কৌশল বদলে ফের কিডনি কেনাবেচা by তৌহিদুল ইসলাম লায়নর
অভাবের কারণে কালাইয়ে ব্যাপক হারে কিডনি
বিক্রির ঘটনা ঘটে ২০১১ সালে। তখন এ ঘটনা আলোচিত হয়েছিল দেশজুড়ে। গণমাধ্যমে
খবর প্রকাশের পর কিডনি ব্যবসায় জড়িত দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছিল
প্রশাসন। কয়েকজন দালালকে আটক করে কারাগারেও পাঠানো হয়েছিল। এর ঠিক তিন বছর
পর ফের সক্রিয় হয়েছে ওই চক্রটি। আবার শুরু হয়েছে কিডনি কেনাবেচা। তবে এবার
কৌশল পাল্টিয়েছে উভয় পক্ষই। ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে, পাসপোর্ট জাল করে, ভুয়া
চিকিৎসাপত্র নিয়ে অনেকে বিদেশ যাচ্ছে কিডনি বিক্রির জন্য। মোটা অঙ্কের
অর্থের বিনিময়ে এ কাজ করছে সেই আগের চক্রই।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার ২৩ গ্রামের আরও অন্তত ৩৭ জন ঋণগ্রস্ত-অভাবী মানুষ হফ্কা ঋণ (দাদন) ব্যবসা ও এনজিও’র ঋণের কিস্তির ফাঁদে পড়ে নিরুপায় হয়ে বিদেশে গিয়ে তাদের দেহের মূল্যবান সম্পদ কিডনি ও যকৃৎ বিক্রি করেছেন। তবে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিখোঁজ রয়েছেন নারী-পুরুষ মিলে আরও অন্তত ১২ জন। কিডনি ব্যবসায় এখন কৌশল বদল করেছে দালালরা। এবার কিডনি বিক্রেতাদের নাম ঠিক রেখে পরিবর্তন করা হচ্ছে মূল ঠিকানা। ব্যবহার করা হচ্ছে ভুয়া বাবা-মায়ের নাম। কিডনি গ্রহীতার সঙ্গে বিক্রেতার রক্তের সম্পর্ক দেখিয়ে নেয়া হচ্ছে কিডনি গ্রহীতাদের স্ব-স্ব এলাকার ইউনিয়ন/পৌরসভা থেকে কিডনি বিক্রেতার জন্মনিবন্ধন ও নাগরিকত্ব সনদ। এ ছাড়া তৈরি করা হচ্ছে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র। পাসপোর্ট প্রস্তুতের সময় পুলিশ পরিদর্শন প্রতিবেদন দাখিলের আগে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কিডনি বিক্রেতাদের পরিবর্তিত নতুন ঠিকানায় সশরীরে উপস্থিত দেখানো হয়।
এদিকে প্রশাসনের যথাযথ মনিটরিং না থাকায় জামিনে থাকা মূল হোতাসহ নতুন নতুন দালাল চক্রের বিরুদ্ধে অভিনব কৌশলে কিডনি কেনাবেচার অভিযোগ উঠেছে। আগের চেয়ে বেশি দামে কিডনি কেনার লোভ দেখিয়ে নতুন দালালরা গোপনে উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম-মহল্লার ঋণগ্রস্ত অভাবী ও খেটে খাওয়া মানুষের এখন নিত্যদিন এলাকা ছাড়া করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে। সরজমিনে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী- পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিডনি বিক্রি দালাল চক্রের মূল হোতা কালাই উপজেলার আবদুস সাত্তার, ঢাকার তারেক আজম, মাহমুদ, সন্ত্রাসী কবির, সিরাজগঞ্জের মকবুল ও বাগেরহাটের সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে নতুনভাবে কিডনি কেনাবেচার দালালি শুরু করেছে কালাই উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের তাজুল ইসলাম, হেলাল, গাজী, নয়াপাড়া গ্রামের নূরনবী, বোড়াই গ্রামের উঁকুন খোরশেদ, টাকাহুত গ্রামের মোশাররফ, শফি, রাসেল ও শাহিন, জয়পুর বহুঁতি গ্রামের মোস্তফা ও আবদুল মান্নান, নওয়ানা গ্রামের মোশারফ ও নারায়ণগঞ্জের মকবুলসহ অনেকে। তবে মামলা ও প্রচার মাধ্যমের সুবাদে দেশজুড়ে হইচই শুরু হওয়ার আগে