বিচারকদের ওপর চাপ বাড়বে -বিশেষ সাক্ষাৎকারে খন্দকার মাহবুব হোসেন by সোহরাব হাসান
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা
সংসদের হাতে ন্যস্ত করা-সংবলিত একটি সংবিধান সংশোধন বিলের খসড়া সম্প্রতি
মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এ নিয়ে বিচার ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক
চলছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেনের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো:
প্রথম আলো : ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদের হাতেই উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা ছিল। তখন আপনারা সেটি মেনে নিয়েছিলেন। এখন বিরোধিতা কেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : ১৯৭২ সালের সংবিধানে কেবল উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা ছিল না; নিম্ন আদালতের নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতির বিষয়টিও সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের সব ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ব্যক্তি, তথা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। এরপর জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল করেন। এতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের দুজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতির সমন্বয়ে এই কাউন্সিল গঠিত হবে এবং কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ বা অক্ষমতার অভিযোগ এলে তদন্তপূর্বক রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবেন।
প্রথম আলো :পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ছাড়া তো কোথাও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নেই। আপনারা কীভাবে সেটি মেনে নিলেন?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : নেই সত্য। কিন্তু আমরা এ ব্যবস্থায় খুশি ছিলাম এ কারণে যে ব্যক্তির হাত থেকে বিষয়টি অন্তত বিচারকদের কাছে চলে এল। এটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা বলেই মনে করি। তা ছাড়া, সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার কথা রয়েছে। এখন বিচারপতিদের অপসারণের বিষয়টি সংসদের হাতে দিলে সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হবে।
প্রথম আলো : সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল হয়েছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায়। বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থায় তো প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোনো বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। বাকি সবকিছুই তাঁকে করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ বা ইচ্ছা অনুযায়ী।
খন্দকার মাহবুব হোসেন : সংসদেও তো প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই প্রতিফলিত হবে। আমাদের সংবিধানের ৭০ ধারাবলে যেভাবে সাংসদদের হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তো সেটি নেই। অন্যান্য দেশে সাংসদেরা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন। কিন্তু আমাদের এখানে সংসদীয় দলের নেতা যা বলবেন, সেটাই তাঁদের মেনে চলতে হয়।
প্রথম আলো : তাহলে কি বলতে চান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদই গণতন্ত্রের প্রধান বাধা?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : এটি শুধু বাধা নয়, গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকিও। যত দিন ৭০ অনুচ্ছেদ থাকবে, তত দিন এটি গণতান্ত্রিক সংসদ হতে পারে না। সরকারি দলের নেতারা কথায় কথায় অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ইত্যাদি গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ টানেন। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করেন না।
প্রথম আলো :বাংলাদেশের সংবিধানে এ পর্যন্ত যতগুলো সংশোধনী হয়েছে, প্রায় সব কটিই কি ব্যক্তিস্বার্থে হয়নি?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : হয়েছে। এ কারণেই সরকার বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, আমরা তার বিরোধিতা করছি। আমাদের আশঙ্কা, সরকার বিচার বিভাগকে রাজনৈতিক চাপে রাখার জন্যই এই সংশোধনী করতে যাচ্ছে। সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে বিচার বিভাগ আরও দুর্বল হবে। আগে বিচারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হোক। এরপর অন্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোও শক্তিশালী হবে।
প্রথম আলো :আপনি বিচার বিভাগ শক্তিশালী করার কথা বলছেন। কিন্তু উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে তার প্রতিফলন আছে কি?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : এখন যে পদ্ধতিতে বিচারক নিয়োগ হয়, সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা বলছি, বিচারক নিয়োগের নীতিমালা করুন। সরকার সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না; বরং মীমাংসিত বিষয় নিয়ে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করছে।
প্রথম আলো :সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কি মীমাংসিত বিষয়?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : মীমাংসিত বিষয় এ কারণে যে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক যখন পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন, তখনো কিন্তু তিনি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে হাত দেননি। অর্থাৎ তিনি বিচারক ও আইনজীবীদের অনুভূতিকে সম্মান জানিয়েছিলেন। আর এর সঙ্গে কেবল বিচারক বা আইনজীবীদের মর্যাদা নয়, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নও জড়িত।
প্রথম আলো :আপনাদের আপত্তির মূল জায়গাটি কী?
খন্দকার মাহবুব হোসেন : সংসদের হাতে বিচারকদের অভিশংসনের দায়িত্ব দেওয়া হলে তাঁরা রাজনৈতিক চাপে থাকবেন। স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না। আইনটি কেমন হবে, সে সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু স্পষ্ট করা হয়নি। ভারতে বিচারকদের অভিশংসনের যে বিধান আছে, তাতে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে হলে পার্লামেন্টের নিম্ন ও উচ্চকক্ষের যথাক্রমে ৫০+৫০ জন সাংসদের লিখিত সুপারিশের প্রয়োজন হয়। কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে নির্দলীয় সংস্থা দ্বারা তদন্ত করতে হবে। সেই নির্দলীয় সংস্থা হতে পারে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বার কাউন্সিলের প্রতিনিধিদের নিয়ে। প্রাথমিক তদন্তের পর তাঁদের সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় ঠিক করতে হবে।
প্রথম আলো : সরকার ও বিরোধী দলের সমর্থক আইনজীবীরা এক সুরে কথা বলছেন? এতে কি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে পেশাগত স্বার্থ বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে না?
খন্দকার মাহবুব হোসেন :বরং আমরা বলব বিচার-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে এককাট্টা। এখানে যেটি অগ্রাধিকার পাচ্ছে, সেটি হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা। মাসদার হোসেন মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের অধ্যাদেশ জারি হয়। পরে এটি আইনেও পরিণত হয়। সেই আইনানুযায়ী নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির বিষয়টি দেখার কথা সুপ্রিম কোর্টের। কিন্তু এখনো সেটি কার্যত আইন মন্ত্রণালয়, তথা নির্বাহী বিভাগের হাতে রয়েছে। আইনে সুপ্রিম কোর্টকে ক্ষমতা দেওয়া হলেও তার প্রয়োজনীয় লোকবল ও সচিবালয় দেওয়া হয়নি। ফলে প্রধান বিচারপতি বা তাঁর অফিসের পক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশগুলো যাচাই-বাছাই করাও সম্ভব হয় না। নিম্ন আদালতের পদায়ন, পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েই গেছে।
প্রথম আলো : আপনাদের আপত্তিটা কোথায়? বর্তমান সংসদ, না নীতিমালা না হওয়া?
খন্দকার মাহবুব হোসেন :দুটোই। বর্তমান সংসদ তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমরা যদি জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সংসদও পাই, সেখানেও ৭০ অনুচ্ছেদ বড় বাধা হয়ে আছে। কিন্তু বর্তমান অনির্বাচিত ও একদলীয় সংসদের হাতে এই ক্ষমতা ন্যস্ত হলে বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধসে পড়বে। বিচারকেরা ভয়ভীতি ও চাপের মধ্যে থাকবেন।
প্রথম আলো :আপনি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিকাশের মাধ্যমে গণতন্ত্র টেকসই করার কথা বলছেন। সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ কতটা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে?
খন্দকার মাহবুব হোসেন :এ কথা সত্য যে অতীতে বিচারকেরা গণতন্ত্র রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেননি। কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন, সেই লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে।
প্রথম আলো :আপনাকে ধন্যবাদ।
খন্দকার মাহবুব হোসেন : ধন্যবাদ।
No comments