দুরবস্থায় পাঁচ রাষ্ট্রীয় ব্যাংক by শওকত হোসেন ও মনজুর আহমেদ
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো চালাতে
হিমশিম খাচ্ছে সরকার। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়েছে, খেলাপি ঋণের
পরিমাণ উদ্বেগজনক পর্যায়ে, অবলোপন করে দেওয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ ঋণ। আর
রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা।
ব্যাংকগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে গত ছয় বছরে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকে বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা অর্থ আত্মসাতের জন্য বেছে নিয়েছেন জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে। আর বেসিক ব্যাংক তো পুরো সময়জুড়েই ছিল কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত। বিশ্বব্যাংক ২০১৩ সালের শেষে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে ব্যাংক খাত খারাপ হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে।
গত ছয় বছরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংকের মধ্যে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৮৫ শতাংশ, সোনালীর ৬৫ শতাংশ, অগ্রণীর ৪০ শতাংশ এবং রূপালীর খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ শতাংশ। সব মিলিয়ে এখন এই চার ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে এই চার ব্যাংক প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করে রেখেছে। আর গত প্রায় ছয় বছরে এই চারটি ও বেসিক ব্যাংকে ঋণের নামে আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।
সরকারি ব্যাংকগুলোতে এখন নতুন ঋণও যেভাবে খেলাপি হচ্ছে, তা-ও উদ্বেগজনক বলেই মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি ব্যাংকের ওপর করা একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, কেবল ২০১৩ সালেই সোনালী ব্যাংকের নতুন খেলাপির পরিমাণ চার হাজার ২৬৬ কোটি টাকা, জনতায় তিন হাজার ৩৯২ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে দুই হাজার ৬৯২ কোটি এবং রূপালী ব্যাংকে নতুন খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৪৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এই চার ব্যাংকে মাত্র এক বছরেই নতুন করে খেলাপি ঋণ তৈরি হয়েছে ১০ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা।
মূলত শুরু থেকেই ব্যাংকগুলোকে সরকার চালিয়েছে দলীয় স্বার্থে ও রাজনৈতিক বিবেচনায়। দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। একদিকে সরকারের নিয়োগ দেওয়া পর্ষদ, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ—সব মিলিয়ে দেশের সবচেয়ে খারাপ ব্যাংকে পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাঁচটি ব্যাংক। অসৎ ব্যবসায়ীরাও অর্থ আত্মসাতের জন্য বেছে নিয়েছেন সরকারি ব্যাংকগুলোকেই।
অথচ ছয় বছর আগেও দেশের অন্যতম সেরা ভালো ব্যাংক ছিল বেসিক। সরকারও যে ভালোভাবে ব্যাংক চালাতে পারে, তার উদাহরণ ছিল বেসিক ব্যাংক। এই ব্যাংকটিকেও ধ্বংস করে দিয়েছে এর মালিকই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ বিষয়ে নিজের মতামত দিয়ে বলেন, ‘যেহেতু সরকার ব্যাংকগুলোকে সামলাতে পারছে না, রক্তক্ষরণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, তাই আমি মনে করি যে সোনালীকে হাতে রেখে অন্য ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে।’
জিয়া ও এরশাদের আমলে ঋণের নামে অর্থ লুটপাটের কারণে সরকার নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে পাঁচ হাজার কোটি টাকা মূলধন দিতে বাধ্য হয়েছিল। সে সময় এই অর্থ দেওয়া হয়েছিল বন্ড আকারে। সেই মূলধন সরবরাহের ধারায় আবার ফিরে এসেছে সরকার। সম্প্রতি ব্যাংক চারটিকে মূলধন হিসেবে নগদ চার হাজার ১০০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে এ অর্থ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষের আমানত নষ্ট করার পর আবার সেই সাধারণ মানুষের করের টাকাই দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে।
যোগাযোগ করা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে এই ব্যাংকগুলোকে মূলধন জোগান দিয়ে আসছে সরকার। কিন্তু এর যেন কোনো শেষ নেই। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেব এত দিনে এসে বলছেন যে ব্যাংকগুলোর পর্ষদে কোনো রাজনৈতিক নিয়োগ হবে না। কিন্তু তিনি মাঝখানে কীভাবে সেই নিয়োগ দিয়েছিলেন? বিশ্বের কোনো দেশেই এ ধরনের নিয়োগ কোনো ইতিবাচক ফল দেয়নি। তাহলে তিনি কোন যুক্তিতে কী পরীক্ষা করতে গেলেন?’ আকবর আলি খান দীর্ঘদিন অর্থসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর সমস্যা হচ্ছে শাসনকাঠামোতে। সেখানেই ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি পরিষ্কারভাবে ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে সরকারকে পরামর্শ দেন।
