আইডিয়ায় মোদি এক নম্বরে, রূপায়ণ হবে তো? by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতের গত ১০ দিনের খবরের কাগজগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ রাখুন। কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সংবাদ সম্প্রচার স্মরণ করুন। দেখবেন, একটি নামই জ্বলজ্বল করেছে, একজনের খবরই হেডলাইনসে প্রাধান্য পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁকে যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁরা তো কাগজের বেশিটাই মোদি-বন্দনায় ভরিয়ে রেখেছেন। যাঁরা তাঁকে ততটা নেকনজরে দেখেন না, তাঁরাও কিন্তু মোদিকে উপেক্ষা করতে পারছেন না। চাঁদ সওদাগরের মনসাপূজার ঢঙে তাঁরাও মোদিকে প্রচারমাধ্যমে জায়গা দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরটাই দেখা যাক। দিল্লির বদলে মোদি তাঁকে আহমেদাবাদে নামালেন। সেদিন মোদির জন্মদিন। জিনপিং ও মোদি সবরমতী নদীর তীরে গান্ধী আশ্রমে বহুক্ষণ কাটালেন। জিনপিংকে মোদি চরকায় সুতো কাটা শেখালেন, নদীর তীরে দুজনে দোলনায় দুললেন এবং পরের দিন দিল্লি এলেন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তখন দিল্লিতে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় মোদি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন, শেখ হাসিনা দেশটাকে রক্ষা করেছেন।’ পরিবর্তিত জামানায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কোন খাতে বইতে চলেছে, এই একটা বাক্যই তার ইঙ্গিতবাহী। এটাও প্রথম পাতার খবর হলো। এরপর মোদি গেলেন মার্কিন মুলুকে। এক যুগ অচ্ছুত থাকার পর মোদির সেই সফর নিয়ে যে কোলাহল সৃষ্টি হয়েছে, তার রেশ সংবাদমাধ্যম থেকে এখনো মিলোয়নি। ম্যাডিসন স্কয়ারে মোদির ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে শুরু করে বারাক ওবামার গুজরাটি সম্ভাষণ ‘কেম ছো (কেমন আছেন) প্রাইম মিনিস্টার?’ নিয়ে এখনো গবেষণার শেষ নেই। দুই দেশের সম্পর্ক কোন উচ্চতায় পৌঁছাল এবং জাপান ও চীনের দিকে অনেকটাই ঝুঁকে পড়া ভারতকে আমেরিকা তাদের দিকে কতখানি টেনে আনতে পারবে, সে নিয়ে অন্তহীন গবেষণা চলছেই। এখানেও সংবাদমাধ্যম মোদিময়।
ভারত-আমেরিকা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আগামী দিনে পাঁচ গুণ বাড়াতে মোদি ও ওবামা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন। সেই লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে একটা লগ্নি-উদ্যোগ স্থাপনে দুই নেতা রাজি হয়েছেন। আজমির, বিশাখাপট্টনম ও এলাহাবাদকে ‘স্মার্ট সিটি’ হিসেবে গড়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পমহল রাজি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে দুই দেশ একজোট হয়ে কাজে নামার বিষয়েও অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। এ জন্য যা যা করণীয়, আগামী দিনগুলোতে তা করা হবে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য ২০০৫ সালে যে বোঝাপড়া দুই দেশের মধ্যে হয়েছিল, তা আরও ১০ বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। এসব বিষয়ের পাশাপাশি সন্ত্রাস রোধে (দাউদ ইব্রাহিমসহ) একসঙ্গে কাজ করার যৌথ প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রশ্নে সহমত হওয়া (যদিও আইএস মোকাবিলায় ভারত সেনা পাঠাবে না জানিয়ে দিয়েছে) মোদির এই সফরের বড় লাভ। কিন্তু এটাও ঠিক, এত মাখামাখি সত্ত্বেও মোদি কিন্তু ওবামার সব সুরে নাচেননি। বাণিজ্য প্রসারে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্তাবলি মোদির সরকার এখনো মানেনি। খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নে তিনি এখনো অনড়। তেমনই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণের জন্য ভারতীয় আইন নিয়ে যে টালবাহানা দীর্ঘদিন ধরে চলছে, তার সুরাহাও এই সফরে হয়নি। মীমাংসার জন্য একটা ‘কনট্যাক্ট গ্রুপ’ গঠনে দুই দেশ রাজি হয়েছে শুধু। তাতে চিড়ে ভিজবে কি না কিংবা ভিজলেও কবে, সে এক জটিল প্রশ্ন।
ফল যা-ই হোক, মোদি যে অন্য সবার চেয়ে অন্যভাবে চিন্তা করতে পারেন, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আউট অব দ্য বক্স আইডিয়া’ এবং প্রচারের আলোকে অতি সহজে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারেন, তার প্রমাণ তিনি বারবার দিচ্ছেন। জাতিসংঘে তিনি ভাষণ দিলেন হিন্দিতে। লিখিত ভাষণের গণ্ডি টপকে বারবার তিনি বক্তব্যের বাড়তি ব্যাখ্যা দিলেন। ইংরেজি ভাষায় তিনি ততটা দক্ষ নন। কিন্তু সেই খামতিকে তিনি কমজোরি ভাবতে নারাজ। ইংরেজির জ্ঞান সীমিত হলে যাঁরা লজ্জা পান, মোদি সেই দলভুক্ত নন; বরং সেই দুর্বলতাকেই তিনি তাঁর হাতিয়ার করে তুলেছেন। তুখোড় ভাষণের মাধ্যমে তিনি অনায়াসে সাধারণের মন ছুঁয়ে যাচ্ছেন। কীভাবে এবং কোন সাবলীলতায় ভর দিয়ে তিনি জনতার সঙ্গে ‘কানেক্ট’ করছেন, ম্যাডিসন স্কয়ারের দীর্ঘ বক্তৃতাই তার প্রমাণ। এভাবে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ভাষণ দিতেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। মোদি সেই দক্ষতার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন তাঁর ‘মার্কেটিং স্কিল’কে। আজকের দিনে নিজেকে কীভাবে ‘প্রজেক্ট’ করতে হবে, কীভাবে মানুষকে শুনতে বা ভাবতে বাধ্য করাতে হবে, মোহিত করতে হবে, মোদিকে দেখে তা শেখা দরকার। সাধারণ নির্বাচনের আগে-পরের ছয় মাসে মোদি বারবার তার প্রমাণ রেখেছেন এবং এখনো প্রতিনিয়ত রেখে যাচ্ছেন।
এই যেমন মার্কিন মুলুক থেকে দেশে ফিরে মোদি কিন্তু বিশ্রামের ধার-কাছ দিয়েও হাঁটলেন না। ফিরলেন ১ অক্টোবর, পরের দিন জাতির জনকের জন্মদিন। সেদিন সকাল থেকে কাজ আর কাজ। গান্ধীজি স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর দিতেন। স্বাধীনতা দিবসের দিন লালকেল্লা থেকে ভাষণে মোদি ২ অক্টোবরের জন্য দেশবাসীর কাছে একটা নতুন ‘এজেন্ডা’ রাখলেন। স্বচ্ছতা দিবস। গোটা দেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জঞ্জালমুক্ত করা ও রাখার একটা অঙ্গীকার তিনি আদায় করে নিলেন। কী করলেন তিনি? আমরা দেখলাম, সাতসকালেই তিনি ঝাড়ু হাতে নেমে পড়লেন। গান্ধীজি ‘মেথর’দের ডেকেছিলেন ‘হরিজন’ বলে। তাদের কলোনির নাম ক্রমে ক্রমে ‘বাল্মীকি কলোনি’ বলে পরিচিত হয়। মোদি সেই কলোনিতে ঢুকে ঝাড়ু চালাতে লাগলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাড়ু হাতে সাফাই