মিঠামইন থেকে বঙ্গভবনের রোডম্যাপ by কাজী সোহাগ
কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল মিঠামইন থেকে
বঙ্গভবনের রোডম্যাপ লিখছেন প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ এডভোকেট। দিনের বেশির
ভাগ সময় এখন তিনি ব্যয় করছেন বইয়ের পেছনে। নিজের জীবদ্দশায় বই লেখার কাজ
শেষ করতে চান তিনি। বইয়ের উল্লেখযোগ্য অংশে থাকছে ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকার
হিসেবে নিজের ভূমিকা। বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাও
তুলে ধরা হচ্ছে বইয়ে। এছাড়া, ছাত্র জীবনের রাজনীতির আদ্যোপান্ত স্থান
পাচ্ছে আত্মজীবনীতে। বইয়ের শেষ দিকে থাকছে বঙ্গভবনের অভিজ্ঞতা।
প্রেসিডেন্টের আত্মজীবনী লেখার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য
জানা যায়। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট সংসদ সচিবালয় থেকে ৭ম, ৮ম ও ৯ম সংসদে তার
ভূমিকার বিস্তারিত সংগ্রহ করেছেন। ১৩ই আগস্ট এ নিয়ে বঙ্গভবন থেকে চিঠি
পাঠানো হয় সংসদ সচিবালয়ে। বঙ্গভবনের সিনিয়র সহকারী সচিব শওকত আলী
স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ৭ম, ৮ম ও নবম সংসদে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও
বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত বক্তব্য ও রুলিংয়ের হার্ড
কপি ও সফট কপি রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ে রেকর্ড, রেফারেন্স সংরক্ষণ করা
প্রয়োজন। সংসদ সচিব চিঠিটি গ্রহণ করেন ১৪ই আগস্ট। ২০ দিন পর সংসদ সচিবালয়
প্রেসিডেন্টের চাহিদামতো বক্তব্য ও রুলিংয়ের লিখিত কপি বঙ্গভবনে পাঠায়। তবে
৭ম সংসদের কোন কপি পাঠাতে পারেনি সচিবালয়। তাই প্রেসিডেন্টকে সরবরাহ করা
৩২১ পৃষ্ঠার ওই কপির সঙ্গে একটি চিঠিও সংযুক্তি করা হয়। সংসদ সচিবালয় থেকে
পাঠানো চিঠিতে এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, ৮ম জাতীয় সংসদের ৪র্থ অধিবেশন
(২০০২) থেকে সংসদ বিতর্ক সম্পাদনা কাজে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করা
হচ্ছে। তখন থেকে কার্যাবাহের রিপোর্ট-এর সফট কপি সংরক্ষিত আছে। কিন্তু ৭ম
জাতীয় সংসদের বিতর্কগুলো ছিলো হাতে সম্পাদিত (১৯৯৬ থেকে ২০০১)। সেগুলো বই
আকারে মুদ্রণ করে ইতিমধ্যে ৭ম জাতীয় সংসদের এমপিদের মধ্যে ও লাইব্রেরিতে
রেফারেন্স হিসেবে রাখার জন্য চামড়া দ্বারা বাঁধাই করে সরবরাহ করা হয়েছে।
বর্তমানে সরবরাহ করার মতো কোন অতিরিক্ত কপি না থাকায় সরবরাহ করা সম্ভব হলো
না। নিজের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি অলিগলি আত্মজীবনীতে তুলে ধরতে
চান প্রেসিডেন্ট। এর বড় একটি অংশ তিনি কাটিয়েছেন সংসদে। নিয়েছেন
গুরুত্বপূর্ণ নানা সিদ্ধান্ত। আবার অধিবেশন কক্ষে হাস্যরস তৈরি করে অনেকের
প্রিয়ভাজন হয়েছেন তিনি। আত্মজীবনীতে হিউমার ছড়ানো এসব বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত
করা হচ্ছে। আড্ডাবাজ হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে গিয়েও
পরিবর্তন হননি। তবে শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছেন মাত্র। ২০১৩ সালের ৫ই আগস্ট
বঙ্গভবনে সংসদ সচিবালয় বিটে কর্মরত কয়েক সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানান তিনি।
ওই তালিকায় প্রতিবেদকও ছিল। ওই দিন তিনি প্রথমবারের মতো আত্মজীবনী লেখার
কথা বলেন। ওই দিন আড্ডা দেন খোলামেলা। বলেন নানা কথা। নিজেকে এখন বন্দি মনে
