চামড়া শিল্পনগরের কাজে অগ্রগতি by আবুল হাসনাত ও অরূপ রায়
ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সব ট্যানারি সাভারের
চামড়া শিল্পনগরে স্থানান্তর হওয়ার এখনকার সময়সীমা ২০১৫ সালের জুনে। আর
কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা আগামী
মার্চে। সে অনুযায়ী কাজও চলছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা সিইটিপির নির্মাণকাজ
শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি ট্যানারি তাদের কারখানা ভবনের নির্মাণকাজও শুরু
করেছে। কিন্তু যেভাবে কাজ চলছে, তাতে নির্ধারিত সময়ে ট্যানারিগুলো
স্থানান্তর হবে কি না, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ঈদের পর পুরোদমে কারখানা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করবেন বলে ট্যানারি মালিকেরা জানিয়েছেন। কারণ, কোরবানি নিয়ে তাঁরা এখন কর্মব্যস্ত সময় পার করবেন। এটা শেষ হলেই কারখানা ভবন তৈরিতে পুরোপুরি মনোযোগী হবেন।
শিল্পনগর প্রকল্পের পরিচালক সিরাজুল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ মাস আগের সঙ্গে এখনকার শিল্পনগরের কোনো মিলই নেই। তখন শিল্পনগরটি ছিল বালুর চর। এখন সেখানে কারখানা ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। সিইটিপির নির্মাণও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোও সেখানে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ প্রস্তুত চামড়া, চামড়াপণ্য ও জুতা রপ্তানিকারক সমিতির (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ট্যানারির মালিকেরা সাভারে যেতে আগ্রহী। কিন্তু সিইটিপি নির্মাণ না হওয়ার কারণে এত দিন হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তরের প্রক্রিয়া আটকে ছিল। তবে এখন এর কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে।
২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) চামড়া শিল্পনগর প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। সাভারের হেমায়েতপুরে ২০০ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণাধীন এই শিল্পনগরের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৫ সালে। নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটি সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১০ সাল পর্যন্ত। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকায়। তাতেও কাজ শেষ হয়নি। ব্যয় না বাড়িয়ে আবারও ২০১২ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হলেও কাজ শেষ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত প্রকল্পের অনুমোদন হয় একনেকে। এ সময় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকায়। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিসিক। শিল্পনগরে ২০৫টি প্লটে ১৫৫টি কারখানা স্থাপন করা হবে।
কারখানার নির্মাণকাজ চলছে: শিল্পনগর সূত্র বলছে, ১৫৫টি ট্যানারির মধ্যে ১৪৭টির লে-আউট পরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১০৪টি ট্যানারি তাদের কারখানা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করেছে।
অবশ্য গত বুধবার সরেজমিন সাভারের শিল্পনগর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পুরো প্রকল্প এলাকায় কোনো কারখানা গড়ে ওঠেনি। এমনকি নির্মাণ শুরু হয়নি কোনো ভবনেরও। অনেক প্লটের সামনে ট্যানারির সাইনবোর্ড ঝোলানো আছে। কোথাও নির্মাণশ্রমিকদের থাকার জন্য কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। শ্রমিকেরা পাইলিংয়ের কাজ করছেন। কোথাও ট্রাক থেকে ইট নামানো হচ্ছে। কোথাও বালু নামানো হচ্ছে।
প্রকল্প এলাকায় নিয়োজিত সহকারী প্রকৌশলী মইন উদ্দিন আহম্মেদ প্রথম আলোকে বলেন, ১২০টি কারখানা তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। কারখানা ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে ২০টি ট্যানারির।
ট্যানারি মালিকেরাও বলছেন, অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের কারখানা স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। ১৫-২০টি কারখানার পাইলিং শেষের দিকে।
বিএফএলএলএফইএর সভাপতি আবু তাহের বলেন, ‘আমার কারখানার (রুমা লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ) ২১৭ মিটার পাইলিংয়ের মধ্যে ১৭০ মিটারই শেষ হয়েছে। বলতে পারেন, মাটির নিচের কাজ শেষ।’