অভিযানে নেমে পড়ল গোটা দেশ। মন্ত্রীরা, নেতারা, আমলারা, শিল্পপতিরা, নায়ক-নায়িকারা এবং নামী-অনামী সাধারণ মানুষ উত্তর থেকে দক্ষিণে, পুব থেকে পশ্চিমে দিনভর ঝাড়ু হাতে রাস্তা থেকে, নালা থেকে জঞ্জাল তুলছেন, এমন দৃশ্য আমি কেন, সম্ভবত কেউই কখনো দেখেনি। মোদি বিভিন্ন ভাষণে বারবার বলেছেন, স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতাকে তিনি জাতীয় আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান। এবং সেই আন্দোলনে তিনি রাজনীতিকে মেলাতে চান না। বলতে দ্বিধা নেই, সেই লক্ষ্যের প্রথম ধাপে তিনি সফল। পরবর্তী পর্যায়ে কী হবে, সে বিষয়ে প্রশ্নচিহ্ন যদিও থেকেই যাচ্ছে।
প্রথম ধাপে কেন সফল? চিরায়ত রাজনীতির ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে মোদি সমাজের বিভিন্ন পেশার নয়জন বিশিষ্ট মানুষকে এই আন্দোলনের শরিক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সেই নয়জন হলেন সিনেমা জগতের দিকপাল কমল হাসান, সালমান খান, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, যোগগুরু বাবা রামদেব, শিল্পপতি অনিল আম্বানি, ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার, গোয়ার রাজ্যপাল মৃদুলা সিনহা, কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর ও জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক ‘তারক মেহতা কা উল্টা চশমা’র পুরো টিম। এই নয়জনের প্রত্যেকে আরও নয়জন করে মানুষ বাছবেন, তাঁরাও প্রত্যেকে বাছবেন নয়জন করে। এভাবে কোটি কোটি মানুষ শামিল হবেন স্বচ্ছ ভারত গড়ে তোলার আন্দোলনে। মোদি এঁদের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা পছন্দমতো জায়গা বেছে নিন। সেখানে নোংরা দেখলে প্রথমে ছবি তুলুন। তারপর সেই জায়গা পরিষ্কার করে ফেলুন। পরিষ্কার জায়গার ছবিও তুলুন। তারপর অপরিচ্ছন্ন ও পরিচ্ছন্ন দুই ছবিই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পোস্ট করুন। সাত দিন এই কাজ করুন। দেখুন কী বিপুল পরিবর্তন ঘটে যাবে দেশে।
মোদির এই আন্দোলনেরই একটা অঙ্গ দেশের প্রতিটি পরিবারের জন্য পায়খানা তৈরি করা। ২০১৯ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারের জন্য ১১ কোটি ১১ লাখ পায়খানা তৈরি হবে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক এ জন্য প্রতিটি গ্রামকে আগামী পাঁচ বছর ধরে বছরে ২০ লাখ রুপি দেবে। দেশের সাড়ে ছয় লাখ গ্রামের জন্য এই কাজে বছরে খরচ হবে ১৩ হাজার কোটি রুপি। স্বচ্ছতা অভিযানে মোদির বাজেট আগামী পাঁচ বছরে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি রুপি। এই অর্থের মধ্যে ২০১৫ সালে শহরাঞ্চলে তৈরি হবে দুই কোটি পায়খানা, খরচ হবে ৬২ হাজার নয় কোটি রুপি। ২০১৯ সালের মধ্যে এক কোটি চার লাখ বাড়িতে তৈরি হবে কলঘর ও পাকা পায়খানা। ওই বছরের মধ্যে চার হাজার ৪১টি শহরে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বন্দোবস্ত করা হবে। গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে মাথায় করে মলমূত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করা হবে। এখন দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ উন্মুক্ত এলাকায় মলমূত্র ত্যাগ করে। দেশের ১০ শতাংশ স্কুলে এখনো মেয়েদের টয়লেট নেই। ২০২২ সালের মধ্যে এই অসুবিধে পুরোপুরি দূর করা মোদির লক্ষ্য।
