দুর্গা: উৎস থেকে নিরন্তর by আহমদ কবির
দুর্গার প্রতি আমার ভক্তি নেই, তবে প্রীতি আছে, বিপুল প্রীতি। এর কারণ, যে জ্ঞান শাখায় আমার সর্বানন্দ অর্থাৎ কলাবিদ্যা, যার ভেতরে রয়েছে সাহিত্য, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্য, তা দুর্গার বাখানে ভরপুর। দুর্গা বাংলার সংগীত, নাটক ও নৃত্য; প্রতিমাশিল্প, পটশিল্প ইত্যাদির অনুপ্রেরণাও। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে দুর্গা যত্রতত্র বিরাজ করেন। কখনো হয়ে যান চণ্ডী, কখনো কালী, কখনো উমা, কখনো শ্যামা, কখনো পার্বতী, কখনো গৌরী, কখনো অপর্ণা, কখনো অন্নদা, কখনো আনন্দময়ী, কখনো হতদরিদ্র শিবের স্ত্রীরূপে ভিখারিনী। দুর্গা হলেন শক্তির দেবী।
বাংলা মঙ্গলকাব্যে দুর্গা স্বনামেও আছেন, যেমন ‘দুর্গামঙ্গল’। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির রয়েছে দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী। দুর্গা বাংলা কবিতার উপমায়, রূপকে, প্রতীকে, চিত্রকল্পে, অনুপ্রাসে, দৃষ্টান্তে প্রায়ই এসে যান, এসে যান কথাসাহিত্যের চরিত্ররূপেও। যেমন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর অবিস্মরণীয় কিশোরী দুর্গা। কেবল বাংলা সাহিত্যে নয়, নানা ভারতীয় সাহিত্যে দুর্গার রয়েছে প্রভূত সংস্থান। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের কথা বলাই অধিকন্তু।
এ প্রসঙ্গে আমরা কালিদাসের কুমারসম্ভব-এর কথা স্মরণ করতে পারি। হর-পার্বতীকে নিয়ে যে কত নাটক, কত যাত্রা, কত কাব্য, কত আখ্যান রচিত হয়েছে, তার হিসাব দেওয়াও দুষ্কর। দুর্গার ক্রমবিকাশের সূচনা পুরাকালের সতী উপাখ্যান থেকে, হয়তো তারও আগে আদ্যাশক্তিতে। আদ্যাশক্তি পৃথিবীর মাতৃরূপের আদি স্তর। সেটি ভারতীয় শক্তি সাধনার নানা বিবর্তনে, নানা উপাখ্যানে ও উপচারে পুষ্ট হয়ে সমৃদ্ধ ধারায় স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে আদি ধর্ম হলো হিন্দুধর্ম। একে সনাতন ধর্মও বলা হয়। কারণ, এ ধর্ম বেদনির্ভর। পৃথিবীর অন্য ধর্মগুলোর তুলনায় হিন্দুধর্ম বেশ জটিল। এর আচারের দিকটি অনেকান্ত, নানা স্তর ও উপস্তরের প্রলেপে প্রলেপে এটি শেষ পর্যন্ত কঠিন গ্রানাইটে রূপ নিয়েছে। দুর্গাও সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন অতি শক্ত ভূমিতে। শশিভূষণ দাশগুপ্ত ভারতীয় শক্তি সাধনার গবেষণায় ‘দুর্গা’ নামের উৎপত্তির স্তরগুলো সম্যক পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন দুর্গার প্রথম উল্লেখ আছে তৈত্তিরীয় আরণ্যক-এ। এটি উপনিষদেরই অন্তর্গত। দুর্গ নামের দৈত্য, যে নানা আপদের হোতা, তাকে বধ করে দেবী ‘দুর্গা’ নামে পরিচিত হয়েছেন বলে আখ্যান আছে। অন্যত্র আছে দুর্গম নামের এক মহা দৈত্যকে হনন করার প্রসঙ্গ। দুর্গা দুর্গতিনাশিনী ব্যাখ্যায়ও তাৎপর্যমণ্ডিত। শশিভূষণ দাশগুপ্ত যে মতটিকে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য মনে করেন তা হলো, দুর্গা দুর্গ রক্ষা বাহিনী দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
