মুক্তির লড়াই দীর্ঘজীবী হোক by কাজল ঘোষ
স্কটল্যান্ডের গণভোটের ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দু’টি ছবি তামাম দুনিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। একটি হাসি আর অন্যটি কান্নার। দু’টি ছবি মূর্ত হয়ে আছে পত্র-পত্রিকার পাতায় পাতায়। খুউব সঙ্গত কারণেই আমি কান্নার পক্ষে। আমার চেতনায় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা অনুভব করি। আমার জন্ম একাত্তরের পরে। এটাই বড় দুঃখ যে, মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী চর্মচক্ষে দেখার সুযোগ হয়নি। অবশ্য যারা দেখেছেন বা যারা দেশের নেতৃত্বে আছেন অথবা যারাই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তারা প্রত্যেক্যেই যেভাবে নিজেদের পক্ষে যায় এমনভাবে ইতিহাস রচনার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তাতে নিজের অবস্থান কি হতো তা নিয়ে প্রায়ই ভাবনার মধ্যে পড়ে যাই। বৃটেনের গণভোটের চিত্র প্রকাশের পরপরই এক বন্ধুর ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাস আমার চিন্তা জগতে নানা জিজ্ঞাসার উদ্রেক করলো। স্ট্যাটাসটিতে তিনি লিখেছেন, স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে ভোট পড়েছে ৪৫ শতাংশ আর বৃটেনের পক্ষে থাকতে চেয়ে ভোট দিয়েছে ৫৫ শতাংশ। তাহলে কি আমরা ধরে নেবো সেখানে ৫৫ ভাগই রাজাকার। কারণ তারা তো দেশের স্বাধীনতা চায় না। এই রায় ঘোষণার পরপরই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন স্কটিশদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন এই বলে, প্রজন্মের জন্য বিষয়টি সুরাহা হলো। অন্যদিকে স্কটিশ স্বাধীনতার পক্ষের দলনেতা স্যামন্ড ভোটের রায় শেষে বলেছেন, স্কটল্যান্ডের জন্য ক্যাম্পেইন শেষ হয়ে যায়নি। স্বাধীনতার স্বপ্নের কখনও মৃত্যু নেই। তারা তো কিন্তু রাজপথে সুবিধা আদায়ের আশায় পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে লড়াইয়ে নামেনি। অথচ আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ আর মুক্তিযুদ্ধের নামে সুবিধা আদায়ের একটা নিরঙ্কুশ লড়াই চলছে গত চার দশক ধরেই। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভুয়া মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেটে সচিব হয়ে রাষ্ট্রীয় সুবিধা নেয়ার তালিকা দেখলেই এটা টের পাওয়া যায়। তারচেয়ে দুঃখজনক অপরাধী চিহ্নিত হওয়ার প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাই যখন জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে যুক্ত হন। দেশে ফিরে দম্ভোক্তি করে নিজের ভালমানুষির সাফাই গাইতে থাকেন।
আমাদের এখানে খুব পুরনো কথা, এটা সব সম্ভবের দেশ। আসলেই তাই। এখানে রাজাকাররা গাড়িতে পতাকা ওড়াতে পারেন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী পদে বসতে পারেন। ফিরে যাই অনেক পেছনে। শ’ শ’ বছর পেছনে। যেখানে উইলিয়াম ওয়ালেস বৃটেনের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেননি। মৃত্যুমুখে পতিত হয়েও ফ্রিডম বলে চিৎকার করেছেন। ১৯৯৫ সালে মেল গিবসনের ‘ব্রেভহার্ট’ ছবিটি মুক্তি পেলে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা না পাওয়ার যন্ত্রণা বিশ্বজুড়েই হইচই ফেলে দেয়। মুক্তির পক্ষে, স্কটিশদের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা অকুতোভয় সেই সেনাকে যেভাবে বৃটিশ রাজন্যবর্গ হত্যা করেছিল তা বিশ্বব্যাপী মুক্তির পক্ষের মানুষদের প্রতিবাদে শামিল করেছে। বলা হয়ে থাকে, স্কটল্যান্ডের গণভোটের এই ব্যবস্থার পেছনে মেল গিবসনের ‘ব্রেভহার্ট’ বড় রকমের ভূমিকা পালন করেছে। ঢাকায় ছবিটি এলে তারুণ্যের ঢেউ লেগেছিল এই ছবিটি দেখতে। মধুমিতায় লাইন দিয়ে টিকিট নিতে বেগ পেতে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা দলে দলে ছবিটি দেখতে হলমুখো হয়েছিল। মনে পড়ে, মল্লিকা হলে ছবিটির শেষ দৃশ্যে যখন উইলিয়াম ওয়ালেসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছিল তখন উইলিয়ামের ‘ফ্রিডম’ চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে এক যুবক ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল।
স্কটল্যান্ডের গণভোটের পর আবারও সেই দৃশ্যগুলো দেখছিলাম কি তীব্র মুক্তি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লড়েছিল উইলিয়ামের নেতৃত্বে একদল স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষ। স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস ও ফলকার্কে তখন বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতার দাবি তীব্র হচ্ছে। কিন্তু মূল সমস্যা দেখা দেয় নেতৃত্বে সেখানে উইলিয়াম ওয়ালেস তার উদাত্ত আহ্বান নিয়ে এগিয়ে আসে মুক্তির সংগ্রামে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াই শুরু করে। ফলকার্কের ময়দানে সেই লড়াইয়ে উইলিয়াম আহ্বান রেখেছিল এই বলে-
I see a whole army of my countrymen
here in difience of tyranny.