সংবাদমাধ্যমে স্থান পাওয়া নিয়ে নরেন্দ্র মোদির এই ‘পাকাপাকি বন্দোবস্ত’র প্রধান কারণ তাঁর অন্য ধরনের ভাবনাচিন্তা, যা আমি আগেই ‘আউট অব দ্য বক্স আইডিয়া’ বলে লিখেছি। পরিচ্ছন্নতার প্রশ্নে তিনি রাজনীতি আনবেন না বলেছেন। না আনতেই পারেন। কিন্তু আশঙ্কা, দিনান্তে এই কর্মযজ্ঞ নিছকই ছবি তোলার মোচ্ছবে না পরিণত হয়। তেমন হলে পুরোটাই রাজনৈতিক ‘গিমিক’ হয়ে দাঁড়ালে এই ‘আউট অব দ্য বক্স আইডিয়াই’ শেষ পর্যন্ত প্রবল পরিহাস হয়ে মোদিকে ধাওয়া করবে। দি এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের (টেরি) হিসাব অনুযায়ী, ভারতের শহরগুলোতে প্রতিবছর ৬৮ মিলিয়ন টন জঞ্জাল জমে। এর মধ্যে ২৭ মিলিয়ন টন জমি ভরাটের কাজে লাগানো হয় অথবা গ্রামীণ এলাকায় ফেলা হয়। ১৪ মিলিয়ন টন শহরেই পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ৩৮ বিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য দেশের ৪৯৮টি শহর ২০০৯ সালে উৎপন্ন করেছে। এর মধ্যে ২৬ বিলিয়ন লিটারের স্থান হয়েছে দেশের নদীগুলোতে! দেশকে পরিচ্ছন্ন করতে গেলে শুধু ঝাড়ু হাতে পথে নামাই শেষ কথা নয়; শেষ কথা হলো এই বিপুল কঠিন ও তরল বর্জ্যের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার বন্দোবস্ত করা। সে জন্য যে পাহাড়প্রমাণ অর্থের প্রয়োজন, তার জোগাড় কোন গৌরী সেন দেবেন, তা এখনো অজানা।
তিনি যে বসে থাকার পাত্র নন, এই চার মাসে নরেন্দ্র মোদি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মগজে নিত্যনতুন আইডিয়া ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই কারণেই সংবাদমাধ্যমে তিনি সদা আলোচিত। কিন্তু শেষ হিসাবে তাঁকে প্রমাণ দিতে হবে, তিনি শুধু স্বপ্ন দেখিয়েই থমকে যান না, স্বপ্নকে তিনি সাকারও করেন।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরটাই দেখা যাক। দিল্লির বদলে মোদি তাঁকে আহমেদাবাদে নামালেন। সেদিন মোদির জন্মদিন। জিনপিং ও মোদি সবরমতী নদীর তীরে গান্ধী আশ্রমে বহুক্ষণ কাটালেন। জিনপিংকে মোদি চরকায় সুতো কাটা শেখালেন, নদীর তীরে দুজনে দোলনায় দুললেন এবং পরের দিন দিল্লি এলেন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তখন দিল্লিতে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় মোদি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছেন, শেখ হাসিনা দেশটাকে রক্ষা করেছেন।’ পরিবর্তিত জামানায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কোন খাতে বইতে চলেছে, এই একটা বাক্যই তার ইঙ্গিতবাহী। এটাও প্রথম পাতার খবর হলো। এরপর মোদি গেলেন মার্কিন মুলুকে। এক যুগ অচ্ছুত থাকার পর মোদির সেই সফর নিয়ে যে কোলাহল সৃষ্টি হয়েছে, তার রেশ সংবাদমাধ্যম থেকে এখনো মিলোয়নি। ম্যাডিসন স্কয়ারে মোদির ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে শুরু করে বারাক ওবামার গুজরাটি সম্ভাষণ ‘কেম ছো (কেমন আছেন) প্রাইম মিনিস্টার?’ নিয়ে এখনো গবেষণার শেষ নেই। দুই দেশের সম্পর্ক কোন উচ্চতায় পৌঁছাল এবং জাপান ও চীনের দিকে অনেকটাই ঝুঁকে পড়া ভারতকে আমেরিকা তাদের দিকে কতখানি টেনে আনতে পারবে, সে নিয়ে অন্তহীন গবেষণা চলছেই। এখানেও সংবাদমাধ্যম মোদিময়।