করছেন প্রেসিডেন্ট। যুক্তি তুলে ধরে বলেন, কেন মনে হবে না। আমি ছিলাম
বরাবরই আড্ডাপ্রিয় একজন মানুষ। এখন আর আগের মতো আড্ডা দিতে পারি না। কথা
বলতে পারি না। সংসদে কাটিয়েছি জীবনের বড় একটি অংশ। সেই সংসদ আমাকে টানে।
কিন্তু মন বললেই সেখানে ছুটে যেতে পারি না। রসিকতা করে বললেন, ইচ্ছা করলে
যেতে পারি মাত্র ১২ মিনিটে। কিন্তু যাই না। কারণ, রাজধানীর ট্রাফিক।
এমনিতেই যানজট নিয়ে মানুষের ত্রাহি অবস্থা। এর ওপর আমি যদি সংসদে যেতে চাই
তাহলে এক ঘণ্টা আগে থেকেই রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হবে। এতে জনসাধারণ আমার ওপর
ক্ষেপবে। জ্যামে আটকে থেকে আমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করবে। তিনি বলেন, মূলত
সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা চিন্তা করে বেশি মুভ করতে পারি না। ইচ্ছা তো
অনেক কিছুই হয়। কিন্তু সব পারি না। আমার মেয়ের বাসা লালমাটিয়ায়। সে একদিন
বললো, বাবা তুমি তো আমার বাসায় একদিনও এলে না। আমি বললাম, তোমার বাসায় আমি
আসতে পারি। তবে এতে অনেক মানুষের গালি শুনে আসতে হবে। এটা কি ঠিক হবে? তার
চেয়ে বরং তুমিই মাঝে মাঝে আমাকে এসে দেখে যেও। রসিকতা করে প্রেসিডেন্ট
বললেন, আগে কয়েকবার জেল খেটেছি। তখন আমার চারপাশে থাকতো পুলিশ। তারা আমার
কোমরে দড়ি বাঁধতে চেয়েছিল। আমি উকিল মানুষ। কিছু বিষয় জানতাম। কোমরে দড়ি
বাঁধলে পুলিশের সুবিধা হতো। ষড়যন্ত্র করার সুযোগ পেতো। যেমন, কিছু
উত্তম-মধ্যম দিয়ে বলতে পারতো পুলিশের ওপর আক্রমণ করার চেষ্টা করায় এ অবস্থা
হয়েছে। তাই আমি তাদের অনুরোধ করতাম কোমরে দড়ি না বেঁধে হাতে বাঁধো। তারা
তাই করতো। হাত বাঁধা থাকলে তো আর পুলিশ বলতে পারবে না আক্রমণ করতে যাচ্ছিল।
যা-ই হোক, তখন পুলিশ হাত বেঁধে রাখতো দড়ি দিয়ে। আর এখন দড়ি লাগে না।
এমনিতেই বাঁধা হয়ে আছি। উল্টো বাড়তি পাওনা হিসেবে কিছু স্যালুট পাই। রসিকতা
করে তিনি বললেন, আগে জেলখানায় যখন ছিলাম তখন সন্ধ্যার পর জেলখানার বাইরে
কারারক্ষীরা তালা দিয়ে রাখতো। এখন আর তালা লাগে না। মনে হয় অটো তালার মধ্যে
রয়েছি। ইচ্ছামতো চলাচল করতে পারি না। একটি নির্দিষ্ট জায়গার পর যেতে চাইলে
ইনফর্ম করা লাগে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে হয়। প্রেসিডেন্ট হওয়ার
পর নিজেকে বোবা বলে মনে করেন আবদুল হামিদ এডভোকেট। তিনি বলেন, বোবার কোন
শত্রু নেই। কোন বিষয়ে আমি কথা বলতে পারি না। সংসদে অনেক কথা বলেছি। দেশের
এই অভিভাবক কিন্তু এখনও জনবিচ্ছিন্ন নন। তার নির্বাচনী এলাকা কিশোরগঞ্জের
মানুষ শত নিরাপত্তার মাঝেও বঙ্গভবনে এসে ভিড় করেন। তার সঙ্গে কথা বলতে,
দেখা করতে বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রেসিডেন্টের পরিবারও চায় তিনি
সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলুন। তাদের সঙ্গে আড্ডা দেন। তা না হলে
মানসিকভাবে হয়তো কিছুটা ভেঙে পড়তে পারেন। প্রেসিডেন্টের ভাই আবদুল হাই
জানান, এলাকার মানুষ নাছোড়বান্দা। তারা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসে বলে
আমাদের হামিদ ভাইকে দেখবো। তার সঙ্গে কথা বলবো। নিরাপত্তার কথা তারা মানতে
চান না। তাদের দাবি একটাই, আমাদের হামিদ মিয়াকে কেউ দূরে রাখতে পারবে না।
তাই দুপুরের পর থেকেই এলাকার সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করেন বঙ্গভবনের গেটে।
তারা জানেন ডাক একসময় পড়বেই। হয়ও তাই।
No comments