‘ডাল’ কাটা সাংবাদিকদের কাজ নয় by মশিউল আলম
গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে
আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর সরকার
গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে।
তাঁর এই দাবির তাৎপর্য কী? কেন ও কী প্রয়োজনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে এমন কথা বলতে হচ্ছে? পৃথিবীর যেসব দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, সেসব দেশের সরকারপ্রধানদের কিন্তু এমন কথা বলতে শোনা যায় না যে সরকার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। কারণ, প্রকাশ্যে এ রকম দাবি করার প্রয়োজন তাঁদের হয় না। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এটা দাবি করার কী প্রয়োজন দেখা দিয়েছে? কেন তাঁকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি তাঁর সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করতে হচ্ছে?
প্রধানমন্ত্রী সেদিন ওই কথাগুলো বলেছেন সাংবাদিকদের উদ্দেশে। তার মানে কি এই যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি সরকারের অঙ্গীকার নিয়ে এ দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে সংশয় আছে বলে প্রধানমন্ত্রীর মনে হচ্ছে? তিনি কি মনে করছেন, তাঁর সরকার যে সংবাদমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, এটা সাংবাদিকেরা বিশ্বাস করেন না?
তা যদি হয়, অর্থাৎ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি সত্যিই অনুভব করেন যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার নিয়ে সাংবাদিকদের মনে সংশয় আছে, তাহলে এটা একটা আশাব্যঞ্জক ব্যাপার। এর মানে হলো, সরকারের অঙ্গীকার নিয়ে সাংবাদিক সমাজের সংশয় ও নিজেদের কাজের স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে উদ্বেগ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এবং এটাও বেশ উৎসাহব্যঞ্জক যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের সেই সংশয় ও উদ্বেগ দূর করতে চাইছেন, তাঁদের আশ্বস্ত করতে চাইছেন যে এই সরকার সংবাদমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে।
কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব? কীভাবে সাংবাদিকদের মনে এমন আস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব যে এই সরকার সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় আন্তরিকভাবে অঙ্গীকারদ্ধ? শুধু মুখের কথায়?
দেখুন, বাংলাদেশে সব সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ও নেতাদের বলতে শোনা যায় যে সরকার সংবাদমাধ্যমের পরিপূর্ণ স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, সেই স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকার দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও এমন কথা অনেকবার বলতে শোনা গেছে। এমনকি, তাঁকে এমন কথাও বলতে শোনা গেছে যে তাঁর সরকার সংবাদমাধ্যমকে যত স্বাধীনতা দিয়েছে, ততটা তাঁর আগের কোনো সরকারই দেয়নি। কথায় কথায় তাঁরা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে বলতেন, আওয়ামী লীগ বাকশাল কায়েম করে মাত্র চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে সংবাদমাধ্যমের যে স্বাধীনতা হরণ করেছিল, বিএনপি সরকার সেই স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছে। এই ‘কৃতিত্ব’ তাঁরা সব সময়ই নিতে চান।
যে কথা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলতেন, সেই একই কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলছেন। কিন্তু তাঁদের এই কথার ওপর সাংবাদিক সমাজের আস্থা নেই বললেই চলে। আস্থা ফেরানোর কাজে এ ধরনের প্রীতিকর কথা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, যদি সরকারের কাজে উল্টো লক্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর সংসদের প্রথম অধিবেশনেই তথ্য অধিকার আইন পাস করে প্রশংসিত হয়েছিল। শেখ হাসিনা এখনো এই দেশের প্রধানমন্ত্রী, তাঁরই আমলে গত বছর যে তথ্যপ্রযুক্তি আইন প্রণয়ন ও গ্রহণ করা হয়েছে, তা এক ভয়ংকর কালাকানুন। এই আইন অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর এক মারাত্মক খড়্গ হিসেবে ঝুলে রয়েছে। অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি, ছবি, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকার নিজের ইচ্ছেমতো এই আইনের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে এবং বিচারে ওই ব্যক্তি দণ্ডিত হলে তাঁর ন্যূনতম সাত বছর ও সর্বোচ্চ ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও বিপুল অঙ্কের অর্থদণ্ড হতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে
যখন তথ্য, সংবাদ ও মতামত প্রকাশের বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে, সেই যুগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের নামে এক ভয়ংকর কালাকানুন তৈরি করা কি গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকারের প্রকাশ?