দুর্গাপূজা শরৎকালেই হয়। এই সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে রামায়ণ। সীতা হরণকারী রাবণকে হত্যা করার জন্য ব্রহ্মার অনুরোধে রাম অকালে দেবীর বোধন, অর্থাৎ পূজা করেন। এটি অকালবোধন নামে পরিচিত। আগে বসন্তকালে পূজা হতো। দুর্গাপূজার শারদীয় সাড়ম্বর হিন্দু বাঙালির একান্ত নিজের। বাঙালি হিন্দুরা মাতৃসাধক। সে জন্য দুর্গা তাদের ধর্মানুভূতি ও উৎসবের প্রধান প্রমূর্তি হয়ে উঠেছেন। এবং সন্দেহ নেই, দুর্গা বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী প্রতীক।
দুর্গাকে নিয়ে বাঙালি বড় লেখক-কবিরা তাঁদের অনুভূতি চমৎকারভাবে ব্যক্ত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রে তাই পাই দুর্গার আধ্যাত্মিক ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। বাঙালির মধ্যে তিনিই প্রথম দুর্গাকে দেশমাতার রূপগত ও চেতনাগত অপূর্ব ধারণার জন্ম দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আনন্দমঠ-এর সন্তানধর্মীদের গাওয়া ‘বন্দে মাতরম’ গানটি স্মর্তব্য। উপনিবেশের কালে এ সংগীত মন্ত্রোচ্চারণের মতো। ‘বন্দে মাতরম’ নিশ্চয়ই ভারতমাতা, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র এ দিয়ে বঙ্গমাতাকেও বুঝিয়েছেন। কমলাকান্ত সেই মাতাকে আফিমের ঘোরে দেখে নিয়েছে, ‘দিগ্বূজা, নানা প্রহরণ প্রহারিণী, শত্রুমর্দ্দিনী, বীরেন্দ্র পৃষ্ঠবিহারিণী—দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরূপিণী, বামে বিদ্যাবিজ্ঞানমূর্ত্তিময়ী, সঙ্গে বলরূপী কার্ত্তিকেয়, কার্যসিদ্ধিরূপী গণেশ, আমি সেই কালস্রোতো মধ্যে দেখিলাম, এই সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা!’
বাঙালি হিন্দু দুর্গার আগমনকে নিজেদের মতো করে নিয়েছে। দুর্গার ছেলেমেয়েরা কেউ তাঁর নিজের নয়, এটি বাঙালি হিন্দুদের কল্পনা। অবশ্য কালিদাস কুমারসম্ভব-এ দুর্গা শিবের পুত্র হিসেবে কার্তিকের জন্মের আখ্যান লিখেছেন, যদিও কার্তিকের সম্ভবের অন্য আখ্যানও আছে। হিন্দু পুরাণে দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আলাদা আলাদা দেবতা; কিন্তু বাংলাদেশে দুর্গার আগমন একক নয়, ওঁদের নিয়েই পূর্ণতা। দুর্গা সিংহবাহিনী, দশভুজা, ওই ভুজগুলোতেও নানা অস্ত্র। এক হাতে ত্রিশূল, অন্য হাত দিয়ে সেই ত্রিশূল দৃঢ়রূপে তেরছাভাবে ধরা, ত্রিশূলমুখ মহিষাসুরের বক্ষ বিদীর্ণ করছে আর ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। মহিষাসুর দমনের জন্য দুর্গার আরেক নাম মহিষমর্দিনী। দুর্গাপূজা সাংবাৎসরিক। হাজার হাজার বছর ধরে দুর্গাপূজা চলছে, কিন্তু প্রতিবছর দুর্গা ও তাঁর বাহিনী একই রূপে আসে—দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মায় সিংহ ও ওই অসুরের একই রূপ থাকে, এঁরা কখনো বুড়ো হন না। পুরাণের দেবদেবীরা এমনকি দৈত্যরাও অনন্তযৌবন, অনন্তযৌবনা।