ভারত-আমেরিকা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আগামী দিনে পাঁচ গুণ বাড়াতে মোদি ও ওবামা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন। সেই লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে একটা লগ্নি-উদ্যোগ স্থাপনে দুই নেতা রাজি হয়েছেন। আজমির, বিশাখাপট্টনম ও এলাহাবাদকে ‘স্মার্ট সিটি’ হিসেবে গড়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পমহল রাজি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে দুই দেশ একজোট হয়ে কাজে নামার বিষয়েও অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে। এ জন্য যা যা করণীয়, আগামী দিনগুলোতে তা করা হবে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য ২০০৫ সালে যে বোঝাপড়া দুই দেশের মধ্যে হয়েছিল, তা আরও ১০ বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। এসব বিষয়ের পাশাপাশি সন্ত্রাস রোধে (দাউদ ইব্রাহিমসহ) একসঙ্গে কাজ করার যৌথ প্রচেষ্টা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রশ্নে সহমত হওয়া (যদিও আইএস মোকাবিলায় ভারত সেনা পাঠাবে না জানিয়ে দিয়েছে) মোদির এই সফরের বড় লাভ। কিন্তু এটাও ঠিক, এত মাখামাখি সত্ত্বেও মোদি কিন্তু ওবামার সব সুরে নাচেননি। বাণিজ্য প্রসারে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্তাবলি মোদির সরকার এখনো মানেনি। খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নে তিনি এখনো অনড়। তেমনই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণের জন্য ভারতীয় আইন নিয়ে যে টালবাহানা দীর্ঘদিন ধরে চলছে, তার সুরাহাও এই সফরে হয়নি। মীমাংসার জন্য একটা ‘কনট্যাক্ট গ্রুপ’ গঠনে দুই দেশ রাজি হয়েছে শুধু। তাতে চিড়ে ভিজবে কি না কিংবা ভিজলেও কবে, সে এক জটিল প্রশ্ন।
ফল যা-ই হোক, মোদি যে অন্য সবার চেয়ে অন্যভাবে চিন্তা করতে পারেন, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আউট অব দ্য বক্স আইডিয়া’ এবং প্রচারের আলোকে অতি সহজে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারেন, তার প্রমাণ তিনি বারবার দিচ্ছেন। জাতিসংঘে তিনি ভাষণ দিলেন হিন্দিতে। লিখিত ভাষণের গণ্ডি টপকে বারবার তিনি বক্তব্যের বাড়তি ব্যাখ্যা দিলেন। ইংরেজি ভাষায় তিনি ততটা দক্ষ নন। কিন্তু সেই খামতিকে তিনি কমজোরি ভাবতে নারাজ। ইংরেজির জ্ঞান সীমিত হলে যাঁরা লজ্জা পান, মোদি সেই দলভুক্ত নন; বরং সেই দুর্বলতাকেই তিনি তাঁর হাতিয়ার করে তুলেছেন। তুখোড় ভাষণের মাধ্যমে তিনি অনায়াসে সাধারণের মন ছুঁয়ে যাচ্ছেন। কীভাবে এবং কোন সাবলীলতায় ভর দিয়ে তিনি জনতার সঙ্গে ‘কানেক্ট’ করছেন, ম্যাডিসন স্কয়ারের দীর্ঘ বক্তৃতাই তার প্রমাণ। এভাবে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ভাষণ দিতেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। মোদি সেই দক্ষতার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন তাঁর ‘মার্কেটিং স্কিল’কে। আজকের দিনে নিজেকে কীভাবে ‘প্রজেক্ট’ করতে হবে, কীভাবে মানুষকে শুনতে বা ভাবতে বাধ্য করাতে হবে, মোহিত করতে হবে, মোদিকে দেখে তা শেখা দরকার। সাধারণ নির্বাচনের আগে-পরের ছয় মাসে মোদি বারবার তার প্রমাণ রেখেছেন এবং এখনো প্রতিনিয়ত রেখে যাচ্ছেন।