তারপর এই সরকারের আমলেই জেলা প্রশাসকদের সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করার ক্ষমতা দিয়ে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্ট সংশোধন করার তোড়জোড় শুরু হলো! গণমাধ্যমের ‘পূর্ণ স্বাধীনতায়’ বিশ্বাসী কোনো সরকারের আমলে যে এ ধরনের প্রস্তাব আদৌ উঠতে পারে, তা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। আওয়াজ শোনা গেল যে সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করার ক্ষমতার দাবিটি তুলেছেন জেলা প্রশাসকেরা; বলা হলো, তথ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কিছুই জানে না। কিন্তু জেলা প্রশাসকেরা এমন পশ্চাদ্মুখী ও স্বৈরতান্ত্রিক আইনি হাতিয়ার সৃষ্টির দাবি তোলার সাহস কী করে পান? সংবাদপত্রশিল্প স্বৈরতান্ত্রিক কালাকানুনের যুগ তো ফেলে এসেছে সেই নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই।
এত বছর পর এ দেশের সংবাদপত্রশিল্পকে আবার সেই পেছনের যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার দুর্বুদ্ধি জেলা প্রশাসকদের মাথায় কে ঢোকাল? স্বস্তির বিষয় যে ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্ট সংশোধনের সেই জোড়জোড় থেমেছে। কিন্তু এ রকম একটা ভাবনা যে সরকারের ভেতরে দেখা দিয়েছিল, সেটা তো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের লক্ষণ নয়, বরং তার উল্টো।
কিছুদিন ধরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বুধবারের ওই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘অল্পসংখ্যক মানুষ ছাড়া বেশির ভাগই এই নীতিমালা পছন্দ করেছে।’ এর অর্থ, সম্প্রচার নীতিমালার অগ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি সরকারপ্রধানসহ সরকারের নেতারা স্রেফ নাকচ করে দিচ্ছেন। বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজ যে এটা গ্রহণ করেনি, এ রকম নিবর্তনমূলক নীতিমালা যে শুধু সাংবাদিক সমাজ নয়, জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না—সরকার হয় এটা উপলব্ধি করতে পারছে না, নয় জেনেশুনে অস্বীকার করতে চাইছে।
এই সম্প্রচার নীতিমালা কত উপায়ে বেসরকারি বেতার-টিভির স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে, কীভাবে এটা বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোকে বিটিভির মতো অকার্যকর ও অজনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমে পরিণত করতে পারে, এই নীতিমালা বাংলাদেশের নবীন টিভি সাংবাদিকতার বিকাশ কী মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে—এসবসহ এই নীতিমালার আরও অনেক উদ্বেগজনক দিক নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। এই লেখার পরিসরে সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ নেই। এই সম্প্রচার নীতিমালা সম্পর্কে সংক্ষেপে এটুকু বলতে হয় যে এটি সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার হাতিয়ার ছাড়া কিছু নয়; সম্প্রচারমাধ্যমের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়ে একটি কথাও এই নীতিমালায় নেই, নেই এই শিল্পে বিনিয়োগকারীদের অর্থলগ্নিকে সুরক্ষা দান প্রসঙ্গে কোনো কথা। এই নীতিমালায় রয়েছে শুধু সম্প্রচারমাধ্যমকে সর্বপ্রকারে নিয়ন্ত্রণ করার বিধিবিধান। এর ভিত্তিতে যদি একটি সম্প্রচার আইন প্রণয়ন করা হয়, তবে সেটি হবে ভয়ংকর এক কালাকানুন, যা এ দেশের সম্প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে খর্ব করবে, এই শিল্পের বিকাশ ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।
লক্ষ করা দরকার, এই সরকার তথ্যপ্রযুক্তি আইন নামের এক ভয়ংকর কালাকানুন তৈরি করেছে, এই সরকারের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকদের সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল করার ক্ষমতা দিয়ে আইন সংশোধনের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল, যা প্রবল প্রতিবাদের মুখে আপাতত চাপা পড়ে আছে এবং এই সরকারের মন্ত্রিসভা সম্প্রতি অনুমোদন করেছে সম্প্রচার নীতিমালার নামে এক নিবর্তনমূলক দলিল, যা এ দেশের নবীন সম্প্রচারমাধ্যমের বিকাশ রুদ্ধ করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুখে যতই বলুন, তাঁর সরকার গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী, সরকারের এসব পদক্ষেপে তার বিপরীত লক্ষণই প্রকাশ পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী সেদিন আরেকটি কথা বলেছেন, ‘আমি সাংবাদিকদের অনুরোধ জানাব, যে ডালের ওপর [আপনারা] বসে আছেন, সেই ডাল কাটার চেষ্টা করবেন না।’
এই কথার মানে কী? এই ‘ডাল’ কি তাঁর সরকার?
প্রধানমন্ত্রী যদি সেটাই বোঝাতে চান, তাহলে সবিনয়ে বলতে হয়, সাংবাদিকদের কোনো ডালে বসারও প্রয়োজন নেই, কোনো ডাল কাটার চেষ্টা করাও তাঁদের কাজ নয়। তবে যেসব সাংবাদিক বসার জন্য ডাল খোঁজেন, তাঁরা সব সময়ই একটা না একটা ডাল পেয়ে যান। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের কিছু নেই।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@prothom-alo.info
No comments