বাংলাদেশে দেবী আসেন প্রতিবছরে শুচিস্নাতা হয়ে। শরতের আকাশ থাকে বৃষ্টি ঝরানো স্বচ্ছতা, মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়, মেঘ রঙের সঙ্গে কাশের শুভ্রতা মিশে যায়। আকাশে-বাতাসে আগমনীর সুর, তার সঙ্গে বাজে ঢাকের বাদ্য প্রতিটি মন্দিরে। দেবী আসছেন, ওই যে তিনি মর্তে পদার্পণ করছেন। তাঁর বোধন হয়, মহালয়া হয়। প্রতিবছর দেবী আসেন একেক বাহনে। কখনো ঘোড়ায়, কখনো হাতিতে; এবার নৌকায়। আগে ধনাঢ্য ব্যক্তি, সামন্ত, জমিদারেরা পূজা করতেন বিরাট আয়োজনে। এখন পূজা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, বিশ্বময়ও। যেখানে যেখানে বাঙালি হিন্দুরা গেছে, সেখানেই পূজামণ্ডপ প্রস্তুত হয়েছে, মানুষের ভিড়ও সেখানে বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুর সংখ্যা অনেক; দুর্গাপূজা তাদের জাতীয় উৎসব। বাংলাদেশেও পূজার উৎসব বেড়েছে। পূজার আনন্দের মধ্যে বিষাদের বিষয় হচ্ছে পূজামণ্ডপ ভাঙচুরের খবর। এগুলো কোনোটিই মুসলমান-হিন্দুর সম্প্রীতির জন্য ভালো নয়। উৎসবের প্রেরণা মানবিক সম্প্রীতি ও আনন্দ। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান সে আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এবার নৌকায় দেবীবাহিনীর মর্তে্য আগমন কম্পিউটার দিয়ে আরও আনন্দময় ও চিত্তাকর্ষক করা যায়।
শাস্ত্রবিদ ও পুরোহিতেরা দুর্গাপূজার আচার–পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন, কিন্তু শিক্ষিত পণ্ডিতের হাতে পড়লে সে পদ্ধতির আনুপুঙ্খিক ব্যাখ্যা-বিবরণ যে কতখানি স্বাদু হতে পারে, তার প্রমাণ ‘দুর্গোৎসবে নবপত্রিকা’ রচনাটি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মুক্তমন রসিক পণ্ডিত। তিনিও দুর্গাপূজার মধ্যে নৃতাত্ত্বিক সূত্র খুঁজে পেয়েছেন; যেমন পরে পেলেন ফ্রেজার।
বঙ্কিমচন্দ্রের কথা আগেই বলেছি, অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক দেবী দুর্গাকে নিয়ে তাঁদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। বড় কবিদের মধ্যে মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও অমিয় চক্রবর্তীর রচনার কথা মনে পড়ে। দুর্গাকে দেশমাতা হিসেবে নিয়ে ‘আনন্দময়ীর আগমন’ লিখে নজরুল ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য জেল খেটেছেন। ১৯০৫-এ বঙ্গবিচ্ছেদ হলে রবীন্দ্রনাথ বেদনার্ত হৃদয়ে ওই অসাধারণ গানটি লিখলেন দুর্গার প্রমূর্তির আদলে—‘আিজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!’ এই রূপ বঙ্গমাতা দুর্গার। দুর্গাপূজার সর্বোত্তম আনন্দ উপহার নিশ্চয়ই সাহিত্য ও সিনেমা পত্রিকাগুলোর শারদীয় সংখ্যা এবং অবশ্যই অনেক অনেক বাংলা গান।
আহমদ কবির: অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলা মঙ্গলকাব্যে দুর্গা স্বনামেও আছেন, যেমন ‘দুর্গামঙ্গল’। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির রয়েছে দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী। দুর্গা বাংলা কবিতার উপমায়, রূপকে, প্রতীকে, চিত্রকল্পে, অনুপ্রাসে, দৃষ্টান্তে প্রায়ই এসে যান, এসে যান কথাসাহিত্যের চরিত্ররূপেও। যেমন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালীর অবিস্মরণীয় কিশোরী দুর্গা। কেবল বাংলা সাহিত্যে নয়, নানা ভারতীয় সাহিত্যে দুর্গার রয়েছে প্রভূত সংস্থান। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের কথা বলাই অধিকন্তু।
