কাতারে প্রবাসীদের নিরানন্দ ঈদ by শরিফুল হাসান
কাতারের স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে পাঁচটা।
রাজধানী দোহার নাজমা জামে মসজিদে তিন থেকে চার হাজার মুসল্লি। তাঁদের
প্রায় সবাই বাংলাদেশি। সূর্যের আলো ছড়ানোর আগেই পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ
শেষ। পরস্পর কোলাকুলি সেরে সবাই রওনা হলেন নিজ নিজ বাসার দিকে। এ সময় অনেক
প্রবাসী বাংলাদেশি বললেন, ঈদের সারাটা দিন তাঁরা ঘুমিয়ে কাটাবেন। আজ
শনিবার কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপিত
হচ্ছে। তবে কাতারের রাস্তাঘাট ঘুরে বোঝার উপায় নেই—এখানে ঈদ উদ্যাপিত
হচ্ছে। কোথাও কোরবানির কোনো আয়োজন চোখে পড়ে না। আগের দিন পুরো দোহা শহর
ঘুরে কোথাও কোনো ব্যানার বা সজ্জা দেখা যায়নি।
কাতারের প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভাষ্য, মধ্যপ্রাচ্যে এভাবে নিরানন্দ ঈদ কাটে অধিকাংশ বাংলাদেশির। আত্মীয়-স্বজনহীন মানুষগুলোর কাছে ঈদ মানে একটা ছুটির দিন, দেশে পালন করা ঈদের স্মৃতিচারণা।
কাতারের বেশ কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি বললেন, দেশটিতে ঈদ উপলক্ষে রাস্তাঘাট সাজানো হয় না। ১৮ ডিসেম্বর কাতারের জাতীয় দিবসে সাজসজ্জা করা হয়। ঈদুল আজহায় কোরবানি দেওয়ার জন্য পুরো দোহার কোথাও কোনো উট-গরু-ছাগল দেখা যায় না। কারণ, শহরে পশু জবাইয়ের নিয়ম নেই। সেটি করতে হয় শহর থেকে বাইরে গিয়ে।
বাংলাদেশ থেকে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে কাতার। বাংলাদেশে যখন সকাল আটটা, কাতারে তখন ভোর পাঁচটা। ফজরের নামাজের পর এখানকার মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় কারা হয়। কারণ, সূর্য উঠলেই প্রচণ্ড গরম। তাই আলো ছড়ানোর আগেই মুসল্লিরা নামাজ শেষ করেন।
বাংলাদেশি প্রবাসীরা কীভাবে ঈদ উদ্যাপন করেন, তা জানতে ভোর পাঁচটায় হাজির হই দোহার নাজমা মসজিদে। সেখানেই কথা হয় চাঁদপুরের সাইফুল ইসলাম, লক্ষ্মীপুরের মোহাম্মদ সোহেল, কক্সবাজারের নূর মোহাম্মদ, মাদারীপুরের আমির হোসেন, নোয়াখালীর ওমর হোসেনসহ অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, তিনি ১৬ বছর ধরে কাতারে আছেন। স্ত্রী-দুই সন্তানের সবাই দেশে। এবার দেশে গিয়ে ঈদ করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু কাজের জন্য পারেননি। তিনি বলেন, ‘পরিবার-পরিজন ছাড়া ঈদ কোনো ঈদ নয়। তাই প্রবাসীদের ঈদ কাটে নিরানন্দভাবে।’
চার ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট আমির হোসেন মাত্র এক মাস আগে কাতার এসেছেন। পরিবার ছেড়ে দেশের বাইরে এটাই তাঁর প্রথম ঈদ। তিনি বলেন, দেশে থাকতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আনন্দ করে ঈদ করতেন। কিন্তু এখন তাঁর কিছুই ভালো লাগছে না।
নূর মোহাম্মদ মন খারাপ করে বলেন, ‘ভাই, একদম একা। ঈদের দিনটায় মনে হয়, আমার বুঝি কেউ নেই। দেশে কাটানো ঈদগুলোর কথা খুব মনে পড়ে।’
কাতারে কি কেউ কোরবানি দেয় না—জানতে চাইলে ওমর ফারুক ও ফখরুল ইসলাম বলেন, এখানে শহরের মধ্যে পশু জবাইয়ের কোনো নিয়ম নেই। আবু হামর এলাকায় গিয়ে পশু কিনে আসে অনেকেই। সেখানেই কোরবানি হয়। সেখান থেকে মাংস নিয়ে আসতে হয়। তবে অনেক সময় বাংলাদেশিরা ঈদের আনন্দ করার জন্য ক্যাম্পে লুকিয়ে ছাগল কোরবানি করেন। তবে পুলিশ জানলে ঝামেলা হয়। তাই পুরো কাজটাই হয় গোপনে। এর বাইরে সচ্ছল কিছু ধনী বাংলাদেশি, যাঁদের নিজের বাড়ি আছে, তাঁরা নিজেদের আঙিনায় অনেকটা গোপনে কোরবানি সম্পন্ন করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার সিরাজুল ইসলামের ভাষ্য, কাতারে আসার আগে তিনি ছয় বছর সৌদি আরব ও চার বছর দুবাই ছিলেন। কেবল কাতার নয়, মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঈদ খুব নিরানন্দভাবে কাটে। তাঁরা সারা দিন পরিবারের কথা ভেবে মন খারাপ করে থাকেন। তবে সন্ধ্যার পর গল্প ও আড্ডা দিয়ে সময় কাটানোর চেষ্টা চলে।
কাতারপ্রবাসী কয়েকজন পেশাজীবী বাংলাদেশি জানান, তাঁরা ঈদের দিন এখানে থাকা অন্য সহকর্মীদের বাসায় গিয়ে দিনটি কাটানোর চেষ্টা করেন।
বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি আক্ষেপ করে বলেন, ঈদে যদি দূতাবাস সবাইকে নিয়ে কোনো একটা আয়োজন করত, তাহলে খুব ভালো হতো।
কাতারে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর শফিউল আজিম প্রথম আলোকে জানান, এখানে শহরের মধ্যে যেখানে-সেখানে পশু জবাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। কোরবানি করা হয় আবু হামর এলাকায়। সেখানেই পশু কেনাবেচা হয়। কেউ কোরবানি দিতে চাইলে সেখানেই দেন।
প্রবাসীদের ঈদ কীভাবে কাটে জানতে চাইলে বাংলাদেশ দূতাবাসের এই কর্মকর্তা বলেন, পরিবার-পরিজন ছাড়া আসলেই প্রবাসীদের ঈদ ভালো কাটে না। তবে ঈদের দিন কোথাও কোথাও বাংলাদেশিরা কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেটাই তাঁদের একমাত্র বিনোদন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আজ ঈদ উপলক্ষে দোহার আল-আরাবিয়া স্টেডিয়ামে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আয়োজনের নাম ‘সুপারস্টার ঈদ কনসার্ট ২০১৪’। অনুষ্ঠানের আয়োজক বাংলাদেশ কালচারাল ফোরাম।
অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডশিল্পী জেমস, চলচ্চিত্রের নায়ক সাকিব খান, নায়িকা অপু বিশ্বাস, সংগীতশিল্পী এলিটা, কোনাল, সিলভী, ঝিলিকসহ অনেক তারকার উপস্থিত থাকার কথা।
সংগঠনের আহ্বায়ক ওহিদ ভূঁইয়া প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, জেমসসহ অধিকাংশ শিল্পী ইতিমধ্যে দোহায় এসেছেন। ঈদের এই অনুষ্ঠানটি দারুণ জমজমাট হবে।
No comments