এই যেমন মার্কিন মুলুক থেকে দেশে ফিরে মোদি কিন্তু বিশ্রামের ধার-কাছ দিয়েও হাঁটলেন না। ফিরলেন ১ অক্টোবর, পরের দিন জাতির জনকের জন্মদিন। সেদিন সকাল থেকে কাজ আর কাজ। গান্ধীজি স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর দিতেন। স্বাধীনতা দিবসের দিন লালকেল্লা থেকে ভাষণে মোদি ২ অক্টোবরের জন্য দেশবাসীর কাছে একটা নতুন ‘এজেন্ডা’ রাখলেন। স্বচ্ছতা দিবস। গোটা দেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জঞ্জালমুক্ত করা ও রাখার একটা অঙ্গীকার তিনি আদায় করে নিলেন। কী করলেন তিনি? আমরা দেখলাম, সাতসকালেই তিনি ঝাড়ু হাতে নেমে পড়লেন। গান্ধীজি ‘মেথর’দের ডেকেছিলেন ‘হরিজন’ বলে। তাদের কলোনির নাম ক্রমে ক্রমে ‘বাল্মীকি কলোনি’ বলে পরিচিত হয়। মোদি সেই কলোনিতে ঢুকে ঝাড়ু চালাতে লাগলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাড়ু হাতে সাফাই অভিযানে নেমে পড়ল গোটা দেশ। মন্ত্রীরা, নেতারা, আমলারা, শিল্পপতিরা, নায়ক-নায়িকারা এবং নামী-অনামী সাধারণ মানুষ উত্তর থেকে দক্ষিণে, পুব থেকে পশ্চিমে দিনভর ঝাড়ু হাতে রাস্তা থেকে, নালা থেকে জঞ্জাল তুলছেন, এমন দৃশ্য আমি কেন, সম্ভবত কেউই কখনো দেখেনি। মোদি বিভিন্ন ভাষণে বারবার বলেছেন, স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতাকে তিনি জাতীয় আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চান। এবং সেই আন্দোলনে তিনি রাজনীতিকে মেলাতে চান না। বলতে দ্বিধা নেই, সেই লক্ষ্যের প্রথম ধাপে তিনি সফল। পরবর্তী পর্যায়ে কী হবে, সে বিষয়ে প্রশ্নচিহ্ন যদিও থেকেই যাচ্ছে।
প্রথম ধাপে কেন সফল? চিরায়ত রাজনীতির ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে মোদি সমাজের বিভিন্ন পেশার নয়জন বিশিষ্ট মানুষকে এই আন্দোলনের শরিক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সেই নয়জন হলেন সিনেমা জগতের দিকপাল কমল হাসান, সালমান খান, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, যোগগুরু বাবা রামদেব, শিল্পপতি অনিল আম্বানি, ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার, গোয়ার রাজ্যপাল মৃদুলা সিনহা, কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর ও জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক ‘তারক মেহতা কা উল্টা চশমা’র পুরো টিম। এই নয়জনের প্রত্যেকে আরও নয়জন করে মানুষ বাছবেন, তাঁরাও প্রত্যেকে বাছবেন নয়জন করে। এভাবে কোটি কোটি মানুষ শামিল হবেন স্বচ্ছ ভারত গড়ে তোলার আন্দোলনে। মোদি এঁদের উদ্দেশে বলেছেন, আপনারা পছন্দমতো জায়গা বেছে নিন। সেখানে নোংরা দেখলে প্রথমে ছবি তুলুন। তারপর সেই জায়গা পরিষ্কার করে ফেলুন। পরিষ্কার জায়গার ছবিও তুলুন। তারপর অপরিচ্ছন্ন ও পরিচ্ছন্ন দুই ছবিই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পোস্ট করুন। সাত দিন এই কাজ করুন। দেখুন কী বিপুল পরিবর্তন ঘটে যাবে দেশে।