এগোচ্ছে সিইটিপির কাজও: প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, সিইটিপির নির্মাণকাজ ৩৫ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে।
সূত্র বলছে, সিইটিপির অংশ হিসেবে বর্জ্য পরিশোধনের জন্য চারটি মডিউল তৈরি করার কথা। কয়েকটি চেম্বার নিয়ে একেকটি মডিউল। এসব চেম্বার তৈরির জন্য আরসিসি ঢালাইয়ের (রড দিয়ে কাঠামো বানিয়ে তাতে সিমেন্ট ও বালু দিয়ে ঢালাই) কাজ প্রায় শেষ। আর দুটি সিসি ঢালাইয়ের (রড ছাড়া অন্যান্য উপকরণ দিয়ে ঢালাই) কাজ অর্ধেক হয়েছে। ঈদের পর তা শেষ করা হবে। নতুন করে দুটি আরসিসি ঢালাইয়ের কাজ শুরু হবে।
এলাকায় গিয়ে দূর থেকে শ্রমিকদের সিইটিপি নির্মাণে কাজ করতে দেখা গেছে। তবে সিইটিপি এলাকার ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সিইটিপির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তব্যরত চীনা প্রকৌশলীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাঁরা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রািজ হননি।
চীন-বাংলাদেশ যৌথ প্রতিষ্ঠান জেএলইপিসিএ-ডিসিএল জেভিকে ২০১২ সালের ১১ মার্চ চামড়া শিল্পনগরে সিইটিপি নির্মাণের কার্যাদেশ দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। শর্ত ছিল ১৮ মাসে কাজ শেষ করতে হবে। ওই মেয়াদ শেষ হয় গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ায় এক বছরের বেশি সময় সিইটিপির নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল। সে কারণেই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যায়নি। এরপর তাদের সময় দেওয়া হয় এ বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত। এ সময়েও কাজ শেষ হয়নি। পরে আরেক দফায় তাদের সময় দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের তোড়জোড়: গত ১০ সেপ্টেম্বর ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। বৈঠকে তিনি বলেন, শিল্পনগরে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান ট্যানারি স্থানান্তরে ব্যর্থ হবে, তাদের প্লট বাতিল করে নতুন উদ্যোক্তাদের বরাদ্দ দেওয়া হবে।
এর পরই শিল্পনগর প্রকল্প কার্যালয় থেকে ৪৩টি ট্যানারি মালিককে তাঁদের প্লট কেন বাতিল করা হবে না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
ক্ষতিপূরণ পাননি কেউ: শিল্প মন্ত্রণালয় ১০ সেপ্টেম্বর বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় যে যেসব ট্যানারির মালিক ইতিমধ্যে সাভার চামড়া শিল্পনগরে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ পুরোদমে শুরু করেছেন, তাঁদের ওই মাসেই আনুপাতিক হারে ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ করা হবে।
তবে ঈদের আগে কোনো ট্যানারি মালিকই ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না।
শিল্পনগর সূত্র বলছে, কারা ক্ষতিপূরণ পাবেন, কী পরিমাণ পাবেন, তা নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে প্রকল্প কার্যালয়। সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ওই কমিটি গঠিত হলে কমিটির সদস্যরা সরেজমিন কারখানা ভবনের নির্মাণকাজের অগ্রগতি দেখে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। এর পরই ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আবু তাহের বলেন, ঈদের আগে প্রথম কিস্তিতে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না।
ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তরের এই প্রকল্প নেওয়া হয় ২০০৩ সালে। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানোর কারণে বেড়েছে ব্যয়ও। ২০১৫ সালের জুনের মধ্যে সব ট্যানারি স্থানান্তর করতে হবে
প্রকল্প কার্যালয়ের দাবি
১০৪টি কারখানার প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। আর কারখানা ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে ২০টি ট্যানারির
‘‘পাঁচ মাস আগে শিল্পনগরটি ছিল বালুর চর। এখন সেখানে কারখানা ভবন ও সিইটিপির নির্মাণকাজ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে
সিরাজুল হায়দার
প্রকল্প পরিচালক, চামড়া শিল্পনগর, সাভার
প্লট বাতিলের শঙ্কা
কারখানা নির্মাণ শুরু না করায় প্রকল্প কার্যালয় থেকে ৪৩টি ট্যানারিকে তাদের প্লট কেন বাতিল করা হবে না, সে বিষয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে
ক্ষতিপূরণ হলো না
কারখানার নির্মাণকাজ শুরু করা ট্যানারি মালিকদের ঈদের আগেই ক্ষতিপূরণের প্রথম কিস্তি দেওয়ার কথা থাকলেও কেউ তা পাননি
No comments