যারা কিডনি বিক্রি করেছিল, তাদের অধিকাংশেরই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল দেশের ঢাকাস্থ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। কিন্তু বর্তমানে দেশের কোন হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন না করার কারণে কিডনি বিক্রেতারা ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে অবস্থিত কলম্ব এশিয়া হাসপাতাল, রবীন্দ্র-দেবীশেটি হাসপাতাল, মেডিকা হাসপাতাল ও সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে তাদের কিডনি প্রতিস্থাপন করছেন। নারায়ণগঞ্জের দালাল মকবুলের মাধ্যমে ভারতে কিডনি বিক্রি করতে গিয়ে দরদামে বনিবনা না হওয়ায় ফিরে এসেছেন কালাই উপজেলার বৈরাগী হাটের রিপন ও দুর্গাপুর গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আমিনুল ইসলাম।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার অভাবী মানুষ গত ৬ মাসে ফের নতুনভাবে কিডনি বিক্রি করেছেন অভিনব কৌশলে কিডনি গ্রহীতার সঙ্গে বিক্রেতার রক্তের সম্পর্ক দেখিয়ে নাম ঠিক রেখে মূল ঠিকানা, বাবা-মায়ের নাম, পাসপোর্ট ও ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে। এমন কয়েকজনের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পর্যবেক্ষণকালে নানা অসঙ্গতি দেখা গেছে। এমন কয়েকজন হলেন কালাই উপজেলার বোড়াই গ্রামের মোকাররম, বিনইল পশ্চিম গুচ্ছগ্রামের জবুনা বেগম, সিমরাইল গ্রামের আবদুর রহিম ও উলিপুর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা আজাদুল। জবুনাকে খুলনা বসুপাড়া এতিমখানা রোডের এবং আবদুর রহিমকে ফেনি সদরের স্থায়ী বাসিন্দা দেখানো হয়েছে। তবে আজাদুলের পাসপোর্টে তার প্রকৃত নাম ও ঠিকানার পরিবর্তন করে ব্যবহার করা হয়েছে মো. আজাদ হোসেন। স্থায়ী ঠিকানা দেখানো হয়েছে জাপান গার্ডেন সিটি বাংলাদেশ-১। অন্যজন হলেন কালাই উপজেলার বোড়াই গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা জোসনা বেগম। জোসনার পাসপোর্ট ও ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্রে তার প্রকৃত নাম ও ঠিকানার পরিবর্তন করে ব্যবহার করা হয়েছে মাহফুজা বেগম। স্থায়ী ঠিকানা দেখানো হয়েছে সালামাইদ, গুলশান, ভাটারা, ঢাকা-১২১২। কালাই উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম-মহল্লার নতুন করে কিডনি বিক্রির তালিকায় আছেন বোড়াই গ্রামের মোকাররম হোসেন, বেলাল উদ্দীন ও তার স্ত্রী জোসনা বেগম; বিনইল পশ্চিম গুচ্ছগ্রামের জবুনা বেগম, সিমরাইল গ্রামের আবেদুর রহমান, ইসলাম মিয়া, আবদুর রহিম, এনামুল, সাকোয়াত ও মোত্তালেব, আরবাব গ্রামের আফজাল, পাইকপাড়া গ্রামের শহীদুল ইসলাম, রঘুনাথপুর গ্রামের জাকারিয়া, ভেরেণ্ডির শফিক ও শাহারুল, পাইকপাড়া গ্রামের শহিদুল, দুর্গাপুরের রাজিয়া, বৈরাগিরহাটের তোফাজ্জল, ভূসা গ্রামের মানিক, আঁকলাপাড়া গ্রামের আনোয়ার, টাকাহুত গ্রামের সেলিনা, উলিপুর গ্রামের আজাদুল ইসলাম ও ছারভানু; কুসুমসাড়ার মোস্তফা, জয়পুর বহুঁতি গ্রামের গোলাম হোসেনের মেয়ে শাবানা ও খাদিজা, ফুলপুকুরিয়া গ্রামের মুসা, সুড়াইল গ্রামের সাইফুল ও কালাই পৌরসভার থুপসাড়া মহল্লার বিপ্লব হোসেন ফকির। এ ছাড়া কিডনি