এ প্রসঙ্গে আমরা কালিদাসের কুমারসম্ভব-এর কথা স্মরণ করতে পারি। হর-পার্বতীকে নিয়ে যে কত নাটক, কত যাত্রা, কত কাব্য, কত আখ্যান রচিত হয়েছে, তার হিসাব দেওয়াও দুষ্কর। দুর্গার ক্রমবিকাশের সূচনা পুরাকালের সতী উপাখ্যান থেকে, হয়তো তারও আগে আদ্যাশক্তিতে। আদ্যাশক্তি পৃথিবীর মাতৃরূপের আদি স্তর। সেটি ভারতীয় শক্তি সাধনার নানা বিবর্তনে, নানা উপাখ্যানে ও উপচারে পুষ্ট হয়ে সমৃদ্ধ ধারায় স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে আদি ধর্ম হলো হিন্দুধর্ম। একে সনাতন ধর্মও বলা হয়। কারণ, এ ধর্ম বেদনির্ভর। পৃথিবীর অন্য ধর্মগুলোর তুলনায় হিন্দুধর্ম বেশ জটিল। এর আচারের দিকটি অনেকান্ত, নানা স্তর ও উপস্তরের প্রলেপে প্রলেপে এটি শেষ পর্যন্ত কঠিন গ্রানাইটে রূপ নিয়েছে। দুর্গাও সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন অতি শক্ত ভূমিতে। শশিভূষণ দাশগুপ্ত ভারতীয় শক্তি সাধনার গবেষণায় ‘দুর্গা’ নামের উৎপত্তির স্তরগুলো সম্যক পর্যালোচনা করে দেখিয়েছেন দুর্গার প্রথম উল্লেখ আছে তৈত্তিরীয় আরণ্যক-এ। এটি উপনিষদেরই অন্তর্গত। দুর্গ নামের দৈত্য, যে নানা আপদের হোতা, তাকে বধ করে দেবী ‘দুর্গা’ নামে পরিচিত হয়েছেন বলে আখ্যান আছে। অন্যত্র আছে দুর্গম নামের এক মহা দৈত্যকে হনন করার প্রসঙ্গ। দুর্গা দুর্গতিনাশিনী ব্যাখ্যায়ও তাৎপর্যমণ্ডিত। শশিভূষণ দাশগুপ্ত যে মতটিকে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য মনে করেন তা হলো, দুর্গা দুর্গ রক্ষা বাহিনী দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
দুর্গাপূজা শরৎকালেই হয়। এই সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে রামায়ণ। সীতা হরণকারী রাবণকে হত্যা করার জন্য ব্রহ্মার অনুরোধে রাম অকালে দেবীর বোধন, অর্থাৎ পূজা করেন। এটি অকালবোধন নামে পরিচিত। আগে বসন্তকালে পূজা হতো। দুর্গাপূজার শারদীয় সাড়ম্বর হিন্দু বাঙালির একান্ত নিজের। বাঙালি হিন্দুরা মাতৃসাধক। সে জন্য দুর্গা তাদের ধর্মানুভূতি ও উৎসবের প্রধান প্রমূর্তি হয়ে উঠেছেন। এবং সন্দেহ নেই, দুর্গা বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী প্রতীক।
দুর্গাকে নিয়ে বাঙালি বড় লেখক-কবিরা তাঁদের অনুভূতি চমৎকারভাবে ব্যক্ত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রে তাই পাই দুর্গার আধ্যাত্মিক ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। বাঙালির মধ্যে তিনিই প্রথম দুর্গাকে দেশমাতার রূপগত ও চেতনাগত অপূর্ব ধারণার জন্ম দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আনন্দমঠ-এর সন্তানধর্মীদের গাওয়া ‘বন্দে মাতরম’ গানটি স্মর্তব্য। উপনিবেশের কালে এ সংগীত মন্ত্রোচ্চারণের মতো। ‘বন্দে মাতরম’ নিশ্চয়ই ভারতমাতা, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র এ দিয়ে বঙ্গমাতাকেও বুঝিয়েছেন। কমলাকান্ত সেই মাতাকে আফিমের ঘোরে দেখে নিয়েছে, ‘দিগ্বূজা, নানা প্রহরণ প্রহারিণী, শত্রুমর্দ্দিনী, বীরেন্দ্র পৃষ্ঠবিহারিণী—দক্ষিণে লক্ষ্মী ভাগ্যরূপিণী, বামে বিদ্যাবিজ্ঞানমূর্ত্তিময়ী, সঙ্গে বলরূপী কার্ত্তিকেয়, কার্যসিদ্ধিরূপী গণেশ, আমি সেই কালস্রোতো মধ্যে দেখিলাম, এই সুবর্ণময়ী বঙ্গপ্রতিমা!’