১০ বছর আগে অন্তত তিনটি ব্যাংক বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ জন্য ৩৯ কোটি ডলার ব্যয়ে একটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হয়, যা বর্তমান টাকার হিসাবে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। এর আওতায় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি হিসেবে গঠন করা হয়। কিন্তু এরপর আর কিছু হয়নি।
বিশ্বব্যাংক ও যুক্তরাজ্য সরকারের সাহায্য সংস্থা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ বা ডিএফআইডির অর্থায়নে ‘শিল্প প্রবৃদ্ধি ও ব্যাংক আধুনিকীকরণ’ নামের প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালের জুনে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মূলত তিনটি পন্থায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। দাতাদের পরামর্শ ছিল, সরকারের মালিকানায় কোনো ব্যাংক রাখারই প্রয়োজন নেই। তবে সরকারের ট্রেজারি ব্যাংক হিসেবে কাজ করে বলে সোনালী ব্যাংক সরকারের মালিকানায়ই থাকবে। রূপালী ব্যাংক বেসরকারীকরণ হবে সবার আগে। পাশাপাশি জনতা ও অগ্রণী ব্যাংককে তৈরি করা হবে বেসরকারীকরণের উপযুক্ত হিসেবে। তার পরই এই ব্যাংক দুটিকে বেসরকারি হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে।
এ জন্য তিন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যেমন, সোনালী ও জনতায় নিয়োগ দেওয়া হয় একদল পরামর্শক, অগ্রণী ব্যাংকে বসানো হয় নতুন ব্যবস্থাপনা টিম এবং রূপালী ব্যাংক বিক্রি করে দেওয়ার জন্য দায়-দেনার হিসাব প্রস্তুত করতে নিয়োগ করা হয় একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এ জন্য তিন ব্যাংক থেকে কেবল পরামর্শকেরাই নিয়ে যান ১৩০ কোটি টাকা।
এত অর্থ খরচ করার পরও প্রকল্পের কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়িত হয়নি। সরকার বদল হওয়ায় সিদ্ধান্তগুলোও বদলে যায়। বেসরকারি হাতে ছেড়ে না দিয়ে সরকার নতুন করে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে। দলীয় কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলো দেখভাল করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে গঠন করা হয় একসময়ে বাতিল করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এর পরই ব্যাংকগুলোর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। যে খারাপ পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল, ব্যাংকগুলো এখন সেই পরিস্থিতিতেই ফিরে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ’৯০ সালের দিকে এই ব্যাংকগুলোর চেহারা সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তখন বিশ্বব্যাংক ঢাকায় এসে ব্যাংকগুলোতে বসে ব্যাপক সংস্কারের তদারক করে। সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ আমলে এই ব্যাংকগুলোতে ভীতিকর, ভয়ংকর পরিস্থিতি হয়েছিল। এখন সেদিকেই যাচ্ছে মনে হয়। এর কারণ সরকার ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে সঠিক লোক নিয়োগ দিতে পারেনি।
ব্যাংক খাতের এই বিশেষজ্ঞ ভারতের সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেন। ঘুষ নিয়ে গ্রাহককে সীমার বেশি ঋণ দিয়েছিল ভারতের সিন্ডিকেট ব্যাংক। এই অভিযোগে গত আগস্ট মাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই সিন্ডিকেট ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সুধীর কুমার জৈন, তাঁর শ্যালকসহ সন্দেহভাজন অন্তত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে ভারতের পুলিশি তদন্ত সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)। অভিযোগ হলো, সুধীর কুমার মনমোহন সিংয়ের আমলে ৫০ লাখ রুপি (বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৬৩ লাখ ৬৪ হাজার) ঘুষ নিয়ে দুটি কোম্পানিকে ঋণসীমার চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছিলেন।
অথচ দেশে বেসিক ব্যাংকে সব ধরনের নিয়মনীতি ভঙ্গ করে অন্তত সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে শুধু দুই বছরের জন্য অপসারণ করেছে আর অর্থ মন্ত্রণালয় কেলেঙ্কারির মূল ব্যক্তি বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুকে ‘সম্মানজনক’ বিদায় দিয়েছে।
৪ ব্যাংকের মোট খেলাপি ১৯ হাজার কোটি টাকা
৬ বছরে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার
জনতা ব্যাংক ৮৫%
সোনালী ব্যাংক ৬৫%
অগ্রণী ব্যাংক ৪০%
রূপালী ব্যাংক ১৭%
সরকারের বিশেষায়িত বেসিক ব্যাংকে ঋণের নামে আত্মসাৎ ৪৫০০ কোটি টাকা
No comments