মোদির এই আন্দোলনেরই একটা অঙ্গ দেশের প্রতিটি পরিবারের জন্য পায়খানা তৈরি করা। ২০১৯ সালের মধ্যে দেশের প্রতিটি গ্রামীণ পরিবারের জন্য ১১ কোটি ১১ লাখ পায়খানা তৈরি হবে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক এ জন্য প্রতিটি গ্রামকে আগামী পাঁচ বছর ধরে বছরে ২০ লাখ রুপি দেবে। দেশের সাড়ে ছয় লাখ গ্রামের জন্য এই কাজে বছরে খরচ হবে ১৩ হাজার কোটি রুপি। স্বচ্ছতা অভিযানে মোদির বাজেট আগামী পাঁচ বছরে এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি রুপি। এই অর্থের মধ্যে ২০১৫ সালে শহরাঞ্চলে তৈরি হবে দুই কোটি পায়খানা, খরচ হবে ৬২ হাজার নয় কোটি রুপি। ২০১৯ সালের মধ্যে এক কোটি চার লাখ বাড়িতে তৈরি হবে কলঘর ও পাকা পায়খানা। ওই বছরের মধ্যে চার হাজার ৪১টি শহরে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বন্দোবস্ত করা হবে। গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে মাথায় করে মলমূত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করা হবে। এখন দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ উন্মুক্ত এলাকায় মলমূত্র ত্যাগ করে। দেশের ১০ শতাংশ স্কুলে এখনো মেয়েদের টয়লেট নেই। ২০২২ সালের মধ্যে এই অসুবিধে পুরোপুরি দূর করা মোদির লক্ষ্য।
সংবাদমাধ্যমে স্থান পাওয়া নিয়ে নরেন্দ্র মোদির এই ‘পাকাপাকি বন্দোবস্ত’র প্রধান কারণ তাঁর অন্য ধরনের ভাবনাচিন্তা, যা আমি আগেই ‘আউট অব দ্য বক্স আইডিয়া’ বলে লিখেছি। পরিচ্ছন্নতার প্রশ্নে তিনি রাজনীতি আনবেন না বলেছেন। না আনতেই পারেন। কিন্তু আশঙ্কা, দিনান্তে এই কর্মযজ্ঞ নিছকই ছবি তোলার মোচ্ছবে না পরিণত হয়। তেমন হলে পুরোটাই রাজনৈতিক ‘গিমিক’ হয়ে দাঁড়ালে এই ‘আউট অব দ্য বক্স আইডিয়াই’ শেষ পর্যন্ত প্রবল পরিহাস হয়ে মোদিকে ধাওয়া করবে। দি এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের (টেরি) হিসাব অনুযায়ী, ভারতের শহরগুলোতে প্রতিবছর ৬৮ মিলিয়ন টন জঞ্জাল জমে। এর মধ্যে ২৭ মিলিয়ন টন জমি ভরাটের কাজে লাগানো হয় অথবা গ্রামীণ এলাকায় ফেলা হয়। ১৪ মিলিয়ন টন শহরেই পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ৩৮ বিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য দেশের ৪৯৮টি শহর ২০০৯ সালে উৎপন্ন করেছে। এর মধ্যে ২৬ বিলিয়ন লিটারের স্থান হয়েছে দেশের নদীগুলোতে! দেশকে পরিচ্ছন্ন করতে গেলে শুধু ঝাড়ু হাতে পথে নামাই শেষ কথা নয়; শেষ কথা হলো এই বিপুল কঠিন ও তরল বর্জ্যের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার বন্দোবস্ত করা। সে জন্য যে পাহাড়প্রমাণ অর্থের প্রয়োজন, তার জোগাড় কোন গৌরী সেন দেবেন, তা এখনো অজানা।
তিনি যে বসে থাকার পাত্র নন, এই চার মাসে নরেন্দ্র মোদি তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মগজে নিত্যনতুন আইডিয়া ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই কারণেই সংবাদমাধ্যমে তিনি সদা আলোচিত। কিন্তু শেষ হিসাবে তাঁকে প্রমাণ দিতে হবে, তিনি শুধু স্বপ্ন দেখিয়েই থমকে যান না, স্বপ্নকে তিনি সাকারও করেন।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।
No comments