you come to fight of free men.
and freemen you are...
for one chance... just one chance...
come back here and tell our enemies
that they may take our lives,
but you will never take our freedom!
ফলকার্কের শেষ যুদ্ধ পরাজয় বরণ করে মুক্তিপ্রেমী স্কটিশ যোদ্ধারা। বৃটিশ সেনারা আটক করে উইলিয়ামকে এবং শেষ বিচারের মুখোমুখি করে। শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত উইলিয়াম পরাজয় মেনে নেয়নি। তার ফ্রিডম ফ্রিডম বলে চিৎকার স্কটল্যান্ডের আকাশে-বাতাসে আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
স্কটল্যান্ড আইন সংশোধন করে ইংল্যান্ডের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ৩৬০ বছর পর স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোটে গেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস এই গণভোট নিয়ে লিখেছে, স্বাধীনতার পথে যাওয়ার বিতর্ক ও ভোটাভুটির পুরোটাই ছিল সভ্য, শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক আলাপ- আলোচনার মধ্যে সীমিত। আর আমাদের এখানে যে কোন বিষয়ে গালমন্দ আর রাজপথের ভাঙচুরই যেন সমাধান। স্বাধীনতার চার দশকেও আমরা একটি সঠিক তালিকা করতে পারিনি কারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ঠিক যেমনটি আমাদের এখানে কারা ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী তারও তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আর সার্টিফিকেটে যে দেশের মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারিত হয় তা কতটা দেশাত্মবোধের চেতনা থেকে যুদ্ধ অথবা স্বাধীনতা অর্জনের পর সুবিধা প্রাপ্তির আশা এটা বড় করে দেখা দেয়। বিপ্লবী চে গুয়েভারা ছিলেন জাত বিপ্লবী। কোনও সুবিধা প্রাপ্তি বা মন্ত্রিত্ব প্রাপ্তির জন্য বিপ্লব করেননি। যেখানে যে দেশে পরাধীনতা সেখানেই লড়তে ছুটে গেছেন। যেভাবে উইলিয়াম ওয়ালেস। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। দেশের প্রশ্নে, স্বাধীনতা প্রশ্নে, মানুষের মুক্তির প্রশ্নে কারও কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় যাদের পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে তাদের মানুষ ছুঁয়ে দেখে পবিত্র বলে। আর আমাদের এখানে প্রতিদিনই নতুন নতুন পদ্ধতিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ধুঁকে ধুঁকে মরছে। সুবিধাভোগীরা সব আমলেই এক রকম। পাকিস্তান আমলেও সুবিধা নিয়েছে তারা। এখনও যুক্ত আছে সুবিধা নেয়ার ধান্দায়। এ দেশে যেন ধান্দারই জয়। ধান্ধাবাজেরাই যেন সব।
২৯শে সেপ্টেম্বর
আমাদের এখানে খুব পুরনো কথা, এটা সব সম্ভবের দেশ। আসলেই তাই। এখানে রাজাকাররা গাড়িতে পতাকা ওড়াতে পারেন। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারণী পদে বসতে পারেন। ফিরে যাই অনেক পেছনে। শ’ শ’ বছর পেছনে। যেখানে উইলিয়াম ওয়ালেস বৃটেনের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেননি। মৃত্যুমুখে পতিত হয়েও ফ্রিডম বলে চিৎকার করেছেন। ১৯৯৫ সালে মেল গিবসনের ‘ব্রেভহার্ট’ ছবিটি মুক্তি পেলে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা না পাওয়ার যন্ত্রণা বিশ্বজুড়েই হইচই ফেলে দেয়। মুক্তির পক্ষে, স্কটিশদের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা অকুতোভয় সেই সেনাকে যেভাবে বৃটিশ রাজন্যবর্গ হত্যা করেছিল তা বিশ্বব্যাপী মুক্তির পক্ষের মানুষদের প্রতিবাদে শামিল করেছে। বলা হয়ে থাকে, স্কটল্যান্ডের গণভোটের এই ব্যবস্থার পেছনে মেল গিবসনের ‘ব্রেভহার্ট’ বড় রকমের ভূমিকা পালন করেছে। ঢাকায় ছবিটি এলে তারুণ্যের ঢেউ লেগেছিল এই ছবিটি দেখতে। মধুমিতায় লাইন দিয়ে টিকিট নিতে বেগ পেতে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা দলে দলে ছবিটি দেখতে হলমুখো হয়েছিল। মনে পড়ে, মল্লিকা হলে ছবিটির শেষ দৃশ্যে যখন উইলিয়াম ওয়ালেসকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছিল তখন উইলিয়ামের ‘ফ্রিডম’ চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে এক যুবক ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল।