বাঙালি হিন্দু দুর্গার আগমনকে নিজেদের মতো করে নিয়েছে। দুর্গার ছেলেমেয়েরা কেউ তাঁর নিজের নয়, এটি বাঙালি হিন্দুদের কল্পনা। অবশ্য কালিদাস কুমারসম্ভব-এ দুর্গা শিবের পুত্র হিসেবে কার্তিকের জন্মের আখ্যান লিখেছেন, যদিও কার্তিকের সম্ভবের অন্য আখ্যানও আছে। হিন্দু পুরাণে দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী আলাদা আলাদা দেবতা; কিন্তু বাংলাদেশে দুর্গার আগমন একক নয়, ওঁদের নিয়েই পূর্ণতা। দুর্গা সিংহবাহিনী, দশভুজা, ওই ভুজগুলোতেও নানা অস্ত্র। এক হাতে ত্রিশূল, অন্য হাত দিয়ে সেই ত্রিশূল দৃঢ়রূপে তেরছাভাবে ধরা, ত্রিশূলমুখ মহিষাসুরের বক্ষ বিদীর্ণ করছে আর ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। মহিষাসুর দমনের জন্য দুর্গার আরেক নাম মহিষমর্দিনী। দুর্গাপূজা সাংবাৎসরিক। হাজার হাজার বছর ধরে দুর্গাপূজা চলছে, কিন্তু প্রতিবছর দুর্গা ও তাঁর বাহিনী একই রূপে আসে—দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মায় সিংহ ও ওই অসুরের একই রূপ থাকে, এঁরা কখনো বুড়ো হন না। পুরাণের দেবদেবীরা এমনকি দৈত্যরাও অনন্তযৌবন, অনন্তযৌবনা।
বাংলাদেশে দেবী আসেন প্রতিবছরে শুচিস্নাতা হয়ে। শরতের আকাশ থাকে বৃষ্টি ঝরানো স্বচ্ছতা, মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়, মেঘ রঙের সঙ্গে কাশের শুভ্রতা মিশে যায়। আকাশে-বাতাসে আগমনীর সুর, তার সঙ্গে বাজে ঢাকের বাদ্য প্রতিটি মন্দিরে। দেবী আসছেন, ওই যে তিনি মর্তে পদার্পণ করছেন। তাঁর বোধন হয়, মহালয়া হয়। প্রতিবছর দেবী আসেন একেক বাহনে। কখনো ঘোড়ায়, কখনো হাতিতে; এবার নৌকায়। আগে ধনাঢ্য ব্যক্তি, সামন্ত, জমিদারেরা পূজা করতেন বিরাট আয়োজনে। এখন পূজা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র, বিশ্বময়ও। যেখানে যেখানে বাঙালি হিন্দুরা গেছে, সেখানেই পূজামণ্ডপ প্রস্তুত হয়েছে, মানুষের ভিড়ও সেখানে বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুর সংখ্যা অনেক; দুর্গাপূজা তাদের জাতীয় উৎসব। বাংলাদেশেও পূজার উৎসব বেড়েছে। পূজার আনন্দের মধ্যে বিষাদের বিষয় হচ্ছে পূজামণ্ডপ ভাঙচুরের খবর। এগুলো কোনোটিই মুসলমান-হিন্দুর সম্প্রীতির জন্য ভালো নয়। উৎসবের প্রেরণা মানবিক সম্প্রীতি ও আনন্দ। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান সে আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এবার নৌকায় দেবীবাহিনীর মর্তে্য আগমন কম্পিউটার দিয়ে আরও আনন্দময় ও চিত্তাকর্ষক করা যায়।
শাস্ত্রবিদ ও পুরোহিতেরা দুর্গাপূজার আচার–পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন, কিন্তু শিক্ষিত পণ্ডিতের হাতে পড়লে সে পদ্ধতির আনুপুঙ্খিক ব্যাখ্যা-বিবরণ যে কতখানি স্বাদু হতে পারে, তার প্রমাণ ‘দুর্গোৎসবে নবপত্রিকা’ রচনাটি। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মুক্তমন রসিক পণ্ডিত। তিনিও দুর্গাপূজার মধ্যে নৃতাত্ত্বিক সূত্র খুঁজে পেয়েছেন; যেমন পরে পেলেন ফ্রেজার।
বঙ্কিমচন্দ্রের কথা আগেই বলেছি, অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক দেবী দুর্গাকে নিয়ে তাঁদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। বড় কবিদের মধ্যে মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও অমিয় চক্রবর্তীর রচনার কথা মনে পড়ে। দুর্গাকে দেশমাতা হিসেবে নিয়ে ‘আনন্দময়ীর আগমন’ লিখে নজরুল ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য জেল খেটেছেন। ১৯০৫-এ বঙ্গবিচ্ছেদ হলে রবীন্দ্রনাথ বেদনার্ত হৃদয়ে ওই অসাধারণ গানটি লিখলেন দুর্গার প্রমূর্তির আদলে—‘আিজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি/তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!’ এই রূপ বঙ্গমাতা দুর্গার। দুর্গাপূজার সর্বোত্তম আনন্দ উপহার নিশ্চয়ই সাহিত্য ও সিনেমা পত্রিকাগুলোর শারদীয় সংখ্যা এবং অবশ্যই অনেক অনেক বাংলা গান।
আহমদ কবির: অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments