একটি মহৎ কর্ম হবে যদি... by আলী ইদরিস
গত ১০ই সেপ্টেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে বললেন জনগণ চাইলে এবং সকল সংসদ একমত হলে আইন করে হরতাল বন্ধ করা যেতে পারে। আবার এ-ও বললেন যে আইন দিয়ে সব কিছু করা যায় না, আইন করে হরতাল বন্ধ হবে কিনা তা দেশের জনগণের ওপর নির্ভর করে। তাই আইন করে হরতাল বন্ধ করার বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারবো না। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষ যে হরতাল চায় না সেটা নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়। কিন্তু প্রমাণ করতে হলে নিরপেক্ষ জরিপ বা গণভোট দরকার হবে। জনগণ হরতাল চায় না কারণ হরতালের কোন উপকারিতা নেই। জনগণের দাবি আদায়ের নামে প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক দলের স্বার্থই আদায় হয়। তাছাড়া এখন আর হরতাল দিয়ে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায় না। একদিনের হরতালের দেশের প্রায় ন্যূনতম ১০০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। লাগাতার হরতাল হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। তাছাড়া শিল্প-কারখানা-ব্যবসা ভেঙে পড়ে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়, শ্রমজীবীরা উপোস করে, চিকিৎসা না পেয়ে বাসায়, হাসপাতালে রোগী মারা যায়, মৃত আত্মীয়ের মুখ দেখা যায় না, দাফনে শামিল হওয়া যায় না, শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারে না, চাকরিপ্রার্থীরা চাকরি হারায়, কৃষক থেকে শুরু করে খামারি, ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক সবার বিরাট ক্ষতি হয়, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি পিছিয়ে যায়, আরও বহু ক্ষতি হয়। অতীতেও ক্ষমতায় থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে বিরোধী দলে গেলে তিনি হরতাল ডাকবেন না কিন্তু কথা রাখা হয়নি। মহাজোট সরকারের অর্থমন্ত্রীও হঠাৎ হঠাৎ ন্যায্য কথা বলে ফেলেন যা দলের বিরুদ্ধে হলেও দেশের জন্য মঙ্গলজনক। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিরোধী দলের ডাকা হরতাল সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, হরতাল নিষিদ্ধ করা উচিত। অর্থনীতির ক্ষতিকারক ও জনগণের ভোগান্তির কারণ হরতাল নিষিদ্ধ করার জন্য ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআই অতীতে বহুবার সরকারের নিকট আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু কোন সরকারই সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি। এফবিসিসিআই ছাড়াও সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজের সর্বস্তরের জনগণ মনেপ্রাণে চায় ক্ষতিকারক হরতাল বন্ধ হোক। কিন্তু একমাত্র রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধী দলে থাকাকালে হরতালকে অস্ত্র হিসেবে সরকারের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য জিইয়ে রাখতে চায়। কারণ হরতাল প্রতিবাদের ও দাবি আদায়ের একমাত্র আরামদায়ক এবং কার্যকর অস্ত্র। একবার ঘোষণা করে গণমাধ্যমে ছেড়ে দিলেই হলো, বাকি কাজ জনসাধারণই সম্পন্ন করে। কিন্তু জনসাধারণ তা ভয়ে ভয়েই করে, ভাঙচুরের ভয়ে, বোমাবাজির ভয়ে, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়ে, প্রতিহতকারী কর্তৃক আক্রমণের ভয়ে ইত্যাদি। অথচ আহ্বানকারী রাজনৈতিক দলগুলো পরদিন গর্বভরে প্রচার করে যে হরতাল সফল হয়েছে কিন্তু দেশের যে বিরাট অর্থনৈতিক ও জনগণের আর্থ-সামাজিক, মানবিক ক্ষতি হয়েছে তা কেউ উল্লেখ করে না। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের স্বার্থ দেখে না নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে হরতালকে প্রয়োগ করে। তাই সংসদে আইন তৈরি করে হরতালকে নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী কেউ নয়। অথচ নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো যেমন করমুক্ত গাড়ি পাওয়া, সংসদে ৯০ দিনের পরিবর্তে হাজিরা না দিয়েও বেতন-ভাতা তুলে নেয়া-এ সব ব্যাপারে বিরোধী ও সরকারি কোন রাজনৈতিক দলই কার্যবিধি সংশোধন করতে চায় না। এজন্যই রাজনৈতিক দলগুলো হরতাল নিষিদ্ধ করতে বাধা দেয়, এটা দেশের দুর্ভাগ্য। দক্ষিণ এশিয়ার দু’একটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর বাকি অংশে হরতাল নামক কর্মসূচির নাম গন্ধ নেই। একমাত্র বাংলাদেশেই হরতালের মহামারী। হরতাল না হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি আরও ত্বরান্বিত হতো। সময় এসেছে আইনের মাধমে হরতালকে নিষিদ্ধ করা। কোন না কোন ক্ষমতাসীন দলকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং নিজেরাও তা মেনে চলার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। যে দলই এ উদ্যোগ নেবেন জনগণ তাদের সাধুবাদ জানাবে। তাই হরতাল নিষিদ্ধ করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসকে অন্তরিক সাধুবাদ জানাই। সরকারের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করে হরতাল নিষিদ্ধ করলে একটি মহৎ কর্ম সম্পন্ন করা হবে। তাতে মহাজোট সরকার জনগণের প্রশংসাই পাবেন।
No comments