বিক্রি উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশ রয়েছেন বিনইল পশ্চিম গুচ্ছগ্রামের মরিয়ম, মেরিনা, শেফালি, ইঁটাতলা গ্রামের মোজাহারের স্ত্রী, বোড়াই গ্রামের তানজিমা, দুর্গাপুর গ্রামের আনোয়ার, সুজাউল, শাহেনা, সেলিনা ও শাওনী, জয়পুর বহুঁতি গ্রামের জাহেদা বেগম ও বায়েজিদ; পাইকপাড়ার ছাইদুরসহ অনেকে। অন্যদিকে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের যকৃৎ বিক্রিকারী মেহেদুলের বুকের কাটা অংশ এখনও জ্বালা-পোড়া করে বলে তিনি জানান।
কিডনি বিক্রেতা বিনইল পশ্চিম গুচ্ছগ্রামের জবুনা বেগম জানান, অভাবের কারণে স্বামী ও তিন সন্তাকে নিয়ে অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটতো তাদের। এ জন্য দাদন ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন ‘এনজিও’তে অনেক টাকা ঋণ হয়। দাদন ব্যবসায়ীর সুদের টাকা ও ‘এনজিও’র কিস্তির টাকা যোগাড় করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। নিরুপায় হয়ে একদিন তার স্বামী ঢাকার উদ্দেশে পাড়ি জমান। স্বামীর খোঁজে ঢাকায় মিরপুরের একটি বাসায় ঝিয়ের কাজ করতে যান জবুনা। এ সময় পার্শ্ববর্তী বাসার ভাড়াটিয়া সেলিমের ঝিয়ের সঙ্গে যবুনার পরিচয় হয়। সে জবুনাকে তার মালিক সেলিমের কিডনি নষ্টের কথা বলে। সে আরও বলে, কেউ কিডনি বিক্রি করলে তার মালিক মোটা দামে তা কিনে নেবে। দেনা শোধের এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জবুনা তার কিডনি ভারতের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-দেবী শেঠি হাসপাতালে গিয়ে প্রতিস্থাপন করেন।
নয়াপাড়া গ্রামের ভুট্টুর ছেলে তাজুলের মাধ্যমে ভারতের মেডিকা হাসপাতালে গিয়ে ৪ লাখ টাকার চুক্তিতে কিডনি বিক্রেতা পাইকপাড়া গ্রামের শহিদুল জানান, দালাল তাজুলের মাধ্যমে ঋণের দায়ে ৪ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করলেও তিনি পেয়েছেন মাত্র দেড় লাখ টাকা। বাকি আড়াই লাখ টাকা গেছে দালালের পেটে।
কিডনি বিক্রেতা সিমরাইল গ্রামের আবদুর রহিম জানান, মোসলেমগঞ্জ বাজারের কয়েকজন দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেয়া ছিল ৪০ হাজার টাকা, ৩টি এনজিও’ থেকে ঋণ নেয়াছিল ৬০ হাজার টাকা। তাই হফ্কা ঋণ ও এনজিও’র কিস্তির চাপে পড়ে তিনি ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাতেন। বাড়িতে স্ত্রীসহ ৩ কন্যা ছিল। ঢাকায় একজনের সঙ্গে পরিচয় হলে ৩ লাখ টাকার চুক্তিতে ভারতের দেবীশেটি হাসপাতালে গিয়ে রহিম তার কিডনি বিক্রি করে ৪ মাস পরে বাড়ি ফিরেন।
আড়াই বছর আগে কিডনি বিক্রি করেছেন এমন একজন হলেন উপজেলার উতরাইল গ্রামের মিজান। তিনি জানান, বছর দুই আগে বৈরাগীর হাট মোরে ডিসি, এসপি, সিভিল সার্জনসহ ঢাকার বড় চিকিৎসকরা মিটিং করে চিকিৎসাসেবাসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দেন। শারীরিক সমস্যা হলে জয়পুরহাট জেলা সদর হাসপাতালে বিনা খরচে চিকিৎসা করার কথা জানান। কিডনি দেয়াতে মাঝেমধ্যে শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়ে জয়পুরহাট জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা চিকিৎসার পরিবর্তে তার সঙ্গে বিদ্রূপ করেন।
No comments