স্কটল্যান্ডের গণভোটের পর আবারও সেই দৃশ্যগুলো দেখছিলাম কি তীব্র মুক্তি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে লড়েছিল উইলিয়ামের নেতৃত্বে একদল স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষ। স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস ও ফলকার্কে তখন বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতার দাবি তীব্র হচ্ছে। কিন্তু মূল সমস্যা দেখা দেয় নেতৃত্বে সেখানে উইলিয়াম ওয়ালেস তার উদাত্ত আহ্বান নিয়ে এগিয়ে আসে মুক্তির সংগ্রামে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে লড়াই শুরু করে। ফলকার্কের ময়দানে সেই লড়াইয়ে উইলিয়াম আহ্বান রেখেছিল এই বলে-
I see a whole army of my countrymen
here in difience of tyranny.
you come to fight of free men.
and freemen you are...
for one chance... just one chance...
come back here and tell our enemies
that they may take our lives,
but you will never take our freedom!
ফলকার্কের শেষ যুদ্ধ পরাজয় বরণ করে মুক্তিপ্রেমী স্কটিশ যোদ্ধারা। বৃটিশ সেনারা আটক করে উইলিয়ামকে এবং শেষ বিচারের মুখোমুখি করে। শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত উইলিয়াম পরাজয় মেনে নেয়নি। তার ফ্রিডম ফ্রিডম বলে চিৎকার স্কটল্যান্ডের আকাশে-বাতাসে আজও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
স্কটল্যান্ড আইন সংশোধন করে ইংল্যান্ডের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ৩৬০ বছর পর স্বাধীনতা প্রশ্নে গণভোটে গেছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস এই গণভোট নিয়ে লিখেছে, স্বাধীনতার পথে যাওয়ার বিতর্ক ও ভোটাভুটির পুরোটাই ছিল সভ্য, শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক আলাপ- আলোচনার মধ্যে সীমিত। আর আমাদের এখানে যে কোন বিষয়ে গালমন্দ আর রাজপথের ভাঙচুরই যেন সমাধান। স্বাধীনতার চার দশকেও আমরা একটি সঠিক তালিকা করতে পারিনি কারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। ঠিক যেমনটি আমাদের এখানে কারা ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী তারও তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আর সার্টিফিকেটে যে দেশের মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারিত হয় তা কতটা দেশাত্মবোধের চেতনা থেকে যুদ্ধ অথবা স্বাধীনতা অর্জনের পর সুবিধা প্রাপ্তির আশা এটা বড় করে দেখা দেয়। বিপ্লবী চে গুয়েভারা ছিলেন জাত বিপ্লবী। কোনও সুবিধা প্রাপ্তি বা মন্ত্রিত্ব প্রাপ্তির জন্য বিপ্লব করেননি। যেখানে যে দেশে পরাধীনতা সেখানেই লড়তে ছুটে গেছেন। যেভাবে উইলিয়াম ওয়ালেস। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। দেশের প্রশ্নে, স্বাধীনতা প্রশ্নে, মানুষের মুক্তির প্রশ্নে কারও কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমায় যাদের পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে তাদের মানুষ ছুঁয়ে দেখে পবিত্র বলে। আর আমাদের এখানে প্রতিদিনই নতুন নতুন পদ্ধতিতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ধুঁকে ধুঁকে মরছে। সুবিধাভোগীরা সব আমলেই এক রকম। পাকিস্তান আমলেও সুবিধা নিয়েছে তারা। এখনও যুক্ত আছে সুবিধা নেয়ার ধান্দায়। এ দেশে যেন ধান্দারই জয়। ধান্ধাবাজেরাই যেন সব।
২৯শে সেপ্টেম্বর
No comments