্টি রাষ্ট্র চালায়। কিন্তু আমলারা পার্টি ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটা বিশেষ অবস্থান তৈরি করে নিজেদের অস্তিত্ব নিরাপদ করে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রবল হয়ে রাষ্ট্র দখল করে। ট্রটস্কি ও স্টালিনের আমলাতন্ত্র নিয়ে ঝগড়া-বিবাদের ইতিহাস মনে হয় সবাই জানে। ট্রটস্কি অভিযোগ করেছিলেন, স্টালিন প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্বকে ব্যুরোক্রেট দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছেন। স্টালিনের আমলারা এতই ক্ষমতাধর ছিল যে, তাদের বিরোধিতাকারী কমরেডদের হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করত না। ট্রটস্কিও নিহত হয়েছিলেন। স্টালিনের সময়ে অসংখ্য কমরেড খুন হয়েছিলেন। এখন জানা যাচ্ছে, কেবল ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণেই নয়, আমলতন্ত্র পার্টিকেও দখল ও বশে আনার জন্য কমরেডদের খুন করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার জন্য
পার্টির দুর্বলতাই দায়ী। আর পার্টির দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল প্রকৃত কমরেডরা নিহত
হওয়ার কারণেই।
আমলাতন্ত্র অবশ্যই উন্নয়নের প্রতিবন্ধক। উন্নয়ন হলে একপর্যায়ে আমলাদের মাতব্বরি দূর হয়। যে কারণে আমলারা প্রকৃত উন্নয়নের ধারা প্রতিহত করে। অনেকটা সামন্ত যুগের জমিদারদের মতো। প্রজার জীবনযাত্রার মান বেড়ে গেলে, তাদের অবস্থার উন্নতি হলে জমিদার ভেসে যায়। যে কারণে জমিদাররা তাদের জমিদারিতে কাউকেই বাড়তে দিত না। কিন্তু আমলাতন্ত্র ক্ষতিকর বলে আমলাদের তাড়িয়ে দেয়া যাবে না। আমলাদের বিপরীতে আমলা তৈরি করতে হবে। যেমন সমবায় কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা বিপরীত স্রোতের আমলাদের মতো কাজ করে। লেবার অফিসার যেমন লেবারদের স্বার্থ দেখে, মালিকের স্বার্থ দেখে না, তেমনি ধরনের আমলাদের প্রতিপক্ষ গণআমলা তৈরি করা সম্ভব। যারা রাষ্ট্রের পক্ষে থাকবে না। জনগণের পক্ষে থাকবে। এভাবে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী আমলা তৈরি করতে পারলে আমলাতন্ত্রের ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে নেয়া যায়।
সরকারের সঙ্গে যারা কাজ করছে, সেই পণ্ডিতরা চিন্তাভাবনা করে একটি প্রতি-আমলাতন্ত্র তৈরি করতে পারে। এদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের থাকবে না। কমিউনিটির দায়িত্বে তারা তৈরি হবে এবং দায়ী থাকবে কমিউনিটির কাছে। তারা পুরোপুরি সরকারি হওয়া সত্ত্বেও সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় যেখানে আইনের শাসন বলবৎ থাকে, সেখানে এমন ধরনের প্রতি-আমলাতন্ত্র তৈরি করা সম্ভব এবং তা গ্রহণযোগ্যও হবে। যেহেতু তারা গণস্বার্থে দায়িত্ব পালন করবে, সেহেতু কমিউনিটি তাদের ‘বন্ধু’ ভাববে। সাধারণ মানুষ আমলাতন্ত্রের ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় জানে না। আমলারাই পারে আমলাদের প্রতিপক্ষ হতে, তাদের শায়েস্তা করতে।
আমলাতন্ত্র নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তার সময় এসেছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতেই হবে। আমলাতন্ত্রের পক্ষ-প্রতিপক্ষ তৈরি করতে হবে। রাজনীতিকরা উচ্চ মেধাসম্পন্ন হলে তারা আমলাদের ঠিকই নিয়ন্ত্রণ করতে পারত।
কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিকদের অবস্থা
দেখে সেটি অসম্ভব বলেই মনে হয়। রাজনীতিকদের চেয়ে আমলাদের মেধা উৎকৃষ্ট। তারাই পারে দেশপ্রেমে সিক্ত হয়ে গণআমলাতন্ত্র তৈরি করতে।
ড. ইশা মোহাম্মদ : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
No comments